অবিবাহিত ছিলাম বলে চাকরিটা হয়নি: বেবী সুলতানা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৬:৫৯:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ মার্চ ২০২৪
  • / ১৪৮ Time View

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টমেকিং ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক বেবী সুলতানা বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষ করতে চলেছেন। একান্ত সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে তাঁর বর্নিল জীবনের গল্পগুলো। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান তুনান।

প্রশ্নঃ কেমন আছেন ম্যাম?
ম্যামঃ আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। (একরাশ হাসিমাখা মুখে উত্তর)

প্রশ্নঃ এই যে কথা বলার শুরুতেই সদা হাস্যোজ্বল একটা মুখ আমরা দেখতে পাই, এই হাসির পেছনের রহস্য কি?
ম্যামঃ হাসির পেছনের রহস্যে আমার বাবার একটা দর্শন কাজ করে। তিনি আমাকে বলতেন যে “দুটো জিনিসে কৃপণতা করবেনা, একটা তোমার হাসি, আর একটা তোমার মিষ্টি করে কথা বলা, কারণ এর জন্য তো তোমার পয়সা খরচ হবেনা, এর বিনিময়ে কোন দেনা-পাওনা নাই, এটা তুমি যত বিলাবে তত তোমার সমৃদ্ধি হবে।” বাবার এই কথাটা আমি সবসময় মেনে চলি। যার সঙ্গে কথা বলি, হেসে কথা বলার চেষ্টা করি, তাকে আর কিছু দিতে না পারি সুন্দর সম্ভাষণটাতো দিতে পারি।

প্রশ্নঃ যদি একটু পেছনে ফিরে যাই, জানতে চাই কেমন ছিল বেবী সুলতানার ছেলেবেলা?
ম্যামঃ আমার বাবা পুলিশে ছিলেন, তার বদলীর সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে আমাদের ভাইবোনেদের ছেলেবেলা কেটেছে, আর আমাদের ছেলেবেলা ছিল প্রকৃতির সাথে। বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন সংস্কৃতি দেখেছি, বরিশালের ঐদিকটাতে আমাদের বেশিরভাগ থাকা হয়েছে। বরিশাল যেহেতু নদীর অঞ্চল, আমার মনে আছে আমাদের একটা নৌকা ছিল, আমরা নৌকায় করে ঘুড়ে বেড়িয়েছি। ছিপ দিয়ে মাছ ধরেছি, আবার যে মাছ ধরছে, তার পিছে পিছে দৌড়েছি। আমাদের খেলনা কিন্তু ঘরের বাহিরে ছিল, এখনকার মত ঘরে বসে খেলিনি। কৈশোরের দিনগুলোতে মাঠে খেলেছি, গাছে উঠে আম, কুল পেড়ে খাওয়া, এইগুলোই আমাদের ছেলেবেলা। আমরা প্রকৃতিকে দেখেছি খুব কাছে থেকে। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো সেই সুযোগটা নেই, তবে আমি মনে করি আমরা মাটির খুব কাছাকাছি বেড়ে উঠার কারণে আমাদের ভেতরে যেই ব্যাপারগুলো কাজ করে, এখনকার মানুষের হয়ত অতটা কাজ করেনা।
প্রশ্নঃ তাহলে কি কংক্রিটের এই শহরে ছেলেবেলাকে খুব মিস করেন?
ম্যামঃ হ্যাঁ খুব মিস করি। মনে হয় গ্রামের দিকে চলে যাই। গাছের একটা ফল পেড়ে খাই। যদিও আমি যাই আমার গ্রামের বাড়িতে।

প্রশ্নঃ ছেলেবেলায় কেমন ছিলেন, দুরন্ত নাকি শান্ত?
ম্যামঃ খুব একটা দুরন্ত ছিলাম না, আমার অনেকগুলো ভাই বোনের মধ্যে সবাই বলত আমি একটু চুপচাপ শান্ত, আবার একটু স্পেশাল। আমার একটু বই পড়ার নেশা ছিল। বাড়িতে ধীর স্থির কাজ গুলো আমাকে দিয়ে করাত সবাই। একটু সেলাইয়ের কাজ করতে দিত। আমার বড় বোন আমাকে বড় করেছেন, আমার মা সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, কিন্তু আমার বড় বোন আমাদের সব ভাই বোনকে আগলে রাখতেন। পড়াশোনা সব কিছু তার দ্বায়িত্বে ছিল। কে কোথায় পড়বে সব তার দ্বায়িত্বে ছিল। আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির দ্বায়িত্ব তার ছিল।

প্রশ্নঃ ইউনিভার্সিটির কথা যখন চলে এলো, জানতে চাই আপনার ছবি আঁকার শুরু সম্পর্কে।
ম্যামঃ ছবি আঁকার শুরু এই যে বললাম একটু চুপচাপ স্বভাবের ছিলাম, সেজন্য ধরো একটু ড্রইং করা, টেবিলক্লথের ফুল আঁকার এই কাজগুলো পরিবারের সবাই আমাকে বলত তুমি একটু করে দাও, আর আমারও ভালো লাগত। চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হই, তখন আমার মেজো বোন অলরেডি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ওই প্রথম ফাইনআর্টস ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে জানলাম, কারণ চারুকলায় শিক্ষা তো আগে এত বিস্তৃত ছিলনা। আমি বলছি সেই ১৯৭৮ এর কথা। ভাইবোনেরা আমাকে ফ্রন্টে ছেড়ে দিয়েছে যে তুমিই পারবা। প্রথমে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, তখন ভাই ওখানে পড়ে। সে বলছে তুমি এখানে পড়, ল তে পড়। আমার মেজো বোন বলছে না তুমি চিটাগং ইউনিভার্সিটি তে পড়, ফাইন আর্টসে পড়। আমাদের পরিবারের জন্য তখন ফাইন আর্টস নতুন একটা বিষয়। কিন্তু আমি আমার বড় ভাইকে দেখেছি গ্রাফ করে চাইনিজ ইংক দিয়ে হলিউডের নায়ক-নায়িকাদের পোর্ট্রেট আঁকতে, তখন সে ক্যাডেট কলেজে পড়ত। দেখে আমারও শখ হলো ভাইয়ের মত আঁকতে, চেষ্টা করলাম এবং দেখলাম এজ ইট ইজ আমিও পোর্ট্রেট আঁকছি। তো সেসব দেখে মেজো বোন বলল তুমিও তো ভালো ছবি আঁক, তুমি ফাইন আর্টসে ভর্তি হও।
যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে পড়বো, ঢাকায় গেলে পরিবার ছেড়ে হঠাৎ করে একা একা থাকতে হবে, তাই আমি ভাবলাম চিটাগং গেলে বোন আছে তাই চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
তখন আমার বাবা মাসে খরচ পাঠাত ৫০০ টাকা করে দুইবোনের জন্য। মেজদিদি কি সুন্দর দেখতাম ঐ টাকা দিয়ে মাস চালাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, সিনেমা দেখছে, রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে, কিন্তু আমার তো হচ্ছেনা। আমার রঙ কিনতে হচ্ছে, কাগজ কিনতে হচ্ছে (এক রাশ হাসি নিয়ে) আমার আর দিদি র মত ঘোরাঘুরির নেশা, নতুন জামা কেনা, সিনেমা দেখা, সব চলে গেলো। ম্যাটেরিয়াল কিনতেই সব টাকা শেষ।
তখন আমার মেজো বোন বলল – “কি পড়িস, এই তুই কি করিস, আমি একটা খাতা কিনছি তা দিয়ে আমার অর্নাস শেষ হয়ে যাবে তাও খাতা শেষ হবেনা, আর তুই প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস কিনিস” (আবারও হাসিমুখ)।
আস্তে আস্তে ভালো লাগা তৈরী হলো, বুঝলাম আমি ফাইন আর্টসের ছাত্রী, আমি সবার থেকে আলাদা।

প্রশ্নঃ আপনার ছাত্রী হবার সুবাদে, অনেক গল্পের মাঝে জানি যে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেবী সুলতানা বেশ দুরন্তই ছিল, মজার ঘটনা যদি একটু বলতেন।
ম্যামঃ (একটু যেন লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলেন) মজার ঘটনা বলতে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্যাম্পাসের প্রতিটা মূহুর্তই শেখার এবং জানার। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রাজনীতি নেই, তোমরা অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওনি, দেখনি হয়ত, কিন্তু আমাদের সেই সময়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছুর মোকাবেলা আমরা করেছি। আর দুর্দান্ত বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সময়টা আমি যে কোনো অবস্থায় ইনজয় করেছে, যেমন ধরো খেলার মাঠে গিয়ে চিয়ার আপ করেছি, র‍্যাগ ডে তে রাস্তায় র‍্যালি করেছি, রাতে ফাংশন দেখতে গেছি, মিছিলে স্লোগান দিয়েছি, চাকসু ইলেকশনে পোস্টার এঁকেছি, রাতে পোস্টার লাগিয়েছি। এইগুলো করেছি।
জিয়াউর রহমানের হত্যার পর সকালে আমাদের সব হল ত্যাগ করতে বলা হলো, তখন হল ত্যাগ করা মুখের কথা ছিল না, বাড়ি থেকে আমাদের মেয়েদের কেউ না কেউ নিতে আসত, আর আমাদের হলে আমি একা খুলনার মেয়ে ছিলাম, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনার মত ছিল না যে হুট করে খবর পাঠানো যাবে। অনেক চেষ্টার পরও যখন হল ছাড়তে বাধ্য করা হল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস দিল, যে বাসে করে স্টেশনে যাবে। অবশেষে ৩-৪ টা মেয়ে আর আমি, ওরাও অনেক দূরের, বরিশাল ও ভোলার, আমরা লাস্ট বাসে গেলাম। স্টেশনে যেতেই দেখি ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে প্লাটফর্ম, আমরা সব হাতে লাগেজ নিয়ে দৌড়াচ্ছি কিন্তু ট্রেনের পা-দানি তো অনেক উচু, তো আমরা উঠতে পারছিনা কিছুতেই, আর ট্রেনে কোথাও জায়গা নেই এত ভীড়, সবাই ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। একটা ছেলে জুনিয়র আমাকে বলছে- বেবি আপা হাত দেন, কিন্তু এত উচু তো উঠতে পারছিনা, পরে দুজন ছেলে ট্রেন থেকে নেমে আমাকে বলছে আপা উঠিয়ে দিব? আমি খেপে গিয়ে বললাম এটা জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি? ট্রেন ছেড়ে দিছে উঠিয়ে দিবা না তো কি? পরে ওরা আমাদের বস্তার মত ঠেলা দিয়ে ট্রেনের মধ্যে উঠিয়ে দিল। ধড়াম ধড়াম করে পড়লাম এক একজন, সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল। তারপর এক বান্ধবীর বাড়িতে গেলাম সেখান থেকে, বড়বোনের বাসায় গেলাম ঢাকা, তখন আমার বাবা ফরিদপুর ছিল, প্রথমবার একা একা বাড়ি এসে বাবাকে দেখে কেঁদে দিয়ে বললাম করার কিছু ছিল না, তাই আমি একা একা চলে এসছি। তারপর একা অনেকবার যাওয়া আসা করেছি, সাহস হয়ে গেল (আবারও একরাশ হাসি)।

প্রশ্নঃ শিক্ষকতা জীবনের শুরু কেমন ছিল?
ম্যামঃ বাবা রিটায়ার্ড করে খুলনা আসলেন, যেহেতু আমাদের বাড়ি খুলনাতে, আমি ‘৭২ এর পরে ‘৮২ তে আবার খুলনা আসি, এই গ্যাপে আমরা আর খুলনা আসিনি। খুলনা এসে তখনও আমার বিয়ে হয়নি, তো ভাবলাম বসে থাকব কেন, কিছু একটা করি। প্রথমে খুলনা আর্ট কলেজে আমি ইন্টারভিউ দিলাম, কলেজে আমার চাকরিটা হয়নি কারণ আমি অবিবাহিত, তাদের ধারণা হলো, আমার বিয়ে হলে সাথে সাথে অন্য কোথাও যদি চলে যাই, তাদের আবার নিয়োগ দিতে হবে, সে জন্য আমাকে নিলো না, পুরুষদের নেয়া হলো। তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হলো যে, চারুকলায় এই জন্য আমার চাকরিটা হলো না। তখন আবার আমি খুলনা পাবলিক কলেজ ইন্টারভিউ দিলাম। পরে ওরা আমাকে বলল জানাবে। মাঝে কিছুদিন একটা কিন্ডারগার্টেনে ক্লাস নিয়েছি এটা ভেবে যে বসে থাকব কেন। পরে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. রফিকুল আলম, উনি আমার আব্বাকে বললেন যে- আমরা আবার শিক্ষক নিচ্ছি, মেয়েকে এপ্লাই করতে বলেন। কিন্তু আমি বলছি- না, আমি আর যাবোনা। আব্বা বোঝালো যে যাও, তারা যখন ডাকছে। তারপর আমাকে সিলেক্ট করলেন। জয়েন করলাম, তখন আমাকে ৩২৫ টাকা বেতন দেবে মাত্র।
মাসখানেক পরে পাবলিক কলেজ থেকে আমাকে জয়েন লেটার পাঠাল, সেখানে আমাকে দিবে তিন হাজার টাকা বেতন।
এর মধ্যে কিন্তু আমার বিয়ে হয়ে গেছিল রাতারাতি, তো সেখান থেকে বলছিল গল্লামারি দূর হয়ে যায়, এতদূর থেকে যাওয়া আসা, পাবলিক কলেজ বাড়ির ধারে, তুমি এখানেই জয়েন কর।
তখন আমি খুব দোটানায় পড়ে গেলাম, এদিকে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারও আমাকে ছাড়তে নারাজ। আর আমার মধ্যে ফাইন আর্টসের প্রতি ভালোবাসা তো ভেতরে রয়েই গেছে, সেইজন্য মনটা তো মানছেনা। এখানে আমি শিল্পচর্চা করতে পারব, আর ওখানে বাচ্চাদের পড়াব, কিছুতেই মন মানছিল না। পরিবারের চাপকে উপেক্ষা করে, অনেক কথা অগ্রাহ্য করে আমি রয়ে গেলাম।

প্রশ্নঃ এরপর চারুকলার বিভিন্ন যুদ্ধে আপনার আবদান ছিল আমরা জানি, সেই গুলো নিয়ে যদি বলতেন।
ম্যামঃ চাকরিতে ঢুকেই আড়াই মাস পরে প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে বললেন উনার ঢাকা চারুকলায় জব হয়ে গেছে তো, উনি কাউকে দ্বায়িত্ব দিতে পারছেন না, আমাকে দ্বায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন। আমি নতুন চাকরিতে ঢুকেছি, অনেক কিছুই বুঝিনা, তার ওপর প্রিন্সিপালের দ্বায়িত্ব শুনেই আমি ভয় পাচ্ছি। তখন আমি আব্বার সাথে আলোচনা করলে সে আমাকে বলেন- “নাও মা, তোমাকে যখন দ্বায়িত্ব দিচ্ছে, ভয়ের কি আছে? সব হয়ে যাবে, ভয়ের কিছু নেই।”
আব্বার কথায় আমি দ্বায়িত্ব নিলাম। তার ওপর সব কলিগদের মধ্যে আমি একা মহিলা, অনেক কিছু সামাল দিয়েছি। আর্ট কলেজে ৮ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে, গল্লামারি থেকে বয়রা শিফট হওয়া, সেটা নিয়ে অনেক সমস্যা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান ফিরে পেতে প্রতিটা ভিসির সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে, একেকজন কে নতুন করে বুঝানো, নানান সমস্যার মোকাবেলা করে শেষে আমরা আবার নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসি, আমাদের প্রথম ক্যাম্পাসে।

প্রশ্নঃ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
ম্যামঃ আমি চাইনা আমার ছাত্ররা আমাকে ভয় পাক। আমি যদি সব সময় খড়গহস্তে কথা বলি, তুমি নিতে পারবেনা, আমি তোমার ভেতর থেকে সৃষ্টিশীল কিছু বের করব, তখন তুমি আমাকে ভয় পেলে চলবেনা। এইজন্য আমার নিজের পার্সোনাল লাইফ দিয়ে উপমা দিই, তখন সে আর ভয় পায়না, তার ভয় কেটে যায়। তখন সে আমাকে না বোঝা জিনিসটা জিজ্ঞেস করতে পারে। ভয় পেলে সে জিজ্ঞেস করার সাহস পাবেনা, তখন তার কাছে অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। আর যে পারেনা, তাকে কাছে টেনে নিয়ে এপ্রিশিয়েট করো, সে কিন্তু পারবে। আমি কিন্তু এখানে শেখাতে এসেছি, বোঝাতে এসেছি, এখন সবার তো ধারণক্ষমতা এক না, যার যেমন তাকে সেভাবে বুঝাতে হবে, একই স্কেলে বললে তো সবাই নিতে পারবে না। এইজন্য কথা গুলো আমার ইনফরমাল হয়ে যায়। আমি ক্লাসে গেলে আমার স্টুডেন্টরা রিলাক্সে কথা বলে, এটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি মাঝে মাঝে ক্লাসে বলি আমি বকা দিলে তোমরা কেন হাসো, এটা আমার একটা ট্রাজেডি (হাসতে হাসতে বললেন), এটাই আমার সাথে ওদের সম্পর্ক। সেদিন আমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছি, উঠে আসছি, তোমরা জানো আমি একা সিঁড়িতে উঠতে বা হাঁটতে কষ্ট হয়, দেখি ‘২৩ ব্যাচের দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে, আমি ওদের বললাম-কিছু বলবা? ওরা বলল- হ্যাঁ ম্যাম, আমরা একটু আপনাকে ধরে নিয়ে যাবো। ঐ যে সবাই আমাকে হাত ধরে ধরে নেয়, ওরা তো ফাস্ট ইয়ার সাহস পাচ্ছেনা। আমি বললাম, তোমাদের এত সাহস, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে তোমরা? এই শুকনা কাঠি আমাকে ধরে নিয়ে যাবা? (বলছেন আর হাসছেন), এই যে সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার কাছে আসে এটা আমি ওদের দিয়েছি। আমি নিজেকে ইউনিভার্সিটির টিচার হিসাবে গুটিয়ে রাখিনি। অনেকেই বলে আপনাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের ঘ্রাণ পাই, আমি তাদের আরো কাছে টেনে নেই।

প্রশ্নঃ মায়ের কথা যখন এলো, বেবী সুলতানার সংসার জীবন কেমন আর মা হিসাবে কেমন?
ম্যামঃ হা হা হা সেটা তো আমার ছেলে ভালো বলতে পারবে। লেখাপড়া শেষে বাবার চিন্তা এসে পড়ে মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। একদিন হঠাৎ একটা লোক বাড়িতে দেখতে এলো আমাকে। আমার আব্বা অনেক ব্রডমাইন্ডের লোক ছিলেন, আমাকে বললেন, মা এদিকে এসো বস। আমি বসলাম। তো দেখি লোকটা অনেক ভেবে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ফাইন আর্টস কি? ব্যস আর কিছু না। ভাবলো বোধহয় ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে, লজ্জাসংকোচ তো নাই, যা বলি উত্তর দেয় (হা হা হা)। দুদিন পর খরচাপাতি ছাড়া একরাতে বিয়ে হয়ে গেলো, সে চলে গেল তার বাড়ি, আমি আমার বাড়ি। কয়দিন পর সে আসলো। আব্বা কলেজ থেকে আমাকে বাড়িতে ডেকে আনল, আমি তো তখন ভয়ে কাচুমাচু, যেই মেয়ে এত কিছু চষে বেড়ানো, সে এইখানে এসে ধরা (হাহাহা)। বিয়ের পর দেখলাম ব্যাংকে চাকরি করা লোকটা খুব চিন্তামনা। তবে বিয়ের পর সংসার জীবনে আমি কখনও কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। আর্ট কলেজে ৮ বছর প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থায় সব ছেলে কলিগ ছিল, কিন্তু লোকটা কখনও কোন প্রশ্ন করেনি বা বাধা আমাকে দেয় নি। একজন অপোজিট চিন্তার মানুষ আমাকে বুঝতে পেরেছে৷ আর অফিস শেষ হলে আমি সংসারী একজন মানুষ। তবে এমনও দিন গেছে ভাত চুলায় দিয়ে কাজ করতে বসেছি, ভাত পুড়ে গেছে, সে কখনো কিছুই বলেনি। আমি কাজ করছি, সে খেয়ে নিচ্ছে, আমাকে কাজের মধ্যে ডাকেনি।
তারপর আমার ছেলে হলো, চাকরি করতাম সকালে, ছেলেকে তার নানা-নানীর কাছে রেখে আবার ফেরার পথে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। এভাবে ছেলে বড় করেছি। এখন আমার একটা নাতি আছে।

প্রশ্নঃ প্রতিদিন যে এত প্রশংসা পান ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, কেমন লাগে তখন?
ম্যামঃ খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন যে তোমরা বলো খুব সুন্দর লাগছে ম্যাম, কোনদিন খারাপ লাগে বলো? আজ সকালেই নিজে নিজে ভাবছিলাম এই যে আমাকে সবাই বলে ম্যাম খুব ভালো লাগছে আপনাকে, এটা কি সুযোগ পেয়ে বলে নাকি মন থেকেই বলে (হা হা হা)।

প্রশ্নঃ প্রতিদিন নিয়ম করে শাড়ি পরেন এখনও, এত অসুস্থ থাকার পরও হাঁটাচলা, কষ্ট হয় শাড়ি পরে, তবুও শাড়ি কেন?
ম্যামঃ চারুকলায় পড়ে তো আমি একটু সুন্দর জিনিস খুঁজি, তো সুন্দর পাত্রে সুন্দর করে খাবার রাখলেই তা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হবে। আমি কোন জায়গায় আছি, সেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে, আমি আলোচনায় যেতে চাইনা। সমালোচনা না করুক, আমি এভাবে আসি। আমাকে একদিন পলাশ বলছিল, ম্যাম আপনার রেডি হতে কত সময় লাগে? আমি বলি, আরে আমার রেডি হওয়া তো মুখস্থ, আমি মেল্ট করে কাজল পরি, যেটা আমার নিজের পরানো কাজল, লিপস্টিক আর শাড়ি, ব্যস, এইতো। এই যে আমার কানে রিং দেখছো, এটা আমার বাবা ক্লাস সিক্সে থাকতে আমাকে দিয়েছিল। এখনো আছে। আমি কিন্তু গয়নাগাটি পরি না, গোল্ডের প্রতি আমার কোন নেশা নেই। আমি জানি আমাকে এভাবেই মানুষ চিনে, কতজন কত কিছু গিফট করে, ওগুলো যত্ন করে রাখি, কিন্তু পরা হয়না। আমি এমনিই সাধারণ। আমি ইউনিভার্সিটিতেও এভাবেই ছিলাম, বয়স বেড়েছে, কিন্তু আমি তেমনই আছি, চেঞ্জ করতে পারিনি।

প্রশ্নঃ ম্যাম কখনো কি রাগ হয়না? রেগে গেলে কি করেন?
ম্যামঃ মানুষ তো রাগ হবেই, রেগে গেলে আমি কথাই বলতে পারিনা। চোখ থেকে পানি চলে আসে (হা হা হা)। খুব কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু বলতে পারিনা।

প্রশ্নঃ অবসরের পর কিভাবে জীবন কাটাবেন ভেবেছেন?
ম্যামঃ আমি ম্যাটেরিয়াল সব রেখে দিয়েছি অবসরের জন্য। রোল কাগজ কেনা আছে, প্লেট রেডি আছে, আমার এসিডের বক্স রেডি আছে, সবই আছে। আবার একটু লেখালেখি করি। আমার স্টুডেন্ট লাইফের অটোগ্রাফ ডায়েরিটা এখনো খুলে পড়ি, আমাকে কারা ঐ সময় কি লিখেছে। পুরোনো কোনো খাতা, বই, কাজের জিনিস আমি ফেলিনা। আর অবসরের জন্য আমার পুরো পরিবার মুখিয়ে আছে। আমার মেজো বোন বলছে, শ্রীমঙ্গল যাবো বোনরা মিলে। ওখানে দিদির রিসোর্ট আছে, কোনো হাসবেন্ড নেবো না, কোন ছেলেমেয়ে না, শুধু বোনরা।
আর আমার অনেক কিছুর ঝোক আসে, যখন লেখালেখি করছি শুধুই লিখছি, সেলাই করলে সেলাই করেই যাচ্ছি, এদিকে রঙ তুলি পড়ে আছে, কিন্তু খেয়াল নেই।

প্রশ্নঃ পিছন ফিরে তাকালে অতীতের কোনো ভুল কি শোধরাতে চান?
ম্যামঃ ভুল তো মানুষের অনেক রকম হয়, আমি শিক্ষকতা করছি, প্রয়োজনে অনেক সময় স্টুডেন্টদের সাথে একটু শক্ত আচরণ করতে হয়, কলিগদের সাথে মতের মিল নাও হতে পারে। এটা আমি কখনো ধরে রাখিনি। ধরে রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়না। সবাই তো এক মানসিকতার না। তাই ধরে না রাখাই ভালো।

প্রশ্নঃ ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কোন উপদেশ বা পরামর্শ দিতে চান?
ম্যামঃ আমি বলবো কি, স্টুডেন্ট, বন্ধু বা সহকর্মী যেই হোক, মানুষের সাথে পরিচয় হলো, এটাও একটা এচিভমেন্ট যে আমি নতুন কাউকে চিনলাম। মানুষকে চেনা, মানুষকে জানা সাময়িক যেন না হয়। মানুষ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ আছে। সবাই বুড়া হয়েছি কিন্তু বন্ধুত্বটা আছে। জীবনে বন্ধুত্ব অনেক বড় একটা সম্পদ। সেটাকে ধরে রাখতে হয়। একা জার্নি করলেও পাশের যাত্রী আপনা হয়ে যায়। এভাবেই সম্পর্ক হয়ে যায় যা ধরে রাখা খুব প্রয়োজন।
হতাশা কে জীবনে জায়গা দেয়া যাবেনা। এটা একটা সংক্রামক, একজনের থেকে অন্যজনের কাছে পাস হয়। হতাশাকে জায়গা দিতে নেই, খুব কঠিন রোগ। এটার মত ধ্বংস কোন অস্ত্র দিয়েও করা যায়না। হতাশাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তুমি একা। তোমাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করে দেবে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তুমি ভালো থাকবে। হাসি-খুশি থাকবা তুমি, ভালো থাকবা।

প্রশ্নঃ এই যে আপনাকে নিয়ে স্মরণিকা বের হবে, কেমন লাগছে?
ম্যামঃ ভয় লাগছে (হা হা হা)। কে আবার কোনটা কি লিখে বসে বাপ রে বাপ। অনুভূতি ভালো লাগা তো আছেই, আমার আত্মবিশ্বাস আছে যে কেউ আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু লিখবেনা (হাসতে হাসতে বললেন)।

প্রশ্নঃ অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। এতটা সময় দেয়ার জন্য। আপনার পথ চলা নিরবচ্ছিন্ন হোক সেই কামনা করি।
ম্যামঃ তোমাকেও ধন্যবাদ, এইভাবেই থেকো, সুন্দর থেকো। অনেক শুভকামনা তোমার জন্য।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

অবিবাহিত ছিলাম বলে চাকরিটা হয়নি: বেবী সুলতানা

Update Time : ০৬:৫৯:০৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৮ মার্চ ২০২৪

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টমেকিং ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক বেবী সুলতানা বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষ করতে চলেছেন। একান্ত সাক্ষাতকারে উঠে এসেছে তাঁর বর্নিল জীবনের গল্পগুলো। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্রইং এন্ড পেইন্টিং ডিসিপ্লিনের ১৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান তুনান।

প্রশ্নঃ কেমন আছেন ম্যাম?
ম্যামঃ আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। (একরাশ হাসিমাখা মুখে উত্তর)

প্রশ্নঃ এই যে কথা বলার শুরুতেই সদা হাস্যোজ্বল একটা মুখ আমরা দেখতে পাই, এই হাসির পেছনের রহস্য কি?
ম্যামঃ হাসির পেছনের রহস্যে আমার বাবার একটা দর্শন কাজ করে। তিনি আমাকে বলতেন যে “দুটো জিনিসে কৃপণতা করবেনা, একটা তোমার হাসি, আর একটা তোমার মিষ্টি করে কথা বলা, কারণ এর জন্য তো তোমার পয়সা খরচ হবেনা, এর বিনিময়ে কোন দেনা-পাওনা নাই, এটা তুমি যত বিলাবে তত তোমার সমৃদ্ধি হবে।” বাবার এই কথাটা আমি সবসময় মেনে চলি। যার সঙ্গে কথা বলি, হেসে কথা বলার চেষ্টা করি, তাকে আর কিছু দিতে না পারি সুন্দর সম্ভাষণটাতো দিতে পারি।

প্রশ্নঃ যদি একটু পেছনে ফিরে যাই, জানতে চাই কেমন ছিল বেবী সুলতানার ছেলেবেলা?
ম্যামঃ আমার বাবা পুলিশে ছিলেন, তার বদলীর সুবাদে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলাতে আমাদের ভাইবোনেদের ছেলেবেলা কেটেছে, আর আমাদের ছেলেবেলা ছিল প্রকৃতির সাথে। বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন সংস্কৃতি দেখেছি, বরিশালের ঐদিকটাতে আমাদের বেশিরভাগ থাকা হয়েছে। বরিশাল যেহেতু নদীর অঞ্চল, আমার মনে আছে আমাদের একটা নৌকা ছিল, আমরা নৌকায় করে ঘুড়ে বেড়িয়েছি। ছিপ দিয়ে মাছ ধরেছি, আবার যে মাছ ধরছে, তার পিছে পিছে দৌড়েছি। আমাদের খেলনা কিন্তু ঘরের বাহিরে ছিল, এখনকার মত ঘরে বসে খেলিনি। কৈশোরের দিনগুলোতে মাঠে খেলেছি, গাছে উঠে আম, কুল পেড়ে খাওয়া, এইগুলোই আমাদের ছেলেবেলা। আমরা প্রকৃতিকে দেখেছি খুব কাছে থেকে। এখনকার ছেলেমেয়েদের তো সেই সুযোগটা নেই, তবে আমি মনে করি আমরা মাটির খুব কাছাকাছি বেড়ে উঠার কারণে আমাদের ভেতরে যেই ব্যাপারগুলো কাজ করে, এখনকার মানুষের হয়ত অতটা কাজ করেনা।
প্রশ্নঃ তাহলে কি কংক্রিটের এই শহরে ছেলেবেলাকে খুব মিস করেন?
ম্যামঃ হ্যাঁ খুব মিস করি। মনে হয় গ্রামের দিকে চলে যাই। গাছের একটা ফল পেড়ে খাই। যদিও আমি যাই আমার গ্রামের বাড়িতে।

প্রশ্নঃ ছেলেবেলায় কেমন ছিলেন, দুরন্ত নাকি শান্ত?
ম্যামঃ খুব একটা দুরন্ত ছিলাম না, আমার অনেকগুলো ভাই বোনের মধ্যে সবাই বলত আমি একটু চুপচাপ শান্ত, আবার একটু স্পেশাল। আমার একটু বই পড়ার নেশা ছিল। বাড়িতে ধীর স্থির কাজ গুলো আমাকে দিয়ে করাত সবাই। একটু সেলাইয়ের কাজ করতে দিত। আমার বড় বোন আমাকে বড় করেছেন, আমার মা সংসার নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন, কিন্তু আমার বড় বোন আমাদের সব ভাই বোনকে আগলে রাখতেন। পড়াশোনা সব কিছু তার দ্বায়িত্বে ছিল। কে কোথায় পড়বে সব তার দ্বায়িত্বে ছিল। আমার ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির দ্বায়িত্ব তার ছিল।

প্রশ্নঃ ইউনিভার্সিটির কথা যখন চলে এলো, জানতে চাই আপনার ছবি আঁকার শুরু সম্পর্কে।
ম্যামঃ ছবি আঁকার শুরু এই যে বললাম একটু চুপচাপ স্বভাবের ছিলাম, সেজন্য ধরো একটু ড্রইং করা, টেবিলক্লথের ফুল আঁকার এই কাজগুলো পরিবারের সবাই আমাকে বলত তুমি একটু করে দাও, আর আমারও ভালো লাগত। চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে যখন ভর্তি হই, তখন আমার মেজো বোন অলরেডি ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ওই প্রথম ফাইনআর্টস ডিপার্টমেন্ট সম্পর্কে জানলাম, কারণ চারুকলায় শিক্ষা তো আগে এত বিস্তৃত ছিলনা। আমি বলছি সেই ১৯৭৮ এর কথা। ভাইবোনেরা আমাকে ফ্রন্টে ছেড়ে দিয়েছে যে তুমিই পারবা। প্রথমে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম, তখন ভাই ওখানে পড়ে। সে বলছে তুমি এখানে পড়, ল তে পড়। আমার মেজো বোন বলছে না তুমি চিটাগং ইউনিভার্সিটি তে পড়, ফাইন আর্টসে পড়। আমাদের পরিবারের জন্য তখন ফাইন আর্টস নতুন একটা বিষয়। কিন্তু আমি আমার বড় ভাইকে দেখেছি গ্রাফ করে চাইনিজ ইংক দিয়ে হলিউডের নায়ক-নায়িকাদের পোর্ট্রেট আঁকতে, তখন সে ক্যাডেট কলেজে পড়ত। দেখে আমারও শখ হলো ভাইয়ের মত আঁকতে, চেষ্টা করলাম এবং দেখলাম এজ ইট ইজ আমিও পোর্ট্রেট আঁকছি। তো সেসব দেখে মেজো বোন বলল তুমিও তো ভালো ছবি আঁক, তুমি ফাইন আর্টসে ভর্তি হও।
যেহেতু ইউনিভার্সিটিতে পড়বো, ঢাকায় গেলে পরিবার ছেড়ে হঠাৎ করে একা একা থাকতে হবে, তাই আমি ভাবলাম চিটাগং গেলে বোন আছে তাই চিটাগং ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম।
তখন আমার বাবা মাসে খরচ পাঠাত ৫০০ টাকা করে দুইবোনের জন্য। মেজদিদি কি সুন্দর দেখতাম ঐ টাকা দিয়ে মাস চালাচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, সিনেমা দেখছে, রেস্টুরেন্টে খাচ্ছে, কিন্তু আমার তো হচ্ছেনা। আমার রঙ কিনতে হচ্ছে, কাগজ কিনতে হচ্ছে (এক রাশ হাসি নিয়ে) আমার আর দিদি র মত ঘোরাঘুরির নেশা, নতুন জামা কেনা, সিনেমা দেখা, সব চলে গেলো। ম্যাটেরিয়াল কিনতেই সব টাকা শেষ।
তখন আমার মেজো বোন বলল – “কি পড়িস, এই তুই কি করিস, আমি একটা খাতা কিনছি তা দিয়ে আমার অর্নাস শেষ হয়ে যাবে তাও খাতা শেষ হবেনা, আর তুই প্রতিদিন নতুন নতুন জিনিস কিনিস” (আবারও হাসিমুখ)।
আস্তে আস্তে ভালো লাগা তৈরী হলো, বুঝলাম আমি ফাইন আর্টসের ছাত্রী, আমি সবার থেকে আলাদা।

প্রশ্নঃ আপনার ছাত্রী হবার সুবাদে, অনেক গল্পের মাঝে জানি যে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বেবী সুলতানা বেশ দুরন্তই ছিল, মজার ঘটনা যদি একটু বলতেন।
ম্যামঃ (একটু যেন লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলেন) মজার ঘটনা বলতে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ক্যাম্পাসের প্রতিটা মূহুর্তই শেখার এবং জানার। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে তো রাজনীতি নেই, তোমরা অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হওনি, দেখনি হয়ত, কিন্তু আমাদের সেই সময়ে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কিছুর মোকাবেলা আমরা করেছি। আর দুর্দান্ত বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ সময়টা আমি যে কোনো অবস্থায় ইনজয় করেছে, যেমন ধরো খেলার মাঠে গিয়ে চিয়ার আপ করেছি, র‍্যাগ ডে তে রাস্তায় র‍্যালি করেছি, রাতে ফাংশন দেখতে গেছি, মিছিলে স্লোগান দিয়েছি, চাকসু ইলেকশনে পোস্টার এঁকেছি, রাতে পোস্টার লাগিয়েছি। এইগুলো করেছি।
জিয়াউর রহমানের হত্যার পর সকালে আমাদের সব হল ত্যাগ করতে বলা হলো, তখন হল ত্যাগ করা মুখের কথা ছিল না, বাড়ি থেকে আমাদের মেয়েদের কেউ না কেউ নিতে আসত, আর আমাদের হলে আমি একা খুলনার মেয়ে ছিলাম, তখন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনার মত ছিল না যে হুট করে খবর পাঠানো যাবে। অনেক চেষ্টার পরও যখন হল ছাড়তে বাধ্য করা হল, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাস দিল, যে বাসে করে স্টেশনে যাবে। অবশেষে ৩-৪ টা মেয়ে আর আমি, ওরাও অনেক দূরের, বরিশাল ও ভোলার, আমরা লাস্ট বাসে গেলাম। স্টেশনে যেতেই দেখি ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে প্লাটফর্ম, আমরা সব হাতে লাগেজ নিয়ে দৌড়াচ্ছি কিন্তু ট্রেনের পা-দানি তো অনেক উচু, তো আমরা উঠতে পারছিনা কিছুতেই, আর ট্রেনে কোথাও জায়গা নেই এত ভীড়, সবাই ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। একটা ছেলে জুনিয়র আমাকে বলছে- বেবি আপা হাত দেন, কিন্তু এত উচু তো উঠতে পারছিনা, পরে দুজন ছেলে ট্রেন থেকে নেমে আমাকে বলছে আপা উঠিয়ে দিব? আমি খেপে গিয়ে বললাম এটা জিজ্ঞেস করতে হয় নাকি? ট্রেন ছেড়ে দিছে উঠিয়ে দিবা না তো কি? পরে ওরা আমাদের বস্তার মত ঠেলা দিয়ে ট্রেনের মধ্যে উঠিয়ে দিল। ধড়াম ধড়াম করে পড়লাম এক একজন, সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল। তারপর এক বান্ধবীর বাড়িতে গেলাম সেখান থেকে, বড়বোনের বাসায় গেলাম ঢাকা, তখন আমার বাবা ফরিদপুর ছিল, প্রথমবার একা একা বাড়ি এসে বাবাকে দেখে কেঁদে দিয়ে বললাম করার কিছু ছিল না, তাই আমি একা একা চলে এসছি। তারপর একা অনেকবার যাওয়া আসা করেছি, সাহস হয়ে গেল (আবারও একরাশ হাসি)।

প্রশ্নঃ শিক্ষকতা জীবনের শুরু কেমন ছিল?
ম্যামঃ বাবা রিটায়ার্ড করে খুলনা আসলেন, যেহেতু আমাদের বাড়ি খুলনাতে, আমি ‘৭২ এর পরে ‘৮২ তে আবার খুলনা আসি, এই গ্যাপে আমরা আর খুলনা আসিনি। খুলনা এসে তখনও আমার বিয়ে হয়নি, তো ভাবলাম বসে থাকব কেন, কিছু একটা করি। প্রথমে খুলনা আর্ট কলেজে আমি ইন্টারভিউ দিলাম, কলেজে আমার চাকরিটা হয়নি কারণ আমি অবিবাহিত, তাদের ধারণা হলো, আমার বিয়ে হলে সাথে সাথে অন্য কোথাও যদি চলে যাই, তাদের আবার নিয়োগ দিতে হবে, সে জন্য আমাকে নিলো না, পুরুষদের নেয়া হলো। তখন আমার মনটা ভীষণ খারাপ হলো যে, চারুকলায় এই জন্য আমার চাকরিটা হলো না। তখন আবার আমি খুলনা পাবলিক কলেজ ইন্টারভিউ দিলাম। পরে ওরা আমাকে বলল জানাবে। মাঝে কিছুদিন একটা কিন্ডারগার্টেনে ক্লাস নিয়েছি এটা ভেবে যে বসে থাকব কেন। পরে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন ড. রফিকুল আলম, উনি আমার আব্বাকে বললেন যে- আমরা আবার শিক্ষক নিচ্ছি, মেয়েকে এপ্লাই করতে বলেন। কিন্তু আমি বলছি- না, আমি আর যাবোনা। আব্বা বোঝালো যে যাও, তারা যখন ডাকছে। তারপর আমাকে সিলেক্ট করলেন। জয়েন করলাম, তখন আমাকে ৩২৫ টাকা বেতন দেবে মাত্র।
মাসখানেক পরে পাবলিক কলেজ থেকে আমাকে জয়েন লেটার পাঠাল, সেখানে আমাকে দিবে তিন হাজার টাকা বেতন।
এর মধ্যে কিন্তু আমার বিয়ে হয়ে গেছিল রাতারাতি, তো সেখান থেকে বলছিল গল্লামারি দূর হয়ে যায়, এতদূর থেকে যাওয়া আসা, পাবলিক কলেজ বাড়ির ধারে, তুমি এখানেই জয়েন কর।
তখন আমি খুব দোটানায় পড়ে গেলাম, এদিকে আর্ট কলেজের প্রিন্সিপাল স্যারও আমাকে ছাড়তে নারাজ। আর আমার মধ্যে ফাইন আর্টসের প্রতি ভালোবাসা তো ভেতরে রয়েই গেছে, সেইজন্য মনটা তো মানছেনা। এখানে আমি শিল্পচর্চা করতে পারব, আর ওখানে বাচ্চাদের পড়াব, কিছুতেই মন মানছিল না। পরিবারের চাপকে উপেক্ষা করে, অনেক কথা অগ্রাহ্য করে আমি রয়ে গেলাম।

প্রশ্নঃ এরপর চারুকলার বিভিন্ন যুদ্ধে আপনার আবদান ছিল আমরা জানি, সেই গুলো নিয়ে যদি বলতেন।
ম্যামঃ চাকরিতে ঢুকেই আড়াই মাস পরে প্রিন্সিপাল আমাকে ডেকে বললেন উনার ঢাকা চারুকলায় জব হয়ে গেছে তো, উনি কাউকে দ্বায়িত্ব দিতে পারছেন না, আমাকে দ্বায়িত্ব দিতে চাচ্ছেন। আমি নতুন চাকরিতে ঢুকেছি, অনেক কিছুই বুঝিনা, তার ওপর প্রিন্সিপালের দ্বায়িত্ব শুনেই আমি ভয় পাচ্ছি। তখন আমি আব্বার সাথে আলোচনা করলে সে আমাকে বলেন- “নাও মা, তোমাকে যখন দ্বায়িত্ব দিচ্ছে, ভয়ের কি আছে? সব হয়ে যাবে, ভয়ের কিছু নেই।”
আব্বার কথায় আমি দ্বায়িত্ব নিলাম। তার ওপর সব কলিগদের মধ্যে আমি একা মহিলা, অনেক কিছু সামাল দিয়েছি। আর্ট কলেজে ৮ বছরে অনেক চড়াই-উতরাই পার করতে হয়েছে, গল্লামারি থেকে বয়রা শিফট হওয়া, সেটা নিয়ে অনেক সমস্যা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান ফিরে পেতে প্রতিটা ভিসির সাথে সাক্ষাৎ করতে হয়েছে, একেকজন কে নতুন করে বুঝানো, নানান সমস্যার মোকাবেলা করে শেষে আমরা আবার নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসি, আমাদের প্রথম ক্যাম্পাসে।

প্রশ্নঃ ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?
ম্যামঃ আমি চাইনা আমার ছাত্ররা আমাকে ভয় পাক। আমি যদি সব সময় খড়গহস্তে কথা বলি, তুমি নিতে পারবেনা, আমি তোমার ভেতর থেকে সৃষ্টিশীল কিছু বের করব, তখন তুমি আমাকে ভয় পেলে চলবেনা। এইজন্য আমার নিজের পার্সোনাল লাইফ দিয়ে উপমা দিই, তখন সে আর ভয় পায়না, তার ভয় কেটে যায়। তখন সে আমাকে না বোঝা জিনিসটা জিজ্ঞেস করতে পারে। ভয় পেলে সে জিজ্ঞেস করার সাহস পাবেনা, তখন তার কাছে অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। আর যে পারেনা, তাকে কাছে টেনে নিয়ে এপ্রিশিয়েট করো, সে কিন্তু পারবে। আমি কিন্তু এখানে শেখাতে এসেছি, বোঝাতে এসেছি, এখন সবার তো ধারণক্ষমতা এক না, যার যেমন তাকে সেভাবে বুঝাতে হবে, একই স্কেলে বললে তো সবাই নিতে পারবে না। এইজন্য কথা গুলো আমার ইনফরমাল হয়ে যায়। আমি ক্লাসে গেলে আমার স্টুডেন্টরা রিলাক্সে কথা বলে, এটা আমার খুব ভালো লাগে। আমি মাঝে মাঝে ক্লাসে বলি আমি বকা দিলে তোমরা কেন হাসো, এটা আমার একটা ট্রাজেডি (হাসতে হাসতে বললেন), এটাই আমার সাথে ওদের সম্পর্ক। সেদিন আমি ওখানে দাঁড়িয়ে আছি, উঠে আসছি, তোমরা জানো আমি একা সিঁড়িতে উঠতে বা হাঁটতে কষ্ট হয়, দেখি ‘২৩ ব্যাচের দুইটা মেয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে, আমি ওদের বললাম-কিছু বলবা? ওরা বলল- হ্যাঁ ম্যাম, আমরা একটু আপনাকে ধরে নিয়ে যাবো। ঐ যে সবাই আমাকে হাত ধরে ধরে নেয়, ওরা তো ফাস্ট ইয়ার সাহস পাচ্ছেনা। আমি বললাম, তোমাদের এত সাহস, আমাকে ধরে নিয়ে যাবে তোমরা? এই শুকনা কাঠি আমাকে ধরে নিয়ে যাবা? (বলছেন আর হাসছেন), এই যে সবাই আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার কাছে আসে এটা আমি ওদের দিয়েছি। আমি নিজেকে ইউনিভার্সিটির টিচার হিসাবে গুটিয়ে রাখিনি। অনেকেই বলে আপনাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের ঘ্রাণ পাই, আমি তাদের আরো কাছে টেনে নেই।

প্রশ্নঃ মায়ের কথা যখন এলো, বেবী সুলতানার সংসার জীবন কেমন আর মা হিসাবে কেমন?
ম্যামঃ হা হা হা সেটা তো আমার ছেলে ভালো বলতে পারবে। লেখাপড়া শেষে বাবার চিন্তা এসে পড়ে মেয়ে বিয়ে দিতে হবে। একদিন হঠাৎ একটা লোক বাড়িতে দেখতে এলো আমাকে। আমার আব্বা অনেক ব্রডমাইন্ডের লোক ছিলেন, আমাকে বললেন, মা এদিকে এসো বস। আমি বসলাম। তো দেখি লোকটা অনেক ভেবে আমাকে জিজ্ঞেস করল, ফাইন আর্টস কি? ব্যস আর কিছু না। ভাবলো বোধহয় ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া মেয়ে, লজ্জাসংকোচ তো নাই, যা বলি উত্তর দেয় (হা হা হা)। দুদিন পর খরচাপাতি ছাড়া একরাতে বিয়ে হয়ে গেলো, সে চলে গেল তার বাড়ি, আমি আমার বাড়ি। কয়দিন পর সে আসলো। আব্বা কলেজ থেকে আমাকে বাড়িতে ডেকে আনল, আমি তো তখন ভয়ে কাচুমাচু, যেই মেয়ে এত কিছু চষে বেড়ানো, সে এইখানে এসে ধরা (হাহাহা)। বিয়ের পর দেখলাম ব্যাংকে চাকরি করা লোকটা খুব চিন্তামনা। তবে বিয়ের পর সংসার জীবনে আমি কখনও কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। আর্ট কলেজে ৮ বছর প্রিন্সিপাল থাকা অবস্থায় সব ছেলে কলিগ ছিল, কিন্তু লোকটা কখনও কোন প্রশ্ন করেনি বা বাধা আমাকে দেয় নি। একজন অপোজিট চিন্তার মানুষ আমাকে বুঝতে পেরেছে৷ আর অফিস শেষ হলে আমি সংসারী একজন মানুষ। তবে এমনও দিন গেছে ভাত চুলায় দিয়ে কাজ করতে বসেছি, ভাত পুড়ে গেছে, সে কখনো কিছুই বলেনি। আমি কাজ করছি, সে খেয়ে নিচ্ছে, আমাকে কাজের মধ্যে ডাকেনি।
তারপর আমার ছেলে হলো, চাকরি করতাম সকালে, ছেলেকে তার নানা-নানীর কাছে রেখে আবার ফেরার পথে ছেলে নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। এভাবে ছেলে বড় করেছি। এখন আমার একটা নাতি আছে।

প্রশ্নঃ প্রতিদিন যে এত প্রশংসা পান ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, কেমন লাগে তখন?
ম্যামঃ খুব ভালো লাগে। প্রতিদিন যে তোমরা বলো খুব সুন্দর লাগছে ম্যাম, কোনদিন খারাপ লাগে বলো? আজ সকালেই নিজে নিজে ভাবছিলাম এই যে আমাকে সবাই বলে ম্যাম খুব ভালো লাগছে আপনাকে, এটা কি সুযোগ পেয়ে বলে নাকি মন থেকেই বলে (হা হা হা)।

প্রশ্নঃ প্রতিদিন নিয়ম করে শাড়ি পরেন এখনও, এত অসুস্থ থাকার পরও হাঁটাচলা, কষ্ট হয় শাড়ি পরে, তবুও শাড়ি কেন?
ম্যামঃ চারুকলায় পড়ে তো আমি একটু সুন্দর জিনিস খুঁজি, তো সুন্দর পাত্রে সুন্দর করে খাবার রাখলেই তা বেশি গ্রহণযোগ্যতা পায়। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপন করতে হবে। আমি কোন জায়গায় আছি, সেভাবে নিজেকে উপস্থাপন করতে হবে, আমি আলোচনায় যেতে চাইনা। সমালোচনা না করুক, আমি এভাবে আসি। আমাকে একদিন পলাশ বলছিল, ম্যাম আপনার রেডি হতে কত সময় লাগে? আমি বলি, আরে আমার রেডি হওয়া তো মুখস্থ, আমি মেল্ট করে কাজল পরি, যেটা আমার নিজের পরানো কাজল, লিপস্টিক আর শাড়ি, ব্যস, এইতো। এই যে আমার কানে রিং দেখছো, এটা আমার বাবা ক্লাস সিক্সে থাকতে আমাকে দিয়েছিল। এখনো আছে। আমি কিন্তু গয়নাগাটি পরি না, গোল্ডের প্রতি আমার কোন নেশা নেই। আমি জানি আমাকে এভাবেই মানুষ চিনে, কতজন কত কিছু গিফট করে, ওগুলো যত্ন করে রাখি, কিন্তু পরা হয়না। আমি এমনিই সাধারণ। আমি ইউনিভার্সিটিতেও এভাবেই ছিলাম, বয়স বেড়েছে, কিন্তু আমি তেমনই আছি, চেঞ্জ করতে পারিনি।

প্রশ্নঃ ম্যাম কখনো কি রাগ হয়না? রেগে গেলে কি করেন?
ম্যামঃ মানুষ তো রাগ হবেই, রেগে গেলে আমি কথাই বলতে পারিনা। চোখ থেকে পানি চলে আসে (হা হা হা)। খুব কষ্ট হয়, কিন্তু কিছু বলতে পারিনা।

প্রশ্নঃ অবসরের পর কিভাবে জীবন কাটাবেন ভেবেছেন?
ম্যামঃ আমি ম্যাটেরিয়াল সব রেখে দিয়েছি অবসরের জন্য। রোল কাগজ কেনা আছে, প্লেট রেডি আছে, আমার এসিডের বক্স রেডি আছে, সবই আছে। আবার একটু লেখালেখি করি। আমার স্টুডেন্ট লাইফের অটোগ্রাফ ডায়েরিটা এখনো খুলে পড়ি, আমাকে কারা ঐ সময় কি লিখেছে। পুরোনো কোনো খাতা, বই, কাজের জিনিস আমি ফেলিনা। আর অবসরের জন্য আমার পুরো পরিবার মুখিয়ে আছে। আমার মেজো বোন বলছে, শ্রীমঙ্গল যাবো বোনরা মিলে। ওখানে দিদির রিসোর্ট আছে, কোনো হাসবেন্ড নেবো না, কোন ছেলেমেয়ে না, শুধু বোনরা।
আর আমার অনেক কিছুর ঝোক আসে, যখন লেখালেখি করছি শুধুই লিখছি, সেলাই করলে সেলাই করেই যাচ্ছি, এদিকে রঙ তুলি পড়ে আছে, কিন্তু খেয়াল নেই।

প্রশ্নঃ পিছন ফিরে তাকালে অতীতের কোনো ভুল কি শোধরাতে চান?
ম্যামঃ ভুল তো মানুষের অনেক রকম হয়, আমি শিক্ষকতা করছি, প্রয়োজনে অনেক সময় স্টুডেন্টদের সাথে একটু শক্ত আচরণ করতে হয়, কলিগদের সাথে মতের মিল নাও হতে পারে। এটা আমি কখনো ধরে রাখিনি। ধরে রাখলে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়না। সবাই তো এক মানসিকতার না। তাই ধরে না রাখাই ভালো।

প্রশ্নঃ ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে কোন উপদেশ বা পরামর্শ দিতে চান?
ম্যামঃ আমি বলবো কি, স্টুডেন্ট, বন্ধু বা সহকর্মী যেই হোক, মানুষের সাথে পরিচয় হলো, এটাও একটা এচিভমেন্ট যে আমি নতুন কাউকে চিনলাম। মানুষকে চেনা, মানুষকে জানা সাময়িক যেন না হয়। মানুষ ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেনা। আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ আছে। সবাই বুড়া হয়েছি কিন্তু বন্ধুত্বটা আছে। জীবনে বন্ধুত্ব অনেক বড় একটা সম্পদ। সেটাকে ধরে রাখতে হয়। একা জার্নি করলেও পাশের যাত্রী আপনা হয়ে যায়। এভাবেই সম্পর্ক হয়ে যায় যা ধরে রাখা খুব প্রয়োজন।
হতাশা কে জীবনে জায়গা দেয়া যাবেনা। এটা একটা সংক্রামক, একজনের থেকে অন্যজনের কাছে পাস হয়। হতাশাকে জায়গা দিতে নেই, খুব কঠিন রোগ। এটার মত ধ্বংস কোন অস্ত্র দিয়েও করা যায়না। হতাশাকে নিয়ন্ত্রণ করবে, তুমি একা। তোমাকে কেউ নিয়ন্ত্রণ করে দেবে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তুমি ভালো থাকবে। হাসি-খুশি থাকবা তুমি, ভালো থাকবা।

প্রশ্নঃ এই যে আপনাকে নিয়ে স্মরণিকা বের হবে, কেমন লাগছে?
ম্যামঃ ভয় লাগছে (হা হা হা)। কে আবার কোনটা কি লিখে বসে বাপ রে বাপ। অনুভূতি ভালো লাগা তো আছেই, আমার আত্মবিশ্বাস আছে যে কেউ আমাকে নিয়ে খারাপ কিছু লিখবেনা (হাসতে হাসতে বললেন)।

প্রশ্নঃ অনেক ধন্যবাদ ম্যাম। এতটা সময় দেয়ার জন্য। আপনার পথ চলা নিরবচ্ছিন্ন হোক সেই কামনা করি।
ম্যামঃ তোমাকেও ধন্যবাদ, এইভাবেই থেকো, সুন্দর থেকো। অনেক শুভকামনা তোমার জন্য।