বিলুপ্তির পথে খেজুরের রস

  • Update Time : ০২:১৫:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ নভেম্বর ২০২১
  • / 442

শরীফ মো: মাছুম বিল্লাহ:

মৃদু মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় প্রচন্ড শীতের রাত্রি শেষে, শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় সূর্য মামার আলোক রশ্মির ঝলকানিতে শীতের আগামনী বার্তা নিয়ে কাপছে প্রকৃতি। আর এসময়ে গ্রামে গ্রামে গাছিরা খেজুর গাছ ফাইল করতে ব্যস্ত থাকার কথা। কালের বিবর্তনে সময়ের পরিক্রমায় গাছ ও গাছির সংকটে হাইমচর থেকে বিলুপ্তির পথে মনোমুগ্ধকর গ্রাণ সমৃদ্ধ খেজুরের রস।

বিগত দিনে শীতের মৌসুম আসলে এ উপজেলার রস আহরণ কারী বাহু গাছিরা গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে রস আহরণের জন্যে অগনিত খেজুর গাছ চেছে পাইল করতেন। পাইল করার কয়েকদিন পরে পুনরায় পাইল দিয়ে গাছে হাড়ি পাতার ব্যবস্থা করতেন। গাছে হাড়ি উঠলেই উপজেলা ব্যাপী শুরু হতো পিঠা আর পায়েস খাওয়ার উৎসব।

খেজুরের রসের মনমুগ্ধকর ঘ্রাণে সকাল হলেই শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধারা মিলে গাছের তলায় ঝড়ো হতেন। সেইসব দৃশ্য এখন তেমন একটা নেই বল্লেই চলে। এছাড়াও বহু পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত খেজুর রস বিক্রির মাধ্যমে। এ উপজেলা থেকে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্য সব পেশায় চলে যাচ্ছে।

খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার একাধিক কারন আছে বলে মনেকরেন অভিজ্ঞ মহল ও গাছীরা। প্রথমত ইট পোরানো পাজায় খেজুর গাছ দিয়ে ইট পোড়ানো সহ কম খরচে গৃহ নির্মাণের কাজে খেজুরগাছ ব্যবহৃত হওয়ায় কমে আসছে গাছের পরিমাণ। এছাড়াও আরও একটা অন্যতম কারণ হলো বৈদ্যুতিক লাইনের জন্য ডালপালা ছাটাইকরণের নামে খেজুর গাছের গোড়া বা অর্ধভাগ থেকে কর্তন। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খেজুর গাছের অস্তিত্বের উপর। এছাড়াও প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খেজুরের রস তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে এখন আর দেখা মেলে না শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে রসে বোঝাই হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরী করার সেই মনরোম দৃশ্য।

হাইমচর উপজেলার ৩নং আলগী দক্ষিণ, আলগী উত্তর, চরভৈরবী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রচুর গাছ দেখতে পাওয়া যেত। যা এখন বিলুপ্তির পথে প্রায়। কিছু কিছু গাছ কাটা হলেও গাছি সংকটে কোন একসময় এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখনই যথোপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহন আশু প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। তা না হলে অতিশীঘ্রই খেজুরের রস বইয়ের পাতায় আর মানুষের মুখের গল্প হয়ে থাকবে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রতীক খেজুর গাছ। পাশাপাশি অর্থকরী সম্পদও। আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে এ গাছের সর্ম্পক অতি পুরনো ও নিবিড়। পূর্বে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের রাস্তার দু’পাশে কিংবা বাড়ির আশেপাশে খেজুর গাছ সারিসারি দেখা মিলতো।

শীত মৌসুম আসা মাত্রই প্রতিটি খেজুর গাছে গাছিরা হাঁড়ি দিয়ে সুস্বাদু রস সংগ্রহ করতো। বউ-জামাই ও নাতি-নাতনী, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে শীতের দিনে রসের পাটালিগুড় ও পিঠা তৈরির ঐতিহ্যগুলি বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রায় বিলুপ্তির পথে।

বিশেষ করে শীত মৌসুমের শেষে হাঁড়িতে জমাকৃত খেজুরেরগুড় আত্মীয় স্বজনদের দেয়া হতো। মাত্র কয়েক বছর আগেও হাইমচর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খেজুর গাছে রসের হাড়ি ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখা যেতো।

কিন্তু কালের আবর্তেনে অপরিকল্পিত ভাবে রস সংগ্রহ করা এবং নতুন করে খেজুর গাছ না লাগানোর কারনে খেজুর গাছ বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।

বর্তমানে আর মাঠের ধারে, পল্লীর নিভৃতে গেঁয়ো পথের পাশে সারি সারি খেজুর গাছের দৃশ্য চোখে পড়েনা। চোখে পড়ে না খেজুর গাছে রস সংগ্রহের মাটির হাড়ি।

Please Share This Post in Your Social Media


বিলুপ্তির পথে খেজুরের রস

Update Time : ০২:১৫:২২ অপরাহ্ন, সোমবার, ৮ নভেম্বর ২০২১

শরীফ মো: মাছুম বিল্লাহ:

মৃদু মৃদু ঠান্ডা হাওয়ায় প্রচন্ড শীতের রাত্রি শেষে, শিশির ভেজা ঘাসের ডগায় সূর্য মামার আলোক রশ্মির ঝলকানিতে শীতের আগামনী বার্তা নিয়ে কাপছে প্রকৃতি। আর এসময়ে গ্রামে গ্রামে গাছিরা খেজুর গাছ ফাইল করতে ব্যস্ত থাকার কথা। কালের বিবর্তনে সময়ের পরিক্রমায় গাছ ও গাছির সংকটে হাইমচর থেকে বিলুপ্তির পথে মনোমুগ্ধকর গ্রাণ সমৃদ্ধ খেজুরের রস।

বিগত দিনে শীতের মৌসুম আসলে এ উপজেলার রস আহরণ কারী বাহু গাছিরা গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে রস আহরণের জন্যে অগনিত খেজুর গাছ চেছে পাইল করতেন। পাইল করার কয়েকদিন পরে পুনরায় পাইল দিয়ে গাছে হাড়ি পাতার ব্যবস্থা করতেন। গাছে হাড়ি উঠলেই উপজেলা ব্যাপী শুরু হতো পিঠা আর পায়েস খাওয়ার উৎসব।

খেজুরের রসের মনমুগ্ধকর ঘ্রাণে সকাল হলেই শিশু, কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধারা মিলে গাছের তলায় ঝড়ো হতেন। সেইসব দৃশ্য এখন তেমন একটা নেই বল্লেই চলে। এছাড়াও বহু পরিবার তাদের জীবিকা নির্বাহ করত খেজুর রস বিক্রির মাধ্যমে। এ উপজেলা থেকে খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় তারা বাধ্য হয়ে জীবন ও জীবিকার তাগিদে অন্য সব পেশায় চলে যাচ্ছে।

খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ার একাধিক কারন আছে বলে মনেকরেন অভিজ্ঞ মহল ও গাছীরা। প্রথমত ইট পোরানো পাজায় খেজুর গাছ দিয়ে ইট পোড়ানো সহ কম খরচে গৃহ নির্মাণের কাজে খেজুরগাছ ব্যবহৃত হওয়ায় কমে আসছে গাছের পরিমাণ। এছাড়াও আরও একটা অন্যতম কারণ হলো বৈদ্যুতিক লাইনের জন্য ডালপালা ছাটাইকরণের নামে খেজুর গাছের গোড়া বা অর্ধভাগ থেকে কর্তন। ইতিমধ্যেই এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে খেজুর গাছের অস্তিত্বের উপর। এছাড়াও প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে গাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় খেজুরের রস তেমন একটা পাওয়া যাচ্ছে না। যার ফলে এখন আর দেখা মেলে না শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে রসে বোঝাই হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে বাড়ি বাড়ি ফেরী করার সেই মনরোম দৃশ্য।

হাইমচর উপজেলার ৩নং আলগী দক্ষিণ, আলগী উত্তর, চরভৈরবী ইউনিয়নসহ বিভিন্ন গ্রামে প্রচুর গাছ দেখতে পাওয়া যেত। যা এখন বিলুপ্তির পথে প্রায়। কিছু কিছু গাছ কাটা হলেও গাছি সংকটে কোন একসময় এগুলোও বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এখনই যথোপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহন আশু প্রয়োজন হয়ে পড়ছে। তা না হলে অতিশীঘ্রই খেজুরের রস বইয়ের পাতায় আর মানুষের মুখের গল্প হয়ে থাকবে।

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রতীক খেজুর গাছ। পাশাপাশি অর্থকরী সম্পদও। আবহমান গ্রাম বাংলার মানুষের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুগ যুগ ধরে এ গাছের সর্ম্পক অতি পুরনো ও নিবিড়। পূর্বে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি গ্রামের রাস্তার দু’পাশে কিংবা বাড়ির আশেপাশে খেজুর গাছ সারিসারি দেখা মিলতো।

শীত মৌসুম আসা মাত্রই প্রতিটি খেজুর গাছে গাছিরা হাঁড়ি দিয়ে সুস্বাদু রস সংগ্রহ করতো। বউ-জামাই ও নাতি-নাতনী, বন্ধু-বান্ধব নিয়ে শীতের দিনে রসের পাটালিগুড় ও পিঠা তৈরির ঐতিহ্যগুলি বর্তমান ডিজিটাল যুগে প্রায় বিলুপ্তির পথে।

বিশেষ করে শীত মৌসুমের শেষে হাঁড়িতে জমাকৃত খেজুরেরগুড় আত্মীয় স্বজনদের দেয়া হতো। মাত্র কয়েক বছর আগেও হাইমচর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে খেজুর গাছে রসের হাড়ি ঝুলে থাকার দৃশ্য দেখা যেতো।

কিন্তু কালের আবর্তেনে অপরিকল্পিত ভাবে রস সংগ্রহ করা এবং নতুন করে খেজুর গাছ না লাগানোর কারনে খেজুর গাছ বর্তমানে বিলুপ্তির পথে।

বর্তমানে আর মাঠের ধারে, পল্লীর নিভৃতে গেঁয়ো পথের পাশে সারি সারি খেজুর গাছের দৃশ্য চোখে পড়েনা। চোখে পড়ে না খেজুর গাছে রস সংগ্রহের মাটির হাড়ি।