হংকং শহরে জীবিতদের চেয়ে দামি ঘরে মৃতরা

  • Update Time : ০৭:১৯:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ জুলাই ২০২৩
  • / 116

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

হংকং শহরে জীবিতদের চেয়ে দামি ঘরে মৃতরা
জন্মালে মরতে হবে। পৃথিবীর সব মানুষ ও প্রাণের জন্য এটা বড় সত্য। মৃত্যুর পর মানুষ চিরঘুমে থাকেন। তবে এজন্য দরকার হয় একটি নির্দিষ্ট স্থানের, যাকে গোরস্তান বা কবরস্থান বলেই চেনে সবাই। তবে কিছু কিছু ধর্ম ও প্রথায় মৃত্যুর পর মানুষের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়।

এই পৃথিবীতে এখন জনসংখ্যা আটশ’ কোটির উপরে। এরমধ্যে প্রতিদিন যেমন জন্ম হচ্ছে লাখো শিশুর, তেমনি মৃত্যু হচ্ছে লাখো মানুষেরও। মৃতের জন্য দরকার বিশ্রামঘর। কিন্তু দিনকে দিন সংকুচিত হয়ে আসছে মানুষের আবাসস্থল। ফলে মৃতদের সমাহিত করারও জায়গা কমছে।

এ কারণে বিশ্বের সব দেশেই সমাধিস্থল বা কবরস্থানের দাম বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে মহামূল্যবান সব বিকল্প উপায়ও। বিশ্বের সবচেয়ে দামি কবরস্থান এখন হংকংয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে খরচের শহর হিসাবে যাদের পরিচয়, তাদের অন্যতম এই শহরেই তৈরি হয়েছে ব্যয়বহুল সমাধিস্থল।

একজন মৃতের চির ঘুমের জন্য প্রয়োজন হয় সাড়ে তিন হাতের মতো জায়গা। কিন্তু হংকংয়ের বেশিরভাড় মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি হওয়ায় মৃত্যুর পর তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর দাহ করা সেই ছাই অনেকের সংরক্ষণ করতে চান বিশেষ জায়গায় রেখে দিয়ে।

দাহের পরে দেহাবশেষ রাখতে হংকংয়ে তৈরি হয়েছে মহামূল্যবান এক দালান। এই দালানে জুতো বক্সের চেয়ে ছোট্ট একটি কুঠরিতে রাখা যাবে যে কারো দেহাবশেষ। তবে এজন্য গুণতে হবে বহু অর্থ। ওইটুকু জায়গার দাম শুরু হয়েছে ৫৩ হাজার ডলার থেকে ক্রমেই উপরের দিকে।

এত দামি জায়গায় কোনো জীবিত ব্যক্তি নন, থাকবেন মৃতরা। তাই হংকংয়ের ১২ তলা শান সাম টাওয়ারের সাদা মার্বেলের ঘরগুলোর লক্ষ্য গড়পরতা ক্রেতারা নন। যেসব গ্রাহকরা মৃত্যুর পরও পরকালে বেশি কিছু চাইছেন, তাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই মৃতের ঠিকানা।

ঢেউ খেলানো নকশার কলম্বারিয়াম স্টাইলের দালানে ২৩ হাজার মানুষের দেহাবশেষ রাখা যাবে। একক ইউনিট ছাড়াও থাকছে আরো সুবিধা। দুই ইউনিটে খরচ হবে ৭৬ হাজার ডলার। আর আটজনের দেহাবশেষ রাখা যায়, এখন পারিবারিক ইউনিটে খরচ চার লাখ ৩০ হাজার ডলার।

প্রায় এক ঘনবর্গফুট হিসেবে এই চেম্বারগুলোর দাম শহরের অন্যান্য থাকার জায়গার চেয়ে বেশি। যেমন, অভিজাত দ্য পিকের একটি আবাসনে গত মার্চে বর্গফুট প্রতি দাম চাওয়া হয়েছিল ৩২ হাজার ডলার। সেখান শান সাম ভবনের প্রতি ঘনবর্গফুটের দাম শুরু ৫৩ হাজার ডলার থেকে।

তবে শেষ বিশ্রামের জন্য আরও ব্যয়বহুল স্থান আছে হংকংয়ে। ফ্যানলিংয়ে মন্দিরের মতো দেখতে একটি কমপ্লেক্সে কবর প্রতি খরচ ছয় লাখ ৬০ ডলার খরচ। আছে রক্ষণাবেক্ষণ ও সারচার্জ বাবদ ২৫ হাজার ডলার। যা প্রতি বছর গুণতে হবে মৃতের স্বজনদের।

তবে শান সামের মতো ব্যক্তিগত কলম্বারিয়ামগুলো অনন্ত বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছে না। সরকারি লাইসেন্সে বেধে দেয়া সময়ে পর্যন্ত ছাই সংরক্ষণ করবে। যার সীমা ১০ বছর। এরপর আবারও নতুন করে কিনতে হবে জায়গাম, না হয় সরিয়ে নিতে হবে দেহাবশেষ।

এই ভবনের নকশা করেছেন জার্মান স্থপতি উলরিচ কির্চহফ। পাহাড়ের ধারের ঐতিহ্যবাহী চীনা কবরস্থানের নকশা অনুসরণ করেছেন তিনি। পূর্বপুরুষদের বিশ্রামস্থলে বেড়াতে আসা পরিবারের জন্য থাকছে কিছু সেবা। তারা বাগান, ছাদ ও বারান্দায় সময় কাটাতে পারবেন।

ভবনটির প্রায় পঞ্চমাংশই খোলা জায়গা।শান শামের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী মার্গারেট জি। মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা চীনা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ- এ ধারণাকে মাথায় রেখে বিশ্রামাগারটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়ছেন তিনি। এরিমধ্যে ব্যাপক সাড়াও পেয়েছেন তিনি।

মার্গারেট বলেন, এটি মৃতদের বিশ্রামের স্থান নয়। যাদের কাছ থেকে চলে গেছেন তাদের শান্তি দেয়ার জন্যও তৈরি করা হয়েছে। ২০০৭ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সমাধিস্থ করতে বড় ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। বুঝতে পারেন, মৃতদের সম্মান জানানোর জন্য হংকংয়ে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই।

৭০ লাখেরও বেশি মানুষের বাসস্থান হংকং বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি। আয়তনের হিসেবে হংকং ছোট নয়, এক হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার। যা নিউইয়র্ক থেকে প্রায় এক দশমিক চার গুণ বড়। তবে পাহাড়ি গঠনের জন্য বেশিরভাগ জমি ব্যবহার করা যায় না।

গত এক দশকে হংকং শহরের মৃত্যুর হার প্রতি বছর প্রায় ৪৬ হাজার। এ কারণে শেষ বিশ্রামের স্থান নিয়ে প্রায়ই বিপত্তিতে ভুগতে হয়। আবার অভিবাসন ও কম জন্মহারের কারণে হংকংয়ের দ্রুত প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি পাঁচ বাসিন্দার একজনের বয়স ৬৫ এর বেশি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


হংকং শহরে জীবিতদের চেয়ে দামি ঘরে মৃতরা

Update Time : ০৭:১৯:৩৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৮ জুলাই ২০২৩

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

হংকং শহরে জীবিতদের চেয়ে দামি ঘরে মৃতরা
জন্মালে মরতে হবে। পৃথিবীর সব মানুষ ও প্রাণের জন্য এটা বড় সত্য। মৃত্যুর পর মানুষ চিরঘুমে থাকেন। তবে এজন্য দরকার হয় একটি নির্দিষ্ট স্থানের, যাকে গোরস্তান বা কবরস্থান বলেই চেনে সবাই। তবে কিছু কিছু ধর্ম ও প্রথায় মৃত্যুর পর মানুষের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়।

এই পৃথিবীতে এখন জনসংখ্যা আটশ’ কোটির উপরে। এরমধ্যে প্রতিদিন যেমন জন্ম হচ্ছে লাখো শিশুর, তেমনি মৃত্যু হচ্ছে লাখো মানুষেরও। মৃতের জন্য দরকার বিশ্রামঘর। কিন্তু দিনকে দিন সংকুচিত হয়ে আসছে মানুষের আবাসস্থল। ফলে মৃতদের সমাহিত করারও জায়গা কমছে।

এ কারণে বিশ্বের সব দেশেই সমাধিস্থল বা কবরস্থানের দাম বাড়ছে। তৈরি হচ্ছে মহামূল্যবান সব বিকল্প উপায়ও। বিশ্বের সবচেয়ে দামি কবরস্থান এখন হংকংয়ে। বিশ্বের সবচেয়ে খরচের শহর হিসাবে যাদের পরিচয়, তাদের অন্যতম এই শহরেই তৈরি হয়েছে ব্যয়বহুল সমাধিস্থল।

একজন মৃতের চির ঘুমের জন্য প্রয়োজন হয় সাড়ে তিন হাতের মতো জায়গা। কিন্তু হংকংয়ের বেশিরভাড় মানুষ বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারি হওয়ায় মৃত্যুর পর তাদের দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়। আর দাহ করা সেই ছাই অনেকের সংরক্ষণ করতে চান বিশেষ জায়গায় রেখে দিয়ে।

দাহের পরে দেহাবশেষ রাখতে হংকংয়ে তৈরি হয়েছে মহামূল্যবান এক দালান। এই দালানে জুতো বক্সের চেয়ে ছোট্ট একটি কুঠরিতে রাখা যাবে যে কারো দেহাবশেষ। তবে এজন্য গুণতে হবে বহু অর্থ। ওইটুকু জায়গার দাম শুরু হয়েছে ৫৩ হাজার ডলার থেকে ক্রমেই উপরের দিকে।

এত দামি জায়গায় কোনো জীবিত ব্যক্তি নন, থাকবেন মৃতরা। তাই হংকংয়ের ১২ তলা শান সাম টাওয়ারের সাদা মার্বেলের ঘরগুলোর লক্ষ্য গড়পরতা ক্রেতারা নন। যেসব গ্রাহকরা মৃত্যুর পরও পরকালে বেশি কিছু চাইছেন, তাদের জন্যই তৈরি করা হয়েছে এই মৃতের ঠিকানা।

ঢেউ খেলানো নকশার কলম্বারিয়াম স্টাইলের দালানে ২৩ হাজার মানুষের দেহাবশেষ রাখা যাবে। একক ইউনিট ছাড়াও থাকছে আরো সুবিধা। দুই ইউনিটে খরচ হবে ৭৬ হাজার ডলার। আর আটজনের দেহাবশেষ রাখা যায়, এখন পারিবারিক ইউনিটে খরচ চার লাখ ৩০ হাজার ডলার।

প্রায় এক ঘনবর্গফুট হিসেবে এই চেম্বারগুলোর দাম শহরের অন্যান্য থাকার জায়গার চেয়ে বেশি। যেমন, অভিজাত দ্য পিকের একটি আবাসনে গত মার্চে বর্গফুট প্রতি দাম চাওয়া হয়েছিল ৩২ হাজার ডলার। সেখান শান সাম ভবনের প্রতি ঘনবর্গফুটের দাম শুরু ৫৩ হাজার ডলার থেকে।

তবে শেষ বিশ্রামের জন্য আরও ব্যয়বহুল স্থান আছে হংকংয়ে। ফ্যানলিংয়ে মন্দিরের মতো দেখতে একটি কমপ্লেক্সে কবর প্রতি খরচ ছয় লাখ ৬০ ডলার খরচ। আছে রক্ষণাবেক্ষণ ও সারচার্জ বাবদ ২৫ হাজার ডলার। যা প্রতি বছর গুণতে হবে মৃতের স্বজনদের।

তবে শান সামের মতো ব্যক্তিগত কলম্বারিয়ামগুলো অনন্ত বিশ্রামের সুযোগ দিচ্ছে না। সরকারি লাইসেন্সে বেধে দেয়া সময়ে পর্যন্ত ছাই সংরক্ষণ করবে। যার সীমা ১০ বছর। এরপর আবারও নতুন করে কিনতে হবে জায়গাম, না হয় সরিয়ে নিতে হবে দেহাবশেষ।

এই ভবনের নকশা করেছেন জার্মান স্থপতি উলরিচ কির্চহফ। পাহাড়ের ধারের ঐতিহ্যবাহী চীনা কবরস্থানের নকশা অনুসরণ করেছেন তিনি। পূর্বপুরুষদের বিশ্রামস্থলে বেড়াতে আসা পরিবারের জন্য থাকছে কিছু সেবা। তারা বাগান, ছাদ ও বারান্দায় সময় কাটাতে পারবেন।

ভবনটির প্রায় পঞ্চমাংশই খোলা জায়গা।শান শামের উদ্যোক্তা ব্যবসায়ী মার্গারেট জি। মৃতদের প্রতি শ্রদ্ধা চীনা সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ- এ ধারণাকে মাথায় রেখে বিশ্রামাগারটি তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়ছেন তিনি। এরিমধ্যে ব্যাপক সাড়াও পেয়েছেন তিনি।

মার্গারেট বলেন, এটি মৃতদের বিশ্রামের স্থান নয়। যাদের কাছ থেকে চলে গেছেন তাদের শান্তি দেয়ার জন্যও তৈরি করা হয়েছে। ২০০৭ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর সমাধিস্থ করতে বড় ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। বুঝতে পারেন, মৃতদের সম্মান জানানোর জন্য হংকংয়ে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই।

৭০ লাখেরও বেশি মানুষের বাসস্থান হংকং বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি। আয়তনের হিসেবে হংকং ছোট নয়, এক হাজার ১১০ বর্গকিলোমিটার। যা নিউইয়র্ক থেকে প্রায় এক দশমিক চার গুণ বড়। তবে পাহাড়ি গঠনের জন্য বেশিরভাগ জমি ব্যবহার করা যায় না।

গত এক দশকে হংকং শহরের মৃত্যুর হার প্রতি বছর প্রায় ৪৬ হাজার। এ কারণে শেষ বিশ্রামের স্থান নিয়ে প্রায়ই বিপত্তিতে ভুগতে হয়। আবার অভিবাসন ও কম জন্মহারের কারণে হংকংয়ের দ্রুত প্রবীণদের সংখ্যা বাড়ছে। প্রতি পাঁচ বাসিন্দার একজনের বয়স ৬৫ এর বেশি।