যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ২৫২ বাড়ি
- Update Time : ০৮:২৯:০৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩
- / 401
নিজস্ব প্রতিবেদক
বাংলাদেশ থেকে টাকা পাচার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৫২টি বাড়ি কিনেছেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন একটা তালিকা সরকারের হাতে রয়েছে। এই তালিকায় অন্তত ৩০-৩৫ জন পুলিশের ওসি (ইন্সপেক্টর) রয়েছেন। এদের কারো কারো আবার সেখানে একাধিক বাড়ি রয়েছে। এ বিষয়টি নিয়ে কয়েকমাস ধরে তদন্ত করছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
টাকা পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে যারা বাড়ি কিনেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এই তালিকায় সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা ছাড়াও পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাও রয়েছেন। তারা বর্তমানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে রয়েছেন।
বিগত সরকারগুলোর আমলেও আমলা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ সরকারি অনেক কর্মকর্তা বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। তখনো কয়েকশো সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর তালিকা প্রকাশ করা হয়েছিল, যারা বিদেশে টাকা পাচার করেছিলেন। তাদের মধ্যে অনেকেই এখন সেসব বাড়িতে অবস্থান করে দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারি সংসদে দাবি জানিয়েছিলেন, বিদেশে যাদের বাড়ি-গাড়ি আছে এমন আমলাদের তালিকা সংসদে প্রকাশ করা হোক। তখন তিনি বলেছিলেন, গণমাধ্যমে এসেছে আমলাদের বিদেশে প্রচুর সম্পদ আছে। আমলাদের মধ্যে কাদের বিদেশে বাড়ি-গাড়ি আছে তাদের তালিকা সংসদে প্রকাশ করা উচিত। তাদের বরখাস্ত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। এমনকি তাদের ফাঁসি দেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছিলেন এই সংসদ সদস্য।
যুক্তরাষ্ট্রে বাড়ি আছে এমন একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর (ওসি) দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘একটি থানায় পোস্টিং নিতে আমাদের ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। তারপরও এক বছর থাকা যায় না। এখন টাকা কামানো ছাড়া আমাদের কী করার আছে? মানুষের সেবা দেব কখন? এর মধ্যে আবার রাজনৈতিক তদবির আছে। এখন আপনি যদি দুর্নীতি করেন বা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান তাহলে তো আপনাকে নিরাপত্তা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতেই হবে। সরকার বদল হলে আমি যে দেশে থাকত পারব, চাকরি করতে পারব তার নিশ্চয়তা কী? ফলে আমাকে আগে থেকেই বিদেশে থাকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে। স্ত্রী-সন্তানদের আগেই সেখানে পাঠিয়ে নাগরিকত্বসহ পুরো পরিবার থেকে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও সমাজ অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘এই ধরনের তথ্য আমাদের জন্য খুবই উদ্বেগের। তারা জনগণের টাকা বা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা লোপাট করে বিদেশে নিয়ে গেছেন। যারা সমাজের মানুষের কল্যাণে কাজ করবেন তারা যদি নিজেদের উন্নয়নে ব্যস্ত থাকেন তাহলে দেশের মানুষের উন্নয়ন হবে কীভাবে? সংবাদমাধ্যমে যখন এই ধরনের খবর আসে তখন তাদের প্রতি মানুষের আর শ্রদ্ধাবোধ থাকে না। এখন সরকারের উচিত হবে বিদেশে যারা সম্পদ কিনেছেন তাদের সম্পদগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। এখন এই টাকা যেহেতু বিদেশে আছে, ফলে সেখান থেকে ফিরিয়ে আনাও কঠিন। তবে সরকারিভাবে চেষ্টা করতে হবে, সেই সম্পদ বিক্রি করে টাকা দেশে নিয়ে আসার।’
অর্থ পাচার নিয়ে দুই বছর আগে ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই) অর্থ পাচারের একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছিল। সেই রিপোর্ট থেকে জানা যায়, দশ বছরে (২০০৬ থেকে ২০১৫) আমদানি ও রপ্তানির প্রকৃত তথ্য গোপন করে বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার ৩০৯ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৫ লাখ হাজার কোটি টাকা।
একটি তথ্যে দেখা গেছে, আমলাদের অর্ধেকের বেশির সন্তান পড়ালেখা করে বিদেশে। আবার পুলিশেরও ঊর্ধ্বতন কর্তাদের বড় একটা অংশের ছেলেমেয়ে বিদেশে পড়ালেখা করে। যে দেশে ছেলেমেয়ে পড়ালেখা করে সেখানে টাকা পাচারকারীরা তাদের স্ত্রীকে পাঠিয়ে বাড়ি কিনে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করছে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এমনকি ভারতেও অনেক কর্মকর্তা বাড়ি কিনে রেখেছেন।
সরকার গত অর্থবছরে পাচার করা টাকা দেশে আনার সুযোগ দিয়েছিল। গত ৩০ জুন সেসময় শেষ হলেও পাচারের টাকা ফেরত আনেননি একজনও। এর মধ্য দিয়ে সরকারের একটি উদ্যোগ কোনো সাড়া ছাড়াই নিষ্ফলা হিসাবে শেষ হয়। স্বাধীনতার পর দেশে প্রথমবারের মতো বাজেটে পাচার করা টাকা বিনা প্রশ্নে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়; কিন্তু এই উদ্যোগে কোনো সাড়া মিলল না। বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে।