গাজা ফেরত ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে বাড়ছে ট্রমা-আত্মাহুতি

  • Update Time : ০২:৫৫:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪
  • / 8

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গাজা উপত্যকায় ১ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি সেনারা নির্মম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গাজার আনাচে কানাচে এখন ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, গত বছর যাদেরকে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গাজায় পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে আত্মহত্যা করছেন।

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ৪০ বছর বয়সী এলিরান মিজরাহিকে পাঠানো হয়েছিল গাজায়। এরপরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই রিজার্ভ সদস্য দেশে ফেরেন এক ‘ভিন্ন মানুষ’ হয়ে। তার পরিবার বলছে, গাজায় যুদ্ধে গিয়ে মিজরাহি যা দেখেছেন, তাতে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধে যাওয়ার ছয় মাস পর বাড়ি ফিরে তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছিলেন। ফের যুদ্ধে পাঠানোর আগে তিনি আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। তার মা জেনি মিজরাহি বলছিলেন, সে গাজা ছেড়ে ফিরে এসেছিল, কিন্তু গাজা তাকে ছাড়েনি। পোস্ট-ট্রমার কারণে তার মৃত্যু হল।

এদিকে গাজা থেকে ফিরে এলিরান মিজরাহির মত মনোপীড়ায় আক্রান্ত ইসরায়েলি সৈন্যরা ট্রমা-আত্মাহুতি বেছে নিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, যুদ্ধের সময় মানসিক আঘাতে পিটিএসডি বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগা হাজার হাজার সেনা সদস্যকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেল একবছরে ইসরায়েলের হামলায় ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের যে হামলার পর ওই যুদ্ধের সূত্রপাত, সেই হামলায় ইসরায়েলের ১২০০ মানুষের প্রাণ যায়, জিম্মি করা হয় ২৫০ জনকে। ইহুদি রাষ্ট্রটি গঠনের পর থেকে আর কখনো নিজেদের পক্ষে এত প্রাণক্ষয় দেখতে হয়নি।

গাজার যুদ্ধ এখন লেবাননেও ছড়িয়েছে। ইসরায়েলের অনেক সেনা সদস্য এখন ভয়ে আছেন, তাদের হয়ত আরেক যুদ্ধে ডাক পড়বে।

অন্যদিকে গাজায় চার মাস দায়িত্ব পালন করা আইডিএফের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে বলেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই ভয়ে আছেন। তারা ভাবছেন, হয়ত তাদের লেবাননে যুদ্ধ করতে পাঠানো হবে। এই মুহূর্তে আমরা অনেকেই সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না।

কেবল আইডিএফের তত্ত্বাবধানে বিরল দু-একটি সফর ছাড়া বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় ঢুকতে দেয় না ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সে কারণে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার পূর্ণাঙ্গ চিত্র বা সেখানে ইসরায়েলি সেনাদের অভিজ্ঞতা জানা বেশ কঠিন।

গাজায় যুদ্ধ করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে বলেছেন, তারা এমন ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন, যা বাইরের বিশ্ব কখনো অনুধাবন করতে পারবে না।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘চিরকালীন যুদ্ধের’ ভয়ঙ্কর নির্মমতা আর তার জেরে ইসরায়েলি সৈন্যদের যে অদৃশ্য মাশুল গুনতে হচ্ছে, তা উঠে এসেছে তাদের কথায়।

অনেক সৈন্যের কাছে গাজার যুদ্ধ ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এবং যে কোনো উপায়ে সেটা জিততে হবে। কিন্তু এ লড়াইয়ে যে মানসিক মাশুলও গুনতে হচ্ছে, তা অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ যে ইসরায়েলি সমাজের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা, একজন চিকিৎসক এবং আত্মাহুতি দেয়া রিজার্ভ সেনা মিজরাহির পরিবারের কথায় উঠে এসেছে।

গাজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মিজরাহির বন্ধু ও বুলডোজারের সহ-চালক গাই জাকেনের উপলব্ধি ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, আমরা খুব, খুব, খুব কঠিন জিনিস দেখেছি। ওই বিষয়গুলো মেনে নেয়া কঠিন।

গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক আঘাত পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন সাবেক এই সেনা সদস্য। গত জুনে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে দেয়া এক সাক্ষ্যে জাকেন বলেন, অনেক সময় সৈন্যদের ‘শত শত জীবিত বা মৃত সন্ত্রাসীর’ ওপর দিয়ে যেতে হয়। তাদের সবার ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছিল।

জাকেন এখন আর মাংস খেতে পারেন না, কারণ সেটা তাকে গাজায় বুলডোজার থেকে দেখা বীভৎস দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাতে তার ঘুমাতে কষ্ট হয়, কারণ মাথার ভেতর বিস্ফোরণের শব্দ বাজে।

মৃতদেহকে ‘মাংস’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, যখন আপনি বাইরে প্রচুর মাংস ও রক্ত দেখবেন… আমাদের এবং তাদের (হামাস), তারপরে আপনি যখন (মাংস) খেতে বসবেন, ওই স্মৃতি সত্যি আপনাকে পীড়া দেবে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক চিকিৎসকের ভাষ্য, সৈন্যরা যখন বেসামরিক নাগরিকদের মুখোমুখি হয়, তখন অনেকে নৈতিকতার কারণে ধন্দে পড়ে যায়।

তিনি বলেন, যুদ্ধের শুরুতে গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি সেনাদের মনোভাব বিরূপ ছিল। তাদের মধ্যে সাধারণ ধারণা ছিল, বেসামরিক নাগরিকসহ গাজাবাসীরা সবাই ‘খারাপ’, কারণ তারা হামাসকে সমর্থন করে, হামাসকে সহায়তা করে, তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে।

তবে নিজের চোখে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের দেখার পর সেই মনোভাব বদলে যাওয়ার কথা বলেছেন অনেক সেনা সদস্য।

আইডিএফ দাবি করেছে, গাজায় যাতে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা সর্বনিম্নে থাকে, সেজন্য ‘যথাসাধ্য’ চেষ্টা করে তারা। সেজন্য তারা টেক্সট বার্তা পাঠায়, ফোন কল করে এবং হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে লিফলেট ফেলে।

এরপরও গাজায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন; এমনকি সামরিক বাহিনী স্বীকৃত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ আশ্রয় নেয়ার পরও।

সিএনএন লিখেছে, ত্রাণকর্মীরা ও জাতিসংঘ বারবারই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধের বিপর্যয়কর প্রভাবের কথা তুলে ধরেছে। ১৭ বছরের অবরুদ্ধ দশা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের কারণে তাদের মধ্যে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

জাতিসংঘ আগস্টের এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুদ্ধের ভয়াবহতা গাজাবাসীর মনে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা পিটিএসডি’র প্রচলিত সংজ্ঞায় ফেলা যায় না।

সামরিক তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানিয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১১ মের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন অন্তত ১০ জন সৈন্য।

যুদ্ধের পর আইডিএফে আত্মহত্যার সংখ্যা কত- এ প্রশ্নের উত্তরে মনোবিজ্ঞানী ও আইডিএফের কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের কমান্ডার উজি বেচোর সিএনএনকে বলেন, পরিসংখ্যান সরবরাহের অনুমতি মেডিকেল কর্পসকে দেয়া হয়নি এবং সামরিক বাহিনী আত্মহত্যার হারে তেমন হেরফের দেখছে না।

যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনা সেনাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ গেল আগস্টের এক বিবৃতিতে জানায়, প্রতি মাসেই এক হাজারের বেশি আহত সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়, তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মানসিক সমস্যার কথা বলেছেন। ২৭ শতাংশের মধ্যে মানসিক ট্রমা-পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দেয়।

বিবৃতিতে এও বলা হয়, বছর শেষ নাগাদ চিকিৎসার জন্য ভর্তি আহত যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজারে, যাদের প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সেখানে প্রতি বছর ৫০০ জনের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ছয় সহস্রাধিক মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তবে এ সংক্রান্ত প্রায় ২৩ শতাংশ ঘটনা সরকারের খাতায় নথিবদ্ধ হয় না।

সামরিক তথ্যের বরাতে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ২০২১ সালে আইডিএফে সৈন্যদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল আত্মহত্যা। ওই বছর অন্তত ১১ জন সেনা আত্মহুতির পথ বেছে নিয়েছিলেন।

৭ অক্টোবর থেকে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এ বছরের শুরুতে মন্ত্রণালয় বলেছিল, “মিডিয়া ও সোশাল মিডিয়ায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা সামনে আসছে।”

কোনো সংখ্যা উল্লেখ না করে মন্ত্রণালয় বলেছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোর একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলে আত্মহত্যার ঘটনা কমেছে।

৭ অক্টোবরের হামলার এক বছর পূর্তিতে ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৬ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন ‘মানুষের জীবনের’ কথা ভেবে হলেও গাজার যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


গাজা ফেরত ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে বাড়ছে ট্রমা-আত্মাহুতি

Update Time : ০২:৫৫:৪০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৬ অক্টোবর ২০২৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গাজা উপত্যকায় ১ বছরের বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি সেনারা নির্মম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। গাজার আনাচে কানাচে এখন ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, গত বছর যাদেরকে হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গাজায় পাঠানো হয়েছিল তাদের মধ্যে অনেকেই দেশে ফিরে আত্মহত্যা করছেন।

হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে ৪০ বছর বয়সী এলিরান মিজরাহিকে পাঠানো হয়েছিল গাজায়। এরপরে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই রিজার্ভ সদস্য দেশে ফেরেন এক ‘ভিন্ন মানুষ’ হয়ে। তার পরিবার বলছে, গাজায় যুদ্ধে গিয়ে মিজরাহি যা দেখেছেন, তাতে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। যুদ্ধে যাওয়ার ছয় মাস পর বাড়ি ফিরে তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছিলেন। ফের যুদ্ধে পাঠানোর আগে তিনি আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। তার মা জেনি মিজরাহি বলছিলেন, সে গাজা ছেড়ে ফিরে এসেছিল, কিন্তু গাজা তাকে ছাড়েনি। পোস্ট-ট্রমার কারণে তার মৃত্যু হল।

এদিকে গাজা থেকে ফিরে এলিরান মিজরাহির মত মনোপীড়ায় আক্রান্ত ইসরায়েলি সৈন্যরা ট্রমা-আত্মাহুতি বেছে নিয়েছেন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, যুদ্ধের সময় মানসিক আঘাতে পিটিএসডি বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগা হাজার হাজার সেনা সদস্যকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেল একবছরে ইসরায়েলের হামলায় ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের যে হামলার পর ওই যুদ্ধের সূত্রপাত, সেই হামলায় ইসরায়েলের ১২০০ মানুষের প্রাণ যায়, জিম্মি করা হয় ২৫০ জনকে। ইহুদি রাষ্ট্রটি গঠনের পর থেকে আর কখনো নিজেদের পক্ষে এত প্রাণক্ষয় দেখতে হয়নি।

গাজার যুদ্ধ এখন লেবাননেও ছড়িয়েছে। ইসরায়েলের অনেক সেনা সদস্য এখন ভয়ে আছেন, তাদের হয়ত আরেক যুদ্ধে ডাক পড়বে।

অন্যদিকে গাজায় চার মাস দায়িত্ব পালন করা আইডিএফের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে বলেন, আমাদের মধ্যে অনেকেই ভয়ে আছেন। তারা ভাবছেন, হয়ত তাদের লেবাননে যুদ্ধ করতে পাঠানো হবে। এই মুহূর্তে আমরা অনেকেই সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না।

কেবল আইডিএফের তত্ত্বাবধানে বিরল দু-একটি সফর ছাড়া বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় ঢুকতে দেয় না ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সে কারণে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার পূর্ণাঙ্গ চিত্র বা সেখানে ইসরায়েলি সেনাদের অভিজ্ঞতা জানা বেশ কঠিন।

গাজায় যুদ্ধ করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে বলেছেন, তারা এমন ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন, যা বাইরের বিশ্ব কখনো অনুধাবন করতে পারবে না।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘চিরকালীন যুদ্ধের’ ভয়ঙ্কর নির্মমতা আর তার জেরে ইসরায়েলি সৈন্যদের যে অদৃশ্য মাশুল গুনতে হচ্ছে, তা উঠে এসেছে তাদের কথায়।

অনেক সৈন্যের কাছে গাজার যুদ্ধ ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এবং যে কোনো উপায়ে সেটা জিততে হবে। কিন্তু এ লড়াইয়ে যে মানসিক মাশুলও গুনতে হচ্ছে, তা অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ যে ইসরায়েলি সমাজের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা, একজন চিকিৎসক এবং আত্মাহুতি দেয়া রিজার্ভ সেনা মিজরাহির পরিবারের কথায় উঠে এসেছে।

গাজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মিজরাহির বন্ধু ও বুলডোজারের সহ-চালক গাই জাকেনের উপলব্ধি ফুটে উঠেছে। তিনি বলেন, আমরা খুব, খুব, খুব কঠিন জিনিস দেখেছি। ওই বিষয়গুলো মেনে নেয়া কঠিন।

গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক আঘাত পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন সাবেক এই সেনা সদস্য। গত জুনে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে দেয়া এক সাক্ষ্যে জাকেন বলেন, অনেক সময় সৈন্যদের ‘শত শত জীবিত বা মৃত সন্ত্রাসীর’ ওপর দিয়ে যেতে হয়। তাদের সবার ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছিল।

জাকেন এখন আর মাংস খেতে পারেন না, কারণ সেটা তাকে গাজায় বুলডোজার থেকে দেখা বীভৎস দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাতে তার ঘুমাতে কষ্ট হয়, কারণ মাথার ভেতর বিস্ফোরণের শব্দ বাজে।

মৃতদেহকে ‘মাংস’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, যখন আপনি বাইরে প্রচুর মাংস ও রক্ত দেখবেন… আমাদের এবং তাদের (হামাস), তারপরে আপনি যখন (মাংস) খেতে বসবেন, ওই স্মৃতি সত্যি আপনাকে পীড়া দেবে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক চিকিৎসকের ভাষ্য, সৈন্যরা যখন বেসামরিক নাগরিকদের মুখোমুখি হয়, তখন অনেকে নৈতিকতার কারণে ধন্দে পড়ে যায়।

তিনি বলেন, যুদ্ধের শুরুতে গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি সেনাদের মনোভাব বিরূপ ছিল। তাদের মধ্যে সাধারণ ধারণা ছিল, বেসামরিক নাগরিকসহ গাজাবাসীরা সবাই ‘খারাপ’, কারণ তারা হামাসকে সমর্থন করে, হামাসকে সহায়তা করে, তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে।

তবে নিজের চোখে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের দেখার পর সেই মনোভাব বদলে যাওয়ার কথা বলেছেন অনেক সেনা সদস্য।

আইডিএফ দাবি করেছে, গাজায় যাতে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা সর্বনিম্নে থাকে, সেজন্য ‘যথাসাধ্য’ চেষ্টা করে তারা। সেজন্য তারা টেক্সট বার্তা পাঠায়, ফোন কল করে এবং হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে লিফলেট ফেলে।

এরপরও গাজায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন; এমনকি সামরিক বাহিনী স্বীকৃত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ আশ্রয় নেয়ার পরও।

সিএনএন লিখেছে, ত্রাণকর্মীরা ও জাতিসংঘ বারবারই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধের বিপর্যয়কর প্রভাবের কথা তুলে ধরেছে। ১৭ বছরের অবরুদ্ধ দশা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের কারণে তাদের মধ্যে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

জাতিসংঘ আগস্টের এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুদ্ধের ভয়াবহতা গাজাবাসীর মনে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা পিটিএসডি’র প্রচলিত সংজ্ঞায় ফেলা যায় না।

সামরিক তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানিয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১১ মের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন অন্তত ১০ জন সৈন্য।

যুদ্ধের পর আইডিএফে আত্মহত্যার সংখ্যা কত- এ প্রশ্নের উত্তরে মনোবিজ্ঞানী ও আইডিএফের কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের কমান্ডার উজি বেচোর সিএনএনকে বলেন, পরিসংখ্যান সরবরাহের অনুমতি মেডিকেল কর্পসকে দেয়া হয়নি এবং সামরিক বাহিনী আত্মহত্যার হারে তেমন হেরফের দেখছে না।

যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনা সেনাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ গেল আগস্টের এক বিবৃতিতে জানায়, প্রতি মাসেই এক হাজারের বেশি আহত সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেয়া হয়, তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মানসিক সমস্যার কথা বলেছেন। ২৭ শতাংশের মধ্যে মানসিক ট্রমা-পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দেয়।

বিবৃতিতে এও বলা হয়, বছর শেষ নাগাদ চিকিৎসার জন্য ভর্তি আহত যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজারে, যাদের প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।

ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সেখানে প্রতি বছর ৫০০ জনের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ছয় সহস্রাধিক মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তবে এ সংক্রান্ত প্রায় ২৩ শতাংশ ঘটনা সরকারের খাতায় নথিবদ্ধ হয় না।

সামরিক তথ্যের বরাতে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ২০২১ সালে আইডিএফে সৈন্যদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল আত্মহত্যা। ওই বছর অন্তত ১১ জন সেনা আত্মহুতির পথ বেছে নিয়েছিলেন।

৭ অক্টোবর থেকে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এ বছরের শুরুতে মন্ত্রণালয় বলেছিল, “মিডিয়া ও সোশাল মিডিয়ায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা সামনে আসছে।”

কোনো সংখ্যা উল্লেখ না করে মন্ত্রণালয় বলেছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোর একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলে আত্মহত্যার ঘটনা কমেছে।

৭ অক্টোবরের হামলার এক বছর পূর্তিতে ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৬ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন ‘মানুষের জীবনের’ কথা ভেবে হলেও গাজার যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত।