মুক্তিযুদ্ধের প্রাণ শক্তি, আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি
- Update Time : ১০:২৭:৩৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / 58
অস্ত্র সম্ভারে অপেক্ষাক্রত দূর্বল ছিল বাঙালি। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে দক্ষতা আর ক্ষিপ্রতায় বাঙালি ছিল যোজন যোজন এগিয়ে। ফলে ১৯৭১ সালে মাত্র ৯ মাসে বিজয় ধরা দেয় বাঙালির হাতে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি ঝাপিয়ে পড়ে সীমাহীন গতিতে। এ যেন নাহি ডর, নাহি ভয়, আমরা করব জয়। বাঙালির এই ভয়-ডর হীন শক্তি সঞ্চয় হয়েছিল মূলত মহান ভাষা আন্দোলন হতে।
তখনই এদশের মানুষ বুঝেছিল আমাদের জিনিস আমদের রাখতেম হলে ভয়ডর থাকা চলবে না। কারণ মাতৃভাষা নিঃশ্বাস বায়ুর মত আমাদের মানবিক সত্তার এক অপরিহার্য অংশ। তাকে অমর্যাদায় দূরে রেখে আমরা কখনও সুস্থজীবন গড়ে তোলার আশা করতে পারি না।
রাষ্ট্রভাষা রূপে ঊর্দুকে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিতে উদ্যত হলে বাংলাদেশের সংগ্রামী ছাত্র-জনতা বাদ-প্রতিবাদে বিক্ষোভ মুখর হয়ে উঠে। বীর বাঙালি শেষ পর্যন্ত বুকের রক্ত দিয়ে আদায় করে নিল মাতৃভাষা তথা প্রাণপ্রিয় বাংলাভাষার প্রাপ্য মর্যাদা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। ভাষা আন্দোলনের সেই রক্তস্বাক্ষরিত দিন বলেই আমাদের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারির বড় তাৎপর্য রয়েছে।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চের জনসভায় এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করলেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” –তখন বাংলার ছাত্রসমাজ এর তীব্র প্রতিবাদ জানান। এরপর ১৯৫২ সনের ৩০ জানুয়ারি আবার ঢাকায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এক জনসভায় উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ৪ ফেব্রুয়ারি ’৫২-তে ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট, ১১ ফেব্রুয়ারি সারা প্রদেশে আন্দোলনের প্রস্তুতি দিবস এবং ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি অপরাহ্ণে ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। গ্রেফতার, লাঠিচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস কোন কিছুই ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করতে পারেনি। ছাত্ররা পরিষদ ভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে অটল থাকে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের গেট দিয়ে সবাই রাজপথে বের হয়ে আসে। আরম্ভ হয় পুলিশের বেপোরোয়া গুলিবর্ষণ। রক্তরঞ্জিত দেহে ধূলোয় লুটিয়ে পড়েন সালাম, বরকত, রফিক এবং আরো অনেকে। তাঁদের অনমনীয় দৃঢ়তা আর আত্মত্যাগের ফলেই বাংলাভাষা লাভ করে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা।
একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের মুখের ভাষা বাংলাভাষাকে আমাদের মাতৃভাষা করল। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে দেশ ছিল কিন্তু স্বদেশ ছিল না, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের ভূমিকে আমাদের মাতৃভূমি করল। একুশে ফেব্রুয়ারিতে মুখের ভাষার জন্য রক্তদানের মুহূর্ত থেকে আমরা মাতৃভাষা ও স্বদেশকে খুঁজে পেলাম- আমরা নিজেদের একটি জাতি হিসেবে চিনতে পারলাম, আমরা জানলাম যে আমরা গর্বিত বাঙালি, বাংলা আমাদের নিজস্ব ভাষা, বাংলা আমাদের দেশ। বায়ান্নোর সেই রক্তাক্ত পথ ধরে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন ও ছেষট্টির স্বাধীকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের মহান গণঅভ্যুত্থান ও গণবিস্ফোরণের উত্তাল দিনগুলোয়, সত্তরের নির্বাচনে, একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে আর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অগ্নিঝরা দিনগুলোতে শত সহস্র লক্ষ কোটি বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমাদের জাতিসত্তা, আমাদের ঠিকানা, আমাদের পরিচয়কে রক্ষার জন্যে- অবশেষে অসভ্য, বর্বর, নিষ্ঠুর, গণহত্যাকারী, নারীধর্ষণকারী হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে মুক্তিযুদ্ধে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে ভাষার নামে জন্ম নিল একটি দেশ- পৃথিবীতে উদাহরণ শুধু একটি এবং একটিই- বাংলা নামে যে দেশ- নাম তার বাংলাদেশ।
একুশে ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর আমাদের জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি বড় তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে। সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বার সহ আরো অনেক নাম না জানা ভাষা শহীদের রক্তে রাঙানো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ইতিহাসে এক নতুন মর্যাদায় আসীন হয়েছে। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি বাঙালির এ এক বিশাল অর্জন। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম-বরকতরা প্রাণ দেবার পর বাংলাভাষার দাবিতে তথা মায়ের ভাষা বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১৯৬১-র ১৯ মে ভারতের আসাম রাজ্যের বাঙালি অধ্যূষিত শিলচরে এগারো জন বাঙালি মায়ের ভাষা বাংলার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন।
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়ার জন্য কানাডা প্রবাসী ভ্যাঙ্কুভারের জনাব রফিকুল ইসলাম ৮ জানুয়ারি ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল মি. কফি আনানের কছে একটি আবেদন করেন। জাতিসংঘের অফিস থেকে বিষয়টি ইউনেস্কোর কাছে কোন সংস্থার পক্ষ থেকে উত্থাপন করার কথা বলা হয়। জনাব রফিকুল ইসলাম ও তার সহযোগী আবদুস সালাম ‘দি মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ লাভারস অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন। এ যেন ’৫২-এর শহীদ সালাম ও শহীদ রফিক এর পুনর্জন্ম- যেন নামের জন্মান্তর! সমিতির পক্ষ থেকে সাতটি ভাষায় লিখিত ১০ জন ব্যক্তির স্বাক্ষর সংবলিত একটি আবেদন ইউনেস্কোর নিকট প্রেরণ করা হয়। ইউনেস্কোর শিক্ষা বিষয়ক প্রকল্প বিশেষজ্ঞ মিসেস আনা মারিয়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবেদন না করে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে আবেদন করার অনুরোধ জানান।
অবশেষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্যারিসে ইউনেস্কোর কাছে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেয়ার প্রস্তাব পেশ করা হয়। বাংলাদেশসহ ২৭টি দেশ সেই প্রস্তাবে অংশগ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩৯তম প্যারিস সম্মেলনে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। সারা পৃথিবীতে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে বাঙালিরা তথা বাংলাদেশিরা যে সংগ্রাম করে এসেছে- এটা ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ পালনের মাধ্যমে স্বীকৃতি লাভ করল- যা সালাম ও রফিকের প্রয়াসের কীর্তি এবং ইতিহাসের খাতায় নতুন করে তাঁদের নামও অমর হয়ে রইল। আর প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’-এ শহীদদের স্মরণ করে ভাষা আন্দোলন নিয়ে কিংবদন্তি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর রচিত সেই অমর গানটি সম্মিলিতভাবে গেয়ে যাব- “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/আমি কি ভুলিতে পারি?”
[সূত্র: আন্তর্জাতিক ঘোষণায় ভাষার অধিকার’ –মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান]
লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক