বাংলাদেশ-ভারতে ঘন ঘন ভূমিকম্প কীসের আভাস?

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৭:৪৩:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুন ২০২০
  • / ১২৪ Time View

সম্প্রতি ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার অঞ্চলে। বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অনেক বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। সেই কম্পনে কেঁপে কেঁপে উঠছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলও। বুধবার (২৪ জুন) টানা চতুর্থ দিনের মতো ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ভূমিকম্প হয়েছে। এটিও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অনভূত হয়েছে।

শুধু ভারত অংশে নয়, বাংলাদেশেও গত ক’মাসে তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে মৃদু মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ঢাকা থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭। আরেকটি মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৩ মার্চ সিলেটের গোয়াইনঘাটে। ঢাকা থেকে ২২৮ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৬। আর সর্বশেষ ভূমিকম্পটি হয় গত ২৯ মে টাঙ্গাইলের ভূয়াপুরে। ঢাকা থেকে ৯৬ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫।

 
গত ক’দিনের ঘন ঘন ভূমিকম্প মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এটা অনেক বড় কোনো আঘাতের আভাস কি-না, সে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, ৫ থেকে ৭ বছর পরপর এই অঞ্চলে স্বাভাবিক নিয়মে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়ে থাকে। কেউ বলছেন, হঠাৎ ভূমিকম্প হয়েছে, এমন নয়। এই লাইনে প্রতিনিয়তই ভূমিকম্প হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভূমিকম্প পরিস্থিতি নিয়ে অল্প যে কয়েকজন গবেষণা করেছেন, তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। যৌথভাবে তার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সে।

jagonews24

ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ভূমিকম্প হচ্ছে পাবর্ত্য অঞ্চলে; মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার – এই বেল্টে। এখানে ৫ থেকে ৭ বছর পরপর ৪ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এটা যেহেতু সাবস্ট্রাকশন জোন বা দুটো টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল- এখানে ৫ থেকে ৭ বছর পরপর এরকম হবেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুটো প্লেটের সংযোগ স্থল হলো একটা বিরাট অংশ। এটা বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চল, মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের নিচ দিয়ে চলে গেছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দিকে। এটা হচ্ছে ইন্ডিয়া-বার্মা প্লেটের ওপরের অংশের সংযোগ। সংযোগটার নিচের অংশ অনেক পূর্বে চলে গেছে। পুরো অঞ্চলটাকেই বলা হয় সাবস্ট্রাকশন জোন।’

ঘন ঘন মৃদু কম্পনের বিষয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প বিশারদ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থ ইনসাইডে (পৃথিবীর ভেতরে) শক্তি জমা হয়, যখন এটা বেশি মাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন সে চায় এটাকে (শক্তিটা) ছেড়ে দেয়ার জন্য। ফল্ট লাইন বা দুটো প্লেটের সংযোগস্থল থাকে, অনেক সময় সাব-ফল্ট লাইনও থাকে; এই ফল্ট লাইন ও সাব ফল্ট লাইন দিয়ে যে শক্তি অর্জন করে থাকে, সেগুলো অনেক সময় সেটা রিলিজ করে দেয়। তখনই ভূমিকম্প হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত দু’দিন আগে যে দুটো ভূমিকম্প (ভারতে ২১ জুন বিকেল ৪টা ৪৭ মিনিটে এবং ২২ জুন ভোর ৪টা ২২ মিনিটে) হলো ভারত-মিয়ানমার বাউন্ডারি লাইনে, সেখানে সেগিং ফল্ট নামে একটা বড় ফল্ট আছে। এই লাইনে প্রতিনিয়তই ভূমিকম্প হয়। এমন না যে হঠাৎ করে ভূমিকম্প হয়েছে। সাধারণত বেশিরভাগ ভূমিকম্প হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারি কিংবা বড় ধরনের ফল্ট লাইনগুলোতে। কেননা এদিক দিয়ে সহজেই শক্তিটা বেরিয়ে যেতে পারে।’

‘গত পরশু দিন যে দুটো ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা থেকে পূর্বে একটা ৩০০ কিলোমিটার এবং আরেকটি ২৭৯ কিলোমিটার দূরে। সাধারণ প্লেটগুলো মুভমেন্ট করে। এর ফলে সেখানে শক্তি জমা হয়। যখন শক্তিটা একটু সুযোগ পায়, তখনই সে ফল্ট লাইন দিয়ে শক্তিটা বের করে দেয়’—যোগ করেন মমিনুল ইসলাম।

jagonews24

সামনে বড় ভূমিকম্প অপেক্ষা করছে?
ভূমিকম্প বিশারদ এই দুজনই মনে করছেন, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। একজন মনে করছেন, বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আরেকজন মনে করছেন, বাংলাদেশসহ পূর্ব ভারতের আসাম, মনিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমারে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। শক্তি ম্যাচুরড (পূর্ণ) হয়েছে। যে শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটা যদি একবারে রিলিজ হয়, তাহলে কেয়ামতের দশা হবে। আর যদি ধীরে ধীরে হয়, সেটা অন্য জিনিস।

আবহাওয়াবিদ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘১০০ বছরের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, দুটো প্লেটের সংযোগস্থলের আশপাশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশ তিনটা প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে। নেপাল পড়েছে ইউরোশিয়ান প্লেটে, আমরা পড়েছি ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান বা ইন্ডিয়ান প্লেটে এবং পূর্ব পাশে হলো বার্মা মাইক্রো প্লেট। বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের ফল্ট লাইন নেই। দেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে প্লেট বাউন্ডারি। ওইসব সাইট দিয়ে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। গত কয়েকদিনে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে, ফল্টের কাছাকাছি হয়েছে। সেগুলো বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে হয়েছে। সেসব জায়গায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছেই। এটার কিছু প্রভাব আমাদের দেশে পড়ে। তবে বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হবে, এমনটা আমি মনে করছি না।’

তবে সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সেটার প্রভাব এদেশেও পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সিলেট ও টাঙ্গাইলের ভূমিকম্পের বিষয়ে মমিনুল ইসলাম বলেন ‘ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে সেটার প্রভাব অবশ্যই ঢাকায় পড়বে। তবে ওখানে একটা ফল্ট আছে। সেটা সাব-ফল্ট, বড় ফল্ট নয়। অবশ্যই সেটা অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) ফল্ট। ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে, তবে বড় ভূমিকম্পের ভয় নেই।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘আমাদের যে মডেল, সেটা হচ্ছে আমরা যেটাকে বলছি সাবস্ট্রাকশন জোন, সেটা পূর্ব-পশ্চিমে আড়াইশ’ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ১৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত, অরুণাচল প্রদেশ থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত। এটা হচ্ছে সাবস্ট্রাকশন জোন। এর উপরের প্লেট হচ্ছে বার্মা প্লেট এবং নিচের প্লেটটা হচ্ছে ইন্ডিয়া প্লেট। প্লেটের সংযোগস্থলটা হচ্ছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মেঘনা নদীর অববাহিকা দিয়ে নিচে চলে যাচ্ছে। এটার পূর্ব প্রান্তটা হচ্ছে বার্মা প্লেটের ভেতর। এই সাবস্ট্রাকশন জোনটা মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা। পশ্চিমের অংশটা হচ্ছে লক জোন, যেখানে দুটো প্লেট আটকে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। কিন্তু শক্তি প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর পূর্বে যে অংশটা, যেখানে এখন ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। ৫ থেকে ৭ বছরের ব্যবধানে, এটাকে বলি আমরা স্লো স্লিপ আর্থকোয়েক বা পিরিয়ডিক ভূমিকম্প। অর্থাৎ কয়েক বছরের ব্যবধানে স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প হওয়া। এখানকার ভূমিকম্পগুলো ৪ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার, দু-এক সময় ৭ মাত্রারও হয়ে থাকে।’

jagonews24

তিনি আরও বলেন, ‘এটারই যেটা পশ্চিম বা বাংলাদেশের প্রান্তে, এটা লকড হয়ে আছে। এখানে আটকে আছে। এখানে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণ শক্তি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল যে ভূমিকম্প হলো ৫ দশমিক ৪ মাত্রার, তার আগের দিনও হয়েছে। তার কয়েক দিন আগেও হয়েছে। ওই পাশ শক্তিটা ছেড়ে দিল। ওই শক্তি যে ছেড়ে দিচ্ছে, সেটা আবার চাপ সৃষ্টি করছে বাংলাদেশের দিকে। ওখানে আরও শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। শক্তি সঞ্চিত হতে হতে আমাদের অংশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবে। যেটা ১২ বছর গবেষণা করে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সে আমরা প্রকাশ করেছি। যেখানে ৮ দশমিক ৫ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনটা হলে বাংলাদেশ শুধু নয়, এটা পূর্ব ভারতের আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার, গোটা অঞ্চলের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। অত্যন্ত খারাপ হবে। যে শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটা যদি একবারে রিলিজ হয়, তাহলে কেয়ামত। আর যদি ধীরে ধীরে হয়, সেটা অন্য জিনিস। সেটা ম্যাচুরড হয়ে গেছে। যে কোনো সময় এটা হতে পারে।’

বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার বলেও মনে করেন সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তিনি বলছেন, ‘ঢাকা হচ্ছে ঘনবসতি ও সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। পশ্চিম বা বাংলাদেশ অংশের উৎস থেকে ভূমিকম্প যদি ৮ মাত্রার হয়, তাহলে ঢাকা শহরের এমন অবস্থা হবে যে, সরকার বাধ্য হবে এটাকে পরিত্যক্ত রাজধানী বা নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে। কারণ সবকিছুর কর্মকাণ্ড তো ঢাকাতে। সবকিছু যদি ভূমিকম্পে ভেঙে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, দেশ চলবে কী করে, সরকার চলবে কী করে। তাই এখন থেকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা উচিত। মানে একেক অংশ একেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। যাতে একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আরেকটা দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে পারেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল ভূমিকম্পের দিক থেকে তুলনামূলক নিরাপদ। সেখানেও আঘাত হানবে, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। কারণ আমাদের উৎস হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শিলং মালভূমি। এই দুটো হচ্ছে প্রধান উৎস। এটার কাছাকাছি যে অঞ্চলগুলো, সেগুলো তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।’

এক্ষেত্রে আবহাওয়াবিদ মমিনুল ইসলামের ভাষ্য, ‘সব গবেষণাই যে একেবারে শতভাগ সঠিক, এরকম বলা যায় না।’ আর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘২০১৬ সালে যখন আমাদের ১২ বছরের করা গবেষণা নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশ হয়, তখন আমাদের ভেতরে দু-একজন মন্তব্য করেছেন, আমরা অতিরঞ্জিত করেছি মানুষকে ভয় পাওয়ানোর জন্য। সত্য জিনিস তো বলাটা ভালো। তখন এটাকে কেউ যদি অতিরঞ্জিত বলেন, আমাদের তো করার কিছু নাই। – জাগো নিউজ

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

বাংলাদেশ-ভারতে ঘন ঘন ভূমিকম্প কীসের আভাস?

Update Time : ০৭:৪৩:২১ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৪ জুন ২০২০

সম্প্রতি ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার অঞ্চলে। বিশেষত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে অনেক বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হচ্ছে। সেই কম্পনে কেঁপে কেঁপে উঠছে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেটসহ পূর্বাঞ্চলও। বুধবার (২৪ জুন) টানা চতুর্থ দিনের মতো ভারতের মিজোরাম রাজ্যে ভূমিকম্প হয়েছে। এটিও বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে অনভূত হয়েছে।

শুধু ভারত অংশে নয়, বাংলাদেশেও গত ক’মাসে তিনটি ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে মৃদু মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। ঢাকা থেকে ৭১ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৩ দশমিক ৭। আরেকটি মৃদু মাত্রার ভূমিকম্প হয় ১৩ মার্চ সিলেটের গোয়াইনঘাটে। ঢাকা থেকে ২২৮ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৬। আর সর্বশেষ ভূমিকম্পটি হয় গত ২৯ মে টাঙ্গাইলের ভূয়াপুরে। ঢাকা থেকে ৯৬ কিলোমিটার দূরে এই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৫।

 
গত ক’দিনের ঘন ঘন ভূমিকম্প মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। এটা অনেক বড় কোনো আঘাতের আভাস কি-না, সে শঙ্কাও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, ৫ থেকে ৭ বছর পরপর এই অঞ্চলে স্বাভাবিক নিয়মে ঘন ঘন ভূমিকম্প হয়ে থাকে। কেউ বলছেন, হঠাৎ ভূমিকম্প হয়েছে, এমন নয়। এই লাইনে প্রতিনিয়তই ভূমিকম্প হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ভূমিকম্প পরিস্থিতি নিয়ে অল্প যে কয়েকজন গবেষণা করেছেন, তাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। যৌথভাবে তার একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সে।

jagonews24

ঘন ঘন ভূমিকম্প হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘ভূমিকম্প হচ্ছে পাবর্ত্য অঞ্চলে; মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার – এই বেল্টে। এখানে ৫ থেকে ৭ বছর পরপর ৪ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার ভূমিকম্প হয়ে থাকে। এটা যেহেতু সাবস্ট্রাকশন জোন বা দুটো টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থল- এখানে ৫ থেকে ৭ বছর পরপর এরকম হবেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘দুটো প্লেটের সংযোগ স্থল হলো একটা বিরাট অংশ। এটা বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জ হাওর অঞ্চল, মেঘনা নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরের নিচ দিয়ে চলে গেছে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের দিকে। এটা হচ্ছে ইন্ডিয়া-বার্মা প্লেটের ওপরের অংশের সংযোগ। সংযোগটার নিচের অংশ অনেক পূর্বে চলে গেছে। পুরো অঞ্চলটাকেই বলা হয় সাবস্ট্রাকশন জোন।’

ঘন ঘন মৃদু কম্পনের বিষয়ে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদফতরের ভূমিকম্প বিশারদ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আর্থ ইনসাইডে (পৃথিবীর ভেতরে) শক্তি জমা হয়, যখন এটা বেশি মাত্রায় পৌঁছে যায়, তখন সে চায় এটাকে (শক্তিটা) ছেড়ে দেয়ার জন্য। ফল্ট লাইন বা দুটো প্লেটের সংযোগস্থল থাকে, অনেক সময় সাব-ফল্ট লাইনও থাকে; এই ফল্ট লাইন ও সাব ফল্ট লাইন দিয়ে যে শক্তি অর্জন করে থাকে, সেগুলো অনেক সময় সেটা রিলিজ করে দেয়। তখনই ভূমিকম্প হয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘গত দু’দিন আগে যে দুটো ভূমিকম্প (ভারতে ২১ জুন বিকেল ৪টা ৪৭ মিনিটে এবং ২২ জুন ভোর ৪টা ২২ মিনিটে) হলো ভারত-মিয়ানমার বাউন্ডারি লাইনে, সেখানে সেগিং ফল্ট নামে একটা বড় ফল্ট আছে। এই লাইনে প্রতিনিয়তই ভূমিকম্প হয়। এমন না যে হঠাৎ করে ভূমিকম্প হয়েছে। সাধারণত বেশিরভাগ ভূমিকম্প হয়ে থাকে প্লেট বাউন্ডারি কিংবা বড় ধরনের ফল্ট লাইনগুলোতে। কেননা এদিক দিয়ে সহজেই শক্তিটা বেরিয়ে যেতে পারে।’

‘গত পরশু দিন যে দুটো ভূমিকম্প হয়েছে ঢাকা থেকে পূর্বে একটা ৩০০ কিলোমিটার এবং আরেকটি ২৭৯ কিলোমিটার দূরে। সাধারণ প্লেটগুলো মুভমেন্ট করে। এর ফলে সেখানে শক্তি জমা হয়। যখন শক্তিটা একটু সুযোগ পায়, তখনই সে ফল্ট লাইন দিয়ে শক্তিটা বের করে দেয়’—যোগ করেন মমিনুল ইসলাম।

jagonews24

সামনে বড় ভূমিকম্প অপেক্ষা করছে?
ভূমিকম্প বিশারদ এই দুজনই মনে করছেন, পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। একজন মনে করছেন, বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে আরেকজন মনে করছেন, বাংলাদেশসহ পূর্ব ভারতের আসাম, মনিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমারে বড় ধরনের ভূমিকম্প হতে পারে। শক্তি ম্যাচুরড (পূর্ণ) হয়েছে। যে শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটা যদি একবারে রিলিজ হয়, তাহলে কেয়ামতের দশা হবে। আর যদি ধীরে ধীরে হয়, সেটা অন্য জিনিস।

আবহাওয়াবিদ মমিনুল ইসলাম বলেন, ‘১০০ বছরের ইতিহাস দেখলে দেখা যায়, দুটো প্লেটের সংযোগস্থলের আশপাশে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছে। বাংলাদেশ তিনটা প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে। নেপাল পড়েছে ইউরোশিয়ান প্লেটে, আমরা পড়েছি ইন্দো-অস্ট্রেলিয়ান বা ইন্ডিয়ান প্লেটে এবং পূর্ব পাশে হলো বার্মা মাইক্রো প্লেট। বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের ফল্ট লাইন নেই। দেশের সীমান্ত থেকে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে প্লেট বাউন্ডারি। ওইসব সাইট দিয়ে বড় ভূমিকম্প হতে পারে। গত কয়েকদিনে যে ভূমিকম্পগুলো হয়েছে, ফল্টের কাছাকাছি হয়েছে। সেগুলো বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে হয়েছে। সেসব জায়গায় ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছেই। এটার কিছু প্রভাব আমাদের দেশে পড়ে। তবে বাংলাদেশের ভেতরে বড় ধরনের ভূমিকম্প হবে, এমনটা আমি মনে করছি না।’

তবে সেখানে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে সেটার প্রভাব এদেশেও পড়তে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সিলেট ও টাঙ্গাইলের ভূমিকম্পের বিষয়ে মমিনুল ইসলাম বলেন ‘ওই অঞ্চলে ভূমিকম্প হলে সেটার প্রভাব অবশ্যই ঢাকায় পড়বে। তবে ওখানে একটা ফল্ট আছে। সেটা সাব-ফল্ট, বড় ফল্ট নয়। অবশ্যই সেটা অ্যাক্টিভ (সক্রিয়) ফল্ট। ভূমিকম্পের আশঙ্কা আছে, তবে বড় ভূমিকম্পের ভয় নেই।’

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘আমাদের যে মডেল, সেটা হচ্ছে আমরা যেটাকে বলছি সাবস্ট্রাকশন জোন, সেটা পূর্ব-পশ্চিমে আড়াইশ’ কিলোমিটার এবং উত্তর-দক্ষিণে ১৪০০ কিলোমিটার বিস্তৃত, অরুণাচল প্রদেশ থেকে শুরু করে মিয়ানমার পর্যন্ত। এটা হচ্ছে সাবস্ট্রাকশন জোন। এর উপরের প্লেট হচ্ছে বার্মা প্লেট এবং নিচের প্লেটটা হচ্ছে ইন্ডিয়া প্লেট। প্লেটের সংযোগস্থলটা হচ্ছে সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মেঘনা নদীর অববাহিকা দিয়ে নিচে চলে যাচ্ছে। এটার পূর্ব প্রান্তটা হচ্ছে বার্মা প্লেটের ভেতর। এই সাবস্ট্রাকশন জোনটা মোটামুটি দুই ভাগে ভাগ করা। পশ্চিমের অংশটা হচ্ছে লক জোন, যেখানে দুটো প্লেট আটকে আছে। নড়াচড়া করতে পারছে না। কিন্তু শক্তি প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর পূর্বে যে অংশটা, যেখানে এখন ঘন ঘন ভূমিকম্প হচ্ছে। ৫ থেকে ৭ বছরের ব্যবধানে, এটাকে বলি আমরা স্লো স্লিপ আর্থকোয়েক বা পিরিয়ডিক ভূমিকম্প। অর্থাৎ কয়েক বছরের ব্যবধানে স্বল্প মাত্রার ভূমিকম্প হওয়া। এখানকার ভূমিকম্পগুলো ৪ থেকে সাড়ে ৬ মাত্রার, দু-এক সময় ৭ মাত্রারও হয়ে থাকে।’

jagonews24

তিনি আরও বলেন, ‘এটারই যেটা পশ্চিম বা বাংলাদেশের প্রান্তে, এটা লকড হয়ে আছে। এখানে আটকে আছে। এখানে প্রতিনিয়ত প্রচুর পরিমাণ শক্তি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গতকাল যে ভূমিকম্প হলো ৫ দশমিক ৪ মাত্রার, তার আগের দিনও হয়েছে। তার কয়েক দিন আগেও হয়েছে। ওই পাশ শক্তিটা ছেড়ে দিল। ওই শক্তি যে ছেড়ে দিচ্ছে, সেটা আবার চাপ সৃষ্টি করছে বাংলাদেশের দিকে। ওখানে আরও শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে। শক্তি সঞ্চিত হতে হতে আমাদের অংশে বড় মাত্রার ভূমিকম্প হবে। যেটা ১২ বছর গবেষণা করে ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক জার্নাল নেচার জিওসায়েন্সে আমরা প্রকাশ করেছি। যেখানে ৮ দশমিক ৫ থেকে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তেমনটা হলে বাংলাদেশ শুধু নয়, এটা পূর্ব ভারতের আসাম, মনিপুর, মিজোরাম, মিয়ানমার, গোটা অঞ্চলের অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। অত্যন্ত খারাপ হবে। যে শক্তি জমা হয়ে আছে, সেটা যদি একবারে রিলিজ হয়, তাহলে কেয়ামত। আর যদি ধীরে ধীরে হয়, সেটা অন্য জিনিস। সেটা ম্যাচুরড হয়ে গেছে। যে কোনো সময় এটা হতে পারে।’

বড় ধরনের ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি দরকার বলেও মনে করেন সৈয়দ হুমায়ুন আখতার। তিনি বলছেন, ‘ঢাকা হচ্ছে ঘনবসতি ও সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু। পশ্চিম বা বাংলাদেশ অংশের উৎস থেকে ভূমিকম্প যদি ৮ মাত্রার হয়, তাহলে ঢাকা শহরের এমন অবস্থা হবে যে, সরকার বাধ্য হবে এটাকে পরিত্যক্ত রাজধানী বা নগরী হিসেবে ঘোষণা করতে। কারণ সবকিছুর কর্মকাণ্ড তো ঢাকাতে। সবকিছু যদি ভূমিকম্পে ভেঙে যায়, নষ্ট হয়ে যায়, দেশ চলবে কী করে, সরকার চলবে কী করে। তাই এখন থেকে ডিসেন্ট্রালাইজ করা উচিত। মানে একেক অংশ একেক জায়গায় নিয়ে যাওয়া উচিত। যাতে একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আরেকটা দিয়ে রাষ্ট্র চালাতে পারেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল ভূমিকম্পের দিক থেকে তুলনামূলক নিরাপদ। সেখানেও আঘাত হানবে, কিন্তু ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কম হবে। কারণ আমাদের উৎস হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও শিলং মালভূমি। এই দুটো হচ্ছে প্রধান উৎস। এটার কাছাকাছি যে অঞ্চলগুলো, সেগুলো তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই।’

এক্ষেত্রে আবহাওয়াবিদ মমিনুল ইসলামের ভাষ্য, ‘সব গবেষণাই যে একেবারে শতভাগ সঠিক, এরকম বলা যায় না।’ আর সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, ‘২০১৬ সালে যখন আমাদের ১২ বছরের করা গবেষণা নেচার জিওসায়েন্সে প্রকাশ হয়, তখন আমাদের ভেতরে দু-একজন মন্তব্য করেছেন, আমরা অতিরঞ্জিত করেছি মানুষকে ভয় পাওয়ানোর জন্য। সত্য জিনিস তো বলাটা ভালো। তখন এটাকে কেউ যদি অতিরঞ্জিত বলেন, আমাদের তো করার কিছু নাই। – জাগো নিউজ