সময় অসময় সবসময়

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ১১:২১:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২
  • / ৩০৩ Time View
মাহবুবুর রহমান তুহিন:
ছোটবেলায় ট্রান্সলেশন মুখস্ত করেছি ‘Time and Tide wait for none’। তখন শুধুই মুখস্ত করেছি এর মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারিনি। উদ্ধার যখন করলাম, তখন মেঘে মেঘে অনেক বেলা চলে গেছে, পদ্মা-যমুনায় বিপুল স্রোত বয়ে গেছে। শুধু হাহাকার করে জীবন পার করে দিলাম।

শৈশবে আমরা ফেনীর সোনাগাজী থাকতাম। সোনাগাজী থেকে ফেনী যাওয়ার জন্য ছোট ছোট বাস ছিলো, যেগুলো ‘মুড়ির টিন’ নামে পরিচিত ছিল। ঐ গাড়িগুলোতে নানা উপদেশ বাণী লেখা থাকতো, যেমন- বিপদে আল্লাহকে স্মরণ করুন; কিংবা ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি’ এরকম। তখন এসব কথা শুধুই পড়তাম। বুঝতে পারতাম না। পরে যখন বুঝতে শিখেছি তখন জানলাম সময় ও জীবন একে অন্যের পরিপূরক। কারণ আমাদের জীবটাই সময়ের সমষ্টি।

শেষের কবিতার শেষে এসে রবীন্দ্রনাথ বললেন, সময়ের প্রয়োজনে আমাদের সব আয়োজন, আমরা সময়ের ক্রীড়নক। তাই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা অমিত আর লাবণ্য পরষ্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। দূর থেকে লাবণ্য অমিতকে লেখে-

‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কী পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল—
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে।

বেশ কিছুদিন আগে টিভিতে ‘Greetings Card’ তৈরির প্রতিষ্ঠান আরসিসি গ্যালারির প্রচারিত বিজ্ঞাপণে মডেলের মুখে শুনতাম ‘সময়ে যেন কাটে না, বড় একা একা লাগে’।

প্রায় একই সময়ে পত্রিকায় ‘Wills Kings’ সিগেরেটের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো ‘কাজে-অবসরে-সুখের গভীরে-সময় বয়ে যায় দু’জনে-দুজনার’; ‘Wills Kings’ তামাক আর ফিল্টার দু’জনে দুজনার।

এ দুটো বিজ্ঞাপণ চিত্র পর্যালোচনা করে আমরা বুঝতে পারি-একা সময়ে কাটানো যায় না; সময় কাটাতে অন্য কিছুর সাহচর্য প্রয়োজন; তবেই সময়ে সুন্দর ও আনন্দময় হয়। আর সেই সুন্দর আনতে হলে আসলে সময়কেই কাজে লাগাতে হয়।

সময়ের সাথে আমরা নিরন্তর ছুটে চলছি আগামীর পথে। সময় আমাদের ভাবতে শেখায়, অনুভব আর উপলদ্ধি করতে শেখায়। সময় আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দুয়ার খুলে দেয়-তাইতো কবি বলেন-

যখনই চাই সহজলভ্য নারীর কাছে যেতে,
একখানি মুখ ঝলসে ওঠে, তোমাকে চাই পেতে।
সময়ে বসে ভেংচি কাটে-এক্ষুনি নয় সব
আমিও বুঝি তোমাকে পাওয়া একটু অসম্ভব।

সময়ের প্রয়োজনে পুরাতনকে বিদায় নিতে হয়। নতুনকে স্থান করে দিতে হয়। তাই দিন শেষে রাত। আর রাত শেষে দিন। এভাবেই অনবরত চলতে থাকে কালের খেয়া-
দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়
আমি মৃত্যু তোর মাতা; নাহি মোরে ভয়
নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন
আমি তোরে করে দেই প্রত্যহ নবীন।

সময় বড়ই নিষ্ঠুর। সে একজনের সবকিছু নিংড়ে, চুষে নিয়ে অন্যের অপেক্ষা করতে থাকে। কবি আল মাহমুদের একটি কবতিায় আছে ‘কালের রেঁদার টানে, সর্বশিল্প করে থর থর’। মানে করাত যেমন একটি বিশাল বৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করে ফেলে, তেমনি সময়ের করাতও সব সৌন্দর্য, সৌকর্য, সুষমাকে এক সময় ম্লান, মলিন, ম্রিয়মান করে দেয়। এ বেদনাকে প্রলেপ দিতে কবিগুরু গাইতে থাকেন, ‘তোমার হল শুরু আমার হল সাড়া’।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে একটা দেয়ালে বড় করে লেখা ছিলো ‘জেগে উঠল কি তবে সময়ের ঘড়ি, এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি’। তখন বুঝতাম না এর মানে। পরে যখন এর মর্মার্থ উদ্বারের চেষ্টা করলাম, আমার মননে গোপনে-গহীনে প্রশ্নের ধ্বনি বেজে উঠলো। সকল বিদ্রোহের জন্য কী সময়ের ঘড়ি বেজে ওঠে না কি দীর্ঘ সংগ্রামের সোপান পেরিয়ে রক্তস্নাত পলল ভূমিতে বিদ্রোহের বীজ বুনে সময়ের ঘড়ি বাজাতে হয়? বছরের পর বছর পার হল, মেলেনি উত্তর।

রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কাব্যে বলেন, সময় শুধু সৃষ্টিকে নিয়ে যায়, স্রষ্টাকে কোনো স্থান দেয় না। কৃষক সারা বছর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সোনার ফসল ফলিয়ে নদী তীরে দাঁড়িয়ে বহমান তরীকে যখন বলে-

‘ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী, কূলেতে এসে,
যেও যেথা যেতে চাও, যারে খুশি তারে লও
শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।‌‌’

তখন তরী বলে- যত চাও তত লও তরণী পরে
সব ফসল তোলা হলে সেই ফসল ফলনোর স্রষ্টা (কৃষক) তরীকে যখন বলে-

এতকাল নদীকূলে যাহা লয়েছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে
এখন আমারে লহো করুণা করে।

অমনি তরী প্রত্যুত্তরে জানিয়ে দেয়-

ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’।

আমরা ছোটবেলায় বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখতাম ‘এইসব দিন রাত্রি’। যেটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। নাটকের শেষে টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠত ‘আশা আনন্দের যে উজ্জ্বল দিন তার উল্টো পাশেই দুঃখ ও বেদনার দীর্ঘ রজনী। আশা-আনন্দ-দুঃখ-বেদনা নিয়েই আমাদের এই সব দিন রাত্রি।

স্কুলে আমরা বাগধারায় ‘তাসের ঘর’ মানে পড়েছি ‘ক্ষণস্থায়ী’। আমরা বাক্য রচনা করতাম ‘দেখতে দেখতে মূঘল সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। কোন কিছুই স্থায়ী নয়। সময়ের সমুদ্র সবই গ্রাস করে। কালের গহ্বরে সব কিছু হারিয়ে যায়; সত্যিই কী তাই?

‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, রাজা যায় রাজা আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ক্ষুধার্ত সময় সবকিছু গিলে ফেলে, তবে গল্প গিলতে পারে না। গল্প থেকে যায়।

আমাদেরকে গল্প লিখে যেতে হবে। যাতে আমরা অনন্ত জীবন বেঁচে থাকতে পারি। সৃষ্টির মাঝে বিলীন হয়ে নয়, সৃষ্টির চেয়েও বিশালতায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে। যাতে কালকে ছাড়িয়ে মহাকালকে স্পর্শ করতে পারি। এ জন্যই শাহজাহান কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন-

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।

দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন যখন শুকায়ে যায়, তখন নতুন স্বপ্নে সাজাতে হবে প্রিয় প্রাঙ্গনকে। দুঃসময় একসময় কেটে যাবে। কারণ আমরা জানি রাত যত গভীর হয়, সকালের সূর্য ততই নিকটবর্তী হতে থাকে। তাই স্বপ্নলোকের চাবি খুঁজে পেতে হবে। তখন আমরা বুঝতে পারবো যে- ‘মানুষ কেবল নিজের মধ্যে আছে তা নয়, সকলে তাকে যা জানে সে জানার মধ্যেও সে অনেকখানি আছে। তাই ‘আপনাকে জানো’ এ কথাটি শেষ নয়, ‘আপনাকে জানাও’ এটাও খুব বড় কথা’।

তাই জানতে ও জানাতে সময় নষ্ট করার সময় আমাদের হাতে নেই। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে সময়, অসময়, সবসময়।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।

Please Share This Post in Your Social Media

সময় অসময় সবসময়

Update Time : ১১:২১:০০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৯ জুলাই ২০২২
মাহবুবুর রহমান তুহিন:
ছোটবেলায় ট্রান্সলেশন মুখস্ত করেছি ‘Time and Tide wait for none’। তখন শুধুই মুখস্ত করেছি এর মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারিনি। উদ্ধার যখন করলাম, তখন মেঘে মেঘে অনেক বেলা চলে গেছে, পদ্মা-যমুনায় বিপুল স্রোত বয়ে গেছে। শুধু হাহাকার করে জীবন পার করে দিলাম।

শৈশবে আমরা ফেনীর সোনাগাজী থাকতাম। সোনাগাজী থেকে ফেনী যাওয়ার জন্য ছোট ছোট বাস ছিলো, যেগুলো ‘মুড়ির টিন’ নামে পরিচিত ছিল। ঐ গাড়িগুলোতে নানা উপদেশ বাণী লেখা থাকতো, যেমন- বিপদে আল্লাহকে স্মরণ করুন; কিংবা ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি’ এরকম। তখন এসব কথা শুধুই পড়তাম। বুঝতে পারতাম না। পরে যখন বুঝতে শিখেছি তখন জানলাম সময় ও জীবন একে অন্যের পরিপূরক। কারণ আমাদের জীবটাই সময়ের সমষ্টি।

শেষের কবিতার শেষে এসে রবীন্দ্রনাথ বললেন, সময়ের প্রয়োজনে আমাদের সব আয়োজন, আমরা সময়ের ক্রীড়নক। তাই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা অমিত আর লাবণ্য পরষ্পরের কাছ থেকে দূরে সরে যায়। দূর থেকে লাবণ্য অমিতকে লেখে-

‘কালের যাত্রার ধ্বনি শুনিতে কী পাও।
তারি রথ নিত্যই উধাও
জাগাইছে অন্তরীক্ষে হৃদয়স্পন্দন,
চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন।
ওগো বন্ধু, সেই ধাবমান কাল
জড়ায়ে ধরিল মোরে ফেলি তার জাল—
তুলে নিল দ্রুতরথে
দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে
তোমা হতে বহুদূরে।

বেশ কিছুদিন আগে টিভিতে ‘Greetings Card’ তৈরির প্রতিষ্ঠান আরসিসি গ্যালারির প্রচারিত বিজ্ঞাপণে মডেলের মুখে শুনতাম ‘সময়ে যেন কাটে না, বড় একা একা লাগে’।

প্রায় একই সময়ে পত্রিকায় ‘Wills Kings’ সিগেরেটের বিজ্ঞাপনে লেখা থাকতো ‘কাজে-অবসরে-সুখের গভীরে-সময় বয়ে যায় দু’জনে-দুজনার’; ‘Wills Kings’ তামাক আর ফিল্টার দু’জনে দুজনার।

এ দুটো বিজ্ঞাপণ চিত্র পর্যালোচনা করে আমরা বুঝতে পারি-একা সময়ে কাটানো যায় না; সময় কাটাতে অন্য কিছুর সাহচর্য প্রয়োজন; তবেই সময়ে সুন্দর ও আনন্দময় হয়। আর সেই সুন্দর আনতে হলে আসলে সময়কেই কাজে লাগাতে হয়।

সময়ের সাথে আমরা নিরন্তর ছুটে চলছি আগামীর পথে। সময় আমাদের ভাবতে শেখায়, অনুভব আর উপলদ্ধি করতে শেখায়। সময় আমাদের আত্মজিজ্ঞাসার দুয়ার খুলে দেয়-তাইতো কবি বলেন-

যখনই চাই সহজলভ্য নারীর কাছে যেতে,
একখানি মুখ ঝলসে ওঠে, তোমাকে চাই পেতে।
সময়ে বসে ভেংচি কাটে-এক্ষুনি নয় সব
আমিও বুঝি তোমাকে পাওয়া একটু অসম্ভব।

সময়ের প্রয়োজনে পুরাতনকে বিদায় নিতে হয়। নতুনকে স্থান করে দিতে হয়। তাই দিন শেষে রাত। আর রাত শেষে দিন। এভাবেই অনবরত চলতে থাকে কালের খেয়া-
দিনান্তের মুখ চুম্বি রাত্রি ধীরে কয়
আমি মৃত্যু তোর মাতা; নাহি মোরে ভয়
নব নব জন্মদানে পুরাতন দিন
আমি তোরে করে দেই প্রত্যহ নবীন।

সময় বড়ই নিষ্ঠুর। সে একজনের সবকিছু নিংড়ে, চুষে নিয়ে অন্যের অপেক্ষা করতে থাকে। কবি আল মাহমুদের একটি কবতিায় আছে ‘কালের রেঁদার টানে, সর্বশিল্প করে থর থর’। মানে করাত যেমন একটি বিশাল বৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করে ফেলে, তেমনি সময়ের করাতও সব সৌন্দর্য, সৌকর্য, সুষমাকে এক সময় ম্লান, মলিন, ম্রিয়মান করে দেয়। এ বেদনাকে প্রলেপ দিতে কবিগুরু গাইতে থাকেন, ‘তোমার হল শুরু আমার হল সাড়া’।

আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন বাসা থেকে স্কুলে যাওয়ার পথে একটা দেয়ালে বড় করে লেখা ছিলো ‘জেগে উঠল কি তবে সময়ের ঘড়ি, এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি’। তখন বুঝতাম না এর মানে। পরে যখন এর মর্মার্থ উদ্বারের চেষ্টা করলাম, আমার মননে গোপনে-গহীনে প্রশ্নের ধ্বনি বেজে উঠলো। সকল বিদ্রোহের জন্য কী সময়ের ঘড়ি বেজে ওঠে না কি দীর্ঘ সংগ্রামের সোপান পেরিয়ে রক্তস্নাত পলল ভূমিতে বিদ্রোহের বীজ বুনে সময়ের ঘড়ি বাজাতে হয়? বছরের পর বছর পার হল, মেলেনি উত্তর।

রবীন্দ্রনাথ ‘সোনার তরী’ কাব্যে বলেন, সময় শুধু সৃষ্টিকে নিয়ে যায়, স্রষ্টাকে কোনো স্থান দেয় না। কৃষক সারা বছর রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সোনার ফসল ফলিয়ে নদী তীরে দাঁড়িয়ে বহমান তরীকে যখন বলে-

‘ওগো তুমি কোথা যাও কোন বিদেশে?
বারেক ভিড়াও তরী, কূলেতে এসে,
যেও যেথা যেতে চাও, যারে খুশি তারে লও
শুধু তুমি নিয়ে যাও ক্ষণিক হেসে
আমার সোনার ধান কূলেতে এসে।‌‌’

তখন তরী বলে- যত চাও তত লও তরণী পরে
সব ফসল তোলা হলে সেই ফসল ফলনোর স্রষ্টা (কৃষক) তরীকে যখন বলে-

এতকাল নদীকূলে যাহা লয়েছিনু ভুলে
সকলি দিলাম তুলে থরে বিথরে
এখন আমারে লহো করুণা করে।

অমনি তরী প্রত্যুত্তরে জানিয়ে দেয়-

ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী
আমারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’।

আমরা ছোটবেলায় বিটিভিতে হুমায়ূন আহমেদের নাটক দেখতাম ‘এইসব দিন রাত্রি’। যেটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। নাটকের শেষে টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠত ‘আশা আনন্দের যে উজ্জ্বল দিন তার উল্টো পাশেই দুঃখ ও বেদনার দীর্ঘ রজনী। আশা-আনন্দ-দুঃখ-বেদনা নিয়েই আমাদের এই সব দিন রাত্রি।

স্কুলে আমরা বাগধারায় ‘তাসের ঘর’ মানে পড়েছি ‘ক্ষণস্থায়ী’। আমরা বাক্য রচনা করতাম ‘দেখতে দেখতে মূঘল সাম্রাজ্য তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়লো। কোন কিছুই স্থায়ী নয়। সময়ের সমুদ্র সবই গ্রাস করে। কালের গহ্বরে সব কিছু হারিয়ে যায়; সত্যিই কী তাই?

‘বাদশাহ নামদার’ উপন্যাসে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, রাজা যায় রাজা আসে। কিছুই টিকে থাকে না। ক্ষুধার্ত সময় সবকিছু গিলে ফেলে, তবে গল্প গিলতে পারে না। গল্প থেকে যায়।

আমাদেরকে গল্প লিখে যেতে হবে। যাতে আমরা অনন্ত জীবন বেঁচে থাকতে পারি। সৃষ্টির মাঝে বিলীন হয়ে নয়, সৃষ্টির চেয়েও বিশালতায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে। যাতে কালকে ছাড়িয়ে মহাকালকে স্পর্শ করতে পারি। এ জন্যই শাহজাহান কবিতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন-

তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।

দুঃসময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জীবন যখন শুকায়ে যায়, তখন নতুন স্বপ্নে সাজাতে হবে প্রিয় প্রাঙ্গনকে। দুঃসময় একসময় কেটে যাবে। কারণ আমরা জানি রাত যত গভীর হয়, সকালের সূর্য ততই নিকটবর্তী হতে থাকে। তাই স্বপ্নলোকের চাবি খুঁজে পেতে হবে। তখন আমরা বুঝতে পারবো যে- ‘মানুষ কেবল নিজের মধ্যে আছে তা নয়, সকলে তাকে যা জানে সে জানার মধ্যেও সে অনেকখানি আছে। তাই ‘আপনাকে জানো’ এ কথাটি শেষ নয়, ‘আপনাকে জানাও’ এটাও খুব বড় কথা’।

তাই জানতে ও জানাতে সময় নষ্ট করার সময় আমাদের হাতে নেই। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে সময়, অসময়, সবসময়।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়।