‘দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে নদীতে, শুধু দেখা হলো না আমাদের’

  • Update Time : ০৭:৫৮:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ অগাস্ট ২০২০
  • / 184

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটিতে স্ত্রী ফজিলাতুননেছা মুজিবকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নানা স্মৃতিচারণ রয়েছে। স্ত্রীকে ডাক নাম ‘রেণু’ বলে ডাকতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রকাশিত বই দুটিতে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলে জেলগেটে বা আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময় স্ত্রী রেণুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি বেশি উঠে এসেছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় লেখা এ আত্মজীবনী ও দিনলিপিতে বর্ণিত হয়েছে ছাত্রজীবনে স্ত্রীকে নিয়ে তার নানা স্মৃতি। একাধিকবার এসেছে ছাত্র থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে পড়ার খরচের জন্য স্ত্রীর জমানো টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গও। এসেছে বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকতে সন্তানদের নিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে স্ত্রীর সংসার চালানোর তথ্যও।  স্ত্রীর উৎসাহ ও অনুরোধে আত্মজীবনী ও কারাগারের দিনলিপি লিখেছেন সেই তথ্য উঠে এসেছে জাতির পিতার লেখনিতে।

বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিকথায় স্ত্রীর সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের কথাও টেনেছেন। সম্পর্কে চাচাতো বোন রেণুর দাদা বঙ্গবন্ধুর দাদার চাচাতো ভাই ছিলেন। অর্থাৎ তারা বংশগতভাবে উভয়ই ‘শেখ’ পরিবারের সদস্য। এই পরিবারটি টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী বলেও বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু কত সালে বিয়ে করেছেন তা বইয়ে পাওয়া না গেলেও ১৯৪২ সালে তাদের ফুলশয্যা হয় সেটা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে টাকার পাওয়ার পাশাপাশি স্ত্রী রেণুর কাছ থেকেও মাঝে মধ্যে পেতেন বলে উল্লেখ করেছেন। তার লেখায় বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছে, ‘…সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই। নিজে মোটেও খরচ করত না। আমার জন্যই রাখত।’

কোনও একবার কলকাতা যাওয়ার সময়কালে স্ত্রী সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা এভাবে এসেছে, ‘আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি, কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। “অমঙ্গল অশ্রুজল” বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।” ’

১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা জেলখানায় থাকার সময়কালের একটি ঘটনা বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখেছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়েছিলেন। রেণু জানতো, আমি সিগারেট খাই। টাকাপয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখায় আরও একাধিকবার ছাত্রজীবনে, বন্দি জীবনে, এমনকি মুক্ত অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় স্ত্রীর টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে।

ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুর বিএ পরীক্ষার সময় কালের। তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাসে বোনের ভাড়া বাসায় উঠেছেন। পরীক্ষার সময় তার স্ত্রীও কলকাতায় চলে এলেন। এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু যেভাবে তুলে ধরেছেন তা হলো, ‘কিছুদিন পরে রেণুও কলকাতায় হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয় পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’

পাকিস্তান সরকারের বঞ্চনা নিয়ে একবার বঙ্গবন্ধু কথা বলছিলেন তার বাবার সঙ্গে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ও সংসার চালানোর প্রসঙ্গও আসে। যা আড়াল থেকে স্ত্রী রেণু শুনেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘রেণু বলল, “এভাবে কতদিন চলবে।” বুঝতে পারলাম আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

একবার এক মাসের বেশি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করে দেশে ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। গ্রেফতারি পরোয়ানা অবস্থায় পাকিস্তান থেকে দিল্লি-কলকাতা হয়ে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া আসার সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘রেণু নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সব কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না বা বলতে চায় না। সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’

পাকিস্তান থেকে ফিরে ওই সময়ে গ্রামের বাড়িতে সাত-আট দিন থেকে মাদারীপুরে বোনের বাড়িতে আরও সাত দিন বেড়িয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানরাও এসেছিলেন মাদারীপুর পর্যন্ত। সচরাচর লঞ্চে বরিশাল হয়ে ঢাকায় গেলেও গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় বঙ্গবন্ধু কৌশলগত কারণেই সেবার মাদারীপুর হয়ে আসছিলেন। যাওয়ার সময় স্ত্রী রেণু তাকে টাকা দিতে এসেছিলেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বললাম, এতদিন একলা ছিলে এখন আরও দুজন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো আর্থিক সাহায্য পাওয়ার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় টাকা পাবেন? আমার টাকার দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে দেখা হয় ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজোবোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনও আত্মীয়র আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব।’

একবার বন্দি মুজিবকে ঢাকা কারাগার থেকে জাহাজে করে খুলনায় নেওয়া হয়। ওই একই সময় অপর জাহাজে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে ঢাকায় রওয়ানা হন তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরা। এমনটি হতে পারে তা বঙ্গবন্ধুর ভাবনার মধ্যেও ওই সময় ছিল। বিষয়টি তিনি লেখনিতে প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাউকেও খবর দিলাম না। কিছুদিন পূর্বে রেণু লিখেছিল, ঢাকায় আসবে আমাকে দেখতে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নাই।’

খুলনা জেল থেতে গোপালগঞ্জ এসেছিলেন কোর্টের তারিখে। সেই সময় শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ ছিলেন জাতির পিতা। শরীর ও চোখের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে বাড়ির লোকদের কিছু ডিম কিনে দিতে বলেছিলেন তিনি। ওই সময় শরীর খারাপ দেখে রেণু তাকে সতর্কও করেছিলেন। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে এভাবে, ‘রেণু আমাকে সাবধান করল। বলল, “ভুলে যেও না তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।” ওকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কী করা যায়।’

পরে আরেকটি মামলার তারিখ পড়ায় বরাবরের মতো স্ত্রী-সন্তান এলেন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গোপালগঞ্জে। ওই তারিখের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কী করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হলো উল্টা। আরো কাঁদতে শুরু করল।’

১৯৫২ সালে ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিনের মাথায় টুঙ্গিপাড়া পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলেন তিনি। বাড়িতে পৌঁছানোর পর সবার সঙ্গে কথাবার্তা শেষে বিদায় নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে একা পেয়ে কেঁদে ফেলেন স্ত্রী রেণু। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় উঠে এসেছে এভাবে, ‘এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা-শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম।…” রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিলো না।” ’

বঙ্গবন্ধু তখন বিভিন্ন জেলায় গিয়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ব্যস্ত। ছেড়ে দিয়েছেন ল পড়া। সেই সময় নিজের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ল পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আব্বা খুবই অসন্তুষ্ট, টাকাপয়সা দিতে চান না। আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলেমেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে? রেণু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা লাগবে তাই জোগাড় করার চেষ্টায় থাকত।’

বঙ্গবন্ধু তখন মন্ত্রিসভার সদস্য। এ সময় একবার করাচি গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সঙ্গে পূর্ব বাংলার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। করাচি থেকে ঢাকার ফিরে বাসার পরিস্থতি দেখে এভাবে বর্ণনা করেন জাতির পিতা। তিনি লিখেছেন, ‘বাসায় এসে দেখলাম রেণু এখনও ভালো করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, “আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দেবে। আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধ হয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতে টাকা পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ।” ‘

মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ওই গ্রেফতারের সময়কালে স্ত্রী রেণুর পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি, ‘রেণু আমার সবকিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগলো। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের উঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, “তোমাকে কী বলে যাব, যা ভালো বোঝ করো। তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।” বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে গিয়েছিলাম যদি রেণু বাড়ি না যায় তাহলে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ দিকে পিতার অসুস্থতাজনিত কারণে মুক্তি পাওয়ার পর লঞ্চে শেখ কামালসহ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তখন বঙ্গবন্ধুর পিতা খুবই অসুস্থ এমন তথ্যের টেলিগ্রাম আছে স্ত্রী রেণুর কাছে। এটি পেয়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে রওনার আগে টেলিগ্রামটা সঙ্গে দিয়ে সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে একটি আবেদনও করেন তিনি। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাত ৯টায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। এদিকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা না পেয়ে এবং শ্বশুর বেশি অসুস্থ হওয়ায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান রওনা দেন। মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাদের যাত্রা করার বিষয়টি জানতে পারেন। এও জানতে পারেন যে, ওই জাহাজ ১১টায় নারায়ণগঞ্জ পৌঁছবে। এর পর পরই তিনি নারায়ণগঞ্জ গিয়ে জাহাজ ধরেন। ওই জাহাজে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়ে ছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল।’

কারাগারের রোজনামচা বইয়ে স্ত্রী ফজিলাতুননেছা মুজিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জেলগেটে সাক্ষাতের সময়কালের। জেলগেটে সাক্ষাতে কী কথা হতো। ছেলেমেয়ের খবরা-খবর ইত্যাদি উঠে আসে তাদের আলোচনায়। ওই সময় একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে স্ত্রী-সন্তান সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষেও কমবেশি সাক্ষাতেও সুযোগ ঘটত।

একবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্ত্রী-সন্তানরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আসেন। সাক্ষাতের বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায়, ‘প্রায় একঘণ্টা রেণু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাট আলাপ। ওদের বলেছি আর কোনও কষ্ট নাই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি।’

কারাগারে ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যান স্ত্রী-সন্তান। বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে সেদিনকার ঘটনা, ‘জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম, বোধহয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। জমাদার খবর দিল, “চলিয়ে, বেগম সহেবা আয়া।” আমি কী আর দেরি করি? তাড়াতাড়ি পঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। সেই পুরান দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে।’

বঙ্গবন্ধু ২৬ জুলাই ১৯৬৬ তারিখে স্ত্রী-সন্তানদের সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘আজ নিশ্চয়ই ‘দেখা’। ছেলেমেয়ে নিয়ে রেণু আসবে, যদি দয়া করে অনুমতি দেয়। পনের দিন তো হতে চলল, দিন কি কাটতে চায়, বার বার ঘড়ি দেখি কখন চারটা বাজে। দুপুরটা তো কোনোমতে কাগজ নিয়ে চলে যায়। এত দুর্বল হয়ে পড়েছি যে হাঁটতে ইচ্ছে আজ আর হয় না। সাড়ে চারটায় ‘দেখা’ এলো। দূর থেকেই ছোট্ট বাচ্চাটা আব্বা আব্বা করে ডাকা শুরু করে… রেণুকে বললাম, মোটা হতে চলেছি, কী যে করি! অনেক খাবার নিয়ে আসে। রেণু আমার বড় মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, তাই বলতে শুরু করলো। আমার মতামত চায়। বললাম, “জেল থেকে কী মতামত দেব; আর ও পড়তেছে পড়ুক, আইএ, বিএ পাস করুক। তার পর দেখা যাবে।” রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কতদিন যে আমাকে রাখবে কী করে বলব!’

১৯৬৭ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে স্ত্রীর সাক্ষাতে আসার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই ঈদের জামাত। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নেবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন কর।’  ঈদের সময় সাক্ষাতের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে। ঈদের আনন্দ তো বন্দিদের থাকতে পারে না। সময় কেটে গেল, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি এসে শুয়ে পড়লাম আর ভাবলাম এই তো দুনিয়া!’

১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জেলগেটে সাক্ষাতের সুযোগ পান স্ত্রী-সন্তানরা। ওইদিনের ঘটনা বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘১৭ মার্চ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করার অনুমতি দেবে? মন বলেছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালোই হত। সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধহয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, “চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে।” তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিল। ছয়টা বেজে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদেরকে বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না।’

ওই বছর ঈদুল আজহার দিন স্ত্রী রেণু রান্না করে কারাগারে খাবার পাঠান। যার বর্ণনা বঙ্গবন্ধু করেছেন, ‘রেণু বোধহয় ভোর রাত থেকেই পাক করেছে, না হলে কী করে ১২টার মধ্যে পাঠাল!’

আগের সাক্ষাতের ১৫ দিন পরে ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল স্ত্রী-সন্তানের সাক্ষাৎ পান জাতির পিতা। একঘণ্টার ওই সাক্ষাতে ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, পিতা-মাতার শরীরের খোঁজখবর নিতেই কেটে যায়। ওইদিনের সাক্ষাতে সংসারের কিছুটা টানাপোড়েনের কথা জানান স্ত্রী রেণু। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, চার মাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালোভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। “যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নেব”, রেণু বলল। রেণু বলল, “তোমার চিন্তা করতে হবে না।” সত্যিই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি।’

১৯৬৭ সালের এপ্রিলের ২৮ বা ২৯ তারিখে স্ত্রী-সন্তানরা সাক্ষাতে আসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্ত্রীর সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলতে পেরেছিলেন বলে কারাগারের রোজনামচা বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রেণু তার ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে আসবে বিকাল সাড়ে চারটায়। চারটার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম। পৌনে পাঁচটায় সিপাহী আসলো আমাকে নিতে। আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, তাই যে রুমে আলাপ করবো আইবি অফিসার সেখানে বসে নাই। বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা। ঘর-সংসার, বাড়ির কথা, আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটু ভীত হয় নাই। মনে হলো পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দেবে। দেখে খুশি হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, “তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে, অনেকদিন থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটিয়েছি তোমরা মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।” সন্ধ্যা হয়ে এলে ছেলেমেয়েদের ও রেণুকে বিদায় দিলাম। বললাম, “ভাবিও না, অনেক কষ্ট আছে। প্রস্তুত হয়ে থাকিও।” বাংলা ট্রিবিউন

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


‘দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে নদীতে, শুধু দেখা হলো না আমাদের’

Update Time : ০৭:৫৮:৪৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৮ অগাস্ট ২০২০

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ বই দুটিতে স্ত্রী ফজিলাতুননেছা মুজিবকে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নানা স্মৃতিচারণ রয়েছে। স্ত্রীকে ডাক নাম ‘রেণু’ বলে ডাকতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার উদ্যোগে প্রকাশিত বই দুটিতে বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকলে জেলগেটে বা আদালতে হাজিরা দেওয়ার সময় স্ত্রী রেণুর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি বেশি উঠে এসেছে। দেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় লেখা এ আত্মজীবনী ও দিনলিপিতে বর্ণিত হয়েছে ছাত্রজীবনে স্ত্রীকে নিয়ে তার নানা স্মৃতি। একাধিকবার এসেছে ছাত্র থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকে পড়ার খরচের জন্য স্ত্রীর জমানো টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গও। এসেছে বঙ্গবন্ধু বন্দি থাকতে সন্তানদের নিয়ে নানা প্রতিকূলতার মধ্যে স্ত্রীর সংসার চালানোর তথ্যও।  স্ত্রীর উৎসাহ ও অনুরোধে আত্মজীবনী ও কারাগারের দিনলিপি লিখেছেন সেই তথ্য উঠে এসেছে জাতির পিতার লেখনিতে।

বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিকথায় স্ত্রীর সঙ্গে তাদের পারিবারিক সম্পর্কের কথাও টেনেছেন। সম্পর্কে চাচাতো বোন রেণুর দাদা বঙ্গবন্ধুর দাদার চাচাতো ভাই ছিলেন। অর্থাৎ তারা বংশগতভাবে উভয়ই ‘শেখ’ পরিবারের সদস্য। এই পরিবারটি টুঙ্গিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী বলেও বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু কত সালে বিয়ে করেছেন তা বইয়ে পাওয়া না গেলেও ১৯৪২ সালে তাদের ফুলশয্যা হয় সেটা অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন।

বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে টাকার পাওয়ার পাশাপাশি স্ত্রী রেণুর কাছ থেকেও মাঝে মধ্যে পেতেন বলে উল্লেখ করেছেন। তার লেখায় বিষয়টি এভাবে উঠে এসেছে, ‘…সময় সময় রেণুও আমাকে কিছু টাকা দিতে পারত। রেণু যা কিছু জোগাড় করত বাড়ি গেলে এবং দরকার হলে আমাকেই দিত। কোনোদিন আপত্তি করে নাই। নিজে মোটেও খরচ করত না। আমার জন্যই রাখত।’

কোনও একবার কলকাতা যাওয়ার সময়কালে স্ত্রী সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর বর্ণনা এভাবে এসেছে, ‘আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রেণুর ঘরে এলাম বিদায় নিতে। দেখি, কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। “অমঙ্গল অশ্রুজল” বোধ হয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, “একবার কলকাতা গেলে আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এস।” ’

১৯৪৯ সালে বঙ্গবন্ধু ঢাকা জেলখানায় থাকার সময়কালের একটি ঘটনা বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘রেণু তখন হাচিনাকে নিয়ে বাড়িতেই থাকে। হাচিনা তখন একটু হাঁটতে শিখেছে। রেণুর চিঠি জেলেই পেয়েছিলাম। কিছু টাকাও আব্বা পাঠিয়েছিলেন। রেণু জানতো, আমি সিগারেট খাই। টাকাপয়সা নাও থাকতে পারে। টাকার দরকার হলে লিখতে বলেছিল।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইয়ে বঙ্গবন্ধুর লেখায় আরও একাধিকবার ছাত্রজীবনে, বন্দি জীবনে, এমনকি মুক্ত অবস্থায় রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় স্ত্রীর টাকা দেওয়ার প্রসঙ্গ এসেছে।

ঘটনাটি বঙ্গবন্ধুর বিএ পরীক্ষার সময় কালের। তিনি কলকাতার পার্ক সার্কাসে বোনের ভাড়া বাসায় উঠেছেন। পরীক্ষার সময় তার স্ত্রীও কলকাতায় চলে এলেন। এই বিষয়টি বঙ্গবন্ধু যেভাবে তুলে ধরেছেন তা হলো, ‘কিছুদিন পরে রেণুও কলকাতায় হাজির। রেণুর ধারণা, পরীক্ষার সময় সে আমার কাছে থাকলে আমি নিশ্চয় পাস করব। বিএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করলাম।’

পাকিস্তান সরকারের বঞ্চনা নিয়ে একবার বঙ্গবন্ধু কথা বলছিলেন তার বাবার সঙ্গে। এ সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ও সংসার চালানোর প্রসঙ্গও আসে। যা আড়াল থেকে স্ত্রী রেণু শুনেছিলেন বলে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘রেণু বলল, “এভাবে কতদিন চলবে।” বুঝতে পারলাম আড়াল থেকে সব কথা শুনছিল। রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত। যাতে আমার কষ্ট না হয়।’

একবার এক মাসের বেশি পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করে দেশে ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। গ্রেফতারি পরোয়ানা অবস্থায় পাকিস্তান থেকে দিল্লি-কলকাতা হয়ে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া আসার সময়কার ঘটনা উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘রেণু নিশ্চয়ই পথ চেয়ে বসে আছে। সে তো নীরবে সব কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না বা বলতে চায় না। সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’

পাকিস্তান থেকে ফিরে ওই সময়ে গ্রামের বাড়িতে সাত-আট দিন থেকে মাদারীপুরে বোনের বাড়িতে আরও সাত দিন বেড়িয়ে ঢাকায় ফিরছিলেন বঙ্গবন্ধু। তার সঙ্গে স্ত্রী-সন্তানরাও এসেছিলেন মাদারীপুর পর্যন্ত। সচরাচর লঞ্চে বরিশাল হয়ে ঢাকায় গেলেও গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় বঙ্গবন্ধু কৌশলগত কারণেই সেবার মাদারীপুর হয়ে আসছিলেন। যাওয়ার সময় স্ত্রী রেণু তাকে টাকা দিতে এসেছিলেন বলে অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘আমি বললাম, এতদিন একলা ছিলে এখন আরও দুজন তোমার দলে বেড়েছে। আমার দ্বারা তো আর্থিক সাহায্য পাওয়ার আশা নাই। তোমাকেই চালাতে হবে। আব্বার কাছে তো সকল সময় তুমি চাইতে পার না, সে আমি জানি। আর আব্বাই বা কোথায় টাকা পাবেন? আমার টাকার দরকার নাই। শীঘ্রই গ্রেফতার করে ফেলবে। পালিয়ে বেড়াতে আমি পারব না। তোমাদের সাথে কবে দেখা হয় ঠিক নাই। ঢাকা এস না। ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। মেজোবোনের বাসায়ও জায়গা খুব কম। কোনও আত্মীয়র আমার জন্য কষ্ট হয়, তা আমি চাই না। চিঠি লিখ, আমিও লিখব।’

একবার বন্দি মুজিবকে ঢাকা কারাগার থেকে জাহাজে করে খুলনায় নেওয়া হয়। ওই একই সময় অপর জাহাজে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে ঢাকায় রওয়ানা হন তার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানরা। এমনটি হতে পারে তা বঙ্গবন্ধুর ভাবনার মধ্যেও ওই সময় ছিল। বিষয়টি তিনি লেখনিতে প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘যা ভয় করেছিলাম তাই হলো। পূর্বের রাতে আমার মা, আব্বা, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে ঢাকায় রওয়ানা হয়ে গেছেন আমাকে দেখতে। এক জাহাজে আমি এসেছি। আর এক জাহাজে ওরা ঢাকা গিয়েছে। দুই জাহাজের দেখাও হয়েছে একই নদীতে। শুধু দেখা হলো না আমাদের। এক বৎসর দেখি না ওদের। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। বাড়িতে আর কাউকেও খবর দিলাম না। কিছুদিন পূর্বে রেণু লিখেছিল, ঢাকায় আসবে আমাকে দেখতে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি হবে বুঝতে পারি নাই।’

খুলনা জেল থেতে গোপালগঞ্জ এসেছিলেন কোর্টের তারিখে। সেই সময় শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ ছিলেন জাতির পিতা। শরীর ও চোখের অবস্থা খারাপ হওয়ার কারণে বাড়ির লোকদের কিছু ডিম কিনে দিতে বলেছিলেন তিনি। ওই সময় শরীর খারাপ দেখে রেণু তাকে সতর্কও করেছিলেন। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে এভাবে, ‘রেণু আমাকে সাবধান করল। বলল, “ভুলে যেও না তুমি হার্টের অসুখে ভুগেছিলে এবং চক্ষু অপারেশন হয়েছিল।” ওকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম, আর কী করা যায়।’

পরে আরেকটি মামলার তারিখ পড়ায় বরাবরের মতো স্ত্রী-সন্তান এলেন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গোপালগঞ্জে। ওই তারিখের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘রেণু আমাকে যখন একাকী পেল, বলল, “জেলে থাক আপত্তি নাই, তবে স্বাস্থ্যের দিকে নজর রেখ। তোমাকে দেখে আমার মন খারাপ হয়ে গেছে। তোমার বোঝা উচিত আমার দুনিয়ায় কেউ নাই। ছোটবেলায় বাবা-মা মারা গেছেন, আমার কেউই নাই। তোমার কিছু হলে বাঁচব কী করে?” কেঁদেই ফেলল। আমি রেণুকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তাতে ফল হলো উল্টা। আরো কাঁদতে শুরু করল।’

১৯৫২ সালে ফরিদপুর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে পাঁচ দিনের মাথায় টুঙ্গিপাড়া পৌঁছেন বঙ্গবন্ধু। কারাগারে অনশন করার কারণে শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল ছিলেন তিনি। বাড়িতে পৌঁছানোর পর সবার সঙ্গে কথাবার্তা শেষে বিদায় নেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে একা পেয়ে কেঁদে ফেলেন স্ত্রী রেণু। বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায় উঠে এসেছে এভাবে, ‘এক এক করে সকলে যখন আমার কামরা থেকে বিদায় নিল, তখন রেণু কেঁদে ফেলল এবং বলল “তোমার চিঠি পেয়ে আমি বুঝেছিলাম, তুমি কিছু একটা করে ফেলবা। আমি তোমাকে দেখবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কাকে বলব নিয়ে যেতে, আব্বাকে বলতে পারি না লজ্জায়। নাসের ভাই বাড়ি নাই। যখন খবর পেলাম খবরের কাগজে, তখন লজ্জা-শরম ত্যাগ করে আব্বাকে বললাম।…” রেণু খুব চাপা, আজ যেন কথার বাঁধ ভেঙে গেছে। শুধু বললাম, “উপায় ছিলো না।” ’

বঙ্গবন্ধু তখন বিভিন্ন জেলায় গিয়ে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে ব্যস্ত। ছেড়ে দিয়েছেন ল পড়া। সেই সময় নিজের অবস্থা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘ল পড়া ছেড়ে দিয়েছি। আব্বা খুবই অসন্তুষ্ট, টাকাপয়সা দিতে চান না। আমার কিছু একটা করা দরকার। ছেলেমেয়ে হয়েছে, এভাবে কতদিন চলবে? রেণু কিছুই বলে না, নীরবে কষ্ট সহ্য করে চলেছে। আমি বাড়ি গেলেই কিছু টাকা লাগবে তাই জোগাড় করার চেষ্টায় থাকত।’

বঙ্গবন্ধু তখন মন্ত্রিসভার সদস্য। এ সময় একবার করাচি গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সঙ্গে পূর্ব বাংলার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। কয়েকদিন আগে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করেন। করাচি থেকে ঢাকার ফিরে বাসার পরিস্থতি দেখে এভাবে বর্ণনা করেন জাতির পিতা। তিনি লিখেছেন, ‘বাসায় এসে দেখলাম রেণু এখনও ভালো করে সংসার পাততে পারে নাই। তাকে বললাম, “আর বোধহয় দরকার হবে না। কারণ মন্ত্রিত্ব ভেঙে দেবে। আর আমাকেও গ্রেফতার করবে। ঢাকায় কোথায় থাকবা, বোধ হয় বাড়িই চলে যেতে হবে। আমার কাছে থাকবা বলে এসেছিলা, ঢাকায় ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার সুযোগ হবে, তা বোধহয় হল না। নিজের হাতে টাকা পয়সাগুলিও খরচ করে ফেলেছ।” ‘

মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হয়। ওই গ্রেফতারের সময়কালে স্ত্রী রেণুর পরিস্থিতির স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি, ‘রেণু আমার সবকিছু ঠিক করে দিল এবং কাঁদতে লাগলো। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওদের উঠাতে নিষেধ করলাম। রেণুকে বললাম, “তোমাকে কী বলে যাব, যা ভালো বোঝ করো। তবে ঢাকায় থাকলে কষ্ট হবে, তার চেয়ে বাড়ি চলে যাও।” বন্ধু ইয়ার মোহাম্মদ খানকে বলে গিয়েছিলাম যদি রেণু বাড়ি না যায় তাহলে একটা বাড়ি ভাড়া করে দিতে।’

অসমাপ্ত আত্মজীবনীর শেষ দিকে পিতার অসুস্থতাজনিত কারণে মুক্তি পাওয়ার পর লঞ্চে শেখ কামালসহ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ রয়েছে। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান ঢাকায় থাকতেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তখন বঙ্গবন্ধুর পিতা খুবই অসুস্থ এমন তথ্যের টেলিগ্রাম আছে স্ত্রী রেণুর কাছে। এটি পেয়ে সন্তানদের নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে রওনার আগে টেলিগ্রামটা সঙ্গে দিয়ে সরকারের কাছে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চেয়ে একটি আবেদনও করেন তিনি। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রাত ৯টায় বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেওয়া হয়। এদিকে মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা না পেয়ে এবং শ্বশুর বেশি অসুস্থ হওয়ায় বাদামতলী ঘাট থেকে জাহাজে বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী-সন্তান রওনা দেন। মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু তাদের যাত্রা করার বিষয়টি জানতে পারেন। এও জানতে পারেন যে, ওই জাহাজ ১১টায় নারায়ণগঞ্জ পৌঁছবে। এর পর পরই তিনি নারায়ণগঞ্জ গিয়ে জাহাজ ধরেন। ওই জাহাজে স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি তিনি বর্ণনা করেছেন, ‘আমাকে দেখে রেণু আশ্চর্য হয়ে গেল। বাচ্চারা ঘুমিয়ে ছিল। রেণু তাদের ঘুম থেকে তুলল।’

কারাগারের রোজনামচা বইয়ে স্ত্রী ফজিলাতুননেছা মুজিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি জেলগেটে সাক্ষাতের সময়কালের। জেলগেটে সাক্ষাতে কী কথা হতো। ছেলেমেয়ের খবরা-খবর ইত্যাদি উঠে আসে তাদের আলোচনায়। ওই সময় একটি নির্দিষ্ট সময়ান্তে স্ত্রী-সন্তান সাক্ষাতের সুযোগ পেতেন। এছাড়া বিভিন্ন উপলক্ষেও কমবেশি সাক্ষাতেও সুযোগ ঘটত।

একবার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্ত্রী-সন্তানরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতে আসেন। সাক্ষাতের বিষয়টি বঙ্গবন্ধুর বর্ণনায়, ‘প্রায় একঘণ্টা রেণু এবং আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছিলাম। সংসারের ছোটখাট আলাপ। ওদের বলেছি আর কোনও কষ্ট নাই; একাকী সঙ্গীবিহীন আছি।’

কারাগারে ১৯৬৬ সালের ৬ জুলাই বঙ্গবন্ধুকে দেখতে যান স্ত্রী-সন্তান। বঙ্গবন্ধুর লেখনিতে সেদিনকার ঘটনা, ‘জমাদার সাহেবকে আসতে দেখে ভাবলাম, বোধহয় বেগম সাহেবা এসেছেন। গত তারিখে আসতে পারেন নাই অসুস্থতার জন্য। জমাদার খবর দিল, “চলিয়ে, বেগম সহেবা আয়া।” আমি কী আর দেরি করি? তাড়াতাড়ি পঞ্জাবি পরেই হাঁটা দিলাম গেটের দিকে। সেই পুরান দৃশ্য। রাসেল হাচিনার কোলে।’

বঙ্গবন্ধু ২৬ জুলাই ১৯৬৬ তারিখে স্ত্রী-সন্তানদের সাক্ষাতের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, ‘আজ নিশ্চয়ই ‘দেখা’। ছেলেমেয়ে নিয়ে রেণু আসবে, যদি দয়া করে অনুমতি দেয়। পনের দিন তো হতে চলল, দিন কি কাটতে চায়, বার বার ঘড়ি দেখি কখন চারটা বাজে। দুপুরটা তো কোনোমতে কাগজ নিয়ে চলে যায়। এত দুর্বল হয়ে পড়েছি যে হাঁটতে ইচ্ছে আজ আর হয় না। সাড়ে চারটায় ‘দেখা’ এলো। দূর থেকেই ছোট্ট বাচ্চাটা আব্বা আব্বা করে ডাকা শুরু করে… রেণুকে বললাম, মোটা হতে চলেছি, কী যে করি! অনেক খাবার নিয়ে আসে। রেণু আমার বড় মেয়ের বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে, তাই বলতে শুরু করলো। আমার মতামত চায়। বললাম, “জেল থেকে কী মতামত দেব; আর ও পড়তেছে পড়ুক, আইএ, বিএ পাস করুক। তার পর দেখা যাবে।” রেণু ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কতদিন যে আমাকে রাখবে কী করে বলব!’

১৯৬৭ সালের ১১ জানুয়ারি তারিখে স্ত্রীর সাক্ষাতে আসার প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই ঈদের জামাত। ছেলেমেয়েরা ঈদের কাপড় নেবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে। ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন কর।’  ঈদের সময় সাক্ষাতের প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘১৪ তারিখে রেণু বিশেষ অনুমতি নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। ঈদের জন্য এই অনুমতি দিয়েছে। ঈদের আনন্দ তো বন্দিদের থাকতে পারে না। সময় কেটে গেল, রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেল। আমি এসে শুয়ে পড়লাম আর ভাবলাম এই তো দুনিয়া!’

১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে জেলগেটে সাক্ষাতের সুযোগ পান স্ত্রী-সন্তানরা। ওইদিনের ঘটনা বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘১৭ মার্চ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। মাত্র ১৪ তারিখে রেণু ছেলেমেয়েদের নিয়ে দেখতে এসেছিল। আবার এত তাড়াতাড়ি দেখা করার অনুমতি দেবে? মন বলেছিল, যদি আমার ছেলেমেয়েরা ও রেণু আসত ভালোই হত। সাড়ে চারটা বেজে গিয়েছে, বুঝলাম আজ বোধহয় রেণু ও ছেলেমেয়েরা দেখা করার অনুমতি পায় নাই। পাঁচটাও বেজে গেছে। ঠিক সেই মুহূর্তে জমাদার সাহেব বললেন, “চলুন আপনার বেগম সাহেবা ও ছেলেমেয়েরা এসেছে।” তাড়াতাড়ি কাপড় পরে রওয়ানা করলাম জেলগেটের দিকে। ছোট মেয়েটা আর আড়াই বৎসরের ছেলে রাসেল ফুলের মালা হাতে করে দাঁড়াইয়া আছে। মালাটা রাসেলকে পরাইয়া দিলাম। সে কিছুতেই পরবে না, আমার গলায় দিল। ছয়টা বেজে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি রেণুকে ও ছেলেমেয়েদেরকে বিদায় দিতে হলো। রাসেলও বুঝতে আরম্ভ করেছে, এখন আর আমাকে নিয়ে যেতে চায় না। আমার ছোট মেয়েটা খুব ব্যথা পায় আমাকে ছেড়ে যেতে, ওর মুখ দেখে বুঝতে পারি। ব্যথা আমিও পাই, কিন্তু উপায় নাই। রেণুও বড় চাপা, মুখে কিছুই প্রকাশ করে না।’

ওই বছর ঈদুল আজহার দিন স্ত্রী রেণু রান্না করে কারাগারে খাবার পাঠান। যার বর্ণনা বঙ্গবন্ধু করেছেন, ‘রেণু বোধহয় ভোর রাত থেকেই পাক করেছে, না হলে কী করে ১২টার মধ্যে পাঠাল!’

আগের সাক্ষাতের ১৫ দিন পরে ১৯৬৭ সালের ১৫ এপ্রিল স্ত্রী-সন্তানের সাক্ষাৎ পান জাতির পিতা। একঘণ্টার ওই সাক্ষাতে ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, পিতা-মাতার শরীরের খোঁজখবর নিতেই কেটে যায়। ওইদিনের সাক্ষাতে সংসারের কিছুটা টানাপোড়েনের কথা জানান স্ত্রী রেণু। বিষয়টি বঙ্গবন্ধু প্রকাশ করেছেন এভাবে, ‘কোম্পানি আজও আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা দেয় নাই, তাই একটু অসুবিধা হতে চলেছে বলে রেণু বলল। ডিসেম্বর মাসে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, চার মাস হয়ে গেল আজও টাকা দিল না! আমি বললাম, জেল থেকে টেলিগ্রাম করব। প্রথম যদি না দেয় তবে অন্য পন্থা অবলম্বন করব। আমার টাকা তাদের দিতেই হবে। কোনোমতে চালাইয়া নিয়ে যাও। বাড়ির থেকে চাউল আসবে, নিজের বাড়ি, ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে, বছর খানেক ভালোভাবেই চলবে, তারপর দেখা যাবে। আমার যথেষ্ট বন্ধু আছে যারা কিছু টাকা ধার দিতে কৃপণতা করবে না। “যদি বেশি অসুবিধা হয় নিজের বাড়ি ভাড়া দিয়ে ছোট বাড়ি একটা ভাড়া করে নেব”, রেণু বলল। রেণু বলল, “তোমার চিন্তা করতে হবে না।” সত্যিই আমি কোনোদিন চিন্তা বাইরেও করতাম না, সংসারের ধার আমি খুব কমই ধারি।’

১৯৬৭ সালের এপ্রিলের ২৮ বা ২৯ তারিখে স্ত্রী-সন্তানরা সাক্ষাতে আসেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্ত্রীর সঙ্গে প্রাণখুলে কথা বলতে পেরেছিলেন বলে কারাগারের রোজনামচা বইয়ে উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘রেণু তার ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে আসবে বিকাল সাড়ে চারটায়। চারটার সময় আমি প্রস্তুত হয়ে রইলাম। পৌনে পাঁচটায় সিপাহী আসলো আমাকে নিতে। আমি সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি, তাই যে রুমে আলাপ করবো আইবি অফিসার সেখানে বসে নাই। বহুদিন পরে ছেলেমেয়েদের ও রেণুর সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বললাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা। ঘর-সংসার, বাড়ির কথা, আরও অনেক কিছু। আমার শাস্তি হয়েছে বলে একটু ভীত হয় নাই। মনে হলো পূর্বেই এরা বুঝতে পেরেছিল। রেণু বলল, পূর্বেই সে জানতো যে আমাকে সাজা দেবে। দেখে খুশি হলাম। ছেলেমেয়েরা একটু দুঃখ পেয়েছে বলে মনে হলো, তবে হাবভাবে প্রকাশ করতে চাইছে না। বললাম, “তোমরা মন দিয়ে লেখাপড়া শিখ, আমার কতদিন থাকতে হয় জানি না। তবে, অনেকদিন থাকতে হবে বলে মনে হয়। আর্থিক অসুবিধা খুব বেশি হবে না, তোমার মা চালাইয়া নিবে। কিছু ব্যবসাও আছে আর বাড়ির সম্পত্তিও আছে। আমি তো সারাজীবনই বাইরে বাইরে অথবা জেলে জেলে কাটিয়েছি তোমরা মা’ই সংসার চালাইয়াছে। তোমরা মানুষ হও।” সন্ধ্যা হয়ে এলে ছেলেমেয়েদের ও রেণুকে বিদায় দিলাম। বললাম, “ভাবিও না, অনেক কষ্ট আছে। প্রস্তুত হয়ে থাকিও।” বাংলা ট্রিবিউন