আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর হোক

  • Update Time : ০৮:২০:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জুলাই ২০২০
  • / 562

 

মোঃ রবিউল হোসাইন:

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে থাকে।একই পরীক্ষা দিয়ে যারা একই ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা হচ্ছেন তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সুবিচার হচ্ছে তাদের চাকরিতে যোগ্যতাভিত্তিক সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ক্যাডার গুলোতে রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার বৈষম্য। কখনো পদোন্নতি বৈষম্য, কখনো কর্তৃত্ব বৈষম্য আবার কখনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বৈষম্য। তাই আন্তঃক্যাডার বৈষম্য যতদিন দূর হবে না ততদিন বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা সাধারণ ক্যাডারের দিকেই ঝুঁকবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সদ্য প্রকাশিত ৩৮ তম বিসিএসের ফলাফলে দেখা যায় বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা বিশেষ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। যারা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ হন তাঁরা তুলনামূলক অন্য কোন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি মেধাবী এতে কোন সন্দেহ নেই।এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমন কী ঘটে গেল যে এসকল মেধাবী ছেলেমেয়েরা তাদের এবং তাদের বাবা মায়ের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন?

ক্যাডারভিত্তিক বৈষম্যের নানা ধরন রয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রকট হচ্ছে পদোন্নতি বৈষম্য। একই পরীক্ষা দিয়ে,একই দিনে পরীক্ষার ফল পেয়ে, আবার একই দিনে যোগদান করে, ক্যাডার কর্মকর্তারা যদি তাঁদের পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করেন তাহলে তাঁদের একই দিনে পদোন্নতি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না । এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিসিএস শিক্ষা এবং বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

বিসিএস শিক্ষা ছাড়া বাকি ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি হলেও শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি হয় বিষয়ভিত্তিক। অদ্ভুত এই নিয়মের কারণে পদোন্নতিতে চরম বৈষম্য চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে যা দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবরে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতি নিয়মিত প্রক্রিয়া হলেও প্রায় দুই বছর ধরে কোন পদোন্নতি হয়নি শিক্ষা ক্যাডারে। এতদিন এ ক্যাডারে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে ক্যাডার কর্মকর্তাদের মাঝে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখা সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনিক পদ, রিজার্ভ এবং এক বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন এমন পদ ধরে মোট ৫১৫ টি অধ্যাপক, ৩৫৭ টি সহযোগী অধ্যাপক এবং ১১০০ টি সহকারী অধ্যাপকের পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধ্যাপক পদের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছেন ৭৩৮ জন, আর সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য আছেন মোট ৩ হাজার ৬২২ জন। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা আছেন ২ হাজার ৮জন।

যেখানে বিভিন্ন ক্যাডারে ৩৩ তম বিসিএসের কর্মকর্তারা অনেকেই পদোন্নতি পেয়েছেন, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের ২৮,২৯,৩০,৩১,৩২,৩৩ তম বিসিএসের অনেক কর্মকর্তারা এখনো পদোন্নতি পাননি। ফলে এ সকল ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। পদোন্নতি একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য এটা যেন একটা গোলক ধাঁধা! দুই তিনটা বিশেষ ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকলেও নিয়মিতভাবে পদোন্নতি দেয়া হয় কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারসসহ বেশিরভাগ ক্যাডারে শূন্যপদ না থাকলে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। একজন ক্যাডার কর্মকর্তা যখন পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করেন তখন পদোন্নতি তার অধিকার। এই অধিকার কেউ ভোগ করবে আর কাউকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে তা কখনো রাষ্ট্রীয় সুবিচার হতে পারেনা।

শুধু তাই নয়, অন্য ক্যাডারগুলোতে পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হয় কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে চতুর্থ গ্রেডে উন্নীত হয়, যা চরম ক্যাডার বৈষম্য।

অন্যান্য ক্যাডারে স্পেশাল গ্রেড, সুপার গ্রেড ,১ম গ্রেড, ২য় গ্রেড ও ৩য় গ্রেড থাকলেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ গ্রেড হচ্ছে ৪র্থ গ্রেড! ভাবা যায় কী ভয়ানক ক্যাডার বৈষম্য!
শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের গবেষনায় উৎসাহী করার জন্য এম ফিল ও পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করলে পূর্বে একটি ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা ছিল কিন্তু বর্তমানে সেই ইনক্রিমেন্টটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।ফলে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা গবেষনায় উৎসাহী ছিলেন তাঁরা এখন গবেষনায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

শিক্ষা ক্যাডারের জন্য ১২০০০ পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে।৭ বছর ধরে পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চললেও এখনও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।আশির দশকে যে কয়েকটি পদ নিয়ে ক্যাডারটি যাত্রা শুরু করেছিল, এখনো সে পদই রয়েছে।প্রশাসন ক্যাডারে নতুন পদ সৃষ্টিতে যত সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশী সময় লাগে অন্যান্য ক্যাডারের পদ সৃষ্টিতে। পদ সৃষ্টির এই কাজটি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে যে,প্রশাসন ক্যাডারের পদ বৃদ্ধির বিষয়টিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কিনা।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতির জন্য তাদের অতিরিক্ত ডিগ্রী থাকা বাধ্যতামূলক।সব ক্যাডারের জন্য যদি আর কোন উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন না হয় তাহলে স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য কী কারণে উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন হবে? বিসিএস পরীক্ষার সময় যে যোগ্যতার ভিত্তিতে পরীক্ষা হয় তাতে স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেকেই অন্য অনেকের চেয়ে বেশি দিনের শিক্ষাজীবন নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকেন।তারপরও তাঁদের পদোন্নতি পাওয়ার সময় আরো বেশি ডিগ্রী চেয়ে তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, অবহেলা প্রকাশ করা হচ্ছে ।অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তার সমান অথবা অধিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ক্যাডারদের নিয়মিত পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যা হওয়া মোটেও উচিত নয়।

ক্যাডার বৈষম্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নবীন কর্মকর্তাদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং। কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষা ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে যোগ দিতে হয়। ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার সেজে তারা স্বীয় দায়িত্বকরে যান। ফাউন্ডেশন ট্রেনিং না থাকার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেককেই পারিপার্শিক বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।অন্যান্য ক্যাডাররা চাকরির শুরুতেই ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করার সুযোগ পেলেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ৩৫(বেশিরভাগ)তম, ৩৬তম, ও ৩৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা এখনো ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করার সুযোগ পাননি।৩৫ তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের চাকরির ৩ বছর ৩ মাস চললেও তারা ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করার সুযোগ হয়নি। শিক্ষা ক্যাডারে বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার কর্মকর্তা। বাকি অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তা আনুমানিক ১২/১৩ হাজার। ১২/১৩হাজার ক্যাডার কর্মকর্তার জন্য আট-দশটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থাকলেও ১৬ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য মাত্র একটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট! এই ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে আবার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদেরও বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং প্রদান করা হয়।বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী চাকরির দুই বছরের মাথায় স্থায়ীকরণ হওয়ার কথা থাকলেও বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করার পরেও ফাউন্ডেশন ট্রেনিং না থাকার কারণে শিক্ষা ক্যাডারের ৩৫তম,৩৬তম ও, ৩৭তম বিসিএসের কোন কর্মকর্তার চাকরি এখনো স্থায়ীকরণ হয়নি।

বিসিএস শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য সকল ক্যাডারের ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে যারা মেধা তালিকায় স্থান পান তাঁদের জন্য ফরেন ট্যুর বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে যারা মেধা তালিকায় স্থান পান তাঁদের জন্য কোন ফরেন ট্যুর বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না।

বিসিএস শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়তই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত পরীক্ষার হলে নকল ধরতে গিয়ে কিংবা কলেজ ছাত্র নেতাদের সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে বনিবনা না হলে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা একটু উনিশ বিশ হলেই রোগীর আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা হরহামেশাই কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, পিটুনির শিকার হচ্ছেন যেটা আমরা পত্র-পত্রিকায় প্রায়শই দেখছি। সম্প্রতি “গরিবের ডাক্তার” খ্যাত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে ভুল চিকিৎসার অপবাদ দিয়ে রোগীর আত্মীয় স্বজনরা উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করেন।

উপসচিব পদে পদোন্নতিতে সকল ক্যাডারের অধিকার থাকলেও পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে।উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য শতকরা ৭৫ ভাগ এবং অন্যান্য ২৬ ক্যাডারের জন্য ২৫ ভাগ রাখার ফলে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না বরং প্রশাসন ক্যাডারের ৮ থেকে ১০ ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপসচিব করা হচ্ছে।প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য পদোন্নতিতে অলিখিত বিশেষ পদ্ধতি অব্যাহত রেখে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে ক্যাডার বৈষম্য কে দিনকে দিন জিইয়ে রাখা হচ্ছে।

পদোন্নতি সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্ক আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।তাই শিক্ষা ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।দেখা যায় যে, পদোন্নতি বঞ্চিত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা যতদিনে পদোন্নতি পেয়ে ষষ্ঠ গ্রেডে যাচ্ছেন, ততদিনে তাঁর অন্য ক্যাডারের ব্যাচমেটদের স্যালারি স্কেল চতুর্থ বা তৃতীয় গ্রেডের হয়ে যাচ্ছে। একই ব্যাচে যোগদান করা সহকর্মীরাই হয়ে যাচ্ছেন স্যার! হয়তো তাদের টেবিলে ফাইল সাইন করার জন্য সেই শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা কিংবা স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তাকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে!

হাতেগোনা দু’চারটা ক্যাডারে কার লোন, কার মেইন্টেইন্যান্স ভাতা,বাবুর্চি ভাতা, প্রহরি ভাতা, মোবাইল ভাতা, মোবাইল বিল, ইন্টারনেট বিল,গাড়ি সুবিধা ইত্যাদি থাকলেও বেশির ভাগ ক্যাডারে এ সকল সুযোগ চিন্তাও করা যায়না।

অতি সম্প্রতি করোনায় ডা: মঈন স্যারের মৃত্যু ক্যাডার বৈষম্য কে আরো চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।আমরা দেখেছি ডাক্তার মঈনের জন্য একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে হোম কোয়ারেন্টিন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়া ৩৫ তম ব্যাচের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাজী নাজিব হাসান কে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়।দুজনের মধ্যে পার্থক্য হলো একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং আরেকজন স্বাস্থ্য ক্যাডারের! এটা কি চরম আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নয়?

বর্তমানে উপজেলায় যে প্রকৌশলী- চিকিৎসক কিংবা কৃষি কর্মকর্তা থাকেন, তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে থাকেন।এক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করলে স্বাভাবিকভাবে একটা কর্তৃত্ব চলে আসে। প্রশাসন ক্যাডারের একজন তরুন কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হন।অন্যদিকে সেই নিবার্হী কর্মকর্তার অনেক সিনিয়র এবং তার চেয়ে মেধা এবং যোগ্যতায় অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও একজন চিকিৎসক-কৃষিবিদ কিংবা প্রকৌশলী পদোন্নতি না পেয়ে প্রবেশ পদে ই হয়তো থাকেন! জেলা পর্যায়েও একই অবস্থা। এতে করে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তার উপর প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করাটা মোটেও সম্মানজনক হয় না।এই অবস্থার অবসান না হলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কখনোই দূর হবে না।

আরেকটা বিষয়, স্বাস্থ্য সচিব একজন পেশাদার ডাক্তার না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়ে থাকেন।একজন আমলার পক্ষে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব বিষয় ও খুঁটিনাটি জানা অসম্ভব, চিকিৎসার মতো চরম বিশেষায়িত পেশায় তো তা বলাই বাহুল্য। একজন কৃষি সচিব একজন পেশাদার কৃষিবিদ না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়ে থাকেন।একজন কৃষিবিদ কৃষি সংক্রান্ত বিষয়গুলো যেভাবে ভালো করে বুঝবেন, একজন আমলার পক্ষে বিদেশে ৭ দিনের প্রশিক্ষন নিয়ে তা বুঝা কখনো সম্ভব নয়।একজন শিক্ষা সচিব শিক্ষা ক্যাডার থেকে না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়ে থাকেন।একজন শিক্ষাবিদ শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো যেভাবে ঠিক করতে পারবেন, সেভাবে একজন আমলার পক্ষে কখনই তা সম্ভব নয়।

সময় এসেছে এখন চিন্তা করার কেন ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার -কৃষিবিদরা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে জলাঞ্জলী দিয়ে সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন।

লেখক:
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা),৩৫তম ব্যাচ
প্রভাষক, ইংরেজি
রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


আন্তঃক্যাডার বৈষম্য দূর হোক

Update Time : ০৮:২০:২২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৮ জুলাই ২০২০

 

মোঃ রবিউল হোসাইন:

বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে ক্যাডার ভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে থাকে।একই পরীক্ষা দিয়ে যারা একই ব্যাচের বিসিএস কর্মকর্তা হচ্ছেন তাদের প্রতি রাষ্ট্রীয় সুবিচার হচ্ছে তাদের চাকরিতে যোগ্যতাভিত্তিক সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা।কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ক্যাডার গুলোতে রয়েছে বিভিন্ন মাত্রার বৈষম্য। কখনো পদোন্নতি বৈষম্য, কখনো কর্তৃত্ব বৈষম্য আবার কখনো আর্থিক সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত বৈষম্য। তাই আন্তঃক্যাডার বৈষম্য যতদিন দূর হবে না ততদিন বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা সাধারণ ক্যাডারের দিকেই ঝুঁকবেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সদ্য প্রকাশিত ৩৮ তম বিসিএসের ফলাফলে দেখা যায় বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীরা বিশেষ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন বেশি। যারা প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ হন তাঁরা তুলনামূলক অন্য কোন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের চেয়ে বেশি মেধাবী এতে কোন সন্দেহ নেই।এখন প্রশ্ন হচ্ছে এমন কী ঘটে গেল যে এসকল মেধাবী ছেলেমেয়েরা তাদের এবং তাদের বাবা মায়ের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের পেশাকে জলাঞ্জলি দিয়ে সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন?

ক্যাডারভিত্তিক বৈষম্যের নানা ধরন রয়েছে। তবে সবচেয়ে প্রকট হচ্ছে পদোন্নতি বৈষম্য। একই পরীক্ষা দিয়ে,একই দিনে পরীক্ষার ফল পেয়ে, আবার একই দিনে যোগদান করে, ক্যাডার কর্মকর্তারা যদি তাঁদের পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করেন তাহলে তাঁদের একই দিনে পদোন্নতি হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না । এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বিসিএস শিক্ষা এবং বিসিএস স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা।

বিসিএস শিক্ষা ছাড়া বাকি ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি হলেও শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতি হয় বিষয়ভিত্তিক। অদ্ভুত এই নিয়মের কারণে পদোন্নতিতে চরম বৈষম্য চলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে যা দিন দিন আরো প্রকট হচ্ছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের অক্টোবরে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। পদোন্নতি নিয়মিত প্রক্রিয়া হলেও প্রায় দুই বছর ধরে কোন পদোন্নতি হয়নি শিক্ষা ক্যাডারে। এতদিন এ ক্যাডারে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তাদের পদোন্নতি না হওয়ায় তীব্র ক্ষোভ এবং অসন্তোষ বিরাজ করছে ক্যাডার কর্মকর্তাদের মাঝে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কলেজ শাখা সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনিক পদ, রিজার্ভ এবং এক বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন এমন পদ ধরে মোট ৫১৫ টি অধ্যাপক, ৩৫৭ টি সহযোগী অধ্যাপক এবং ১১০০ টি সহকারী অধ্যাপকের পদ শূন্য রয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় অধ্যাপক পদের জন্য বেশ কয়েক বছর ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছেন ৭৩৮ জন, আর সহযোগী অধ্যাপক পদের জন্য আছেন মোট ৩ হাজার ৬২২ জন। সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির যোগ্য কর্মকর্তা আছেন ২ হাজার ৮জন।

যেখানে বিভিন্ন ক্যাডারে ৩৩ তম বিসিএসের কর্মকর্তারা অনেকেই পদোন্নতি পেয়েছেন, সেখানে শিক্ষা ক্যাডারের ২৮,২৯,৩০,৩১,৩২,৩৩ তম বিসিএসের অনেক কর্মকর্তারা এখনো পদোন্নতি পাননি। ফলে এ সকল ব্যাচের শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা যেমন আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন তেমনি প্রতিনিয়ত সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছেন। পদোন্নতি একটা নিয়মিত প্রক্রিয়া হলেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য এটা যেন একটা গোলক ধাঁধা! দুই তিনটা বিশেষ ক্যাডারে শূন্য পদ না থাকলেও নিয়মিতভাবে পদোন্নতি দেয়া হয় কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারসসহ বেশিরভাগ ক্যাডারে শূন্যপদ না থাকলে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। একজন ক্যাডার কর্মকর্তা যখন পদোন্নতির সকল শর্ত পূরণ করেন তখন পদোন্নতি তার অধিকার। এই অধিকার কেউ ভোগ করবে আর কাউকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হবে তা কখনো রাষ্ট্রীয় সুবিচার হতে পারেনা।

শুধু তাই নয়, অন্য ক্যাডারগুলোতে পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত হয় কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে পঞ্চম গ্রেড থেকে পদোন্নতি পেয়ে চতুর্থ গ্রেডে উন্নীত হয়, যা চরম ক্যাডার বৈষম্য।

অন্যান্য ক্যাডারে স্পেশাল গ্রেড, সুপার গ্রেড ,১ম গ্রেড, ২য় গ্রেড ও ৩য় গ্রেড থাকলেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ গ্রেড হচ্ছে ৪র্থ গ্রেড! ভাবা যায় কী ভয়ানক ক্যাডার বৈষম্য!
শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের গবেষনায় উৎসাহী করার জন্য এম ফিল ও পি এইচ ডি ডিগ্রি অর্জন করলে পূর্বে একটি ইনক্রিমেন্টের ব্যবস্থা ছিল কিন্তু বর্তমানে সেই ইনক্রিমেন্টটি উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।ফলে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা গবেষনায় উৎসাহী ছিলেন তাঁরা এখন গবেষনায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।

শিক্ষা ক্যাডারের জন্য ১২০০০ পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৪ সালে।৭ বছর ধরে পদ সৃষ্টির প্রক্রিয়া চললেও এখনও সেটি আলোর মুখ দেখেনি।আশির দশকে যে কয়েকটি পদ নিয়ে ক্যাডারটি যাত্রা শুরু করেছিল, এখনো সে পদই রয়েছে।প্রশাসন ক্যাডারে নতুন পদ সৃষ্টিতে যত সময় লাগে, তার চেয়ে অনেক বেশী সময় লাগে অন্যান্য ক্যাডারের পদ সৃষ্টিতে। পদ সৃষ্টির এই কাজটি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে যে,প্রশাসন ক্যাডারের পদ বৃদ্ধির বিষয়টিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে কিনা।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য ক্যাডারের পদোন্নতির জন্য তাদের অতিরিক্ত ডিগ্রী থাকা বাধ্যতামূলক।সব ক্যাডারের জন্য যদি আর কোন উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন না হয় তাহলে স্বাস্থ্য ক্যাডারের জন্য কী কারণে উচ্চতর ডিগ্রির প্রয়োজন হবে? বিসিএস পরীক্ষার সময় যে যোগ্যতার ভিত্তিতে পরীক্ষা হয় তাতে স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেকেই অন্য অনেকের চেয়ে বেশি দিনের শিক্ষাজীবন নিয়ে পরীক্ষা দিয়ে থাকেন।তারপরও তাঁদের পদোন্নতি পাওয়ার সময় আরো বেশি ডিগ্রী চেয়ে তাদের প্রতি অবিচার করা হচ্ছে, অবহেলা প্রকাশ করা হচ্ছে ।অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তার সমান অথবা অধিক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য ক্যাডারদের নিয়মিত পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে যা হওয়া মোটেও উচিত নয়।

ক্যাডার বৈষম্যের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নবীন কর্মকর্তাদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং। কোন ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই শিক্ষা ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কর্মস্থলে যোগ দিতে হয়। ঢাল তলোয়ারহীন নিধিরাম সর্দার সেজে তারা স্বীয় দায়িত্বকরে যান। ফাউন্ডেশন ট্রেনিং না থাকার কারণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের অনেককেই পারিপার্শিক বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।অন্যান্য ক্যাডাররা চাকরির শুরুতেই ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করার সুযোগ পেলেও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের ৩৫(বেশিরভাগ)তম, ৩৬তম, ও ৩৭তম ব্যাচের কর্মকর্তারা এখনো ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করার সুযোগ পাননি।৩৫ তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের চাকরির ৩ বছর ৩ মাস চললেও তারা ফাউন্ডেশন ট্রেনিং করার সুযোগ হয়নি। শিক্ষা ক্যাডারে বর্তমানে প্রায় ১৬ হাজার কর্মকর্তা। বাকি অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তা আনুমানিক ১২/১৩ হাজার। ১২/১৩হাজার ক্যাডার কর্মকর্তার জন্য আট-দশটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট থাকলেও ১৬ হাজার ক্যাডার কর্মকর্তাদের জন্য মাত্র একটা ট্রেনিং ইন্সটিটিউট! এই ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে আবার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষকদেরও বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং প্রদান করা হয়।বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী চাকরির দুই বছরের মাথায় স্থায়ীকরণ হওয়ার কথা থাকলেও বিভাগীয় পরীক্ষায় পাশ করার পরেও ফাউন্ডেশন ট্রেনিং না থাকার কারণে শিক্ষা ক্যাডারের ৩৫তম,৩৬তম ও, ৩৭তম বিসিএসের কোন কর্মকর্তার চাকরি এখনো স্থায়ীকরণ হয়নি।

বিসিএস শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডার ছাড়া অন্যান্য সকল ক্যাডারের ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে যারা মেধা তালিকায় স্থান পান তাঁদের জন্য ফরেন ট্যুর বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে যারা মেধা তালিকায় স্থান পান তাঁদের জন্য কোন ফরেন ট্যুর বা বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না।

বিসিএস শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়তই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগেন। শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত পরীক্ষার হলে নকল ধরতে গিয়ে কিংবা কলেজ ছাত্র নেতাদের সাথে বিভিন্ন ব্যাপারে বনিবনা না হলে তাদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। অন্যদিকে স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা একটু উনিশ বিশ হলেই রোগীর আত্মীয় স্বজনদের দ্বারা হরহামেশাই কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, পিটুনির শিকার হচ্ছেন যেটা আমরা পত্র-পত্রিকায় প্রায়শই দেখছি। সম্প্রতি “গরিবের ডাক্তার” খ্যাত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে ভুল চিকিৎসার অপবাদ দিয়ে রোগীর আত্মীয় স্বজনরা উপর্যুপরি আঘাত করে হত্যা করেন।

উপসচিব পদে পদোন্নতিতে সকল ক্যাডারের অধিকার থাকলেও পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে।উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের জন্য শতকরা ৭৫ ভাগ এবং অন্যান্য ২৬ ক্যাডারের জন্য ২৫ ভাগ রাখার ফলে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে উপসচিব পদে পদোন্নতি পাচ্ছেন না বরং প্রশাসন ক্যাডারের ৮ থেকে ১০ ব্যাচ জুনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তাদের উপসচিব করা হচ্ছে।প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের জন্য পদোন্নতিতে অলিখিত বিশেষ পদ্ধতি অব্যাহত রেখে অন্যান্য ক্যাডার কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করে ক্যাডার বৈষম্য কে দিনকে দিন জিইয়ে রাখা হচ্ছে।

পদোন্নতি সঙ্গে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা সম্পর্ক আছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।তাই শিক্ষা ক্যাডার এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা প্রতিনিয়ত নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।দেখা যায় যে, পদোন্নতি বঞ্চিত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা যতদিনে পদোন্নতি পেয়ে ষষ্ঠ গ্রেডে যাচ্ছেন, ততদিনে তাঁর অন্য ক্যাডারের ব্যাচমেটদের স্যালারি স্কেল চতুর্থ বা তৃতীয় গ্রেডের হয়ে যাচ্ছে। একই ব্যাচে যোগদান করা সহকর্মীরাই হয়ে যাচ্ছেন স্যার! হয়তো তাদের টেবিলে ফাইল সাইন করার জন্য সেই শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা কিংবা স্বাস্থ্য ক্যাডার কর্মকর্তাকেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হবে!

হাতেগোনা দু’চারটা ক্যাডারে কার লোন, কার মেইন্টেইন্যান্স ভাতা,বাবুর্চি ভাতা, প্রহরি ভাতা, মোবাইল ভাতা, মোবাইল বিল, ইন্টারনেট বিল,গাড়ি সুবিধা ইত্যাদি থাকলেও বেশির ভাগ ক্যাডারে এ সকল সুযোগ চিন্তাও করা যায়না।

অতি সম্প্রতি করোনায় ডা: মঈন স্যারের মৃত্যু ক্যাডার বৈষম্য কে আরো চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে।আমরা দেখেছি ডাক্তার মঈনের জন্য একটা এয়ার অ্যাম্বুলেন্স এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে হোম কোয়ারেন্টিন ও সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হওয়া ৩৫ তম ব্যাচের সহকারী কমিশনার (ভূমি) কাজী নাজিব হাসান কে উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনা হয়।দুজনের মধ্যে পার্থক্য হলো একজন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা এবং আরেকজন স্বাস্থ্য ক্যাডারের! এটা কি চরম আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নয়?

বর্তমানে উপজেলায় যে প্রকৌশলী- চিকিৎসক কিংবা কৃষি কর্মকর্তা থাকেন, তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অধীনে থাকেন।এক ক্যাডারের কর্মকর্তাকে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণ করলে স্বাভাবিকভাবে একটা কর্তৃত্ব চলে আসে। প্রশাসন ক্যাডারের একজন তরুন কর্মকর্তা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হন।অন্যদিকে সেই নিবার্হী কর্মকর্তার অনেক সিনিয়র এবং তার চেয়ে মেধা এবং যোগ্যতায় অনেক বেশি থাকা সত্ত্বেও একজন চিকিৎসক-কৃষিবিদ কিংবা প্রকৌশলী পদোন্নতি না পেয়ে প্রবেশ পদে ই হয়তো থাকেন! জেলা পর্যায়েও একই অবস্থা। এতে করে অন্য ক্যাডারের কর্মকর্তার উপর প্রশাসনিক ক্ষমতা প্রয়োগ করাটা মোটেও সম্মানজনক হয় না।এই অবস্থার অবসান না হলে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য কখনোই দূর হবে না।

আরেকটা বিষয়, স্বাস্থ্য সচিব একজন পেশাদার ডাক্তার না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়ে থাকেন।একজন আমলার পক্ষে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সব বিষয় ও খুঁটিনাটি জানা অসম্ভব, চিকিৎসার মতো চরম বিশেষায়িত পেশায় তো তা বলাই বাহুল্য। একজন কৃষি সচিব একজন পেশাদার কৃষিবিদ না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়ে থাকেন।একজন কৃষিবিদ কৃষি সংক্রান্ত বিষয়গুলো যেভাবে ভালো করে বুঝবেন, একজন আমলার পক্ষে বিদেশে ৭ দিনের প্রশিক্ষন নিয়ে তা বুঝা কখনো সম্ভব নয়।একজন শিক্ষা সচিব শিক্ষা ক্যাডার থেকে না হয়ে প্রশাসন ক্যাডার থেকেই হয়ে থাকেন।একজন শিক্ষাবিদ শিক্ষা সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো যেভাবে ঠিক করতে পারবেন, সেভাবে একজন আমলার পক্ষে কখনই তা সম্ভব নয়।

সময় এসেছে এখন চিন্তা করার কেন ডাক্তার- ইঞ্জিনিয়ার -কৃষিবিদরা তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নকে জলাঞ্জলী দিয়ে সাধারণ ক্যাডারের দিকে ঝুঁকছেন।

লেখক:
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা),৩৫তম ব্যাচ
প্রভাষক, ইংরেজি
রাঙ্গামাটি সরকারি মহিলা কলেজ।