রাণীনগরে ঘুষ ও দালাল সিন্ডিকেটে ভূমি অফিস, হয়রানির শিকার সাধারণ মানুষ

  • Update Time : ০৩:১২:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩
  • / 172

রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি:

যেখানে ভূমি সংক্রান্ত সকল সেবা দ্রুত সেবাগ্রহীতাদের মাঝে পৌঁছে দিতে নানা উদ্দ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর উল্টো চিত্র নওগাঁর রাণীনগর উপজেলা ভূমি অফিসে। এই উপজেলা ভূমি অফিসে কারণে-অকারণে সেবাগ্রহীতা জনসাধারণকে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। আবার দিন দিন দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে।

ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, দালালদের মাধ্যমে এবং অফিসের লোকদের সঙ্গে ঘুষের চুক্তিবদ্ধ না হয়ে সেবা নিতে গেলে সেবাগ্রহীতাদের চড়ম দুর্ভোগে পড়তে হয়। এমনকি চাহিদা মত ঘুষ না দিলে দীর্ঘদিনেও অফিসের লেবিল থেকে নড়ে না ফাইল। ফলে চড়ম দুর্ভোগে পড়ছে উপজেলা ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ।

জানা গেছে, জমির খারিজ, ডিসিআর, মিসকেসসহ অন্যান্য জমি সংক্রান্ত সেবা ও সমস্যা সমাধানের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে আসেন এলাকার জনসাধারণ। এ অফিসে পা রাখলেই নানা সমস্যায় পড়তে হয় সেবাগ্রহীতাদের। সব চেয়ে হয়রানিতে পড়তে হয় খাজির ও মিসকেস নিয়ে। বর্তমানে উপজেলা ভূমি অফিসের প্রায় সকল কার্যক্রম অনলাইনে। তথ্য মতে, একজন খারিজ গ্রহীতা প্রথমে অনলাইনে আবেদন করবেন। এরপর সেই হাত কপি ফাইলটি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে জমা দিতে হয়। আবার জমি সংক্রান্ত সকল সেবার জন্য নিময় অনুয়ায়ী লিখিত অবেদনও জমা দেওয়া হয়। এরপর শুরু হওয়ার কথা সেই ফাইলের কাজ। কিন্তু অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে রাণীনগর উপজেলা ভূমি অফিসের উল্টো চিত্র। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অনলাইনে আবেদনের পর ডিসিআর এর জন্য মাত্র ১১০০ টাকা দিলে জমির খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই ভূমি অফিসে দালালসহ অফিসে ধাপে ধাপে নিচ টেবিল থেকে উপর টেবিল পর্যন্ত প্রতি খারিজে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে।

সেবাগ্রহীতারা অফিসের অভ্যন্তরের ও বাহিরের দালাল ছাড়া আবেদনপত্র জমা দিলে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনটি অফসি ঘুষ ও দালাল সিন্ডিকেটের বাহিরে গেলেই আবেদন বাতিল করাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়। অথচ দালালদের চাহিদা মতো অতিরিক্ত টাকা দিলেই তারা অফিসের ভিতরে গেলেই চোখের নিমিষেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। আর ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন ভূমি অফিসে ঘুরে ও ধরর্ণা দিয়েও মেলেনা কোন প্রতিকার। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। ফলে ওই সব লোকজন দালাল এবং অফিসের অসাধু লোকজনের মাধ্যমে গেলেও প্রতিটি ধাপে ধাপে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নেওয়া হয়। আর এই অতিরিক্ত ঘুষের এক অংশ চলে যায় ভূমি অফিসের বিভিন্নজনের পকেটে।

উপজেলার প্রেমতলী এলাকার ভুক্তভোগী সাঈদ উদ্দিন মুন্সি বলেন, মালঞ্চি মৌজায় আমার ক্রয়কৃত প্রায় ৪০ শতক জমি আছে। আনুমানিক ৬ থেকে ৭ মাস আগে ইউনিয়ন পর্যায়ের সকল প্রক্রিয়া শেষ করে জমিগুলো খারিজের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন করি। ওই সময় আমার ক্রয়কৃত জমির মূল দলিল হারিয়ে যাওয়ার কারণে আবেদনে ফটোকপি দিয়েছিলাম। খারিজের আবেদনে দলিলের ফটোকপি দেওয়ার কারণে ওই আবেদন বাতিল করে সংশ্লিষ্টরা। এরপর গত প্রায় ৩ মাস আগে ক্রয়কৃত জমির দলিলের জাবেদা কপি সংগ্রহ করে খারিজের জন্য আবারও আবেদন করেছি। এরপরেও আমার খারিজ আজ অবধি হয়নি। তিনি বলেন, এই খারিজের জন্য দিনের পর দিন ভূমি অফিসে ঘুরে আমি ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছি। জমির দলিলের জাবেদা কপি দেওয়ার পরেও কর্তারা খারিজ করে দেয়নি।

আরেক ভুক্তভোগী করজগ্রামের জাকারিয়া হাসান চৌধুরী চপল বলেন, আমাদের পরিবারের সম্পত্তির স্টেটমেন্টের জাবেদা কপি নেওয়ার জন্য গত ৬ মাস আগে নওগাঁ ডিসি অফিসের রেকর্ড রুমে আবেদন করি। আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে রেকর্ডরুম থেকে উপজেলা ভূমি অফিসে স্টেটমেন্টের কপি চেয়ে চিঠি ইস্যু করেন। এরপর শুরু হয় আমাদের হয়রানি। আজ হবে, কাল হবে, দিবো দিচ্ছি বলে খোঁজার অযুহাতে অফিসের লোকজন আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে দীর্ঘ আড়াই মাস পর ৪টি স্টেটমেন্টের মধ্যে দুইটি উপজেলা ভূমি অফিস থেকে দেওয়া হয়। আর দুইটি তাদের অফিসে নেই এবং খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা বলে সাফ জানিয়ে দেন।

ভুক্তভোগী আবুল হোসেন বলেন, আমার শ^শুর বাড়ি রাণীনগর সদরের পশ্চিম বালুভরা গ্রামে। স্ত্রীর ভাগের ৫ শতক জমি পাবো শ্বশুড়বাড়ি থেকে। সেই জমি শ্বশুড়বাড়ির লোকজন অবৈধভাবে ভোগদখল করে আসছে। সেই প্রাপ্যতা পেতে প্রায় ৯ মাস আগে উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে একটি মিসকেস করি। এরপর দিনের পর দিন ভূমি অফিসে ধরর্না দেওয়ার পরে দেখি মিসকেস আবেদনের উপর স্মারক নম্বরটিও পরেনি। কিছুদিন আগে ভূমি অফিসের প্রধান কর্মকতার কাছে গেলে ফাইলটি খুঁজে বের করে নম্বর বসানোর নির্দেশ দেয়। জানি না আমার এই সমস্যা কবে নাগাদ সমাধান হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে রাণীনগর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, আমার জানা মতে অফিসে কোন দালাল নেই। ঘুষ ও হয়রানি করার কোন প্রশ্নই আসে না। যদি কেউ ঘুষ নিয়ে থাকে, অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media


রাণীনগরে ঘুষ ও দালাল সিন্ডিকেটে ভূমি অফিস, হয়রানির শিকার সাধারণ মানুষ

Update Time : ০৩:১২:৫৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩

রাণীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি:

যেখানে ভূমি সংক্রান্ত সকল সেবা দ্রুত সেবাগ্রহীতাদের মাঝে পৌঁছে দিতে নানা উদ্দ্যোগ নিয়েছে সরকার। কিন্তু এর উল্টো চিত্র নওগাঁর রাণীনগর উপজেলা ভূমি অফিসে। এই উপজেলা ভূমি অফিসে কারণে-অকারণে সেবাগ্রহীতা জনসাধারণকে হয়রানি করার অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। আবার দিন দিন দালাল সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলছে।

ভূক্তভোগীদের অভিযোগ, দালালদের মাধ্যমে এবং অফিসের লোকদের সঙ্গে ঘুষের চুক্তিবদ্ধ না হয়ে সেবা নিতে গেলে সেবাগ্রহীতাদের চড়ম দুর্ভোগে পড়তে হয়। এমনকি চাহিদা মত ঘুষ না দিলে দীর্ঘদিনেও অফিসের লেবিল থেকে নড়ে না ফাইল। ফলে চড়ম দুর্ভোগে পড়ছে উপজেলা ভূমি অফিসে সেবা নিতে আসা জনসাধারণ।

জানা গেছে, জমির খারিজ, ডিসিআর, মিসকেসসহ অন্যান্য জমি সংক্রান্ত সেবা ও সমস্যা সমাধানের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে আসেন এলাকার জনসাধারণ। এ অফিসে পা রাখলেই নানা সমস্যায় পড়তে হয় সেবাগ্রহীতাদের। সব চেয়ে হয়রানিতে পড়তে হয় খাজির ও মিসকেস নিয়ে। বর্তমানে উপজেলা ভূমি অফিসের প্রায় সকল কার্যক্রম অনলাইনে। তথ্য মতে, একজন খারিজ গ্রহীতা প্রথমে অনলাইনে আবেদন করবেন। এরপর সেই হাত কপি ফাইলটি অফিসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছে জমা দিতে হয়। আবার জমি সংক্রান্ত সকল সেবার জন্য নিময় অনুয়ায়ী লিখিত অবেদনও জমা দেওয়া হয়। এরপর শুরু হওয়ার কথা সেই ফাইলের কাজ। কিন্তু অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে রাণীনগর উপজেলা ভূমি অফিসের উল্টো চিত্র। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অনলাইনে আবেদনের পর ডিসিআর এর জন্য মাত্র ১১০০ টাকা দিলে জমির খারিজ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই ভূমি অফিসে দালালসহ অফিসে ধাপে ধাপে নিচ টেবিল থেকে উপর টেবিল পর্যন্ত প্রতি খারিজে প্রায় ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত সেবাগ্রহীতাদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে।

সেবাগ্রহীতারা অফিসের অভ্যন্তরের ও বাহিরের দালাল ছাড়া আবেদনপত্র জমা দিলে তা আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনটি অফসি ঘুষ ও দালাল সিন্ডিকেটের বাহিরে গেলেই আবেদন বাতিল করাসহ নানাভাবে হয়রানি করা হয়। অথচ দালালদের চাহিদা মতো অতিরিক্ত টাকা দিলেই তারা অফিসের ভিতরে গেলেই চোখের নিমিষেই সমস্যা সমাধান হয়ে যায়। আর ঘুষ না দিলে দিনের পর দিন ভূমি অফিসে ঘুরে ও ধরর্ণা দিয়েও মেলেনা কোন প্রতিকার। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সেবা নিতে আসা সাধারণ মানুষরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। ফলে ওই সব লোকজন দালাল এবং অফিসের অসাধু লোকজনের মাধ্যমে গেলেও প্রতিটি ধাপে ধাপে তাদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে নেওয়া হয়। আর এই অতিরিক্ত ঘুষের এক অংশ চলে যায় ভূমি অফিসের বিভিন্নজনের পকেটে।

উপজেলার প্রেমতলী এলাকার ভুক্তভোগী সাঈদ উদ্দিন মুন্সি বলেন, মালঞ্চি মৌজায় আমার ক্রয়কৃত প্রায় ৪০ শতক জমি আছে। আনুমানিক ৬ থেকে ৭ মাস আগে ইউনিয়ন পর্যায়ের সকল প্রক্রিয়া শেষ করে জমিগুলো খারিজের জন্য উপজেলা ভূমি অফিসে আবেদন করি। ওই সময় আমার ক্রয়কৃত জমির মূল দলিল হারিয়ে যাওয়ার কারণে আবেদনে ফটোকপি দিয়েছিলাম। খারিজের আবেদনে দলিলের ফটোকপি দেওয়ার কারণে ওই আবেদন বাতিল করে সংশ্লিষ্টরা। এরপর গত প্রায় ৩ মাস আগে ক্রয়কৃত জমির দলিলের জাবেদা কপি সংগ্রহ করে খারিজের জন্য আবারও আবেদন করেছি। এরপরেও আমার খারিজ আজ অবধি হয়নি। তিনি বলেন, এই খারিজের জন্য দিনের পর দিন ভূমি অফিসে ঘুরে আমি ব্যাপক হয়রানির শিকার হচ্ছি। জমির দলিলের জাবেদা কপি দেওয়ার পরেও কর্তারা খারিজ করে দেয়নি।

আরেক ভুক্তভোগী করজগ্রামের জাকারিয়া হাসান চৌধুরী চপল বলেন, আমাদের পরিবারের সম্পত্তির স্টেটমেন্টের জাবেদা কপি নেওয়ার জন্য গত ৬ মাস আগে নওগাঁ ডিসি অফিসের রেকর্ড রুমে আবেদন করি। আবেদনের পরিপ্রক্ষিতে রেকর্ডরুম থেকে উপজেলা ভূমি অফিসে স্টেটমেন্টের কপি চেয়ে চিঠি ইস্যু করেন। এরপর শুরু হয় আমাদের হয়রানি। আজ হবে, কাল হবে, দিবো দিচ্ছি বলে খোঁজার অযুহাতে অফিসের লোকজন আমার কাছ থেকে ৫০০ টাকা নিয়ে দীর্ঘ আড়াই মাস পর ৪টি স্টেটমেন্টের মধ্যে দুইটি উপজেলা ভূমি অফিস থেকে দেওয়া হয়। আর দুইটি তাদের অফিসে নেই এবং খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা বলে সাফ জানিয়ে দেন।

ভুক্তভোগী আবুল হোসেন বলেন, আমার শ^শুর বাড়ি রাণীনগর সদরের পশ্চিম বালুভরা গ্রামে। স্ত্রীর ভাগের ৫ শতক জমি পাবো শ্বশুড়বাড়ি থেকে। সেই জমি শ্বশুড়বাড়ির লোকজন অবৈধভাবে ভোগদখল করে আসছে। সেই প্রাপ্যতা পেতে প্রায় ৯ মাস আগে উপজেলা ভূমি অফিসে গিয়ে একটি মিসকেস করি। এরপর দিনের পর দিন ভূমি অফিসে ধরর্না দেওয়ার পরে দেখি মিসকেস আবেদনের উপর স্মারক নম্বরটিও পরেনি। কিছুদিন আগে ভূমি অফিসের প্রধান কর্মকতার কাছে গেলে ফাইলটি খুঁজে বের করে নম্বর বসানোর নির্দেশ দেয়। জানি না আমার এই সমস্যা কবে নাগাদ সমাধান হবে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সকল অভিযোগ অস্বীকার করে রাণীনগর উপজেলা সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান বলেন, আমার জানা মতে অফিসে কোন দালাল নেই। ঘুষ ও হয়রানি করার কোন প্রশ্নই আসে না। যদি কেউ ঘুষ নিয়ে থাকে, অভিযোগ পেলে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।