উদ্যোক্তা সিমির পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে

  • Update Time : ০৬:২৬:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২
  • / 442

আনিসুল ইসলাম নাঈম:

কাজী শাহনেওয়াজ আফরিন সিমির জন্ম পঞ্চগড় উপজেলার গলেহাকান্তমনি গ্রামে। বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মা গৃহিণী। সিমি পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল নিজের প্রচেষ্টায় কিছু করার। নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর বিবিএস শেষ করেছেন। ইচ্ছা ছিল এমবিএ বা ল’তে পড়ার। কিন্তুু সংসারের নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি। চাকরির সুযোগ থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করা হয়নি। ঘরে বসেই কিছু করার চিন্তা নিয়ে এগোতে থাকেন। তখন করোনার কথা মাথায় রেখে ভাবেন অনলাইনে ব্যবসা করবেন। ঘরে বসেই প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন। ‘জুনাইরাস সিক্রেট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন।

সেই থেকে সিমি দর্জিকে দিয়ে নিজের পছন্দমতো ডিজাইনের ড্রেস বানাতেন। সেগুলোয় সুঁই-সুতা দিয়ে হাতের কাজ করতেন। শাড়ি এবং ওয়ালম্যাট তৈরি করতেন। সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসার দিকে হাঁটতে থাকেন। মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করতে থাকেন। নতুন উদ্যম নিয়ে আবার পথচলা শুরু করেন।

এ প্রসঙ্গে সিমি বিডি সমাচারকে বলেন’ সুই সুতার প্রতি আগ্রহ থেকেই নিজে ডিজাইন করা ড্রেস ও গাউন নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমেই গাউন ড্রেস, কটি ও হিজাব গুলো বাজিমাত করতে থাকে। ডিজাইনার গাউন গুলো একই সাথে হিজাবি ও ওয়েস্টান দু’ভাবেই পড়া যায় বলে প্রথম থেকেই ব্যাপক সারা পায়। তাছাড়া কাপড় ও সেলাইয়ের ভালো কোয়ালিটির কারনে এক কাস্টমার বেশ কয়েকবার আমার থেকে ড্রেস নিয়ে আমার রিপিট কাস্টমার হন।ফলে আমার রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া দেশের গন্ডি পেরিয়ে লন্ডন, আমেরিকা,ফ্রান্স,ইটালি,কানাডা,অস্ট্রেলিয়া, স্পেন সহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে আমার ড্রেস। দেশের বাহির থেকেও একেকজন কাস্টমার আমার থেকে বারবার ড্রেস অর্ডার করে রিপিট কাস্টমার হচ্ছেন। তাছাড়া দেশে ও দেশের বাহিরে লন্ডন,ইটালি ও আমেরিকায় পাইকারিতে যাচ্ছে আমার ড্রেস। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমার মাসিক ইনকাম প্রায় ২ লক্ষ টাকার উপরে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি শুধু লাগামহীন পন্য বিক্রি করে সেল করে কোটিপতি হলেই সফল উদ্দ্যোক্তা হওয়া যায়না। একজন সফল উদ্দ্যোক্তা হতে হলে কাস্টমারের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা জরুরি। আমার কাস্টমারের সংখ্যা তুলনামুলক কম।কিন্তুু আমার রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা অনেক বেশি বলে আমার সেল বেশি হয়। কোয়ালিটিফুল ড্রেস সেল করে আজ আমি রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা বাড়িয়েছি।দেশ ও দেশের বাহিরের একেক জন কাস্টমার আমার থেকে ৫-৬ টা গাউন, কোটি ও ড্রেস নেওয়ার পর পরই আবারও নতুন ৭-৮ বার করে একি ড্রেস অন্য কালার অর্ডার করেছেন। আমার কিছু কাস্টমার আছে যারা পেইজ এ নতুন কিছু কালেকশন আসলে সাথে সাথেই সেটা অর্ডার করে রাখেন। আর কিছু কাস্টমার সবসময় আমাকে বলতে থাকেন নতুন কোন কালেকশন আনলে যেন তাদেরকে দেই।আমি মনে করি আমার বড় সফলতা কাস্টমারের বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা।’

কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে সিমি বলেন, ‘প্রথম থেকে কারো কাছ থেকেই কোনো প্রকার সাপোর্ট পাইনি। ব্যবসার শুরুতে মানুষের অনেক কটু কথা ও সমালোচনা শুনতে হয়েছে। জীবনের কঠিন সময় একাই পার করেছি। কিন্তু কখনো ভেঙে পড়িনি। শত বাধার পরও নিজের দুই সন্তান, সংসার ও ব্যবসাকে সমানতালে চালিয়ে নিয়েছি। স্বামী তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই প্রোডাক্ট সোর্সিং, মার্কেটিং, কাস্টমার দেখাশোনা এবং ডেলিভারি ম্যান—সব কিছু আমাকেই করতে হতো। একমাত্র স্বামীর সাপোর্ট ও নিজের চেষ্টায় শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাই। তবে ব্যবসায় ভালো করার পর অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন।’

কাস্টমাইজ ড্রেসের পাশাপাশি সিমির অনলাইন পেজে জামদানি শাড়ির চাহিদাও ব্যাপক। নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লি থেকে শাড়িগুলো আনা হয়। এছাড়া টাঙ্গাইল ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করা হয়। এগুলো সংগ্রহ করা হয় হোল সেলারদের কাছ থেকে। শাড়ির জন্য বিদেশ থেকেও অনেক অর্ডার আসে। সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।

সব মিলিয়ে সিমির মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য বিক্রি করে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করে একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করছেন। এভাবে সিমির প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসার স্বপ্ন, উদ্যম আর সাফল্যগাথা দেশের হাজারো তরুণ উদ্যোক্তাকে উৎসাহ এবং সাহস জোগাবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সিমি বলেন, ‘ব্যবসাকে সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়া ও প্রতিষ্ঠানকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করানোর স্বপ্ন আছে। সৎ ও হালালভাবে ব্যবসাকে আরোও বড় করতে চাই। ইচ্ছে আছে এবছর ভালো কোন একটা জায়গায় একটা শো-রুম দেওয়ার।মহান আল্লাহর রহমতে ও আমার কাস্টমারদের ভালোবাসায় আমি যেন আরও সফলতা অর্জন করতে পারি সবার কাছে এই দোয়া চাই।’

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


উদ্যোক্তা সিমির পণ্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে

Update Time : ০৬:২৬:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২

আনিসুল ইসলাম নাঈম:

কাজী শাহনেওয়াজ আফরিন সিমির জন্ম পঞ্চগড় উপজেলার গলেহাকান্তমনি গ্রামে। বাবা ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মা গৃহিণী। সিমি পঞ্চগড় সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ছোটবেলা থেকেই তার ইচ্ছা ছিল নিজের প্রচেষ্টায় কিছু করার। নিজের একটি আলাদা পরিচয় তৈরি করার। সামরিক বাহিনীতে চাকরি করারও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু এইচএসসি পাস করার পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। বিয়ের পর বিবিএস শেষ করেছেন। ইচ্ছা ছিল এমবিএ বা ল’তে পড়ার। কিন্তুু সংসারের নানা ঝামেলায় হয়ে ওঠেনি। চাকরির সুযোগ থাকলেও সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবে করা হয়নি। ঘরে বসেই কিছু করার চিন্তা নিয়ে এগোতে থাকেন। তখন করোনার কথা মাথায় রেখে ভাবেন অনলাইনে ব্যবসা করবেন। ঘরে বসেই প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন। ‘জুনাইরাস সিক্রেট’ নামে একটি ফেসবুক পেজ খোলেন।

সেই থেকে সিমি দর্জিকে দিয়ে নিজের পছন্দমতো ডিজাইনের ড্রেস বানাতেন। সেগুলোয় সুঁই-সুতা দিয়ে হাতের কাজ করতেন। শাড়ি এবং ওয়ালম্যাট তৈরি করতেন। সামান্য পুঁজি নিয়ে ব্যবসার দিকে হাঁটতে থাকেন। মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে চেষ্টা করতে থাকেন। নতুন উদ্যম নিয়ে আবার পথচলা শুরু করেন।

এ প্রসঙ্গে সিমি বিডি সমাচারকে বলেন’ সুই সুতার প্রতি আগ্রহ থেকেই নিজে ডিজাইন করা ড্রেস ও গাউন নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমেই গাউন ড্রেস, কটি ও হিজাব গুলো বাজিমাত করতে থাকে। ডিজাইনার গাউন গুলো একই সাথে হিজাবি ও ওয়েস্টান দু’ভাবেই পড়া যায় বলে প্রথম থেকেই ব্যাপক সারা পায়। তাছাড়া কাপড় ও সেলাইয়ের ভালো কোয়ালিটির কারনে এক কাস্টমার বেশ কয়েকবার আমার থেকে ড্রেস নিয়ে আমার রিপিট কাস্টমার হন।ফলে আমার রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাছাড়া দেশের গন্ডি পেরিয়ে লন্ডন, আমেরিকা,ফ্রান্স,ইটালি,কানাডা,অস্ট্রেলিয়া, স্পেন সহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে আমার ড্রেস। দেশের বাহির থেকেও একেকজন কাস্টমার আমার থেকে বারবার ড্রেস অর্ডার করে রিপিট কাস্টমার হচ্ছেন। তাছাড়া দেশে ও দেশের বাহিরে লন্ডন,ইটালি ও আমেরিকায় পাইকারিতে যাচ্ছে আমার ড্রেস। আলহামদুলিল্লাহ এখন আমার মাসিক ইনকাম প্রায় ২ লক্ষ টাকার উপরে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমি মনে করি শুধু লাগামহীন পন্য বিক্রি করে সেল করে কোটিপতি হলেই সফল উদ্দ্যোক্তা হওয়া যায়না। একজন সফল উদ্দ্যোক্তা হতে হলে কাস্টমারের আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করা জরুরি। আমার কাস্টমারের সংখ্যা তুলনামুলক কম।কিন্তুু আমার রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা অনেক বেশি বলে আমার সেল বেশি হয়। কোয়ালিটিফুল ড্রেস সেল করে আজ আমি রিপিট কাস্টমারের সংখ্যা বাড়িয়েছি।দেশ ও দেশের বাহিরের একেক জন কাস্টমার আমার থেকে ৫-৬ টা গাউন, কোটি ও ড্রেস নেওয়ার পর পরই আবারও নতুন ৭-৮ বার করে একি ড্রেস অন্য কালার অর্ডার করেছেন। আমার কিছু কাস্টমার আছে যারা পেইজ এ নতুন কিছু কালেকশন আসলে সাথে সাথেই সেটা অর্ডার করে রাখেন। আর কিছু কাস্টমার সবসময় আমাকে বলতে থাকেন নতুন কোন কালেকশন আনলে যেন তাদেরকে দেই।আমি মনে করি আমার বড় সফলতা কাস্টমারের বিশ্বাস, আস্থা ও ভালোবাসা।’

কিছুটা আক্ষেপ নিয়ে সিমি বলেন, ‘প্রথম থেকে কারো কাছ থেকেই কোনো প্রকার সাপোর্ট পাইনি। ব্যবসার শুরুতে মানুষের অনেক কটু কথা ও সমালোচনা শুনতে হয়েছে। জীবনের কঠিন সময় একাই পার করেছি। কিন্তু কখনো ভেঙে পড়িনি। শত বাধার পরও নিজের দুই সন্তান, সংসার ও ব্যবসাকে সমানতালে চালিয়ে নিয়েছি। স্বামী তার চাকরি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই প্রোডাক্ট সোর্সিং, মার্কেটিং, কাস্টমার দেখাশোনা এবং ডেলিভারি ম্যান—সব কিছু আমাকেই করতে হতো। একমাত্র স্বামীর সাপোর্ট ও নিজের চেষ্টায় শত বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাই। তবে ব্যবসায় ভালো করার পর অনেকেই উৎসাহ দিয়েছেন।’

কাস্টমাইজ ড্রেসের পাশাপাশি সিমির অনলাইন পেজে জামদানি শাড়ির চাহিদাও ব্যাপক। নারায়ণগঞ্জের জামদানি পল্লি থেকে শাড়িগুলো আনা হয়। এছাড়া টাঙ্গাইল ও তাঁতের শাড়ি বিক্রি করা হয়। এগুলো সংগ্রহ করা হয় হোল সেলারদের কাছ থেকে। শাড়ির জন্য বিদেশ থেকেও অনেক অর্ডার আসে। সেগুলো কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেওয়া হয়।

সব মিলিয়ে সিমির মনে থাকা স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছেন। পাশাপাশি মানসম্মত পণ্য বিক্রি করে ক্রেতার চাহিদা পূরণ করে একটি স্থায়ী অবস্থান তৈরি করছেন। এভাবে সিমির প্রতিষ্ঠিত অনলাইন ব্যবসার স্বপ্ন, উদ্যম আর সাফল্যগাথা দেশের হাজারো তরুণ উদ্যোক্তাকে উৎসাহ এবং সাহস জোগাবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে সিমি বলেন, ‘ব্যবসাকে সবার মাঝে পৌঁছে দেওয়া ও প্রতিষ্ঠানকে একটি ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করানোর স্বপ্ন আছে। সৎ ও হালালভাবে ব্যবসাকে আরোও বড় করতে চাই। ইচ্ছে আছে এবছর ভালো কোন একটা জায়গায় একটা শো-রুম দেওয়ার।মহান আল্লাহর রহমতে ও আমার কাস্টমারদের ভালোবাসায় আমি যেন আরও সফলতা অর্জন করতে পারি সবার কাছে এই দোয়া চাই।’