মায়ের স্বপ্ন

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০১:২৬:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ মে ২০২১
  • / ৪৪০ Time View
মিজান মালিক:
গ্রামে আমাদের বেশ জমিজমা ছিল। অনেক পরিমাণ ধান আসতো। এই ধান মারাইয়ের জন্য নানা বাড়ি থেকে হালের গরু পাঠানো হতো। দু’ফসলি জমি। কোনো কোনো জমিতে প্রচুর মরিচ আসতো। অন্যান্য ফসল তো হতোই। মরিচ তোলার জন্য অনেক লোক কাজ করতো। আব্বা যেহেতু কৃষক পরিবারের ছিলেন, ফলে নিজে সব তদারক করতেন। আমাদের গ্রামের সাপ্তাহিক বাজারের নাম ছিল আখনের হাট।
.
এখন নদীতে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষাকালে আমাকে নৌকায় বসিয়ে রেখে আব্বা বাজারে ঢুকতেন। অপেক্ষায় থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়তাম। আব্বার এক বন্ধু কিছু নাস্তাপানি নিয়ে এসে একবার বললেন, তোমার আব্বা তো একটু ব্যস্ত। কিছু মালামাল বিক্রি বাকি আছে। চলে আসবে। আমাদের যে ধান আসতো বাজারে বস্তায় বস্তায় চলে যেতো বিক্রির জন্য। কাঁচা মরিচ, পাকা মরিচ, আলু প্রভৃতি কৃষিপণ্য মনকে মন বিক্রি করা হতো। আব্বা সেগুলো বিক্রি শেষ করে সাপ্তাহিক বাজার করে আসতেন।আব্বা দাদার এক ছেলে ছিলেন।
অনেক চাপে থাকতেন।
.
মনে পড়ে ছোট বেলায় আব্বাকে আমি বেশি সাপোর্ট দিতাম। ধান কাটায়, ফসল উঠানোয়.. প্রভৃতি কাজে। এখনো আমার একটি আঙ্গুলের মাথায় মাংস কম। কেটে গিয়েছিল সেই ছোট বেলায়।
.
আবার দুষ্টমিতেও সবাইকে ছাড়িয়ে। দুপুরে না ঘুমিয়ে গাছে ওঠে বসে থাকতাম। নানান ধরনের ফল পেরে এনে ভর্তা বানানী খাওয়া ছিল রুটিন। ওদিকে আব্বার ওপর কাজের অনেক চাপ। আমার বড় ভাই তখন তার পড়াশোনা, স্কুলের মাস্টারি এগুলো নিয়ে ব্যস্ত। আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই মনির ফল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বাম হাতটা ভেঙে ফেলে। যেহেতু তার একটি হাত ভাঙা, বাঁকা,তাই তার পড়াশোনা নিশ্চিত করার বিষয়ে সবার আগ্রহ ছিল।
.
ছবিঃ কবি মিজান মালিক
আমি যখন সেভেনে উঠি, হঠাৎ বলা হলো, আমার পড়াশোনা বন্ধ। আব্বার সাথে জমিজমা কৃষি ব্যবসা প্রভৃতি কাজে সহায়তা করতে হবে। তিন ভাইয়ের মধ্যে, আমার পড়াশোনা বন্ধের এই বিষয়টি আমার ভাই বললেও পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মনে হয় ঠিক হয়নি।
.
যা হোক এই যখন আলোচনার বিষয়, তখন মা একদিন সবাইকে বললেন,মা স্বপ্নে দেখেছেন আমি লেখাপড়া করে অনেক বড় হয়েছি। ফলে আমার লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না।
.
ছোট বেলা থেকেই আমার অদম্য ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করবো। বাড়িতে আমার আব্বার টুকটাক কাজেও সহায়তা করছি। মা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে অনেক পেরেশান ছিলেন। যদিও বড় ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে তাকে ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে।
.
আজ ভাবি,মা যদি সেদিন পাশে না দাঁড়াতেন,আমার অদম্য ইচ্ছা ওখানেই হয়তো হারিয়ে যেতো।
শুধু তাই নয়, ছোট বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে যাত্রাপালা দেখতাম। আব্বা খুব রাগ করতেন।রাত জেগে কেন বাইরে এসব দেখে সময় নষ্ট করি। মমতাময়ী মা আমার সারারাত জেগে থাকতেন। আমি ঘরে আসার পর খেতেন।
.
আশেপাশে ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতে গিয়ে মারামারি হতো। আমি মার খেয়ে এসে আব্বাকে নালিশ করে উল্টো মার খেয়েছি মনে আছে। কেন আমি মারামারিতে জড়িয়েছি,এটা আমার অপরাধ। মা এসে আব্বাকে নিবৃত করতেন।
.
আজ মা নেই। মাকে হারাই২০১৫ সালে। জীবদ্দশায় সেভাবে মায়ের দেখাশোনা করতে পারিনি। পড়াশোনা ও পেশাগত ব্যস্ততার কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি অনেক কিছু করতে পারিনি মায়ের জন্য। এই অনুশোচনা আমার চিরকালের।
.
যাদের মা বেঁচে আছেন,তারা সৌভাগ্যবান। মায়ের পাশে থেকো। তাঁর যেনো অযত্ন না হয় খেয়াল রাখতে হবে।
বাবা মাকে উৎসর্গ করে আমার লেখা একটি গান তৈরি হচ্ছে। শিরোনাম ” তর্জমা”। এক চোখেতে বাবার ছবি/ অন্য চোখে আমার দুঃখী মা/ হারিয়ে খুঁজি তাদের আমি করি নিজের তর্জমা…
.
যাদের মা বাবা বেঁচে আছেন তাদের ‌সুযোগ আছে অনেক কিছু করার।
সব দিবস‌ই মা বাবার জন্য বিশেষ দিবস। তাদের জন্য দোয়া, তাদের কাছ থেকে দোয়া, দুটৈই সন্তানের জন্ম বিশেষ আরাধনা।
লেখক: কবি, গীতিকার,সৃজনশীল লেখক ও সাংবাদিক।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

মায়ের স্বপ্ন

Update Time : ০১:২৬:৩৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৯ মে ২০২১
মিজান মালিক:
গ্রামে আমাদের বেশ জমিজমা ছিল। অনেক পরিমাণ ধান আসতো। এই ধান মারাইয়ের জন্য নানা বাড়ি থেকে হালের গরু পাঠানো হতো। দু’ফসলি জমি। কোনো কোনো জমিতে প্রচুর মরিচ আসতো। অন্যান্য ফসল তো হতোই। মরিচ তোলার জন্য অনেক লোক কাজ করতো। আব্বা যেহেতু কৃষক পরিবারের ছিলেন, ফলে নিজে সব তদারক করতেন। আমাদের গ্রামের সাপ্তাহিক বাজারের নাম ছিল আখনের হাট।
.
এখন নদীতে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। বর্ষাকালে আমাকে নৌকায় বসিয়ে রেখে আব্বা বাজারে ঢুকতেন। অপেক্ষায় থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়তাম। আব্বার এক বন্ধু কিছু নাস্তাপানি নিয়ে এসে একবার বললেন, তোমার আব্বা তো একটু ব্যস্ত। কিছু মালামাল বিক্রি বাকি আছে। চলে আসবে। আমাদের যে ধান আসতো বাজারে বস্তায় বস্তায় চলে যেতো বিক্রির জন্য। কাঁচা মরিচ, পাকা মরিচ, আলু প্রভৃতি কৃষিপণ্য মনকে মন বিক্রি করা হতো। আব্বা সেগুলো বিক্রি শেষ করে সাপ্তাহিক বাজার করে আসতেন।আব্বা দাদার এক ছেলে ছিলেন।
অনেক চাপে থাকতেন।
.
মনে পড়ে ছোট বেলায় আব্বাকে আমি বেশি সাপোর্ট দিতাম। ধান কাটায়, ফসল উঠানোয়.. প্রভৃতি কাজে। এখনো আমার একটি আঙ্গুলের মাথায় মাংস কম। কেটে গিয়েছিল সেই ছোট বেলায়।
.
আবার দুষ্টমিতেও সবাইকে ছাড়িয়ে। দুপুরে না ঘুমিয়ে গাছে ওঠে বসে থাকতাম। নানান ধরনের ফল পেরে এনে ভর্তা বানানী খাওয়া ছিল রুটিন। ওদিকে আব্বার ওপর কাজের অনেক চাপ। আমার বড় ভাই তখন তার পড়াশোনা, স্কুলের মাস্টারি এগুলো নিয়ে ব্যস্ত। আমার ইমিডিয়েট ছোট ভাই মনির ফল গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বাম হাতটা ভেঙে ফেলে। যেহেতু তার একটি হাত ভাঙা, বাঁকা,তাই তার পড়াশোনা নিশ্চিত করার বিষয়ে সবার আগ্রহ ছিল।
.
ছবিঃ কবি মিজান মালিক
আমি যখন সেভেনে উঠি, হঠাৎ বলা হলো, আমার পড়াশোনা বন্ধ। আব্বার সাথে জমিজমা কৃষি ব্যবসা প্রভৃতি কাজে সহায়তা করতে হবে। তিন ভাইয়ের মধ্যে, আমার পড়াশোনা বন্ধের এই বিষয়টি আমার ভাই বললেও পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মনে হয় ঠিক হয়নি।
.
যা হোক এই যখন আলোচনার বিষয়, তখন মা একদিন সবাইকে বললেন,মা স্বপ্নে দেখেছেন আমি লেখাপড়া করে অনেক বড় হয়েছি। ফলে আমার লেখাপড়া বন্ধ করা যাবে না।
.
ছোট বেলা থেকেই আমার অদম্য ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করবো। বাড়িতে আমার আব্বার টুকটাক কাজেও সহায়তা করছি। মা তাঁর ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে অনেক পেরেশান ছিলেন। যদিও বড় ছেলেকে মানুষ করতে গিয়ে তাকে ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে।
.
আজ ভাবি,মা যদি সেদিন পাশে না দাঁড়াতেন,আমার অদম্য ইচ্ছা ওখানেই হয়তো হারিয়ে যেতো।
শুধু তাই নয়, ছোট বেলায় লুকিয়ে লুকিয়ে যাত্রাপালা দেখতাম। আব্বা খুব রাগ করতেন।রাত জেগে কেন বাইরে এসব দেখে সময় নষ্ট করি। মমতাময়ী মা আমার সারারাত জেগে থাকতেন। আমি ঘরে আসার পর খেতেন।
.
আশেপাশে ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতে গিয়ে মারামারি হতো। আমি মার খেয়ে এসে আব্বাকে নালিশ করে উল্টো মার খেয়েছি মনে আছে। কেন আমি মারামারিতে জড়িয়েছি,এটা আমার অপরাধ। মা এসে আব্বাকে নিবৃত করতেন।
.
আজ মা নেই। মাকে হারাই২০১৫ সালে। জীবদ্দশায় সেভাবে মায়ের দেখাশোনা করতে পারিনি। পড়াশোনা ও পেশাগত ব্যস্ততার কারণেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমি অনেক কিছু করতে পারিনি মায়ের জন্য। এই অনুশোচনা আমার চিরকালের।
.
যাদের মা বেঁচে আছেন,তারা সৌভাগ্যবান। মায়ের পাশে থেকো। তাঁর যেনো অযত্ন না হয় খেয়াল রাখতে হবে।
বাবা মাকে উৎসর্গ করে আমার লেখা একটি গান তৈরি হচ্ছে। শিরোনাম ” তর্জমা”। এক চোখেতে বাবার ছবি/ অন্য চোখে আমার দুঃখী মা/ হারিয়ে খুঁজি তাদের আমি করি নিজের তর্জমা…
.
যাদের মা বাবা বেঁচে আছেন তাদের ‌সুযোগ আছে অনেক কিছু করার।
সব দিবস‌ই মা বাবার জন্য বিশেষ দিবস। তাদের জন্য দোয়া, তাদের কাছ থেকে দোয়া, দুটৈই সন্তানের জন্ম বিশেষ আরাধনা।
লেখক: কবি, গীতিকার,সৃজনশীল লেখক ও সাংবাদিক।