যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রভাব ফেলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

  • Update Time : ১২:৩৩:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ অগাস্ট ২০২২
  • / 183

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ

মহামারিতে কেঁপে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলো আরেক বিরূপ সময়ের। ঠিক দুই বছর আগেই যেখানে কোভিড থেকে বাঁচতে পারাটাই যেন ছিল একমাত্র চাওয়া, সেখানে মানুষকে এখন সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন নতুন সঙ্কটের।

একদিকে অপরাধ লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে, কারণে অকারণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ- স্কুল থেকে শুরু করে সাবওয়ের নিরাপত্তা প্রশ্নের সম্মুখীন। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি তেলের।

স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। হু হু করে বাড়ছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য। ইতিমধ্যে আইএমএফ বৈশ্বিক মন্দার আশংকা প্রকাশ করেছে। সারা বিশ্ব শীঘ্রই মন্দার দ্বারপ্রান্তে আসতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের একটি আপডেটে আইএমএফ জানিয়েছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি এবং মহামারি ফিরে আসায় সাম্প্রতিক মাসগুলিতে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলি ইতিমধ্যে অন্ধকার হয়ে গেছে।

এই হুমকি যদি তীব্রতর হতে থাকে, বিশ্ব অর্থনীতি ১৯৭০ সালের পর সবচেয়ে দুর্বলতম সময়ের মুখোমুখি হবে, আর তা হবে বিশ্বজুড়ে তীব্র স্থবিরতার সময়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে।

দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, বেতন বাড়েনি

নিউ ইয়র্কের একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষক ৬৫ বছর বয়সী মিস ওয়িলিয়াম বারবারই দুঃখ করে বলছিলেন, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। রুটির দাম বেড়েছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ, ট্যাক্সির ভাড়া বেড়েছে, বাড়ি ভাড়া বেড়েছে, কিন্তু তার বেতন বাড়েনি।

টেলিভিশন চ্যানেল সিবিএস নিউজে এইচ এন্ড এস বেকারির সহ-মালিক প্যাটেরাকিস, জুলাইয়ে ময়দার মূল্য ৩৫% বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে বলেন, “এটি সম্পূর্ণভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ঘটেছে।” এই যুদ্ধ “বিশ্বের রুটির ঝুড়ি” হিসাবে বিবেচিত একটি দেশে গম, ওটস এবং রান্নার তেলের উৎপাদন ব্যাহত করেছে।

ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহের ২৫ শতাংশ উৎপাদন করে। রাশিয়ার আক্রমণের ফলে সেখানে বেশিরভাগ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু রিজার্ভ এখনও থাকলেও তা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

গম চাষ, তেল উৎপাদন

একদিকে সাপ্লাই চেইনে সঙ্কট, মহামারির কারণে সৃষ্ট আংশিকভাবে শ্রমিকের ঘাটতি আরেকদিকে তেলের মূল্য বৃদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে সরবরাহ ব্যয়।

আমেরিকান বেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও রব ম্যাকি বলেছেন, “দুর্ভাগ্যবশত সেই খরচগুলো ভোক্তাদের বহন করতে হবে। এবং আমাদের সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিরা এটি অন্য কারও চেয়ে বেশি অনুভব করতে চলেছে।”

সাময়িকভাবে বিকল্প উপাদান ও ইউক্রেনের বাইরে উৎপাদিত গম এবং ময়দা আনার দিকে ঝুঁকলেও, বেকারি শিল্প সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রে জমি খালি করে আরও গম চাষ, এবং জ্বালানি খরচ কমাতে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য।

গ্যাস নিয়ে বাইডেনের প্রতিশ্রুতি

গ্যাসের মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা জো বাইডেন কোনভাবেই পারছেন না এর লাগাম টানতে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন আয়ভুক্ত পরিবারগুলোকে বাজারের তালিকা ছোট করতে বাধ্য করছে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে এমন ভীতি সৃষ্টি করেছে যার ফলস্বরূপ তেলের মূল্য গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। আর এর খেসারত আমেরিকানরা দিচ্ছে তেলের পাম্পে।

অকল্পনীয় মূল্য বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অভিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশ উবার এবং লিফটে গাড়ী চালিয়েই জীবন নির্বাহ করে।

পয়তাল্লিশ বছর বয়সী ফিলিপ জিন, যখন গত রবিবার রাতে উবারের জন্য তার গাড়ির ট্যাঙ্ক ভরেছিলেন, তখন প্রতি গ্যালনের দাম ছিল ৪ দশমিক ১৯ ডলার।

সাত ঘণ্টা পরে, এটি লাফিয়ে পৌঁছে ৪ দশমিক ৪৫ এ, যা একটি “অকল্পনীয়” চিত্র।

চার বছর আগে রাইডশেয়ার অ্যাপে কাজ শুরু করা পেনসিলভানিয়ার ড্রাইভার বলেন, জ্বালানি খরচ গড়ে তার আয়ের প্রায় দশ শতাংশ খেয়ে ফেলে, আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ষাট শতাংশে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

অবশেষে উপায়ন্তর না থাকায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জো বাইডেন নিজ দেশে অনেকের সমালোচনা উপেক্ষা করে সৌদি প্রিন্সের সাথে দেখা করলেন। কিন্তু ফলাফল শুধু শূন্য না, ব্যর্থ এই মিটিংয়ের ফলে তেলের দাম যুক্তরাষ্ট্রে ব্যারেল প্রতি ছেড়ে গেছে একশ ডলার।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি এই মুহূর্তে নতুন করে তেল উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না, বরং তিনি যা করবেন তা বাস্তবতার নিরিখেই করবেন।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা সারা বিশ্বের আমাদের অংশীদার, বন্ধুদের, এবং বিশেষ করে ভোক্তা দেশগুলোর কথা শুনি। কিন্তু দিনের শেষে, ওপেক প্লাস বাজার পরিস্থিতি অনুসরণ করে, সেই প্রয়োজন অনুযায়ীই শক্তি সরবরাহ করবে।”

ওপেক প্লাস

ওপেক প্লাসের বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী আগামী মাস থেকে সৌদি আরবের ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করার কথা। তেইশটি তেল উৎপাদনকারী দেশের এই জোট – ওপেক প্লাস, যুক্তরাষ্ট্রসহ ভোক্তা দেশগুলোর অনুরোধে ইতিমধ্যে জুনে তেল উৎপাদন বাড়াতে যাচ্ছে।

তারপরও, বাজারে মন্দার ঝুঁকি থাকায়, সাম্প্রতিক সময়ে তেলের বেড়ে যাওয়া দাম কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে, আগামী ৩রা অগাস্ট জোটের পলিসি মিটিংয়ের আগে এই চিত্র বদলে যেতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি আরব মাঝারি মেয়াদে তেল উৎপাদন আর বাড়াতে পারবে না। মে মাসে, সৌদি জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান বলেছেন, সৌদি উৎপাদন “সম্ভবত” ২০২৬ সালের শেষের দিকে বা ২০২৭ সালের শুরুতে প্রতিদিন ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন এবং ১৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত হবে।”

কিন্তু ২০২৬-২৭ তো বহু দূরের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সংকটের তাহলে আশু সমাধান কি?

দেশের ভেতরের তেল পাম্প প্রতিষ্ঠানগুলোও কোনো আশার বানী দিচ্ছে না। তেল ও পেট্রোলের দাম বাড়ছে- জ্বালানি কোম্পানির মুনাফা বাড়ছে।

এদিকে ইউরোপও রাশিয়ার উপর নির্ভরতা শেষ করতে চায়। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ তেল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই মুহূর্তে আরও তেল পাম্প করে পুঁজি করতে আগ্রহী নয়।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী পরিশোধন ক্ষমতা ২০২১ সালে প্রতিদিন ৯ দশমিক ১ মিলিয়ন ব্যারেল কমেছে। তিরিশ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক পরিশোধন ক্ষমতার একরকম পতন এবারই প্রথম।

তেল পরিশোধন ক্ষমতা কমেছে

যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের শুরু থেকে পরিশোধন ক্ষমতা কমেছে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ব্যারেল। যুক্তরাষ্ট্র এখন তেল উৎপাদন করছে ১১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল, অথচ মহামারির আগে ২০২০ সালের মার্চে সেট করা রেকর্ড অনুযায়ী তেল উৎপাদন করার কথা ছিল ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন ব্যারেল।

যুক্তরাষ্ট্রে তেলের উৎপাদন কমে গেছে অথচ যোগ হয়েছে ইউরোপকে তেলের জোগান দেয়ার প্রয়োজনীয়তা।

এক সমীক্ষা অনুযায়ী তেলের উৎপাদন না বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল যে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি কোম্পানি এবং ওয়াল স্ট্রিট বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত নয় যে, প্রচুর পরিমাণে নতুন কূপ খনন করে লাভ করার জন্য তেলের দাম যথেষ্ট বেশি থাকবে।

অনেকেই মাথায় রাখছেন কিভাবে দুই বছর আগে তেলের দাম হঠাৎ করে ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে কোম্পানিগুলিকে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই এবং অনেক কূপ বন্ধ করতে হয়েছিল।

মার্চের মাঝামাঝি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ডালাস একটি জরিপ করে। এই জরিপে ১৪১ টি তেল কোম্পানির নির্বাহীরা আরও তেল পাম্প না করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে একটি হ’ল বিনিয়োগকারীরা চায় না যে কোম্পানিগুলো আরও বেশি তেল উৎপাদন করুক, কারণ তারা মনে করেন এতে করে তেলের উচ্চমূল্যের সমাপ্তি ত্বরান্বিত হবে।

ইরানের নতুন পারমাণবিক চুক্তি?
তেল এক্সিকিউটিভ এবং বিনিয়োগকারীরা তেলের দাম আবার দ্রুত হ্রাস পেতে পারে আশংকা করে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া যুদ্ধে হারতে পারে এবং পিছু হটতে পারে।

চীনে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব এবং লকডাউন সেই দেশের অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও এনার্জির চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে।

ইরানের সাথে নতুন পারমাণবিক চুক্তি তেল রপ্তানির সূচনা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো শুধু নয় – সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলির সংস্থার অন্যান্য সদস্যরাও ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি তেল পাম্প করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ওয়াল স্ট্রিট আগ্রহী নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বড় তেল কোম্পানিগুলো অভিযোগ করে যে তারা আরও বিনিয়োগ করতে চাইলেও এটা কঠিন হবে কারণ ওয়াল স্ট্রিট পূঁজি বাজার নতুন জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আগ্রহী নয়।

এর পরিবর্তে কিছু বিনিয়োগকারী যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা, তাদের অর্থ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং অন্যান্য ব্যবসায় লাগাচ্ছেন।

বিনিয়োগকারীরা যে পরিবেশবাদী হয়ে উঠেছেন, তা নয়- সিদ্ধান্তগুলো আসছে পুরোটাই বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে।

একদিকে রাশিয়ার তেল ধীরে ধীরে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ব বাজার থেকে সরানো হচ্ছে। বাড়ছে গ্যাসের সংকট। অপরদিকে চীনে নেয়া হয়েছে, জিরো – কোভিড পলিসি, চলছে লকডাউন- এরকম পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল।

আইএমএফের সতর্কবার্তাকে আমলে নিয়ে বিশ্বনেতারা বৈশ্বিক মন্দা ঠেকাতে কী উদ্যোগ নেয় এর উপরে নির্ভর করছে আগামী দিনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলাফল হয়ত দ্রুতই নির্ধারণ করে দেবে শেষ পর্যন্ত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, হয়তো নতুন করে নির্ধারণ হবে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জোটের অবস্থান।

কিন্তু তাতে করে নিন্মবিত্ত মানুষ, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের ভাগ্যের কোন বদল হবে না, বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা যে আরও অসহায় হয়ে যাবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা মুনাফার রাজনীতি, নিপীড়িতের জীবন কোনটারই বিবেচ্য নয়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রভাব ফেলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ

Update Time : ১২:৩৩:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১ অগাস্ট ২০২২

আন্তর্জাতিক ডেস্কঃ

মহামারিতে কেঁপে ওঠা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ ধাক্কা সামলে উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই মুখোমুখি হলো আরেক বিরূপ সময়ের। ঠিক দুই বছর আগেই যেখানে কোভিড থেকে বাঁচতে পারাটাই যেন ছিল একমাত্র চাওয়া, সেখানে মানুষকে এখন সম্মুখীন হতে হচ্ছে অনাকাঙ্ক্ষিত নতুন নতুন সঙ্কটের।

একদিকে অপরাধ লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে, কারণে অকারণে প্রাণ হারাচ্ছে মানুষ- স্কুল থেকে শুরু করে সাবওয়ের নিরাপত্তা প্রশ্নের সম্মুখীন। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধি তেলের।

স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে উৎকণ্ঠা বেড়ে চলেছে। হু হু করে বাড়ছে নিত্যব্যবহার্য পণ্যের মূল্য। ইতিমধ্যে আইএমএফ বৈশ্বিক মন্দার আশংকা প্রকাশ করেছে। সারা বিশ্ব শীঘ্রই মন্দার দ্বারপ্রান্তে আসতে পারে বলে সতর্ক করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ।

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের একটি আপডেটে আইএমএফ জানিয়েছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি এবং মহামারি ফিরে আসায় সাম্প্রতিক মাসগুলিতে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলি ইতিমধ্যে অন্ধকার হয়ে গেছে।

এই হুমকি যদি তীব্রতর হতে থাকে, বিশ্ব অর্থনীতি ১৯৭০ সালের পর সবচেয়ে দুর্বলতম সময়ের মুখোমুখি হবে, আর তা হবে বিশ্বজুড়ে তীব্র স্থবিরতার সময়। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে সাধারণ মানুষকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে তুলেছে।

দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, বেতন বাড়েনি

নিউ ইয়র্কের একটি স্কুলের সহকারী শিক্ষক ৬৫ বছর বয়সী মিস ওয়িলিয়াম বারবারই দুঃখ করে বলছিলেন, সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে। রুটির দাম বেড়েছে প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ, ট্যাক্সির ভাড়া বেড়েছে, বাড়ি ভাড়া বেড়েছে, কিন্তু তার বেতন বাড়েনি।

টেলিভিশন চ্যানেল সিবিএস নিউজে এইচ এন্ড এস বেকারির সহ-মালিক প্যাটেরাকিস, জুলাইয়ে ময়দার মূল্য ৩৫% বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করে বলেন, “এটি সম্পূর্ণভাবে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ঘটেছে।” এই যুদ্ধ “বিশ্বের রুটির ঝুড়ি” হিসাবে বিবেচিত একটি দেশে গম, ওটস এবং রান্নার তেলের উৎপাদন ব্যাহত করেছে।

ইউক্রেন এবং রাশিয়া বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহের ২৫ শতাংশ উৎপাদন করে। রাশিয়ার আক্রমণের ফলে সেখানে বেশিরভাগ উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। কিছু রিজার্ভ এখনও থাকলেও তা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।

গম চাষ, তেল উৎপাদন

একদিকে সাপ্লাই চেইনে সঙ্কট, মহামারির কারণে সৃষ্ট আংশিকভাবে শ্রমিকের ঘাটতি আরেকদিকে তেলের মূল্য বৃদ্ধি বাড়িয়ে দিয়েছে সরবরাহ ব্যয়।

আমেরিকান বেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট এবং সিইও রব ম্যাকি বলেছেন, “দুর্ভাগ্যবশত সেই খরচগুলো ভোক্তাদের বহন করতে হবে। এবং আমাদের সমাজের সবচেয়ে দুর্বল ব্যক্তিরা এটি অন্য কারও চেয়ে বেশি অনুভব করতে চলেছে।”

সাময়িকভাবে বিকল্প উপাদান ও ইউক্রেনের বাইরে উৎপাদিত গম এবং ময়দা আনার দিকে ঝুঁকলেও, বেকারি শিল্প সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রে জমি খালি করে আরও গম চাষ, এবং জ্বালানি খরচ কমাতে প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেল উৎপাদন বাড়ানোর জন্য।

গ্যাস নিয়ে বাইডেনের প্রতিশ্রুতি

গ্যাসের মূল্য কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা জো বাইডেন কোনভাবেই পারছেন না এর লাগাম টানতে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ অবশেষে যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন আয়ভুক্ত পরিবারগুলোকে বাজারের তালিকা ছোট করতে বাধ্য করছে।

ইউক্রেনে যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে এমন ভীতি সৃষ্টি করেছে যার ফলস্বরূপ তেলের মূল্য গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছেছে। আর এর খেসারত আমেরিকানরা দিচ্ছে তেলের পাম্পে।

অকল্পনীয় মূল্য বৃদ্ধি

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অভিবাসীদের একটি বৃহৎ অংশ উবার এবং লিফটে গাড়ী চালিয়েই জীবন নির্বাহ করে।

পয়তাল্লিশ বছর বয়সী ফিলিপ জিন, যখন গত রবিবার রাতে উবারের জন্য তার গাড়ির ট্যাঙ্ক ভরেছিলেন, তখন প্রতি গ্যালনের দাম ছিল ৪ দশমিক ১৯ ডলার।

সাত ঘণ্টা পরে, এটি লাফিয়ে পৌঁছে ৪ দশমিক ৪৫ এ, যা একটি “অকল্পনীয়” চিত্র।

চার বছর আগে রাইডশেয়ার অ্যাপে কাজ শুরু করা পেনসিলভানিয়ার ড্রাইভার বলেন, জ্বালানি খরচ গড়ে তার আয়ের প্রায় দশ শতাংশ খেয়ে ফেলে, আজ তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ষাট শতাংশে।

সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান

অবশেষে উপায়ন্তর না থাকায় উৎপাদন বাড়ানোর জন্য জো বাইডেন নিজ দেশে অনেকের সমালোচনা উপেক্ষা করে সৌদি প্রিন্সের সাথে দেখা করলেন। কিন্তু ফলাফল শুধু শূন্য না, ব্যর্থ এই মিটিংয়ের ফলে তেলের দাম যুক্তরাষ্ট্রে ব্যারেল প্রতি ছেড়ে গেছে একশ ডলার।

সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তিনি এই মুহূর্তে নতুন করে তেল উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি দিতে পারবেন না, বরং তিনি যা করবেন তা বাস্তবতার নিরিখেই করবেন।

সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমরা সারা বিশ্বের আমাদের অংশীদার, বন্ধুদের, এবং বিশেষ করে ভোক্তা দেশগুলোর কথা শুনি। কিন্তু দিনের শেষে, ওপেক প্লাস বাজার পরিস্থিতি অনুসরণ করে, সেই প্রয়োজন অনুযায়ীই শক্তি সরবরাহ করবে।”

ওপেক প্লাস

ওপেক প্লাসের বর্তমান চুক্তি অনুযায়ী আগামী মাস থেকে সৌদি আরবের ১১ মিলিয়ন ব্যারেল তেল উৎপাদন করার কথা। তেইশটি তেল উৎপাদনকারী দেশের এই জোট – ওপেক প্লাস, যুক্তরাষ্ট্রসহ ভোক্তা দেশগুলোর অনুরোধে ইতিমধ্যে জুনে তেল উৎপাদন বাড়াতে যাচ্ছে।

তারপরও, বাজারে মন্দার ঝুঁকি থাকায়, সাম্প্রতিক সময়ে তেলের বেড়ে যাওয়া দাম কমে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে, আগামী ৩রা অগাস্ট জোটের পলিসি মিটিংয়ের আগে এই চিত্র বদলে যেতে পারে।

বাস্তবতা হচ্ছে সৌদি আরব মাঝারি মেয়াদে তেল উৎপাদন আর বাড়াতে পারবে না। মে মাসে, সৌদি জ্বালানি মন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান বলেছেন, সৌদি উৎপাদন “সম্ভবত” ২০২৬ সালের শেষের দিকে বা ২০২৭ সালের শুরুতে প্রতিদিন ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন এবং ১৩ দশমিক ৪ মিলিয়ন ব্যারেলে উন্নীত হবে।”

কিন্তু ২০২৬-২৭ তো বহু দূরের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের জন্য তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সংকটের তাহলে আশু সমাধান কি?

দেশের ভেতরের তেল পাম্প প্রতিষ্ঠানগুলোও কোনো আশার বানী দিচ্ছে না। তেল ও পেট্রোলের দাম বাড়ছে- জ্বালানি কোম্পানির মুনাফা বাড়ছে।

এদিকে ইউরোপও রাশিয়ার উপর নির্ভরতা শেষ করতে চায়। তবুও যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ তেল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এই মুহূর্তে আরও তেল পাম্প করে পুঁজি করতে আগ্রহী নয়।

ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী পরিশোধন ক্ষমতা ২০২১ সালে প্রতিদিন ৯ দশমিক ১ মিলিয়ন ব্যারেল কমেছে। তিরিশ বছরের মধ্যে বৈশ্বিক পরিশোধন ক্ষমতার একরকম পতন এবারই প্রথম।

তেল পরিশোধন ক্ষমতা কমেছে

যুক্তরাষ্ট্রে ২০২০ সালের শুরু থেকে পরিশোধন ক্ষমতা কমেছে ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ব্যারেল। যুক্তরাষ্ট্র এখন তেল উৎপাদন করছে ১১ দশমিক ৮ মিলিয়ন ব্যারেল, অথচ মহামারির আগে ২০২০ সালের মার্চে সেট করা রেকর্ড অনুযায়ী তেল উৎপাদন করার কথা ছিল ১৩ দশমিক ৩ মিলিয়ন ব্যারেল।

যুক্তরাষ্ট্রে তেলের উৎপাদন কমে গেছে অথচ যোগ হয়েছে ইউরোপকে তেলের জোগান দেয়ার প্রয়োজনীয়তা।

এক সমীক্ষা অনুযায়ী তেলের উৎপাদন না বাড়ার সবচেয়ে বড় কারণ হল যে যুক্তরাষ্ট্রের এনার্জি কোম্পানি এবং ওয়াল স্ট্রিট বিনিয়োগকারীরা নিশ্চিত নয় যে, প্রচুর পরিমাণে নতুন কূপ খনন করে লাভ করার জন্য তেলের দাম যথেষ্ট বেশি থাকবে।

অনেকেই মাথায় রাখছেন কিভাবে দুই বছর আগে তেলের দাম হঠাৎ করে ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল, যার ফলশ্রুতিতে কোম্পানিগুলিকে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই এবং অনেক কূপ বন্ধ করতে হয়েছিল।

মার্চের মাঝামাঝি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ডালাস একটি জরিপ করে। এই জরিপে ১৪১ টি তেল কোম্পানির নির্বাহীরা আরও তেল পাম্প না করার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণের কথা উল্লেখ করেছেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলোর মধ্যে একটি হ’ল বিনিয়োগকারীরা চায় না যে কোম্পানিগুলো আরও বেশি তেল উৎপাদন করুক, কারণ তারা মনে করেন এতে করে তেলের উচ্চমূল্যের সমাপ্তি ত্বরান্বিত হবে।

ইরানের নতুন পারমাণবিক চুক্তি?
তেল এক্সিকিউটিভ এবং বিনিয়োগকারীরা তেলের দাম আবার দ্রুত হ্রাস পেতে পারে আশংকা করে বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া যুদ্ধে হারতে পারে এবং পিছু হটতে পারে।

চীনে কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাব এবং লকডাউন সেই দেশের অর্থনীতিকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে এবং বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও এনার্জির চাহিদা কমিয়ে দিতে পারে।

ইরানের সাথে নতুন পারমাণবিক চুক্তি তেল রপ্তানির সূচনা করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের তেল কোম্পানিগুলো শুধু নয় – সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং পেট্রোলিয়াম রপ্তানিকারক দেশগুলির সংস্থার অন্যান্য সদস্যরাও ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেক বেশি তেল পাম্প করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছে।

ওয়াল স্ট্রিট আগ্রহী নয়
যুক্তরাষ্ট্রের বড় তেল কোম্পানিগুলো অভিযোগ করে যে তারা আরও বিনিয়োগ করতে চাইলেও এটা কঠিন হবে কারণ ওয়াল স্ট্রিট পূঁজি বাজার নতুন জ্বালানি প্রকল্পে অর্থায়ন করতে আগ্রহী নয়।

এর পরিবর্তে কিছু বিনিয়োগকারী যারা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে উদ্বিগ্ন তারা, তাদের অর্থ পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, বৈদ্যুতিক গাড়ি এবং অন্যান্য ব্যবসায় লাগাচ্ছেন।

বিনিয়োগকারীরা যে পরিবেশবাদী হয়ে উঠেছেন, তা নয়- সিদ্ধান্তগুলো আসছে পুরোটাই বাণিজ্যিক চিন্তা থেকে।

একদিকে রাশিয়ার তেল ধীরে ধীরে এবং অবিচ্ছিন্নভাবে বিশ্ব বাজার থেকে সরানো হচ্ছে। বাড়ছে গ্যাসের সংকট। অপরদিকে চীনে নেয়া হয়েছে, জিরো – কোভিড পলিসি, চলছে লকডাউন- এরকম পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মূল্যস্ফীতি শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা বলা মুশকিল।

আইএমএফের সতর্কবার্তাকে আমলে নিয়ে বিশ্বনেতারা বৈশ্বিক মন্দা ঠেকাতে কী উদ্যোগ নেয় এর উপরে নির্ভর করছে আগামী দিনের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি।

রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধের ফলাফল হয়ত দ্রুতই নির্ধারণ করে দেবে শেষ পর্যন্ত চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, হয়তো নতুন করে নির্ধারণ হবে বিভিন্ন রাষ্ট্র ও জোটের অবস্থান।

কিন্তু তাতে করে নিন্মবিত্ত মানুষ, দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের ভাগ্যের কোন বদল হবে না, বরং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা যে আরও অসহায় হয়ে যাবে- তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ ক্ষমতার রাজনীতি কিংবা মুনাফার রাজনীতি, নিপীড়িতের জীবন কোনটারই বিবেচ্য নয়।

সূত্র: বিবিসি বাংলা