বিসিএস ক্যাডার না উদ্যেক্তা?
- Update Time : ০৮:২১:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০
- / 195
মফিজুর রহমান পলাশঃ
মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই এর মানে এই নয় যে আপনাকে বিসিএস ক্যাডারই হতে হবে। আপনি হেনরি রকফেলারের মতো একশো বিঘা জমিতে মুরগীর খামার করে সফল হোন, দেখবেন তরুন সমাজ আপনাকেই অনুসরণ করবে। আপনাকেই মডেল মানবে।
পুলিশ হতে পারেন নি বলে যারা নিজেকে হীনমন্যতায় ডোবাচ্ছেন, কে জানে তাদের মধ্যেই কেউ একজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়ে গোটা বাহিনীকেই পরিচালনা করার সুযোগ পাবেন। পুলিশ ক্যাডার এখানে নস্যি!
জন্মের আগেই যেসব বাবা মা সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখেন ছেলে হলে প্রকৌশলী আর মেয়ে হলে চিকিৎসক বানাবেন–তাদের জন্য সত্যিই মায়া হয়, করুনা হয়।
যে সন্তান পৃথিবীতেই আসেনি, তাকে কিভাবে আপনি ডাক্তার-প্রকৌশলী বানানোর ষড়যন্ত্র শুরু করে দিলেন? আপনি কি নিশ্চিত আপনার মেয়ে রোগীকে ইনজেকশন পুশ করতে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবেন না? আপনার যে ছেলেকে প্রকৌশলী বানাতে খড়গহস্ত হয়ে আছেন, তার হয়তো অংক ভালোই লাগবেনা, বরং সে ঘুরতে ভালবাসবেন। তাকে গনিত শেখাতে গিয়ে সময় নষ্ট না করে একটা ট্যুরিজম ব্যবসায় লাগিয়ে দেন। ও সোনা হবে!
ফরেন ক্যাডার ছেলে না পেলে যারা মেয়ে বিয়ে দেবেন না, তারা অন্তত জেনে রাখুন, বহু ক্যাডার অফিসার আছেন যারা বিসিএস পরীক্ষায় ফরেন ক্যাডার লিস্টেই রাখেন নি! বহু এডমিন অফিসারকে চিনি যারা পুলিশকে খাতায়ই রাখেন নি, তদ্রুপ বহু পুলিশ ক্যাডার আছেন, যারা ভাইবায় বাদ পড়ার ভয়ে কেবল দুই নম্বর পছন্দক্রমে এডমিন ক্যাডার রেখেছেন। নইলে এ্যাডমিন ক্যাডার তারা ক্যাডার চয়েজ লিস্টেই রাখতেন না। আমি বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে পুলিশে চাকরি পাওয়ার পরেও আমার শিক্ষক বাবার চোখে আমার কর্মজীবন মোটেও ভালো বলে মনে হয়নি। বহু শিক্ষককে চিনি যারা পুলিশ, এডমিন, ফরেন, ট্যাক্স–সবকিছু বাদ দিয়ে এক নম্বরে শিক্ষা ক্যাডারকেই স্থান দিয়ে শিক্ষকতা করছেন। চাকরি ও পদমর্যাদা দিয়ে মনুষ্যত্ব যাচাই করা অত্যন্ত কঠিন ও ঝূকিপূর্ন একটি কাজ।
সমস্যা কিন্তু পেশায় নয়, সমস্যা মানসিকতার। সমাজে যেমন চিকিৎসকের প্রয়োজন, তেমনি প্রকৌশলী, বিচারক, শিক্ষকেরও প্রয়োজন রয়েছে। এই সমাজে ক্ষমতা ও অর্থকে বেশি মূল্যায়ন করা হয় বলেই ক্ষমতাধর ক্যাডার কর্মকর্তাদের সামাজিক মূল্যে বেশি। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না ক্ষমতা কারো ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। রাষ্ট্রের প্রয়োজনে রাষ্ট্র কিছু মানুষকে এই ক্ষমতা দিয়েছে যাতে সেটার সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে জনগনের সেবা করা যায়। প্রত্যেকটি পেশা একে অপরের পরিপূরক। হালের মহামারী করোনা এসে আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো সমাজে পেশাগুলোর কেমন গুরুত্ব রয়েছে। একদিন ময়লা পরিস্কারওয়ালা না আসলে অবস্থাটা কেমন হবে ভেবে দেখুন তো। একজন বেসরকারি চাকুরে বা ব্যাংকার, একজন সাংবাদিকের ভূমিকা আপনি কিভাবে অস্বীকার করবেন?
প্রশ্ন হলো ভালো ক্যাডার কোনটাকে বলবেন? ফরেন ক্যাডারের কাজ বেশিরভাগই দেশের বাইরে। অনেকেই যেমন দেশের বাইরে কাজ করার কথা ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। তার মানে এই ক্যাডার পঁচে যায়নি। একজন সরকারী কর্মী হওয়া সত্ত্বেও আমার এক সময়ের স্বপ্ন ছিলো ব্যবসায়ী হওয়া! একমাত্র উদ্যেক্তা বা ব্যবসায়ীই পারেন মৌলিক পরিসরে মানুষের সেবা করার পাশাপাশি নিজের আর্থ-সামাজিক উন্নতিতে অবদান রাখতে।
আমার মনে হয় সন্তান জন্মের আগেই তাকে ডাক্তার, প্রকৌশলী, উকিল বানানোর ষড়যন্ত্রকারী অভিভাবকের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত শ্রেনীর। ব্যতিক্রম থাকবেই তবে সেটা সব সময় উদাহরন নয়। অভিভাবক সন্তানকে ডাক্তার বানাতে চান কারন তাঁর চোখে ডাক্তারের অনেক ইমকাম। কিন্তু তিনি যদি জানতেন একজন লেখকের আয় ক্ষেত্রবিশেষে একজন ডাক্তার প্রকৌশলীর চেয়ে ঢের বেশি তাহলে হয়তো তাঁর চিন্তার পরিবর্তন ঘটতো। বেশিরভাগ অভিভাবকের গল্প একই। নইলে সন্তানকে খেলোয়ার, অভিনেতা, ফটোগ্রাফার কিংবা পোল্ট্রি শিল্পের নিয়ন্ত্রক, কাকড়া চাষ, ফুল চাষ বা মধুর মোড়ল তথা উদ্যেক্তা বানাতে অনীহা কোথায়?
মেধাবীরা মূল্যায়ন আদায় করতে জানেন। আমাদের দেশে একজন ডাক্তারের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা এখন যা আছে তার চেয়ে কবে ভালো ছিলো? একজন প্রকৌশলী কবে আজকের চেয়ে ভালো অবস্থায় ছিলেন? সমস্যা হলো একেক সময় একেক রকম ক্রেজ চলে। তরুন সমাজ সেই ক্রেজের স্রোতে গা ভাসান।
ইদানীং বিসিএসের ক্রেজ চলছে। সারাজীবন এই ক্রেজ থাকবে এমনও নয়। যতদিন জোয়ার আছে, তরুন মেধাবীরা বিসিএসে আসতে চাইবেন। তবে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরী না হলে দেশের সামগ্রীক উন্নতি হওয়া কঠিন হয়ে যাবে। তরুনরা যত বেশি সৃজনশীল উদ্যেগে এগিয়ে আসবেন, ব্যবসায় বাণিজ্যে আত্মনিয়োগ করবেন ততদ্রুত দেশ উন্নতির শিখরে পৌছে যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ব্যবসায়ীরা টাকা আয় করেন, সরকারী কর্মচারীরা সেখান থেকে বেতন নেন।
আর আমরা যত বেশি বিসিএস নিয়ে কথা বলি ততটাই অবচেতন মনে কি কোটি কোটি শ্রমজীবী মানুষের অবদান অস্বীকার করছি না? এঁরাই তো আমাদের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছেন। আসুন সামান্য হলেও তাঁদের ত্যাগেরও মূল্যায়ন করি।
লেখক:
সহকারী পুলিশ কমিশনার(এসি মিডিয়া),
মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস ডিভিশন,
ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশ।