বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা

  • Update Time : ১০:৩৯:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী ২০২৩
  • / 193

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

দেশের আমদানি কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে, তৈরি হয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। আমদানিতে যে পরিমাণ খরচ করতে হচ্ছে তার চেয়ে রপ্তানি আয় অনেক কম। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার।

বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০২ টাকা হিসাবে)। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ১ হাজার কোটি ১৭৯ লাখ (১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বর মাস শেষে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩৬৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে, সেবা খাতে দেশের খরচ হয়েছে ৫৩৯ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭৩ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৩৬ কোটি ডলার।

ব্যাংকারদের মতে, চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স এখন ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ৬২২ কোটি ডলার।

সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভার অল ব্যাল্যান্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। নভেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার। সূচকটিতে আগের অর্থবছরের একই সময় ২০২ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বরে ১৮৫ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ১৯৭ কোটি ডলারে উঠেছে।

দেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও বেড়ে ৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৮৭ কোটি ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে আমদানি খরচ বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরজুড়ে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষপর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অফ পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।

এবার আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানিতে প্রবৃদ্ধির চেয়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে অনেক কম, ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৫ শতাংশের মতো।

গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সে এই পাঁচ মাসে ২১ শতাংশের মতো নেগেটিভ (ঋণাত্মক) প্রবৃদ্ধি হলেও এবার ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।

গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমদানিতে এখনও যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে যদি ভালো প্রবৃদ্ধি না হয়, তাহলে এবারও ব্যালান্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে।’

বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা

Update Time : ১০:৩৯:১৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জানুয়ারী ২০২৩

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

দেশের আমদানি কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে, তৈরি হয়েছে বাণিজ্য ঘাটতি। আমদানিতে যে পরিমাণ খরচ করতে হচ্ছে তার চেয়ে রপ্তানি আয় অনেক কম। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১৭৯ কোটি ডলার।

বাংলাদেশী মুদ্রায় যার পরিমাণ ১ লাখ ২০ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০২ টাকা হিসাবে)। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাবের ভারসাম্য (ব্যাল্যান্স অব পেমেন্ট) হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। এতে ১ হাজার কোটি ১৭৯ লাখ (১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি, বিশ্ববাজারে জ্বালানিসহ সব ধরনের পণ্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী ও আশানুরূপ রেমিট্যান্স প্রবাহ না থাকায় বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়ছে বাংলাদেশ।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নভেম্বর মাস শেষে সেবা খাতে বাংলাদেশ আয় করেছে ৩৬৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে, সেবা খাতে দেশের খরচ হয়েছে ৫৩৯ কোটি ডলার। সেবা খাতের ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ১৭৩ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঘাটতি ছিল ১৩৬ কোটি ডলার।

ব্যাংকারদের মতে, চলতি হিসাব বা কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সে উদ্বৃত্ত থাকা ভালো। চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকার অর্থ হলো নিয়মিত লেনদেনে দেশকে কোনো ঋণ করতে হচ্ছে না। আর ঘাটতি থাকলে সরকারকে ঋণ নিয়ে তা পূরণ করতে হয়। সেই হিসাবে উন্নয়নশীল দেশের চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাংলাদেশের কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালান্স এখন ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের নভেম্বর শেষে এ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৬৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরে একই সময়ে এ ঘাটতি ছিল ৬২২ কোটি ডলার।

সামগ্রিক লেনদেনেও (ওভার অল ব্যাল্যান্স) বড় ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। নভেম্বর শেষে সামগ্রিক লেনদেনের (ঋণাত্মক) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩৮ কোটি ডলার। সূচকটিতে আগের অর্থবছরের একই সময় ২০২ কোটি ডলার ঘাটতি ছিল।

দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-নভেম্বরে ১৮৫ কোটি ডলারের এফডিআই পেয়েছিল বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তা বেড়ে ১৯৭ কোটি ডলারে উঠেছে।

দেশের বিভিন্ন খাতে সরাসরি মোট যে বিদেশি বিনিয়োগ আসে, তা থেকে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান মুনাফার অর্থ নিয়ে যাওয়ার পর যা অবশিষ্ট থাকে, সেটাকে নিট এফডিআই বলা হয়। আলোচিত সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগও বেড়ে ৯০ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। গত অর্থবছর একই সময়ে নিট বিদেশি বিনিয়োগ ছিল ৮৭ কোটি ডলার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, গত বছরের আগস্ট মাস থেকে আমদানি খরচ বাড়তে শুরু করে। পুরো অর্থবছরজুড়ে সেই উল্লম্ফন দেখা যায়। শেষপর্যন্ত ৩৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে অর্থবছর শেষ হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। কিন্তু আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছিল ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ। সে কারণেই ব্যালান্স অফ পেমেন্টের ঘাটতি চূড়ায় উঠেছিল।

এবার আমদানি ব্যয়ে ধীরগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) আমদানিতে প্রবৃদ্ধির চেয়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেশি হয়েছে। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরের চেয়ে অনেক কম, ১১ দশমিক ৭৫ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৩৫ শতাংশের মতো।

গত অর্থবছরে রেমিট্যান্সে এই পাঁচ মাসে ২১ শতাংশের মতো নেগেটিভ (ঋণাত্মক) প্রবৃদ্ধি হলেও এবার ২ দশমিক ১৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সব মিলিয়ে লেনদেন ভারসাম্যে ৫ দশমিক ৬৭ বিলিয়ন ডলারের বড় ঘাটতির মুখে পড়েছে বাংলাদেশ।

গত অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে পাহাড়সম ঘাটতি দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছিল মন্তব্য করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘আমদানিতে এখনও যে গতি রয়েছে, সেটা যদি অব্যাহত থাকে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সে যদি ভালো প্রবৃদ্ধি না হয়, তাহলে এবারও ব্যালান্স অব পেমেন্টে বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ হবে।’

বেশ কয়েক বছর পর ২০২০-২১ অর্থবছরে লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতিতে পড়ে বাংলাদেশ। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি নিয়ে শেষ হয়েছিল ওই বছর। তার আগে ৯ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলারের বড় উদ্বৃত্ত নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উদ্বৃত্ত ছিল ৩ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার।