ভারতের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ভোগাচ্ছে অন্যদের

  • Update Time : ০৪:৩৩:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৩
  • / 133

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রাশিয়া গত মাসে কৃষ্ণসাগর চুক্তি প্রত্যাহার করার তিনদিন পর বাসমতি ছাড়া সব চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভাঙ্গা চাল রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো দেশটি, যা এখনও বহাল রয়েছে।

ভারতের এ নিষেধাজ্ঞার কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ- খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং এল নিনোর কারণে চালের ঘাটতির আশঙ্কা ছিল এর মূলে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখন বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে।

ভারতের অন্যতম বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক ওলাম এগ্রি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নীতিন গুপ্তা বলেছেন, আগে প্রতি মেট্রিক টন চালের দাম ৫৫০ ডলার হলেও, ইতোমধ্যে তা ৬৫০ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বব্যাপী চালের বাজারে ভারতের ভূমিকা এবং দেশটির আসন্ন নির্বাচন, জলবায়ু পরিবর্তন ও এল নিনো চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক ভারত

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চাল রপ্তানি করা দেশ ভারত ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চাল বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল। সেবছর দেশটি ১৪০টি দেশে ৯৬৬ কোটি ডলার মূল্যের দুই দশমিক দুই কোটি টন চাল রপ্তানি করে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লাখ টন বাসমতি চাল, ৪০ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৬০ লাখ টন নন-বাসমতি সাদা চাল এবং ৩৫ লাখ টন ভাঙ্গা চাল।

ভারত তার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অর্ধেক পূরণ করে সিদ্ধ এবং বাসমতি চাল রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে, তবে নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বিশ্বব্যাপী চালের দাম ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং নেপালের মতো দেশের দরিদ্র জনগণ, যারা ভারতীয় সাদা চালের উপর নির্ভর করে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেনিন, সেনেগাল, টোগো এবং মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলো, যারা সবচেয়ে সস্তা ভাঙ্গা চাল আমদানি করে।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে শস্যের দাম ইতোমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। রাশিয়া ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে দাম আরও বেড়েছে, যা ইউক্রেন থেকে শস্য বিশ্ব বাজারে পৌঁছানোর অনুমতি দিতো।

আর এখন, ভারতের চাল নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তানের ফসল এল নিনোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনুরূপ নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা রয়েছে। এই দেশগুলো একসাথে বিশ্বব্যাপী চাল বিক্রির ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী।

ব্যবসায়ী এবং বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য উপাদান চালের ঘাটতি গম, সয়াবিন, ভুট্টা এবং যবের ওপরও প্রভাব ফেলবে, যা মানুষ এবং পশুর খাদ্য উভয় ক্ষেত্রেই চালের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি শুধুমাত্র অন্যান্য খাদ্য আইটেম নয়, জ্বালানির চাহিদা এবং দামের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারত কেনো চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে?

অর্ধেকেরও বেশি ভারতীয় জনসংখ্যার জন্য ভাত একটি প্রধান খাদ্য। দেশটি বছরে প্রায় ১৪ কোটি টন চাল উত্পাদন করে, যা প্রায় ১১ কোটি টনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে দেশের ৮০ কোটি দরিদ্র মানুষের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা চাল।

ইন্টারন্যাশনাল পট্যাটো সেন্টারের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইআরআরআই) সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী সমরেন্দু মোহান্তি বলেন, আমাদের বাফার স্টক লেভেল খুব, খুব আরামদায়ক। আমাদের সরকারি গুদামে প্রায় চার কোটি টন চাল রয়েছে। আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ দাম, অন্যান্য সমস্ত খাদ্যের দামের সাথে বেড়েই চলেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী দাম বেড়ে যাওয়ায়, গত বছরে ভারতে চালের দাম ১০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ দাম কমাতে এবং এল নিনোর কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কায় সর্বশেষ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি ও শস্যের ঘাটতি উন্নত বিশ্বের বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে না, যেখানে ৮০ শতাংশই বাসমতি চাল গ্রহণ করেন। তবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার পাশাপাশি কিছু পশ্চিম আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশে এর প্রভাব উদ্বেগজনক।

নেপাল, বাংলাদেশ এবং বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে, যেখানে খাদ্য বাজেটের অর্ধেকই চালের পেছনে ব্যয় করা হয়, এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে।

ভিয়েতনামে চালের দাম গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং নেপালে চালের দাম ভারত নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর থেকে ১৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানা গেছে।

চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাল আমদানিকারক ফিলিপাইন টাইফুনসহ চরম দুর্যোগে ভুগছে। নেপাল এবং ফিলিপাইন উভয়ই বলেছে, তারা ভারত সরকারকে চাল চালানের অনুমতি দিতে বলবে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


ভারতের চাল রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা ভোগাচ্ছে অন্যদের

Update Time : ০৪:৩৩:৩২ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৬ অগাস্ট ২০২৩

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রাশিয়া গত মাসে কৃষ্ণসাগর চুক্তি প্রত্যাহার করার তিনদিন পর বাসমতি ছাড়া সব চাল রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ভারত। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভাঙ্গা চাল রপ্তানির ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো দেশটি, যা এখনও বহাল রয়েছে।

ভারতের এ নিষেধাজ্ঞার কারণ ছিল অভ্যন্তরীণ- খাদ্যের দাম বৃদ্ধি, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং এল নিনোর কারণে চালের ঘাটতির আশঙ্কা ছিল এর মূলে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার প্রভাব এখন বিশ্বব্যাপী অনুভূত হচ্ছে।

ভারতের অন্যতম বৃহত্তম চাল রপ্তানিকারক ওলাম এগ্রি ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেডের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট নীতিন গুপ্তা বলেছেন, আগে প্রতি মেট্রিক টন চালের দাম ৫৫০ ডলার হলেও, ইতোমধ্যে তা ৬৫০ ডলারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বব্যাপী চালের বাজারে ভারতের ভূমিকা এবং দেশটির আসন্ন নির্বাচন, জলবায়ু পরিবর্তন ও এল নিনো চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রপ্তানিকারক ভারত

পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চাল রপ্তানি করা দেশ ভারত ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী চাল বাণিজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশের জন্য দায়ী ছিল। সেবছর দেশটি ১৪০টি দেশে ৯৬৬ কোটি ডলার মূল্যের দুই দশমিক দুই কোটি টন চাল রপ্তানি করে। এর মধ্যে রয়েছে ৪৫ লাখ টন বাসমতি চাল, ৪০ লাখ টন সিদ্ধ চাল, ৬০ লাখ টন নন-বাসমতি সাদা চাল এবং ৩৫ লাখ টন ভাঙ্গা চাল।

ভারত তার আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি অর্ধেক পূরণ করে সিদ্ধ এবং বাসমতি চাল রপ্তানি অব্যাহত রেখেছে, তবে নিষেধাজ্ঞার পর থেকে বিশ্বব্যাপী চালের দাম ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেড়েছে। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ এবং নেপালের মতো দেশের দরিদ্র জনগণ, যারা ভারতীয় সাদা চালের উপর নির্ভর করে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেনিন, সেনেগাল, টোগো এবং মালির মতো আফ্রিকান দেশগুলো, যারা সবচেয়ে সস্তা ভাঙ্গা চাল আমদানি করে।

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে শস্যের দাম ইতোমধ্যে অনেক বেড়ে গেছে। রাশিয়া ব্ল্যাক সি গ্রেইন ইনিশিয়েটিভ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে দাম আরও বেড়েছে, যা ইউক্রেন থেকে শস্য বিশ্ব বাজারে পৌঁছানোর অনুমতি দিতো।

আর এখন, ভারতের চাল নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম এবং পাকিস্তানের ফসল এল নিনোর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনুরূপ নিষেধাজ্ঞার আশঙ্কা রয়েছে। এই দেশগুলো একসাথে বিশ্বব্যাপী চাল বিক্রির ৩০ শতাংশের জন্য দায়ী।

ব্যবসায়ী এবং বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি জনসংখ্যার প্রধান খাদ্য উপাদান চালের ঘাটতি গম, সয়াবিন, ভুট্টা এবং যবের ওপরও প্রভাব ফেলবে, যা মানুষ এবং পশুর খাদ্য উভয় ক্ষেত্রেই চালের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এটি শুধুমাত্র অন্যান্য খাদ্য আইটেম নয়, জ্বালানির চাহিদা এবং দামের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

ভারত কেনো চাল রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে?

অর্ধেকেরও বেশি ভারতীয় জনসংখ্যার জন্য ভাত একটি প্রধান খাদ্য। দেশটি বছরে প্রায় ১৪ কোটি টন চাল উত্পাদন করে, যা প্রায় ১১ কোটি টনের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট। এর মধ্যে রয়েছে দেশের ৮০ কোটি দরিদ্র মানুষের মধ্যে ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা চাল।

ইন্টারন্যাশনাল পট্যাটো সেন্টারের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইআরআরআই) সাবেক প্রধান বিজ্ঞানী সমরেন্দু মোহান্তি বলেন, আমাদের বাফার স্টক লেভেল খুব, খুব আরামদায়ক। আমাদের সরকারি গুদামে প্রায় চার কোটি টন চাল রয়েছে। আমাদের কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু আমাদের অভ্যন্তরীণ দাম, অন্যান্য সমস্ত খাদ্যের দামের সাথে বেড়েই চলেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী দাম বেড়ে যাওয়ায়, গত বছরে ভারতে চালের দাম ১০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। অভ্যন্তরীণ দাম কমাতে এবং এল নিনোর কারণে উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কায় সর্বশেষ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মূল্যবৃদ্ধি ও শস্যের ঘাটতি উন্নত বিশ্বের বাজারে সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে না, যেখানে ৮০ শতাংশই বাসমতি চাল গ্রহণ করেন। তবে মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার পাশাপাশি কিছু পশ্চিম আফ্রিকান এবং এশিয়ান দেশে এর প্রভাব উদ্বেগজনক।

নেপাল, বাংলাদেশ এবং বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেশে, যেখানে খাদ্য বাজেটের অর্ধেকই চালের পেছনে ব্যয় করা হয়, এ নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে শুরু করেছে।

ভিয়েতনামে চালের দাম গত ১৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং নেপালে চালের দাম ভারত নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করার পর থেকে ১৬ শতাংশ বেড়েছে বলে জানা গেছে।

চীনের পরে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চাল আমদানিকারক ফিলিপাইন টাইফুনসহ চরম দুর্যোগে ভুগছে। নেপাল এবং ফিলিপাইন উভয়ই বলেছে, তারা ভারত সরকারকে চাল চালানের অনুমতি দিতে বলবে।