লকডাউন কেন ও কীভাবে

  • Update Time : ০৬:৫৪:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুন ২০২০
  • / 211

 

রুমী আহমেদ খান:

লকডাউন করলে কি সব ভাইরাস মরে যাবে আর না করলে বেঁচে থাকবে?
ব্যাপারটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। আমাদের বুঝতে হবে যে লকডাউন হচ্ছে চেয়ারের একটি পা–এর মতো। এর সঙ্গে আরও তিনটা পা থাকলেই চেয়ারটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। লকডাউন একা একা কখনোই কাজ করে না—এর সঙ্গে আরও কিছু পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিলেই ভাইরাস বা যেকোনো মহামারির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

লকডাউন যা করে তা হচ্ছে সংক্রমণের হার বৃদ্ধিকে কমায়। সংক্রমণ বাড়ার কার্ভটিকে সোজা করে দেয়। যেমন ধরুন, চট্টগ্রাম শহরে ১০ লাখ লোক একই সঙ্গে সংক্রমিত হলো, তার ২০ শতাংশ মানে ২ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করার এবং ৫০ হাজার মানুষকে আইসিইউতে ভর্তি করার প্রয়োজন দেখা দেবে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে যদি তা হয়, তবে চট্টগ্রাম কেন বিশ্বের কোনো শহরের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাই এর চাপ নিতে পারবে না। কারণ এত জরুরি রোগীর একসঙ্গে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা কার্যত অসম্ভব। এমন কিছু যদি ঘটে তবে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটবে এবং তা ঠেকানো যাবে না।

এমন পরিস্থিতি যাতে না হয়, সে জন্যই সংক্রমণের গতি কমাতে মহামারি বিশেষজ্ঞরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও লকডাউন কার্যকর করার পরামর্শ দেন। এই লকডাউনের সময়টা সরকার বা কর্তৃপক্ষ ব্যয় করবে সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে। যেমন পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো, হাসপাতালের শয্যা, আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিন্ত করা, চিকিৎসক–নার্সদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পিপিই নিশ্চিন্ত করা। লকডাউন চেয়ারের একটা পা হলে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিন্ত করা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুত করার বিষয়টি হচ্ছে বাকি তিনটি পা।

একটা কার্যকর লকডাউন নিশ্চিত করা গেলে ১০ লাখ মানুষের সংক্রমণ এক সপ্তাহে না হয়ে তাকে প্রলম্বিত করা যাবে। ৭ দিনে ৫০ হাজার মানুষকে আইসিউতে সেবা দেওয়া আর আর ৫ মাসে সেই সেবা দেওয়া এক কথা নয়। লম্বা সময় পাওয়া গেলে হাসপাতালগুলো প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাবে, চাপ কম হবে, রোগীরা ভালো চিকিৎসাসেবা পাবে এবং মৃত্যুর হার কমবে।

কিন্তু প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি না করে লকডাউন দেওয়া ও খুলে দেওয়ার ফলে যা হবে তা হচ্ছে, তা আমরা জলোচ্ছ্বাসের মতো মহামারির এই স্রোতটিকে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে নিয়ে যাব। জুনের বদলে আগস্টে একই সঙ্গে অনেক রোগীর চাপ বাড়বে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু সামর্থ্য তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এই রোগীর চাপ নিতে পারবে না।

যখন মহামারি কোথাও আঘাত হানে, প্রথম ধাক্কায় মৃত্যুর হার খুব বেশি হয় এবং বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দ্রুত এই মৃত্যুর হার কমতে থাকে। চীনে দেখেছি জানুয়ারি মাসে যেখানে মৃত্যুর হার ছিল ২৫ শতাংশ, দুমাস পরে সেই মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আমরাও আমাদের এখানে তাই দেখছি। এখন কয়েক সপ্তাহ ধরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও আইসিইউতে কম রোগীকেই নিতে হচ্ছে। কেন? ভাইরাস কি দুর্বল হয়ে গেল?

আসলে তা না, ভাইরাস ভাইরাসের মতোই আছে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবল হয়েছে। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্তরা ভালো সুরক্ষা পাচ্ছেন। জনগণ সচেতন হয়েছেন, লক্ষণগুলোর দিকে তাঁরা খেয়াল রাখছেন। যথাসময়ে পরীক্ষার চেষ্টা করেছেন ও হাসপাতলে আসছেন। অন্যদিকে গত ছয় মাসে আমরা এই রোগের চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি, এখন অনেক জটিল রোগীকে বা জটিল অবস্থাকে আমরা মোকাবিলা করতে পারছি।

এই ভাইরাস কোনো শহরে আজীবন তাণ্ডব চালিয়ে যাবে না। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে মহামারির সুনামি চলছে, মাস দুয়েক পর হয়তো অন্য শহরে গিয়ে আঘাত হানবে। প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সংক্রমণের হার কমানোর জন্য কী করছে এখন? অন্য শহরগুলো কি প্রস্তুত হচ্ছে? সামর্থ্য বাড়ানো হচ্ছে। আমরা নাগরিকেরা সবাই কি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি উঁচুর দিকে ওঠা সংক্রমণের কার্ভটি ফ্ল্যাট করা ও প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনের জন্য?

রুমী আহমেদ খান, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত এবং ট্রেনিং প্রোগ্রামের পরিচালক। মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


লকডাউন কেন ও কীভাবে

Update Time : ০৬:৫৪:৩৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ জুন ২০২০

 

রুমী আহমেদ খান:

লকডাউন করলে কি সব ভাইরাস মরে যাবে আর না করলে বেঁচে থাকবে?
ব্যাপারটার একটু ব্যাখ্যা দরকার। আমাদের বুঝতে হবে যে লকডাউন হচ্ছে চেয়ারের একটি পা–এর মতো। এর সঙ্গে আরও তিনটা পা থাকলেই চেয়ারটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে। লকডাউন একা একা কখনোই কাজ করে না—এর সঙ্গে আরও কিছু পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিলেই ভাইরাস বা যেকোনো মহামারির বিরুদ্ধে একটি কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়।

লকডাউন যা করে তা হচ্ছে সংক্রমণের হার বৃদ্ধিকে কমায়। সংক্রমণ বাড়ার কার্ভটিকে সোজা করে দেয়। যেমন ধরুন, চট্টগ্রাম শহরে ১০ লাখ লোক একই সঙ্গে সংক্রমিত হলো, তার ২০ শতাংশ মানে ২ লাখ মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করার এবং ৫০ হাজার মানুষকে আইসিইউতে ভর্তি করার প্রয়োজন দেখা দেবে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে যদি তা হয়, তবে চট্টগ্রাম কেন বিশ্বের কোনো শহরের চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থাই এর চাপ নিতে পারবে না। কারণ এত জরুরি রোগীর একসঙ্গে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা কার্যত অসম্ভব। এমন কিছু যদি ঘটে তবে অনেক মানুষের মৃত্যু ঘটবে এবং তা ঠেকানো যাবে না।

এমন পরিস্থিতি যাতে না হয়, সে জন্যই সংক্রমণের গতি কমাতে মহামারি বিশেষজ্ঞরা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও লকডাউন কার্যকর করার পরামর্শ দেন। এই লকডাউনের সময়টা সরকার বা কর্তৃপক্ষ ব্যয় করবে সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজে। যেমন পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো, হাসপাতালের শয্যা, আইসিইউর সংখ্যা বাড়ানো, পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিন্ত করা, চিকিৎসক–নার্সদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া, তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পিপিই নিশ্চিন্ত করা। লকডাউন চেয়ারের একটা পা হলে এই সক্ষমতা বৃদ্ধি, অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিন্ত করা, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুত করার বিষয়টি হচ্ছে বাকি তিনটি পা।

একটা কার্যকর লকডাউন নিশ্চিত করা গেলে ১০ লাখ মানুষের সংক্রমণ এক সপ্তাহে না হয়ে তাকে প্রলম্বিত করা যাবে। ৭ দিনে ৫০ হাজার মানুষকে আইসিউতে সেবা দেওয়া আর আর ৫ মাসে সেই সেবা দেওয়া এক কথা নয়। লম্বা সময় পাওয়া গেলে হাসপাতালগুলো প্রস্তুতি নেওয়ার সময় পাবে, চাপ কম হবে, রোগীরা ভালো চিকিৎসাসেবা পাবে এবং মৃত্যুর হার কমবে।

কিন্তু প্রয়োজনীয় সক্ষমতা তৈরি না করে লকডাউন দেওয়া ও খুলে দেওয়ার ফলে যা হবে তা হচ্ছে, তা আমরা জলোচ্ছ্বাসের মতো মহামারির এই স্রোতটিকে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে অগাস্টের প্রথম সপ্তাহে নিয়ে যাব। জুনের বদলে আগস্টে একই সঙ্গে অনেক রোগীর চাপ বাড়বে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু সামর্থ্য তৈরি না হওয়ায় স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা এই রোগীর চাপ নিতে পারবে না।

যখন মহামারি কোথাও আঘাত হানে, প্রথম ধাক্কায় মৃত্যুর হার খুব বেশি হয় এবং বিদ্যমান চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রথম ধাক্কা সামলে নিয়ে সংগঠিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারলে দ্রুত এই মৃত্যুর হার কমতে থাকে। চীনে দেখেছি জানুয়ারি মাসে যেখানে মৃত্যুর হার ছিল ২৫ শতাংশ, দুমাস পরে সেই মৃত্যুর হার শূন্য দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। আমরাও আমাদের এখানে তাই দেখছি। এখন কয়েক সপ্তাহ ধরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলেও আইসিইউতে কম রোগীকেই নিতে হচ্ছে। কেন? ভাইরাস কি দুর্বল হয়ে গেল?

আসলে তা না, ভাইরাস ভাইরাসের মতোই আছে, আমাদের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সবল হয়েছে। চিকিৎসাসেবার সঙ্গে যুক্তরা ভালো সুরক্ষা পাচ্ছেন। জনগণ সচেতন হয়েছেন, লক্ষণগুলোর দিকে তাঁরা খেয়াল রাখছেন। যথাসময়ে পরীক্ষার চেষ্টা করেছেন ও হাসপাতলে আসছেন। অন্যদিকে গত ছয় মাসে আমরা এই রোগের চিকিৎসাসংক্রান্ত বিষয়ে অনেক কিছু জেনেছি, এখন অনেক জটিল রোগীকে বা জটিল অবস্থাকে আমরা মোকাবিলা করতে পারছি।

এই ভাইরাস কোনো শহরে আজীবন তাণ্ডব চালিয়ে যাবে না। এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামে মহামারির সুনামি চলছে, মাস দুয়েক পর হয়তো অন্য শহরে গিয়ে আঘাত হানবে। প্রশ্ন হচ্ছে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সংক্রমণের হার কমানোর জন্য কী করছে এখন? অন্য শহরগুলো কি প্রস্তুত হচ্ছে? সামর্থ্য বাড়ানো হচ্ছে। আমরা নাগরিকেরা সবাই কি আমাদের দায়িত্ব পালন করছি উঁচুর দিকে ওঠা সংক্রমণের কার্ভটি ফ্ল্যাট করা ও প্রয়োজনীয় সক্ষমতা অর্জনের জন্য?

রুমী আহমেদ খান, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডো রিজিওনাল মেডিকেল সেন্টারে কর্মরত এবং ট্রেনিং প্রোগ্রামের পরিচালক। মেডিসিনের (রেসপিরেটরি ও আইসিইউ) সহযোগী অধ্যাপক।