শতকোটি টাকা খরচেও নিয়ন্ত্রণহীন এডিস মশার বিস্তার

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৩:০৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০২৩
  • / ১২৯ Time View

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশজুড়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। হাসপাতালেও রোগীর ছড়াছড়ি। প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এডিস মশার বিস্তার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তর আর মানুষের কর্মকাণ্ডে এডিস বংশ বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে।

উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েও এডিসের বংশ বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নগরের পরিবেশ ধ্বংস এডিস বিস্তারের বড় কারণ।

জনস্বাস্থ্যবিদ এম এম আকতারুজ্জামান জানান, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত, হঠাৎ রোদ আর তীব্র গরম সবই এডিস মশার বংশ বিস্তারে উপযোগী পরিবেশ। এবার দেশজুড়েই ছিলো পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া।

এছাড়া বাসাবাড়ির ছাদ, শহরের বিভিন্ন স্থানে অল্প পানি জমে থাকাসহ নানা কারণেই এবছর এডিস মশার বংশ বিস্তার ও ঘনত্ব ছিলো বেশি। যার ফলে দেশ জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। গেল কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে আক্রান্তের হারও।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, এডিস মশা তার জীবন চক্রই পাল্টে ফেলেছে। সব ধরনের পরিবেশের খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আগে শুধু বৃষ্টির পানি, ঘরে বা বাইরে জমা পরিষ্কার পানিতেই এডিস হতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন এডিস শুধু নোংরা পানি নয়, লোনা পানিতেও জন্মাচ্ছে। আবার শুধু দিন নয় এবার গবেষণা বলছে, দিন এবং রাত সব সময়ই এডিস মশা কামড়াচ্ছে। তাই এই সংকট থেকে সহজেই মুক্তির পথ দেখছে বিশেষজ্ঞরা।

প্রাকৃতিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণের যে চক্র তাও রাজধানী থেকে হারিয়ে গেছে। একটি বাদুর ঘণ্টায় প্রায় তিনশ মশা খায়। একটি ব্যাঙ তার দেহের অর্ধেক পরিমাণ পোকা খেয়ে পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরও প্রধান খাবার মশা। প্রকৃতির সেই ভারসাম্য হারিয়েছে অনেক আগেই। তাই এসব থেকে প্রাকৃতিকভাবে মুক্তির উপায় না থাকায় মশার উপদ্রব বাড়ছেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন অবস্থায় দুই সিটি কর্পোরেশনই ওষুধ ছিটিয়ে, অভিযান চালিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এই ওষুধে এডিস মরছে কিনা কিনা কিম্বা বংশ বিস্তার রোধ কমলো কিনা তার কোন বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা নেই।

অথচ গেল কয়েক বছরে দুই সিটি এই ওষুধের পিছনেই খরচ করেছে হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণের এই অর্থ খরচ করেও তেমন কোন ফল মেলেনি।

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এবারের রিপোর্টে সিটি কর্পোরেশন যে কাজ করছে, তা প্রমাণিত। আগে যেখানে প্রায় ৪৫ শতাংশ বাসাবাড়িতে, লিফটের গোঁড়ায় পানি জমে থাকত, এবার সেটা নাই বললেই চলে।

যেহেতু ময়লা পানিতেও এডিস মশা বংশ ছড়াচ্ছে তাই সামনে আরো ভয়ংকর রূপ নিবে ডেঙ্গু। রাজধানীর সব খাল, পুকুর আর জলাশয়ই ময়লার ভাগারে রূপ নিয়েছে। নদীর সাথে যুক্ত না থাকায় পানি প্রবাহ নেই খালগুলোর।

এসব জমে থাকা ময়লা পানিতে থাকে এডিসের বিস্তার কিভাবে রোধ করা হবে জানতে চাইলে মেয়র আতিক বলেন, খাল আর পুকুর দূষণের জন্য দায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নগরবাসী। সবাই সচেতন না হলে এটি করা কঠিন।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, যেকোনো কীটনাশক বেশিদিন ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠে কীটপতঙ্গরা। ফলে কীটনাশক পরিবর্তন করে দেয়াটাও জরুরী।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান জানালেন, হাসপাতালে প্রতিনিয়তই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। বেশিরভাগ রোগীর ওষুধে বমি ও মাথা ব্যথা বন্ধ হচ্ছে না। অনেক রোগীর রক্তচাপ একবারেই কমে যাচ্ছে। কিডনি, এমনকি মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাসে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার বড় কথা নয়। এই ভাইরাসে মৃত্যু বাড়ছে সেটি চিন্তার বিষয়। গবেষণায় উঠে এসেছে, কেউ যদি ডেন-১ দিয়ে প্রথমবার আক্রান্ত হয় দ্বিতীয়বার ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত তার জন্য ঝুঁকি বেশি। এবার এমন রোগীই বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, কিভাবে নগরবাসীকে ডেঙ্গুর হাত থেকে রেহাই দেয়া যায়, সে বিষয়ে একটি রোড ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। কীটনাশক ডেঙ্গু মশার লার্ভা মারলেও ড্রেনে যে গাপ্পি মাছগুলো আছে, তাও মেরে ফেলছে। এজন্য এবার লার্ভা মারার জন্য নতুন জৈব ওষুধ আনা হয়েছে।

আগামী মাসে ডেঙ্গুর ভরা মৌসুম চলবে। সেই সময়টা মোকাবেলা করতে এখনই প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

শতকোটি টাকা খরচেও নিয়ন্ত্রণহীন এডিস মশার বিস্তার

Update Time : ০৩:০৮:৩০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ জুলাই ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশজুড়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু। প্রায় সব জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এই রোগ। হাসপাতালেও রোগীর ছড়াছড়ি। প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা খরচ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না এডিস মশার বিস্তার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তর আর মানুষের কর্মকাণ্ডে এডিস বংশ বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছে।

উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, নানা ধরনের ব্যবস্থা নিয়েও এডিসের বংশ বিস্তার রোধ করা যাচ্ছে না। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডসহ নগরের পরিবেশ ধ্বংস এডিস বিস্তারের বড় কারণ।

জনস্বাস্থ্যবিদ এম এম আকতারুজ্জামান জানান, থেমে থেমে বৃষ্টিপাত, হঠাৎ রোদ আর তীব্র গরম সবই এডিস মশার বংশ বিস্তারে উপযোগী পরিবেশ। এবার দেশজুড়েই ছিলো পরিবেশ বিপর্যয় ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। ঠিক সময়ে বৃষ্টিপাত না হওয়া।

এছাড়া বাসাবাড়ির ছাদ, শহরের বিভিন্ন স্থানে অল্প পানি জমে থাকাসহ নানা কারণেই এবছর এডিস মশার বংশ বিস্তার ও ঘনত্ব ছিলো বেশি। যার ফলে দেশ জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে ডেঙ্গু। গেল কয়েক বছরের রেকর্ড ভেঙ্গেছে আক্রান্তের হারও।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, এডিস মশা তার জীবন চক্রই পাল্টে ফেলেছে। সব ধরনের পরিবেশের খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। আগে শুধু বৃষ্টির পানি, ঘরে বা বাইরে জমা পরিষ্কার পানিতেই এডিস হতো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এখন এডিস শুধু নোংরা পানি নয়, লোনা পানিতেও জন্মাচ্ছে। আবার শুধু দিন নয় এবার গবেষণা বলছে, দিন এবং রাত সব সময়ই এডিস মশা কামড়াচ্ছে। তাই এই সংকট থেকে সহজেই মুক্তির পথ দেখছে বিশেষজ্ঞরা।

প্রাকৃতিকভাবে মশা নিয়ন্ত্রণের যে চক্র তাও রাজধানী থেকে হারিয়ে গেছে। একটি বাদুর ঘণ্টায় প্রায় তিনশ মশা খায়। একটি ব্যাঙ তার দেহের অর্ধেক পরিমাণ পোকা খেয়ে পরিবেশ ভারসাম্য রক্ষা করে। বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরও প্রধান খাবার মশা। প্রকৃতির সেই ভারসাম্য হারিয়েছে অনেক আগেই। তাই এসব থেকে প্রাকৃতিকভাবে মুক্তির উপায় না থাকায় মশার উপদ্রব বাড়ছেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন অবস্থায় দুই সিটি কর্পোরেশনই ওষুধ ছিটিয়ে, অভিযান চালিয়ে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এই ওষুধে এডিস মরছে কিনা কিনা কিম্বা বংশ বিস্তার রোধ কমলো কিনা তার কোন বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা নেই।

অথচ গেল কয়েক বছরে দুই সিটি এই ওষুধের পিছনেই খরচ করেছে হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণের এই অর্থ খরচ করেও তেমন কোন ফল মেলেনি।

উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এবারের রিপোর্টে সিটি কর্পোরেশন যে কাজ করছে, তা প্রমাণিত। আগে যেখানে প্রায় ৪৫ শতাংশ বাসাবাড়িতে, লিফটের গোঁড়ায় পানি জমে থাকত, এবার সেটা নাই বললেই চলে।

যেহেতু ময়লা পানিতেও এডিস মশা বংশ ছড়াচ্ছে তাই সামনে আরো ভয়ংকর রূপ নিবে ডেঙ্গু। রাজধানীর সব খাল, পুকুর আর জলাশয়ই ময়লার ভাগারে রূপ নিয়েছে। নদীর সাথে যুক্ত না থাকায় পানি প্রবাহ নেই খালগুলোর।

এসব জমে থাকা ময়লা পানিতে থাকে এডিসের বিস্তার কিভাবে রোধ করা হবে জানতে চাইলে মেয়র আতিক বলেন, খাল আর পুকুর দূষণের জন্য দায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও নগরবাসী। সবাই সচেতন না হলে এটি করা কঠিন।

কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার জানান, যেকোনো কীটনাশক বেশিদিন ব্যবহার করলে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠে কীটপতঙ্গরা। ফলে কীটনাশক পরিবর্তন করে দেয়াটাও জরুরী।

মুগদা জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. নিয়াতুজ্জামান জানালেন, হাসপাতালে প্রতিনিয়তই বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। বেশিরভাগ রোগীর ওষুধে বমি ও মাথা ব্যথা বন্ধ হচ্ছে না। অনেক রোগীর রক্তচাপ একবারেই কমে যাচ্ছে। কিডনি, এমনকি মস্তিষ্ক পর্যন্ত আক্রান্ত হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাসে।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন জানান, ডেঙ্গু জ্বরের বিস্তার বড় কথা নয়। এই ভাইরাসে মৃত্যু বাড়ছে সেটি চিন্তার বিষয়। গবেষণায় উঠে এসেছে, কেউ যদি ডেন-১ দিয়ে প্রথমবার আক্রান্ত হয় দ্বিতীয়বার ডেন-২ দ্বারা আক্রান্ত তার জন্য ঝুঁকি বেশি। এবার এমন রোগীই বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, কিভাবে নগরবাসীকে ডেঙ্গুর হাত থেকে রেহাই দেয়া যায়, সে বিষয়ে একটি রোড ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। কীটনাশক ডেঙ্গু মশার লার্ভা মারলেও ড্রেনে যে গাপ্পি মাছগুলো আছে, তাও মেরে ফেলছে। এজন্য এবার লার্ভা মারার জন্য নতুন জৈব ওষুধ আনা হয়েছে।

আগামী মাসে ডেঙ্গুর ভরা মৌসুম চলবে। সেই সময়টা মোকাবেলা করতে এখনই প্রস্তুতি নেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।