একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে লেবানন

  • Update Time : ০৬:৪১:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ অগাস্ট ২০২০
  • / 140
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল নাগাদ চলা গৃহযুদ্ধ অনেক আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সুশাসনের অভাব আর দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে দশকের পর দশক ধরে ভুগছে দেশটির মানুষ। সিরিয়া আর ইসরায়েলের আধিপত্য তো আছেই। এ দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দারিদ্র্য, বেকারত্ব।

গতবছর (২০১৯ সাল) বিপর্যয় দেখা দেয় লেবাননের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়। ডলারের বিপরীতে লিরার মান কমে ৮০ শতাংশ। একদিকে সিরিয়া সীমান্ত, অন্যদিকে ইসরায়েল সীমান্ত, এর মাঝে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এ দেশটির মূল্যস্ফীতি সে সময় অনেক বেড়ে যায়। করোনা মহামারীরূপ ধারণ করার আগেই বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০২০ সালে লেবাননের ৪৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে যাবে।

করোনা মহামারীর আগে থেকেই মন্দার মুখে ছিলো লেবাননের অর্থনীতি। আর এই বিপর্যয়ের মধ্যে রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আরও কঠিন সংকটের মুখ পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। বৈরুতের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে, থমকে গেছে পর্যটন খাত। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় থমকে আছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। আর্থিক সহায়তা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতিতে দিশেহারা দেশটির সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউরোপ আর গাল্ফভুক্ত দেশগুলো। জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পাঠিয়েছে খাদ্য সহায়তা।

সহায়তা দিতে এসে জাতিসংঘের খাদ্য প্রকল্পের মুখপাত্র জানান, ট্রাজেডির আগে থেকেই এখানকার ১০ লাখ মানুষ অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছিলো। মধ্যবিত্ত কিন্তু চাকরি নেই এমন অনেক পরিবারের ভোগান্তি ছিলো চরমে। কারণ খাবারের দাম বেশি, কিন্তু ডলারের বিপরীতে লেবানিজ লিরার মান কম। এর মধ্যে এই বিস্ফোরণ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

দেশটির অর্থমন্ত্রী জানান, বিস্ফোরণে বৈরুতের সব অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষতি হয়েছে। সব ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, সেই বন্দরই দেশটির প্রধান সমুদ্রবন্দর। আমদানি নির্ভর এ দেশের ৬০ শতাংশ আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয় এ বন্দর দিয়ে। দেশের ৬০ লাখ মানুষের খাদ্যের বড় যোগান আসে এ বন্দর দিয়েই।

মার্চেই কিছু ঋণ পরিশোধেও ব্যর্থ হয় লেবানন সরকার। দেশটির ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমায় ঋণ মান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস। মুডিস কর্তৃপক্ষ জানায়, এ দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ অস্থিতিশীল পর্যায়ে চলে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগামী ৫ বছরের জন্য সুদমুক্ত ঋণ দিতে ব্যবসায়ীদের, যেন তারা ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

দেশটিকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। যদিও এর আগে লেবানন আইএমএফ’র কাছ থেকে ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চাইলেও সেই আলোচনা থমকে ছিলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পুর্বাভাস ছিলো, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজারে ধস আর কোভিড নাইনটিনের কারণে চলতি বছর দেশটির অর্থনীতি ১২ শতাংশ সংকুচিত হবে। যা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

স্বেচ্ছাসেবীরা বলছেন, আপাতত জরুরি খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বন্দরটিই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এখনো বোঝা যাচ্ছে না, কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এ বন্দর দিয়ে সহজে পণ্য আনা যায়। চেষ্টা করা হবে এই বন্দরই ব্যবহার করতে। বেশি জরুরি হলে ত্রিপোলি বন্দরও ব্যবহার করার সুযোগ আছে।

ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির পর্যটন খাতও। বৈরুতের ৯০ শতাংশ হোটেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ বিস্ফোরণে। ২০১৮ সালে দেশটির মোট জিডিপির এক পঞ্চমাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে। সে বছর ২০ লাখ পর্যটক এসেছে দেশটিতে। হোটেল মোটেল খোলা থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা আর করোনার কারণে বুকিংয়ের হার ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কম ছিলো। এবার তো ধ্বংসস্তুপ বৈরুতের একাংশ। আর্থিক সংকটে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় নিয়ে দিশেহারা লেবানন।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


একের পর এক বিপর্যয়ের মুখে লেবানন

Update Time : ০৬:৪১:২৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৭ অগাস্ট ২০২০
আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল নাগাদ চলা গৃহযুদ্ধ অনেক আগেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের অর্থনীতিকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সুশাসনের অভাব আর দুর্নীতিতে জর্জরিত হয়ে দশকের পর দশক ধরে ভুগছে দেশটির মানুষ। সিরিয়া আর ইসরায়েলের আধিপত্য তো আছেই। এ দেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দারিদ্র্য, বেকারত্ব।

গতবছর (২০১৯ সাল) বিপর্যয় দেখা দেয় লেবাননের ব্যাংকিং ব্যবস্থায়। ডলারের বিপরীতে লিরার মান কমে ৮০ শতাংশ। একদিকে সিরিয়া সীমান্ত, অন্যদিকে ইসরায়েল সীমান্ত, এর মাঝে ভূমধ্যসাগরের তীরে অবস্থিত এ দেশটির মূল্যস্ফীতি সে সময় অনেক বেড়ে যায়। করোনা মহামারীরূপ ধারণ করার আগেই বিশ্বব্যাংক জানায়, ২০২০ সালে লেবাননের ৪৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে যাবে।

করোনা মহামারীর আগে থেকেই মন্দার মুখে ছিলো লেবাননের অর্থনীতি। আর এই বিপর্যয়ের মধ্যে রাজধানী বৈরুতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে আরও কঠিন সংকটের মুখ পড়েছে দেশটির অর্থনীতি। বৈরুতের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে স্থবিরতা নেমে এসেছে, থমকে গেছে পর্যটন খাত। দেশের সবচেয়ে বড় সমুদ্রবন্দরটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় থমকে আছে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য। আর্থিক সহায়তা নিয়ে ক্ষয়ক্ষতিতে দিশেহারা দেশটির সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে ইউরোপ আর গাল্ফভুক্ত দেশগুলো। জাতিসংঘের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও পাঠিয়েছে খাদ্য সহায়তা।

সহায়তা দিতে এসে জাতিসংঘের খাদ্য প্রকল্পের মুখপাত্র জানান, ট্রাজেডির আগে থেকেই এখানকার ১০ লাখ মানুষ অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছিলো। মধ্যবিত্ত কিন্তু চাকরি নেই এমন অনেক পরিবারের ভোগান্তি ছিলো চরমে। কারণ খাবারের দাম বেশি, কিন্তু ডলারের বিপরীতে লেবানিজ লিরার মান কম। এর মধ্যে এই বিস্ফোরণ মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা।

দেশটির অর্থমন্ত্রী জানান, বিস্ফোরণে বৈরুতের সব অ্যাপার্টমেন্টের ক্ষতি হয়েছে। সব ব্যবসাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যে বন্দরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে, সেই বন্দরই দেশটির প্রধান সমুদ্রবন্দর। আমদানি নির্ভর এ দেশের ৬০ শতাংশ আমদানি কার্যক্রম সম্পন্ন হয় এ বন্দর দিয়ে। দেশের ৬০ লাখ মানুষের খাদ্যের বড় যোগান আসে এ বন্দর দিয়েই।

মার্চেই কিছু ঋণ পরিশোধেও ব্যর্থ হয় লেবানন সরকার। দেশটির ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমায় ঋণ মান নির্ণয়কারী সংস্থা মুডিস। মুডিস কর্তৃপক্ষ জানায়, এ দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ অস্থিতিশীল পর্যায়ে চলে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আগামী ৫ বছরের জন্য সুদমুক্ত ঋণ দিতে ব্যবসায়ীদের, যেন তারা ক্ষতি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে।

দেশটিকে সব ধরনের সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল। যদিও এর আগে লেবানন আইএমএফ’র কাছ থেকে ১ হাজার কোটি ডলার ঋণ সহায়তা চাইলেও সেই আলোচনা থমকে ছিলো। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পুর্বাভাস ছিলো, খাদ্যে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাবাজারে ধস আর কোভিড নাইনটিনের কারণে চলতি বছর দেশটির অর্থনীতি ১২ শতাংশ সংকুচিত হবে। যা মধ্যপ্রাচ্য কিংবা এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক বেশি।

স্বেচ্ছাসেবীরা বলছেন, আপাতত জরুরি খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি বন্দরটিই বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এখনো বোঝা যাচ্ছে না, কি পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। এ বন্দর দিয়ে সহজে পণ্য আনা যায়। চেষ্টা করা হবে এই বন্দরই ব্যবহার করতে। বেশি জরুরি হলে ত্রিপোলি বন্দরও ব্যবহার করার সুযোগ আছে।

ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশটির পর্যটন খাতও। বৈরুতের ৯০ শতাংশ হোটেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ বিস্ফোরণে। ২০১৮ সালে দেশটির মোট জিডিপির এক পঞ্চমাংশ এসেছে পর্যটন খাত থেকে। সে বছর ২০ লাখ পর্যটক এসেছে দেশটিতে। হোটেল মোটেল খোলা থাকলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা আর করোনার কারণে বুকিংয়ের হার ৫ থেকে ১৫ শতাংশ কম ছিলো। এবার তো ধ্বংসস্তুপ বৈরুতের একাংশ। আর্থিক সংকটে ভবিষ্যৎ বিপর্যয় নিয়ে দিশেহারা লেবানন।