আহারে স্কুলজীবনের শুক্রবার!

  • Update Time : ০৭:৫১:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ জুন ২০২৩
  • / 280

 

নব্বইয়ের দশকে যখন স্কুলে পড়তাম তখন শুক্রবার মসজিদে আসা যেন একটা উৎসবের মতো ব্যাপার ছিল। রেলের লোকো মাঠ থেকে বেলা বারোটার মধ্যেই ক্রিকেট খেলা শেষ করে ফেলতাম। এরপর তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে আজানের সাথে সাথে রেলের মসজিদের সামনে হাজির। মসজিদে ঢোকা হতো না। সমবয়সী আরো অনেকেই ১২:৩০ মিনিটের মধ্যেই মসজিদের সামনে হাজির হয়ে যেত।

এরপর দল বেঁধে লঞ্চঘাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম। ওদিকে যেয়ে যে কোন একটি লঞ্চের উপরে কিছু সময় বসতাম কিংবা চার নম্বর ঘাটের দিকে একটু ঘোরাঘুরি করে মসজিদের সামনে চলে আসতাম।

না, তখনও মসজিদে ঢোকা হত না। মসজিদের পাশেই রেলের মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসার টিনের ক্লাস রুমের বেঞ্চে বসে আবার গল্প শুরু হত।

রেলের মসজিদের ইমাম প্রয়াত দেলোয়ার কাকা তখন ওয়াজের শেষপ্রান্তে। উনি সুন্নতের জন্য আহবান করতেন। সবাই সুন্নতে দাঁড়িয়ে যেত। আমরা তখনও গল্পে মশগুল।

গল্পের বিষয় শুধু ক্রিকেট নিয়েই, সকালে কে কেমন ক্রিকেট খেললো, কে কয় রান করলো, কেন জিতলাম, কেন হারালাম, বিকালে কিভাবে খেলবো, কাদের সাথে খেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।

একসময় সুন্নত. নামাজ শেষ হয়ে যায়। ইমাম সাহেব কাকা খুতবা শুরু করেন। আমরা আস্তে আস্তে মাদ্রাসার বেঞ্চ থেকে উঠে মসজিদের সামনে এসে দাঁড়াই। তখনও প্রায় সময় ঢোকা হত না। যখন খুতবা শেষ হয়ে যেত, সবাই নামাজের কাতার ঠিক করায় ব্যস্ত, আমরা ঠিক সেই সময় মসজিদের বারান্দার কাতারে দাঁড়িয়ে যেতাম। আমাদের সাধারণত মসজিদের ভেতরে ঢোকা হতো না, অথচ আমরা ১২:৩০ এর মধ্যেই মসজিদের সামনে হাজির হয়ে যেতাম।

এরপর নামাজ শেষ হয়। আমরা বারান্দায় বসে থাকি। সুন্নত পড়ে এলাকার মুরুব্বিরা অধিকাংশই বাসার দিকে চলে যায়।

নামাজের শেষে প্রতি সপ্তাহে মিলাদ হত। যেই মিলাদ পড়া শুরু হত, আমরা মসজিদের ভিতরে ঢুকতাম। কারণ মিলাদের শেষেই জিলাপির ব্যবস্থা থাকত। জিলাপি খেতে খেতে বের হতাম। আসলে জিলাপি খাওয়াটা যতটা আনন্দের ছিল, তার চেয়ে বরং সবাই একসাথে থাকতে পারাটা অনেক বেশি আনন্দের ছিল।

নামাজের পর যে যার বাসায় চলে যেতাম কিন্তু বিকালেও ক্রিকেট খেলা থাকত। সারা সকাল মাঠে ছিলাম এখন যদি দুপুরে খেয়েই আবার বের হয়ে যাই তাহলে তো মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না। কারণ আব্বা ঘরে। সাধারণত যদি একটু বড় ম্যাচ থাকত, তাহলে ৩.৩০ মিনিটে খেলা শুরু হত ।

যাদের বাসা থেকে বের হতে সমস্যা হত না, তারা ৩.১৫ বা ৩.২০ মিনিটের দিকে আমাদের বাসার সামনে এসে বিভিন্ন ভাবে ডাকা শুরু করত, যাতে আব্বা বুঝতে না পারে কিন্তু আমরা দুই ভাই ( আরেকজন তখন খুব ছোট) বুঝতে পারি।
ডাকাডাকির ধরণ ছিল এরকম;
– এ ইলিয়াস কাঞ্চন খেলতে যাবি না?
– এ রফিকুল, এ শরীফুল! খেলা শুরু হয়ে গেল।
– এ রনি! সবাই চলে আইছে তাড়াতাড়ি আয় আমরা গেলাম।
– তোর ব্যাট নিয়ে বের হইস।

এই ধরনের চিল্লানী যখন ঘরের দরজার সামনে থেকে ভিতরে থাকা আমাদের কানে যেত, তখন আমরা দুই ভাই মোটামুটি তালবাহানা তৈরি করে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। আর আব্বা যদি ঘুমিয়ে থাকত, তাহলে তো এত টেনশন ছিল না।

প্রচন্ড রোদে শুক্রবার দুই বেলা ক্রিকেট খেলতাম। শরীর থেকে একটা ঘামও বের হত না। কী আজব শরীর! আর এখন তো হাঁটতে গেলেই কত সমস্যা! ঘামে শার্ট ভিজে যায়।

তবে শুক্রবার যতই খেলা থাকুক, মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাসায় ঢোকা লাগত। এটা অলিখিত আইন ছিল। এভাবেই শেষ হত আমাদের প্রতিটি শুক্রবার। আবার অপেক্ষা করতাম, পরের শুক্রবার কবে আসবে?

আহারে সেই সব শুক্রবার! সারাদিন ক্রিকেট, জুম্মার নামাজ আর এলাকার সমবয়সী সবাই একসাথে। একারণেই হয়ত শুক্রবার এত আনন্দময়, উৎসবমুখর ছিল।

লেখক: রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।

Please Share This Post in Your Social Media


আহারে স্কুলজীবনের শুক্রবার!

Update Time : ০৭:৫১:৫৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ জুন ২০২৩

 

নব্বইয়ের দশকে যখন স্কুলে পড়তাম তখন শুক্রবার মসজিদে আসা যেন একটা উৎসবের মতো ব্যাপার ছিল। রেলের লোকো মাঠ থেকে বেলা বারোটার মধ্যেই ক্রিকেট খেলা শেষ করে ফেলতাম। এরপর তাড়াতাড়ি গোসল শেষ করে আজানের সাথে সাথে রেলের মসজিদের সামনে হাজির। মসজিদে ঢোকা হতো না। সমবয়সী আরো অনেকেই ১২:৩০ মিনিটের মধ্যেই মসজিদের সামনে হাজির হয়ে যেত।

এরপর দল বেঁধে লঞ্চঘাটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম। ওদিকে যেয়ে যে কোন একটি লঞ্চের উপরে কিছু সময় বসতাম কিংবা চার নম্বর ঘাটের দিকে একটু ঘোরাঘুরি করে মসজিদের সামনে চলে আসতাম।

না, তখনও মসজিদে ঢোকা হত না। মসজিদের পাশেই রেলের মাদ্রাসা। সেই মাদ্রাসার টিনের ক্লাস রুমের বেঞ্চে বসে আবার গল্প শুরু হত।

রেলের মসজিদের ইমাম প্রয়াত দেলোয়ার কাকা তখন ওয়াজের শেষপ্রান্তে। উনি সুন্নতের জন্য আহবান করতেন। সবাই সুন্নতে দাঁড়িয়ে যেত। আমরা তখনও গল্পে মশগুল।

গল্পের বিষয় শুধু ক্রিকেট নিয়েই, সকালে কে কেমন ক্রিকেট খেললো, কে কয় রান করলো, কেন জিতলাম, কেন হারালাম, বিকালে কিভাবে খেলবো, কাদের সাথে খেলা ইত্যাদি ইত্যাদি।

একসময় সুন্নত. নামাজ শেষ হয়ে যায়। ইমাম সাহেব কাকা খুতবা শুরু করেন। আমরা আস্তে আস্তে মাদ্রাসার বেঞ্চ থেকে উঠে মসজিদের সামনে এসে দাঁড়াই। তখনও প্রায় সময় ঢোকা হত না। যখন খুতবা শেষ হয়ে যেত, সবাই নামাজের কাতার ঠিক করায় ব্যস্ত, আমরা ঠিক সেই সময় মসজিদের বারান্দার কাতারে দাঁড়িয়ে যেতাম। আমাদের সাধারণত মসজিদের ভেতরে ঢোকা হতো না, অথচ আমরা ১২:৩০ এর মধ্যেই মসজিদের সামনে হাজির হয়ে যেতাম।

এরপর নামাজ শেষ হয়। আমরা বারান্দায় বসে থাকি। সুন্নত পড়ে এলাকার মুরুব্বিরা অধিকাংশই বাসার দিকে চলে যায়।

নামাজের শেষে প্রতি সপ্তাহে মিলাদ হত। যেই মিলাদ পড়া শুরু হত, আমরা মসজিদের ভিতরে ঢুকতাম। কারণ মিলাদের শেষেই জিলাপির ব্যবস্থা থাকত। জিলাপি খেতে খেতে বের হতাম। আসলে জিলাপি খাওয়াটা যতটা আনন্দের ছিল, তার চেয়ে বরং সবাই একসাথে থাকতে পারাটা অনেক বেশি আনন্দের ছিল।

নামাজের পর যে যার বাসায় চলে যেতাম কিন্তু বিকালেও ক্রিকেট খেলা থাকত। সারা সকাল মাঠে ছিলাম এখন যদি দুপুরে খেয়েই আবার বের হয়ে যাই তাহলে তো মাইর একটাও মাটিতে পড়বে না। কারণ আব্বা ঘরে। সাধারণত যদি একটু বড় ম্যাচ থাকত, তাহলে ৩.৩০ মিনিটে খেলা শুরু হত ।

যাদের বাসা থেকে বের হতে সমস্যা হত না, তারা ৩.১৫ বা ৩.২০ মিনিটের দিকে আমাদের বাসার সামনে এসে বিভিন্ন ভাবে ডাকা শুরু করত, যাতে আব্বা বুঝতে না পারে কিন্তু আমরা দুই ভাই ( আরেকজন তখন খুব ছোট) বুঝতে পারি।
ডাকাডাকির ধরণ ছিল এরকম;
– এ ইলিয়াস কাঞ্চন খেলতে যাবি না?
– এ রফিকুল, এ শরীফুল! খেলা শুরু হয়ে গেল।
– এ রনি! সবাই চলে আইছে তাড়াতাড়ি আয় আমরা গেলাম।
– তোর ব্যাট নিয়ে বের হইস।

এই ধরনের চিল্লানী যখন ঘরের দরজার সামনে থেকে ভিতরে থাকা আমাদের কানে যেত, তখন আমরা দুই ভাই মোটামুটি তালবাহানা তৈরি করে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম। আর আব্বা যদি ঘুমিয়ে থাকত, তাহলে তো এত টেনশন ছিল না।

প্রচন্ড রোদে শুক্রবার দুই বেলা ক্রিকেট খেলতাম। শরীর থেকে একটা ঘামও বের হত না। কী আজব শরীর! আর এখন তো হাঁটতে গেলেই কত সমস্যা! ঘামে শার্ট ভিজে যায়।

তবে শুক্রবার যতই খেলা থাকুক, মাগরিবের আজানের সাথে সাথে বাসায় ঢোকা লাগত। এটা অলিখিত আইন ছিল। এভাবেই শেষ হত আমাদের প্রতিটি শুক্রবার। আবার অপেক্ষা করতাম, পরের শুক্রবার কবে আসবে?

আহারে সেই সব শুক্রবার! সারাদিন ক্রিকেট, জুম্মার নামাজ আর এলাকার সমবয়সী সবাই একসাথে। একারণেই হয়ত শুক্রবার এত আনন্দময়, উৎসবমুখর ছিল।

লেখক: রিয়াজুল হক, যুগ্ম পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।