স্বীকৃতি না পাওয়া খাসেরহাটের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ

  • Update Time : ০৪:৩৫:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১
  • / 139
ইউসুফ আলী চৌধুরী,রাজশাহী:
২৫ জুন ১৯৫১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের (খাসেরহাট কবিরাজ টোলা) গ্রামে পিতা তিতু মিয়া ও মাতা ছকিনার ঘরে জন্মগ্রহন করেন মোঃ সিরাজ। শিক্ষা জীবন প্রাইমারী স্কুলেই ইতি।
.
সিরাজ পিতামাতার দেওয়া নাম হলেও এলাকায় শম্ভু নামে সবাই চিনে। শম্ভুর রান্নার হাত ছিল দারুন, তাই এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাবুর্চী হিসাবে রান্না করার জন্য তাকে ডাকা হতো। ইতিমধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সিরাজের বয়স তখন ২০ বছর। বাড়ীর পাশেই বিনোদপুর খাসেরহাট প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প।দেশের বীর সন্তানেরা দেশকে পাকিস্থানী বাহিনীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে দলে দলে যোগদান করছে। শম্ভুও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের প্রস্তুতি নেয়।
.
শম্ভু প্রতিবেদককে জানান, সেই সময় একদিন বিকাল ৪ টার দিকে বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্প থেকে মোঃ জয়নাল (ভুতু) নামে একজন আমাকে বলে কমান্ডার সাহেব আপনাকে ডেকেছেন। জয়নাল (ভুতু) ভাই আমাকে ক্যাম্পে সেক্টর কমান্ডারের সাথে দেখা করালো।
.
৭ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ডাঃ মোঃ মঈন উদ্দিন আহম্মদ মন্টু। কমান্ডার সাহেব আমাকে বললো আপনাকে এখানে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার জন্য রান্নার কাজ করতে হবে। আমি রান্না করবো কি না জানতে চায় ? জানালাম রান্না করবো। কমান্ডার সাহেব আমার সম্পুর্ন ঠিকানা একটি খাতায় লিখে নিয়ে আমাকে এবং মোঃ জয়নাল (ভুতু) ভাই দুজনকে রান্না করার দায়িত্ব দিলেন পদবী হলো বাবুর্চী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথারীতি পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো।
.
মুক্তিযুদ্ধ শেষে যার যার বাড়ীতে ফিরে এলাম। বাড়ীতে এসে কাজ কাম না থাকায় সংসারে অভাব দেখা দিল। তখন কাজের সন্ধানে রাজশাহীতে চলে আসি। রাজশাহীতে এসে আমার গ্রামের এ্যাডভোকেট মোঃ মহসিন আলী ভাইয়ের বাসায় থাকতে শুরু করলাম। মহসিন ভাই লোকনাথ হাইস্কুলে আমাকে পিয়নের চাকরি নিয়ে দিলেন। মাসিক বেতন ছিল ১৬৫/- টাকা। স্কুলে চাকরি করি আর মহসিন ভাইয়ের বাসায় থাকি। অল্প বেতনের জন্য স্কুলের চাকুরী ছেড়ে দিলাম। এরপর চাকুরি ছেড়ে রিক্সা চালায় আর এক রিক্সা চালক বন্ধুর বাড়িতে থাকি। বন্ধুর বাড়ি নিউ কলোনী (বিহারী কলোনী)।
.
রাজশাহী শহরে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাদে এক সময় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক হয়ে যায় পরবর্তীতে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে অল্প কিছু জায়গা ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। রাজশাহী আসার পর আমার জন্মস্থান বিনোদপুর খাসেরহাটে যাতায়াত খুব কম হয়েছে। যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অভাব আমাকে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। আমার অজ্ঞতা আর দারিদ্রতার কারণে আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন করা হয়নি। বৃদ্ধ হওয়ায় দিনদিন কাজ করার শক্তি হারাচ্ছি। পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে আজও অভাব দূর করার চেষ্টায় কাজ করে চলছি।
.
বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্পে যারা ছিল, আমি ছাড়া সবাই এখন মুক্তিযোদ্ধা। ওয়ারেন্ট অফিসার (অবঃ) মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন সিরাজ ওরফে সম্ভু ভাই বাবুর্চী হিসাবে আমাদের বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্পে রান্না করতেন, এখনও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাতে নাম উঠেনি এটা দুঃখজনক।
.
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাঃ মশিউর রহমান বাচ্চু বিশ্বাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ কাইউম আলীসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সিরাজকে বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্পে রান্না করেছে বলে প্রতিবেদককে জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই আবেদন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


স্বীকৃতি না পাওয়া খাসেরহাটের বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ

Update Time : ০৪:৩৫:৪৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ২০ জানুয়ারী ২০২১
ইউসুফ আলী চৌধুরী,রাজশাহী:
২৫ জুন ১৯৫১ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের (খাসেরহাট কবিরাজ টোলা) গ্রামে পিতা তিতু মিয়া ও মাতা ছকিনার ঘরে জন্মগ্রহন করেন মোঃ সিরাজ। শিক্ষা জীবন প্রাইমারী স্কুলেই ইতি।
.
সিরাজ পিতামাতার দেওয়া নাম হলেও এলাকায় শম্ভু নামে সবাই চিনে। শম্ভুর রান্নার হাত ছিল দারুন, তাই এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাবুর্চী হিসাবে রান্না করার জন্য তাকে ডাকা হতো। ইতিমধ্যে শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি সিরাজের বয়স তখন ২০ বছর। বাড়ীর পাশেই বিনোদপুর খাসেরহাট প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প।দেশের বীর সন্তানেরা দেশকে পাকিস্থানী বাহিনীর হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে দলে দলে যোগদান করছে। শম্ভুও মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের প্রস্তুতি নেয়।
.
শম্ভু প্রতিবেদককে জানান, সেই সময় একদিন বিকাল ৪ টার দিকে বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্প থেকে মোঃ জয়নাল (ভুতু) নামে একজন আমাকে বলে কমান্ডার সাহেব আপনাকে ডেকেছেন। জয়নাল (ভুতু) ভাই আমাকে ক্যাম্পে সেক্টর কমান্ডারের সাথে দেখা করালো।
.
৭ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ডাঃ মোঃ মঈন উদ্দিন আহম্মদ মন্টু। কমান্ডার সাহেব আমাকে বললো আপনাকে এখানে থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার জন্য রান্নার কাজ করতে হবে। আমি রান্না করবো কি না জানতে চায় ? জানালাম রান্না করবো। কমান্ডার সাহেব আমার সম্পুর্ন ঠিকানা একটি খাতায় লিখে নিয়ে আমাকে এবং মোঃ জয়নাল (ভুতু) ভাই দুজনকে রান্না করার দায়িত্ব দিলেন পদবী হলো বাবুর্চী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব যথারীতি পালন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো, দেশ স্বাধীন হলো।
.
মুক্তিযুদ্ধ শেষে যার যার বাড়ীতে ফিরে এলাম। বাড়ীতে এসে কাজ কাম না থাকায় সংসারে অভাব দেখা দিল। তখন কাজের সন্ধানে রাজশাহীতে চলে আসি। রাজশাহীতে এসে আমার গ্রামের এ্যাডভোকেট মোঃ মহসিন আলী ভাইয়ের বাসায় থাকতে শুরু করলাম। মহসিন ভাই লোকনাথ হাইস্কুলে আমাকে পিয়নের চাকরি নিয়ে দিলেন। মাসিক বেতন ছিল ১৬৫/- টাকা। স্কুলে চাকরি করি আর মহসিন ভাইয়ের বাসায় থাকি। অল্প বেতনের জন্য স্কুলের চাকুরী ছেড়ে দিলাম। এরপর চাকুরি ছেড়ে রিক্সা চালায় আর এক রিক্সা চালক বন্ধুর বাড়িতে থাকি। বন্ধুর বাড়ি নিউ কলোনী (বিহারী কলোনী)।
.
রাজশাহী শহরে দীর্ঘদিন বসবাসের সুবাদে এক সময় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক হয়ে যায় পরবর্তীতে পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে অল্প কিছু জায়গা ক্রয় করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি। রাজশাহী আসার পর আমার জন্মস্থান বিনোদপুর খাসেরহাটে যাতায়াত খুব কম হয়েছে। যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও অভাব আমাকে যাওয়ার সুযোগ দেয়নি। আমার অজ্ঞতা আর দারিদ্রতার কারণে আজ পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার তালিকাভুক্ত হওয়ার আবেদন করা হয়নি। বৃদ্ধ হওয়ায় দিনদিন কাজ করার শক্তি হারাচ্ছি। পরিবার, সমাজ-রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে আজও অভাব দূর করার চেষ্টায় কাজ করে চলছি।
.
বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্পে যারা ছিল, আমি ছাড়া সবাই এখন মুক্তিযোদ্ধা। ওয়ারেন্ট অফিসার (অবঃ) মোঃ আলতাফ হোসেন বলেন সিরাজ ওরফে সম্ভু ভাই বাবুর্চী হিসাবে আমাদের বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্পে রান্না করতেন, এখনও মুক্তিযোদ্ধার তালিকাতে নাম উঠেনি এটা দুঃখজনক।
.
বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাঃ মশিউর রহমান বাচ্চু বিশ্বাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা জনাব মোঃ কাইউম আলীসহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সিরাজকে বিনোদপুর খাসেরহাট ক্যাম্পে রান্না করেছে বলে প্রতিবেদককে জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কাছে আমার একটাই আবেদন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাকে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।