করোনাভাইরাস বাদেও আরেকটি বিষয় এই জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলেছিল। তা হলো ওই জন্মশতবর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে আগমন। ভারতের এনআরসি ও নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তো বটেই, সরকারের মধ্যেও অস্বস্তি সৃষ্টি করেছে। যার প্রকাশও ঘটেছে সরকারের বিভিন্ন বক্তব্যে। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত-বাংলাদেশ বর্তমান সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ওই জন্মশতবর্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হবে, সেটা অস্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। বছরব্যাপী মুজিব বর্ষের অনুষ্ঠানমালায় অংশগ্রহণের জন্য ভারতের কংগ্রেস দলের প্রধান সোনিয়া গান্ধী, সিপিআই (এম)-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বলে জানা যায়। এ ছাড়া আরও বহু রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের এই জন্মশতবর্ষের বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালায় অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে।
কিন্তু ভারতের নাগরিক সংশোধন আইনকে কেন্দ্র করে দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষের মনে বেশ বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। বাংলাদেশের ইসলামি দলগুলো একে কেন্দ্র করে মুজিব বর্ষ অনুষ্ঠানে নরেন্দ্র মোদির আগমনকে বিরোধিতা করে তাকে প্রতিহত করার কর্মসূচিও ঘোষণা করে। বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা নামে বামদের জোট একইভাবে নরেন্দ্র মোদির আগমনকে প্রতিহত করার দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে। বামদের এই জোটে যেমন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি রয়েছে, তেমনি আধিক্যে রয়েছে ভারতবিরোধী—যারা ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী দেশ বলে মনে করে, সেই সব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাম দলও। ইসলামি দলসমূহ ও বাম জোটের এসব কর্মসূচি জনজমায়েতের দিক থেকে মুজিব বর্ষের কর্মসূচিতে কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে সক্ষম হতো না নিঃসন্দেহে। কিন্তু বাংলাদেশের জনমনে ভারতের বিভিন্ন আচরণের কারণে ভারতবিরোধী যে আন্তস্রোত রয়েছে, সেটাই প্রবল হতো বলে মনে হয়। আর এই ভারতবিরোধিতার মূল দিকটি যতখানি বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট, তার চেয়ে সাম্প্রদায়িকতানির্ভর। মুজিব বর্ষের উৎসব-আনন্দেই এটা কতখানি বিঘ্ন সৃষ্টি করত, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এর রাজনৈতিক তাৎপর্য। কারণ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির পত্তন হয়েছিল জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বকে নাকচ করে একটি ভাষাভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে। ভারতের নাগরিক সংশোধন আইন ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও উপমহাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে ১৯৭১ সালে বাঙালির রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের অবসান ঘটেছিল, সিএএ তাকেই পুনরুজ্জীবিত করেছে। ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে প্রণীত আইন উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই উৎসাহিত করেছে। দিল্লির সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলাদেশের ধর্মবাদী দলগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকলেও তাদের ওয়াজ মাহফিলে, জুমার বয়ানে, মিছিলের স্লোগানে ভারতবিরোধী, মোদি-বিরোধিতার নামে যে সাম্প্রদায়িক প্রচার চলেছে, এসবই সে কথাকেও প্রমাণ করে।
২.
এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্মশতবর্ষের রাজনৈতিক তাৎপর্য কি সামান্য ক্ষুণ্ন হয়? বরং এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও সংগ্রামকে আরও গভীরভাবে উপলব্ধি করাকে আরও জরুরি করে তোলে। বঙ্গবন্ধুর সেই আদর্শ ও সংগ্রাম কী ছিল? সেটা ছিল বাঙালির জন্য একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণ। তার সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এই সংগ্রামকে ধাপে ধাপে নিয়ে গেছেন ধর্মনিরপেক্ষতার রাষ্ট্রীয় মূলনীতির ধারণায়। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতির একটি হিসেবে তাকে সন্নিবেশ করেছেন।
অনেকের ধারণা, বাংলাদেশের সংবিধানের এই ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ভারত থেকে নেওয়া। এই নীতির বিরোধিতাকারীরা এভাবেই সেটাকে উত্থাপন করে এসেছে প্রথম থেকে। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো, ১৯৭৬ সালে গৃহীত সংবিধানের ৪২তম সংশোধনীতে ভারত তাদের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধি সংযোজন করে এবং সেটা কার্যকর হয় ১৯৭৭ সালের ৩ জানুয়ারি। আর বাংলাদেশের সংবিধানে সেটা গৃহীত হয় ১৯৭২ সালে। বরং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নিষ্ঠুর হত্যার পর সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিসহ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বিধিসমূহ কর্তন করেন।
৩.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এই নীতি গ্রহণ কাউকে কাউকে অবাক করতে পারে। কারণ, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ছাত্রসংগঠন ও পরবর্তী সময়ে মুসলিম লীগের কর্মী হিসেবে। সে হিসেবে তিনি ছিলেন দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রস্তাবিত পাকিস্তান আন্দোলনেরও একনিষ্ঠ কর্মী। কিন্তু শুরু থেকেই দেখা যায়, শৈশব-কৈশোরে নিজ গ্রাম ও শহরে সাম্প্রদায়িক আবহে বেড়ে উঠলেও সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের ব্যাপারে ভাবাবেগতাড়িত করতে পারেনি। তিনি বাঙালি মুসলমানের অধিকারের সংগ্রামকে দেখেছিলেন হিন্দু জমিদার, উচ্চবিত্তদের দ্বারা নিপীড়িত কৃষক প্রজা বা উঠতি মুসলিম বাঙালি মধ্যবিত্তের ওপর নিপীড়ন থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে। সে কারণেই তিনি নওয়াব জমিদার নেতৃত্বের হাত থেকে মুক্ত করে সাধারণ মুসলিম জনগণের সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তাঁর অবস্থান ছিল মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশ আবুল হাশিমের গ্রুপে। পাকিস্তান সম্পর্কে তাঁর প্রচারে আমরা দেখি তিনি বলেছেন, ‘পাকিস্তানের দাবি হিন্দুদের বিরুদ্ধে নয়, হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য এবং দুই ভাই যাতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে, তার জন্য।’ ১৯৪৬-এর ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’তে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’–এর জন্য তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ও পশ্চিম বাংলার ইতিহাসবিদেরা তাঁর নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে অভিযুক্ত করলেও, তাঁরই অনুগামী শেখ মুজিবকে দেখি ওই দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। হিন্দু এলাকায় মুসলমানদের, মুসলমান এলাকায় জীবন বিপন্ন করে হিন্দুদের রক্ষার কাজে সাহস নিয়ে এগিয়ে যেতে।
৪.
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই সেই শেখ মুজিব অচিরেই পাকিস্তান সম্পর্কে মোহমুক্ত হন। ভাষার দাবি নিয়ে ১৯৪৮-এর ১১ মার্চ গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন মুজিবের জন্ম হয়, যিনি ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, ছয় দফা, স্বাধিকার সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তানের ওই প্রথম যুগে রাজনৈতিক দল গঠনে তাঁর মুখ্য বিষয় ছিল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করা অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করা। সে কারণে তিনি জেলে থাকতে মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে (যার তিনি যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন) সে সম্পর্কে তাঁর যে মন্তব্য, তিনি তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করেছেন, তা হলো, ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, যাঁরা বাইরে আছেন, তঁারা ভাবনাচিন্তা করেই করেছেন।’ সময় যখন হয়েছে অর্থাৎ যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তর করেন। এ ক্ষেত্রে সভাপতি হিসেবে মাওলানা ভাসানী এই রূপান্তরের পথিকৃৎ ছিলেন। দলের বামপন্থীরা এর সহযোগী হলেও দলের মধ্যে খন্দকার মোশতাকসহ (যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার নায়ক) জ্যেষ্ঠ নেতাদের বিরোধিতা শেখ মুজিব তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব ও দক্ষ সাংগঠনিক যোগ্যতা দিয়ে মোকাবিলা করেছিলেন।
কেবল হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি নয়, যুক্তফ্রন্ট ভাঙার ষড়যন্ত্র পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় শাসকদের চক্রান্তে আদমজী জুট মিলে যখন বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা সংঘটিত হয়, সে সময় যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই তিনি আদমজীতে ছুটে গিয়ে ওই দাঙ্গার অবসান ঘটাতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মার্চে যখন পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের অবসান ঘটাতে বদ্ধপরিকর, সে সময় পাকিস্তানি বা যেকোনো মহলের প্ররোচনায় কোনো প্রকার সাম্প্রদায়িক সংঘাত না ঘটে, তার জন্য ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি দেশবাসীকে হুঁশিয়ার করতে ভোলেননি। বলেছিলেন, ‘শুনুন, মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-বিহারি যারা আছে, তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’
১৯৬৪ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান যখন রুখে দাঁড়িয়েছিল, দাঙ্গাবিরোধী কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে তারও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহসভাপতি হিসেবে বক্ষ্যমাণ নিবন্ধকারের সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সঙ্গে কাজ করার।
৫ .
পাকিস্তান আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এই অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। এ আদর্শকে তিনি সর্বোচ্চ স্থান দিয়েছেন। পাকিস্তান আমলের ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি, মুক্তিযুদ্ধকালে ধর্মের নামে পাকিস্তানিদের গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগের ঘটনাবলির প্রেক্ষাপট ও বাঙালির শাশ্বত অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ, সমাজ সংস্কৃতি ঐতিহ্য তাঁকে বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ়প্রত্যয়ী করেছিল। এর জন্য তাঁকে মিথ্যা প্রচার ও দল এবং দলের বাইরে বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু কিছুই তাঁকে এই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ১০ মাসের মাথায় ১৯৭২ সালে তিনি দেশবাসীকে যে সংবিধান দেন, তা দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। ১৯৭২-এ তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত সেই সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার ওপর নিপীড়ন, বিলোপ করা হইবে।’ (বাংলাদেশের সংবিধান, অক্টোবর, ২০১১)। ওই সংবিধান গ্রহণের সময় সংসদে দেওয়া তাঁর বক্তৃতায় তিনি স্পষ্ট বলেছেন, ‘পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।’
রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করায় বাংলাদেশবিরোধী, এমনকি নিজের দলের লোকদের কাছ থেকেও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন। নিজে ধার্মিক হলেও, নিজেকে ধর্মীয় অনুশাসনের অনুসারী বলে পরিচয় দেওয়ার জন্য তিনি কোনো কূটকৌশলের আশ্রয় নেননি। তাঁর সম্পর্কে অনেকের অভিযোগ যে তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য ওআইসি সম্মেলনে (১৯৭৪) যোগ দিয়েছিলেন। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান দেশের বাস্তবতার ভিত্তিতেই যে সেটা করেছিলেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু তাঁর অসংখ্য বক্তৃতায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের এই ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। সংবিধানের বিতর্কিত চতুর্থ সংশোধনী গ্রহণের পর জাতীয় সংসদের বক্তৃতায় তিনি চারটি মূলনীতি—জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার বীজ বাংলার মাটিতে আসতে পারবে না।’
৬.
অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শ ও ধর্মনিরপেক্ষতার দিশারি বঙ্গবন্ধুকে ১৫ আগস্ট নির্মমভাবে হত্যা করে খুনি মোশতাক মাথায় টুপি চড়িয়ে পাকিস্তানি কায়দায় ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘বিসমিল্লাহ’–এর সংযোজন করেছিলেন। আরেক সামরিক শাসক এরশাদ বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ধর্মীয় আবরণ দিতে সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ বিধির সংযোজন করেছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর বর্ণনায় বাংলাদেশকে ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ হিসেবে অভিহিত করা হতো এযাবৎকাল। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় বসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মূলনীতি ফিরিয়ে আনলেও ওই সংবিধানে জিয়া-এরশাদের ওই সংশোধনীগুলো ঈষৎ পরিবর্তন করে বহাল রয়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সংবিধানের এই অসংগতি ভবিষ্যৎকে কী রূপ নেবে, তা জানা নেই। তবে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাজনীতি প্রমাণ করছে, ধর্মীয় তোষণনীতি নিজ নিজ রাষ্ট্রের জন্য কী ভয়ংকর বিপদ ডেকে নিয়ে আসতে পারে। বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত আমলে জঙ্গিবাদের উত্থান, শিকড় পর্যন্ত মৌলবাদী ধারণার বিস্তৃতি ও সাম্প্রদায়িক মানসিকতার বিকাশ সেই ভবিষ্যতের কিছুটা দিক নির্দেশ করে। ভারতের জনগণ তাদের দেশে ধর্মীয় রাজনীতির পরিণতি ভালো বুঝবেন।
আশার কথা, উভয় দেশের অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক শক্তি এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করছে, জনজাগরণও ঘটছে। বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই সংগ্রাম ও জাগরণের দিশারি হতে পারেন। সেটা হলে মুজিব বর্ষে তা হবে তাঁর প্রতি শ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন।
লেখক: রাশেদ খান মেনন, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য।