সামাজিক সমস্যা ও সমাধানের পথ

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০২:০৭:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২
  • / ২৪৭ Time View

ড. মতিউর রহমান:

২০২০—২০২১ মেয়াদে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবাষির্কী “মুজিব শতবর্ষ“ পালিত হয়। গত বছর (২০২১) একই সাথে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবও উদযাপিত হয়েছে। মুজিব শতবর্ষ, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে প্রায় দুই বছর ধরে বিরাজমান করোনা মহামারি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

২০২১ এর ৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে, যা ওই বছর ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশেও উত্তীর্ণ হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সামাজিক ব্যাধি এবং অন্যান্য সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা জনগণকে কিছুটা হলেও আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। বেকারত্ব, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, অসমতা বৃদ্ধি, সুদ, ঘুষ, দুনীর্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন এবং নারী পাচার এর মত ঘটনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করে। যার অনেকগুলোই আজ দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পথে ধাবিত হবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এ সরকারের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্য অনেক। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বড় একটি স্বীকৃতি।

অন্যদিকে গত বছর দেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশব্যাপী সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় বছরের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে ধারাবাহিক লকডাউনের কারণে জনজীবনে সঙ্কট নেমে আসে। করোনাকালীন এই সঙ্কটের মধ্যেও দেশে অনেকগুলো বৃহৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতু এখন আর কোন কল্পনা নয়, এটি দৃশ্যমান।

এবছরেই পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের সম্মান এবং মযার্দার প্রতীক। কর্ণফুলী টানেলের কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। এবছর এই টানেলের উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মেট্রোরেল ইতিমধ্যে ট্রায়াল দেওয়া শুরু করেছে। এই বছরেই মেট্রোরেলও চালু হবে। এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৮ এ প্রণীত নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ এর ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেয়া ‘রূপকল্প ২০২১’, ‘রূপকল্প ২০৪১’, ‘ব—দ্বীপ পরিকল্পনা’, বিভিন্ন পঞ্চ—বাষির্কী পরিকল্পনা গ্রহণ করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত “সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”সফলভাবে অর্জিত হয়েছে। “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”র বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। উন্নয়নের প্রধান শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে গত একযুগে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থার হিসেবেও বাংলাদেশ আর্থ—সামাজিক সূচকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে।

খাদ্য ও টেকসই কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে কৃষিখাতে ঘটেছে বিপ্লব। মৎস্য ও পশু সম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ইলিশ মাছ আহরণে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে আছে। জাতীয় মহাসড়কসহ গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় আয় বেড়েছে, দারিদ্যে্রর হারও কমেছিল উল্লেখযোগ্যভাবে; যদিও করোনা মহামারিতে তা ফের বেড়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেমিটেন্স অর্জনেও সাফল্য অর্জন করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সমাজের দুর্গত মানুষের অভিগম্যতা বৃদ্ধি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূযোর্গ মোকাবেলা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয় প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীনদের ঘর প্রদান, বস্তিবাসীদের জন্য স্বল্পভাড়ায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্ল্যাট নির্মাণ, করোনা মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সাফল্য অনেক। সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এদেশের আপামর জনগণের অকুন্ঠ সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে ‘উন্নয়নের রোল মডেলে’ পরিণত করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার এত বেশি উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু এই গর্বের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো যখন চলছে তখন কিছু অস্বস্তি এবং সামাজিক সমস্যা এই বড় বড় উন্নয়নগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। লাফিয়ে লাফিয়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের সংকুলান করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত বাড়ছে অসন্তোষ।

গণপরিবহনে বিশৃংখলা সাধারণ মানুষের জন্য বিশাল এক দুভোর্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার কারণে একটা দীর্ঘসময় গণপরিবহন বন্ধ ছিলো। তারপর যখন গণপরিবহন অর্ধেক আসন রেখে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন এর ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তারপর এই ভাড়া আর কমানো হয়নি। এর মধ্যে ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করার সাথে সাথে আবার গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ে এবং এই ভাড়া বাড়ার পর এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলেছে। গণপরিবহন নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা এবং অস্বস্তি ছিলো এবং এখনও রয়ে গেছে। গণপরিবহনকমীর্দের বিশেষ করে চালক ও সুপারভাইজারদের দুর্ব্যবহার, নারী যাত্রীদের হেনস্থা ও সম্ভ্রমহানির মত ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যা সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে।

নৌপরিবহনেও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে লঞ্চ ডুবি এবং সর্বশেষ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। গত বছর ও এ বছরের শুরুতে স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন, বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষকে এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।

অসৎ কিছু নেতা. পাতি নেতা, কর্মীদের ক্ষমতার প্রর্দশন সাধারণ মানুষকে তটস্থ করে ফেলেছে্। ক্ষমতা প্রর্দশনের এই সংষ্কৃতি সাধারণ জনগণ বাদে সবার মধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতা প্রর্দশনের এই সংষ্কৃতি বিপদজনক বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে ক্ষমতা দেখালে তার পরিণতি অশুভ হতে পারে। কাজেই এই সংষ্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে করণীয় ঠিক করতে হবে।

এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সামাজিক ব্যাধি এবং অন্যান্য সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা জনগণকে কিছুটা হলেও আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। বেকারত্ব, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, অসমতা বৃদ্ধি, সুদ, ঘুষ, দুনীর্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন এবং নারী পাচার এর মত ঘটনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অসন্তোষও দেখা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। এসব সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়া দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় বৃহৎ প্রকল্প যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সামাজিক জীবনে স্থিরতা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র দূরীকরন, সুদ, ঘুষ, দুনীর্তি কমানো, নারী নিযার্তন প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান, গণপরিবহণে শৃংখলা ফেরানো এবং বৈষম্য ও অসমতা দূর করা। সেই সাথে ক্ষমতা প্রর্দশনের সংষ্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। আর এইসব যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয় তাহলে বড় বড় উন্নয়নগুলোর সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সে কারণেই এসব সামাজিক সমস্যা ও সঙ্কটগুলোর দিকে সবার আগে নজর দেয়া উচিত। ছোট ছোট সমস্যাগুলো যদি জিইয়ে রাখা হয় তাহলে বড় বড় উন্নয়নগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন। এসব সামাজিক সমস্যা যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে জনগণ বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দিকে মনোযোগ দেবে না বলে বিশেষজ্ঞরা বার বার সর্তক করে আসছেন। সুতরাং সরকারের এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তা নিয়ে “সামাজিক শৃংখলা উন্নয়ন কর্মসূচি” পরিচালনা করতে হবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

Please Share This Post in Your Social Media

সামাজিক সমস্যা ও সমাধানের পথ

Update Time : ০২:০৭:১১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২২

ড. মতিউর রহমান:

২০২০—২০২১ মেয়াদে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবাষির্কী “মুজিব শতবর্ষ“ পালিত হয়। গত বছর (২০২১) একই সাথে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবও উদযাপিত হয়েছে। মুজিব শতবর্ষ, স্বাধীনতা ও বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে প্রায় দুই বছর ধরে বিরাজমান করোনা মহামারি সত্ত্বেও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত থাকার কারণে মানুষের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।

২০২১ এর ৬ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি) বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা করে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের চূড়ান্ত সুপারিশ করে, যা ওই বছর ২৪ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশেও উত্তীর্ণ হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সামাজিক ব্যাধি এবং অন্যান্য সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা জনগণকে কিছুটা হলেও আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। বেকারত্ব, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, অসমতা বৃদ্ধি, সুদ, ঘুষ, দুনীর্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন এবং নারী পাচার এর মত ঘটনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে।

২০০৯ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর অন্যান্য অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করে। যার অনেকগুলোই আজ দৃশ্যমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, এইসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার পথে ধাবিত হবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা এ সরকারের ব্যর্থতার চেয়ে সাফল্য অনেক। স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বড় একটি স্বীকৃতি।

অন্যদিকে গত বছর দেশে করোনা মহামারির দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশব্যাপী সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় বছরের প্রায় অর্ধেক সময় জুড়ে ধারাবাহিক লকডাউনের কারণে জনজীবনে সঙ্কট নেমে আসে। করোনাকালীন এই সঙ্কটের মধ্যেও দেশে অনেকগুলো বৃহৎ উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দৃশ্যমান হয়েছে। পদ্মা সেতু এখন আর কোন কল্পনা নয়, এটি দৃশ্যমান।

এবছরেই পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে এ নিয়ে কোনো সংশয় নেই। পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের সম্মান এবং মযার্দার প্রতীক। কর্ণফুলী টানেলের কাজও এগিয়ে চলেছে দ্রুতগতিতে। এবছর এই টানেলের উদ্বোধন করা হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মেট্রোরেল ইতিমধ্যে ট্রায়াল দেওয়া শুরু করেছে। এই বছরেই মেট্রোরেলও চালু হবে। এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বিভিন্ন মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে।

একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন সেক্টরে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। ২০০৮ এ প্রণীত নির্বাচনী ইশতেহার ‘দিন বদলের সনদ’ এর ভিত্তিতে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেয়া ‘রূপকল্প ২০২১’, ‘রূপকল্প ২০৪১’, ‘ব—দ্বীপ পরিকল্পনা’, বিভিন্ন পঞ্চ—বাষির্কী পরিকল্পনা গ্রহণ করে উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাতিসংঘ ঘোষিত “সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”সফলভাবে অর্জিত হয়েছে। “টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা”র বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। উন্নয়নের প্রধান শক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত দেশের নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা যেমন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের ক্ষেত্রে গত একযুগে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংস্থার হিসেবেও বাংলাদেশ আর্থ—সামাজিক সূচকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে।

খাদ্য ও টেকসই কৃষিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। বিশেষ করে কৃষিখাতে ঘটেছে বিপ্লব। মৎস্য ও পশু সম্পদ উন্নয়নে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ইলিশ মাছ আহরণে বিশ্বে প্রথম অবস্থানে আছে। জাতীয় মহাসড়কসহ গ্রামীণ অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও জাতীয় আয় বেড়েছে, দারিদ্যে্রর হারও কমেছিল উল্লেখযোগ্যভাবে; যদিও করোনা মহামারিতে তা ফের বেড়েছে। বাংলাদেশ রপ্তানি বৃদ্ধি ও রেমিটেন্স অর্জনেও সাফল্য অর্জন করেছে।

সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে সমাজের দুর্গত মানুষের অভিগম্যতা বৃদ্ধি, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানী ভাতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত দূযোর্গ মোকাবেলা, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমন, ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন, নারীর ক্ষমতায়ন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আশ্রয় প্রদান, আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহহীনদের ঘর প্রদান, বস্তিবাসীদের জন্য স্বল্পভাড়ায় ঢাকা ও ঢাকার বাইরে ফ্ল্যাট নির্মাণ, করোনা মহামারি মোকাবেলায় সরকারের সাফল্য অনেক। সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এদেশের আপামর জনগণের অকুন্ঠ সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর প্রিয় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’র অপবাদ ঘুচিয়ে ‘উন্নয়নের রোল মডেলে’ পরিণত করেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো সরকার এত বেশি উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে পারেনি। কিন্তু এই গর্বের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডগুলো যখন চলছে তখন কিছু অস্বস্তি এবং সামাজিক সমস্যা এই বড় বড় উন্নয়নগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে। এসবের মধ্যে সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। লাফিয়ে লাফিয়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আয়ের সাথে ব্যয়ের সংকুলান করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। ক্রমাগত বাড়ছে অসন্তোষ।

গণপরিবহনে বিশৃংখলা সাধারণ মানুষের জন্য বিশাল এক দুভোর্গের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনার কারণে একটা দীর্ঘসময় গণপরিবহন বন্ধ ছিলো। তারপর যখন গণপরিবহন অর্ধেক আসন রেখে চালু করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তখন এর ভাড়া বৃদ্ধি করা হয়েছিল। তারপর এই ভাড়া আর কমানো হয়নি। এর মধ্যে ডিজেল এবং কেরোসিনের দাম বৃদ্ধি করার সাথে সাথে আবার গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ে এবং এই ভাড়া বাড়ার পর এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলেছে। গণপরিবহন নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতা এবং অস্বস্তি ছিলো এবং এখনও রয়ে গেছে। গণপরিবহনকমীর্দের বিশেষ করে চালক ও সুপারভাইজারদের দুর্ব্যবহার, নারী যাত্রীদের হেনস্থা ও সম্ভ্রমহানির মত ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যা সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে আলোড়িত করেছে।

নৌপরিবহনেও স্বেচ্ছাচারিতা বন্ধ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে লঞ্চ ডুবি এবং সর্বশেষ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সাধারণ মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। গত বছর ও এ বছরের শুরুতে স্থানীয় পরিষদ নির্বাচন, বিশেষ করে ইউপি নির্বাচনকে ঘিরে ব্যাপক সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষকে এক ধরনের অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন।

অসৎ কিছু নেতা. পাতি নেতা, কর্মীদের ক্ষমতার প্রর্দশন সাধারণ মানুষকে তটস্থ করে ফেলেছে্। ক্ষমতা প্রর্দশনের এই সংষ্কৃতি সাধারণ জনগণ বাদে সবার মধ্যেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষমতা প্রর্দশনের এই সংষ্কৃতি বিপদজনক বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ সাধারণ মানুষ একত্রিত হয়ে ক্ষমতা দেখালে তার পরিণতি অশুভ হতে পারে। কাজেই এই সংষ্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে করণীয় ঠিক করতে হবে।

এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ধর্ষণের সামাজিক ব্যাধি এবং অন্যান্য সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পেয়েছে যা জনগণকে কিছুটা হলেও আতঙ্কের মধ্যে ফেলেছে। বেকারত্ব, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, অসমতা বৃদ্ধি, সুদ, ঘুষ, দুনীর্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয়। বিশেষ করে ধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা, যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন এবং নারী পাচার এর মত ঘটনার ভয়াবহতা লক্ষ্য করা গেছে। উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অসন্তোষও দেখা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ক্ষোভ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধছে। এসব সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়া দরকার বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং অগ্রযাত্রায় বৃহৎ প্রকল্প যেমন জরুরি, তেমনি জরুরি সামাজিক জীবনে স্থিরতা, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, দারিদ্র দূরীকরন, সুদ, ঘুষ, দুনীর্তি কমানো, নারী নিযার্তন প্রতিরোধ, কর্মসংস্থান, গণপরিবহণে শৃংখলা ফেরানো এবং বৈষম্য ও অসমতা দূর করা। সেই সাথে ক্ষমতা প্রর্দশনের সংষ্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা। আর এইসব যদি বন্ধ করা সম্ভব না হয় তাহলে বড় বড় উন্নয়নগুলোর সুফল সাধারণ মানুষ পাবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

সে কারণেই এসব সামাজিক সমস্যা ও সঙ্কটগুলোর দিকে সবার আগে নজর দেয়া উচিত। ছোট ছোট সমস্যাগুলো যদি জিইয়ে রাখা হয় তাহলে বড় বড় উন্নয়নগুলো ম্লান হয়ে যেতে পারে বলেই বিশ্লেষকরা মনে করেন। এসব সামাজিক সমস্যা যদি নিয়ন্ত্রণ না করা যায় তাহলে ভবিষ্যতে জনগণ বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর দিকে মনোযোগ দেবে না বলে বিশেষজ্ঞরা বার বার সর্তক করে আসছেন। সুতরাং সরকারের এ বিষয়ে আশু পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সহায়তা নিয়ে “সামাজিক শৃংখলা উন্নয়ন কর্মসূচি” পরিচালনা করতে হবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।