বই পর্যালোচনা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৪:১৮:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০২০
  • / ২০৮ Time View
 আনিকা তাবাসসুম রিশা:
বিয়ে একটি ধর্মীয় এবং পবিত্র বন্ধন। বিয়ের মাধ্যমে কি শুধু দুটো মানুষ একত্রিত হয়? মোটেও না। বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক যা দুটো মানুষ নয়, দুটো ভিন্ন পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করে। এই বিয়ে নিয়েই ‘গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স’ একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটির নাম ‘বিয়ে’। বইটি লিখেছেন রেহনুমা বিনতে আনিস। বইটির গায়ের মূল্য ২৫০ টাকা (হার্ডকভার মূল্য), ২২০ টাকা (পেপারব্যাক মূল্য)।
.
আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে ‘বিয়ে’ বইটি কি প্রবন্ধ, নাকি উপন্যাস নাকি গল্প নাকি অন্যকিছু?
.
এটি আসলে লেখিকার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা এবং (দুই একটি ঘটনা ব্যতীত) সমাজে আশে পাশে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনাগুলো নিয়ে রচিত ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিধান।
.
রেহনুমা বিনতে আনিসের জন্ম চট্টগ্রামে। শৈশব কেটেছে ঢাকায়। কৈশোর আবুধাবিতে। এরপরের সময়টা কেটেছে ভারতে। বিয়ের পর আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন তিনি। বইপোকা এই লেখিকা ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব চিটাগাং -এ শিক্ষকতা করেছেন অনেকদিন। আবুধাবীস্থ ‘ইয়াং ম্যাগাজিনে’ নিয়মিত লেখিকা হিসেবে লেখার হাতেখড়ি তার।
.
বইটিতে মোট ২২ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কয়েকটিতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা করা হয়েছে এবং পরে বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে গল্প আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। লেখিকা সাবলীল এবং সহজবোধ্য ভাষায় বিয়ে সম্পর্কিত নানা বিষয় বইটিতে আলোচনা করেছেন।
.
দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ বিয়ের মাধ্যমে একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়, ফলে অনেক বিষয় মানিয়ে নিতে হয়। এই সম্পর্কের মাধ্যমে শুধু দুটো মানুষ নয়, দুটো পরিবারের সমস্ত লোকজনের ভালো থাকা, মন্দ থাকার বিষয়টি নির্ভর করে। আবার ভবিষ্যতে সন্তান নিয়ে একটি সুন্দর পরিবার গঠনেও বিয়ের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
.
লেখিকার মতে, ‘বিয়ে শুধুমাত্র প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। এটি সন্তানদের জন্য ফুলের বাগান রচনা করার প্রচেষ্টা। বাগানের যত পরিচর্যা করা হবে বাগানের ফুল ততই ভালো হবে।
.
‘ অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কটি যত মজবুত হবে যত সুন্দর হবে তত বেশি সুন্দর আর সাফল্যময় একটি পরিবার গঠিত হবে।
.
বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র/পাত্রী নির্বাচনে খেয়াল রাখতে হবে। যাতে অন্যান্য অমিল থাকলে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দুজনের মিল থাকে। তাহলে সম্পর্কটিকে শ্রদ্ধার সাথে টিকিয়ে রাখা সহজ হয়ে উঠবে।
.
আকাশ-পাতাল তফাৎ সম্পন্ন দুটো মানুষের মধ্যে বিয়ে হলে সে সম্পর্কে যেমন সুখ থাকবে না, তেমনি থাকবে না স্থায়ীত্ব। তাই বিয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ। পাত্র-পাত্রী যেন পরস্পরের সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
.
শুধুমাত্র গায়ের রঙ, সৌন্দর্য বা ভালো চাকরির দ্বারা ভালো পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা ঠিক না। সুন্দর চেহারা মানেই যে সুন্দর মন বিষয়টা কিন্তু মোটেও এরকম নয়।
.
যে বিয়েতে যত লোক দেখানো খরচ হবে সে পরিবারের ততই নাম ডাক থাকবে বা পাত্রের কাছে অঢেল টাকা মহারানা নেওয়া বা পাত্রীর বাবার কাছে অঢেল টাকা যৌতুক নেওয়া, এই বিষয়গুলো মোটেও একটি শান্তিপূর্ণ বৈবাহিক জীবনের সূচনা ঘটায় না। মনে রাখতে হবে, ‘যে বিয়েতে খরচ কম সে বিয়ে বরকতময়।’ ছেলে অথবা বাবার চাপ বাড়িয়ে ‘লোক দেখানো বিয়ে করা’ থেকে বেরিয়ে আসা অতীব জরুরি।
বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রীকে শ্রদ্ধা করা যেমন দায়িত্ব, পাশাপাশি উভয়ের বাবা মা বা পরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার করাও দায়িত্ব। এতে করে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মানসিকভাবে শান্তি লাভ করে থাকেন। বিয়ে মানে কি একটি মেয়ের নাম পরিবর্তন হয়ে যাওয়া? স্বামীর নামের সাথে মিলিয়ে রাখা? একদমই না। বরং মেয়ের নামও নিজ বংশের সাথে, নিজ পিতা-মাতার সাথে মিলিয়ে রাখা উচিৎ।
.
উপর্যুক্ত এই বিষয়গুলো লেখিকা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর ‘বিয়ে’ বইটিতে। লেখিকা প্রতিটি অনুচ্ছেদেই তুলে ধরেছেন বিয়ে কেমন হওয়া উচিৎ, কী কী বিষয় মাথায় রেখে বিয়ে করা উচিৎ, বিয়ে পরবর্তী জীবন কেমন হওয়া উচিৎ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কেমন মানুষ বিয়ে করা উচিৎ। বইটি পড়ে ভালো লেগেছে। প্রথমদিকে লেখিকার অভিজ্ঞতাগুলোর যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ দারুণ ছিল। বইটির শেষদিকে যে গল্পগুলো আছে তা আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের গল্পরই অংশ। এই গল্পগুলো শিক্ষণীয়। বইটি পড়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন এসেছে। বিয়ে দুটো মানুষের মধ্যে নয়, দুটো পরিবারের মধ্যে হয়। উভয় পক্ষকে মানিয়ে চলতে হয়। এখানে একে অপরকে বুঝবার ক্ষমতাটা অনেক বেশি থাকতে হয়। রোমান্টিক সিনেমার শেষ দৃশ্যের মত এতো সহজ নয় এই অধ্যায়টা, কিন্তু কিভাবে সহজ করা যায় এটা অনেকাংশে নিজের ওপরেও নির্ভর করে। এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে বলতে পারি বইটি পড়ে নতুন বিবাহিতদের পাশাপাশি অবিবাহিতরাও উপকৃত হবেন। বেশ তথ্য সমৃদ্ধ। যুক্তিগুলো এবং লেখিকার ব্যবহৃত নানা উপমাগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে।
.
যুক্তি, উপমার পাশাপাশি হাদীস এবং কোরআনের উক্তিগুলো মনকে নাড়া দিয়েছে দারুণভাবে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি যারা বিয়ে নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দে আছেন বা নতুন বৈবাহিক জীবনে পদার্পণ করেছেন তাদের বইটি অবশ্যই পড়তে বলবো। এতে অনেক বিষয় আপনার কাছে সহজ হয়ে উঠবে, আবার পারিবারিক অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণও সহজ হয়ে যাবে। বিয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কটিতে থাকা উচিৎ বিশ্বাস, ভরসা, একে অপরকে শ্রদ্ধা করার মন মানসিকতা, একে অপরের পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা। দুজনের সার্বিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে পারে একটি সৌন্দর্যমন্ডিত সংসার। বিয়ে এমন একজনকে করা উচিৎ যার সাথে জীবন অতিবাহিত করাটা সহজ হয়ে উঠবে। বিয়ে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করি।
.
তাই এই বিষয়টি সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা উচিৎ। আমাদের ধর্মেও বিয়েকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, “আর এর নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।” (সূরাঃ আর রূম :২১) অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে আমরা পেতে পারি শান্তি, স্বস্তি, ভালোবাসা, ভরসা, পরকালের পথ সহজগামী হবার উপায়। সর্বোপরি আমার বেশ ভালো লেগেছে বইটি এবং সহজবোধ্য ও উপকারি মনে হয়েছে। এবার আসি বই এর আলংকারিক বিষয়বস্তু নিয়ে। প্রথমে বলি বইটির প্রচ্ছদ নিয়ে। হলুদ ও কমলার মিশেলে দারুণ দৃষ্টি কাড়া একটি প্রচ্ছদ পাঠককে আকৃষ্ট করে। প্রচ্ছদ দেখেই ইচ্ছে করেছিল বইটি একটু ছুঁয়ে দেখি। এরপরের মুগ্ধতা হলো বই এর পৃষ্ঠাগুলো। শুধু ভালো লেখা হলেই যে কোন বই ভালো বলে বিবেচিত হয় বিষয়টি এরকম নয়। ভালো লেখার পাশাপাশি কাগজের মানও হতে হয় দৃষ্টিনন্দিত ।
.
পৃষ্ঠাগুলো ধরে বেশ আরাম আরাম একটা অনুভূতি অনুভব হচ্ছিলো। লেখাগুলোও স্পষ্ট এবং চোখকে আরাম দিয়েছে।
.
কিছু উক্তি দারুণভাবে ছুঁয়ে গেছে মনকে। তার মধ্যে কিছু উল্লেখ করছি। ১। কিছু ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা একটি পরিবারকে জান্নাতের বাগানের মতো সুখময় করতে পারে। আবার ছোট ছোট কিছু ভুল একটি পরিবারকে বানিয়ে দিতে পারে মূর্তিমান জাহান্নাম। ২। চাকরি পরিবর্তন করা যায় কিন্তু চরিত্র পরিবর্তন করা যায় না। ৩। জীবনে সবকিছু বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করা যায় না । মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য এত সীমিত যে, তা দিয়ে জীবনের জটিলতাগুলো অনুধাবন পর্যন্ত করা যায় না সমাধানতো বহু দূরের ব্যাপার। ৪। কাপড় বেশি টানা হেঁচড়া করলে ছিঁড়ে যায়। একইভাবে স্বামী স্ত্রী পরস্পরের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা হেয় করলে তাদের সম্পর্কটা নষ্টের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। ৫। বিয়ে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি ইহকাল ও পরকালের জীবনকে সাজানোর জন্য দুজনের পার্টনারশিপ।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, মাস্টার্স,
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

বই পর্যালোচনা

Update Time : ০৪:১৮:২০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২১ নভেম্বর ২০২০
 আনিকা তাবাসসুম রিশা:
বিয়ে একটি ধর্মীয় এবং পবিত্র বন্ধন। বিয়ের মাধ্যমে কি শুধু দুটো মানুষ একত্রিত হয়? মোটেও না। বিয়ে এমন একটি সম্পর্ক যা দুটো মানুষ নয়, দুটো ভিন্ন পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করে। এই বিয়ে নিয়েই ‘গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স’ একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটির নাম ‘বিয়ে’। বইটি লিখেছেন রেহনুমা বিনতে আনিস। বইটির গায়ের মূল্য ২৫০ টাকা (হার্ডকভার মূল্য), ২২০ টাকা (পেপারব্যাক মূল্য)।
.
আপনাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে ‘বিয়ে’ বইটি কি প্রবন্ধ, নাকি উপন্যাস নাকি গল্প নাকি অন্যকিছু?
.
এটি আসলে লেখিকার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা এবং (দুই একটি ঘটনা ব্যতীত) সমাজে আশে পাশে ঘটে যাওয়া ছোট ছোট ঘটনাগুলো নিয়ে রচিত ‘ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন বিধান।
.
রেহনুমা বিনতে আনিসের জন্ম চট্টগ্রামে। শৈশব কেটেছে ঢাকায়। কৈশোর আবুধাবিতে। এরপরের সময়টা কেটেছে ভারতে। বিয়ের পর আবার চট্টগ্রামে ফিরে আসেন তিনি। বইপোকা এই লেখিকা ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব চিটাগাং -এ শিক্ষকতা করেছেন অনেকদিন। আবুধাবীস্থ ‘ইয়াং ম্যাগাজিনে’ নিয়মিত লেখিকা হিসেবে লেখার হাতেখড়ি তার।
.
বইটিতে মোট ২২ টি অনুচ্ছেদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কয়েকটিতে বিভিন্ন অভিজ্ঞতার আলোকে আলোচনা করা হয়েছে এবং পরে বিভিন্ন ঘটনাগুলোকে গল্প আকারে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। লেখিকা সাবলীল এবং সহজবোধ্য ভাষায় বিয়ে সম্পর্কিত নানা বিষয় বইটিতে আলোচনা করেছেন।
.
দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে বেড়ে ওঠা মানুষ বিয়ের মাধ্যমে একটি বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়, ফলে অনেক বিষয় মানিয়ে নিতে হয়। এই সম্পর্কের মাধ্যমে শুধু দুটো মানুষ নয়, দুটো পরিবারের সমস্ত লোকজনের ভালো থাকা, মন্দ থাকার বিষয়টি নির্ভর করে। আবার ভবিষ্যতে সন্তান নিয়ে একটি সুন্দর পরিবার গঠনেও বিয়ের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে।
.
লেখিকার মতে, ‘বিয়ে শুধুমাত্র প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক নয়। এটি সন্তানদের জন্য ফুলের বাগান রচনা করার প্রচেষ্টা। বাগানের যত পরিচর্যা করা হবে বাগানের ফুল ততই ভালো হবে।
.
‘ অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কটি যত মজবুত হবে যত সুন্দর হবে তত বেশি সুন্দর আর সাফল্যময় একটি পরিবার গঠিত হবে।
.
বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র/পাত্রী নির্বাচনে খেয়াল রাখতে হবে। যাতে অন্যান্য অমিল থাকলে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে দুজনের মিল থাকে। তাহলে সম্পর্কটিকে শ্রদ্ধার সাথে টিকিয়ে রাখা সহজ হয়ে উঠবে।
.
আকাশ-পাতাল তফাৎ সম্পন্ন দুটো মানুষের মধ্যে বিয়ে হলে সে সম্পর্কে যেমন সুখ থাকবে না, তেমনি থাকবে না স্থায়ীত্ব। তাই বিয়ের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিৎ। পাত্র-পাত্রী যেন পরস্পরের সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
.
শুধুমাত্র গায়ের রঙ, সৌন্দর্য বা ভালো চাকরির দ্বারা ভালো পাত্র-পাত্রী নির্বাচন করা ঠিক না। সুন্দর চেহারা মানেই যে সুন্দর মন বিষয়টা কিন্তু মোটেও এরকম নয়।
.
যে বিয়েতে যত লোক দেখানো খরচ হবে সে পরিবারের ততই নাম ডাক থাকবে বা পাত্রের কাছে অঢেল টাকা মহারানা নেওয়া বা পাত্রীর বাবার কাছে অঢেল টাকা যৌতুক নেওয়া, এই বিষয়গুলো মোটেও একটি শান্তিপূর্ণ বৈবাহিক জীবনের সূচনা ঘটায় না। মনে রাখতে হবে, ‘যে বিয়েতে খরচ কম সে বিয়ে বরকতময়।’ ছেলে অথবা বাবার চাপ বাড়িয়ে ‘লোক দেখানো বিয়ে করা’ থেকে বেরিয়ে আসা অতীব জরুরি।
বিয়ের পর স্বামী বা স্ত্রীকে শ্রদ্ধা করা যেমন দায়িত্ব, পাশাপাশি উভয়ের বাবা মা বা পরিবারের সাথে ভালো ব্যবহার করাও দায়িত্ব। এতে করে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মানসিকভাবে শান্তি লাভ করে থাকেন। বিয়ে মানে কি একটি মেয়ের নাম পরিবর্তন হয়ে যাওয়া? স্বামীর নামের সাথে মিলিয়ে রাখা? একদমই না। বরং মেয়ের নামও নিজ বংশের সাথে, নিজ পিতা-মাতার সাথে মিলিয়ে রাখা উচিৎ।
.
উপর্যুক্ত এই বিষয়গুলো লেখিকা খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন তাঁর ‘বিয়ে’ বইটিতে। লেখিকা প্রতিটি অনুচ্ছেদেই তুলে ধরেছেন বিয়ে কেমন হওয়া উচিৎ, কী কী বিষয় মাথায় রেখে বিয়ে করা উচিৎ, বিয়ে পরবর্তী জীবন কেমন হওয়া উচিৎ, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কেমন মানুষ বিয়ে করা উচিৎ। বইটি পড়ে ভালো লেগেছে। প্রথমদিকে লেখিকার অভিজ্ঞতাগুলোর যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ দারুণ ছিল। বইটির শেষদিকে যে গল্পগুলো আছে তা আমাদের সমাজে ঘটে যাওয়া নিত্যদিনের গল্পরই অংশ। এই গল্পগুলো শিক্ষণীয়। বইটি পড়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তন এসেছে। বিয়ে দুটো মানুষের মধ্যে নয়, দুটো পরিবারের মধ্যে হয়। উভয় পক্ষকে মানিয়ে চলতে হয়। এখানে একে অপরকে বুঝবার ক্ষমতাটা অনেক বেশি থাকতে হয়। রোমান্টিক সিনেমার শেষ দৃশ্যের মত এতো সহজ নয় এই অধ্যায়টা, কিন্তু কিভাবে সহজ করা যায় এটা অনেকাংশে নিজের ওপরেও নির্ভর করে। এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে বলতে পারি বইটি পড়ে নতুন বিবাহিতদের পাশাপাশি অবিবাহিতরাও উপকৃত হবেন। বেশ তথ্য সমৃদ্ধ। যুক্তিগুলো এবং লেখিকার ব্যবহৃত নানা উপমাগুলো আপনাকে মুগ্ধ করবে।
.
যুক্তি, উপমার পাশাপাশি হাদীস এবং কোরআনের উক্তিগুলো মনকে নাড়া দিয়েছে দারুণভাবে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি যারা বিয়ে নিয়ে নানা দ্বিধাদ্বন্দে আছেন বা নতুন বৈবাহিক জীবনে পদার্পণ করেছেন তাদের বইটি অবশ্যই পড়তে বলবো। এতে অনেক বিষয় আপনার কাছে সহজ হয়ে উঠবে, আবার পারিবারিক অনেক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণও সহজ হয়ে যাবে। বিয়ের মাধ্যমে সৃষ্ট সম্পর্কটিতে থাকা উচিৎ বিশ্বাস, ভরসা, একে অপরকে শ্রদ্ধা করার মন মানসিকতা, একে অপরের পরিবারের সদস্যদের প্রতি দায়িত্ব পালনের ইচ্ছা। দুজনের সার্বিক প্রচেষ্টায় গড়ে উঠতে পারে একটি সৌন্দর্যমন্ডিত সংসার। বিয়ে এমন একজনকে করা উচিৎ যার সাথে জীবন অতিবাহিত করাটা সহজ হয়ে উঠবে। বিয়ে জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলে মনে করি।
.
তাই এই বিষয়টি সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা উচিৎ। আমাদের ধর্মেও বিয়েকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে। সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, “আর এর নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছে। নিশ্চয় এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য নিদর্শনাবলি রয়েছে।” (সূরাঃ আর রূম :২১) অর্থাৎ বিয়ের মাধ্যমে আমরা পেতে পারি শান্তি, স্বস্তি, ভালোবাসা, ভরসা, পরকালের পথ সহজগামী হবার উপায়। সর্বোপরি আমার বেশ ভালো লেগেছে বইটি এবং সহজবোধ্য ও উপকারি মনে হয়েছে। এবার আসি বই এর আলংকারিক বিষয়বস্তু নিয়ে। প্রথমে বলি বইটির প্রচ্ছদ নিয়ে। হলুদ ও কমলার মিশেলে দারুণ দৃষ্টি কাড়া একটি প্রচ্ছদ পাঠককে আকৃষ্ট করে। প্রচ্ছদ দেখেই ইচ্ছে করেছিল বইটি একটু ছুঁয়ে দেখি। এরপরের মুগ্ধতা হলো বই এর পৃষ্ঠাগুলো। শুধু ভালো লেখা হলেই যে কোন বই ভালো বলে বিবেচিত হয় বিষয়টি এরকম নয়। ভালো লেখার পাশাপাশি কাগজের মানও হতে হয় দৃষ্টিনন্দিত ।
.
পৃষ্ঠাগুলো ধরে বেশ আরাম আরাম একটা অনুভূতি অনুভব হচ্ছিলো। লেখাগুলোও স্পষ্ট এবং চোখকে আরাম দিয়েছে।
.
কিছু উক্তি দারুণভাবে ছুঁয়ে গেছে মনকে। তার মধ্যে কিছু উল্লেখ করছি। ১। কিছু ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা একটি পরিবারকে জান্নাতের বাগানের মতো সুখময় করতে পারে। আবার ছোট ছোট কিছু ভুল একটি পরিবারকে বানিয়ে দিতে পারে মূর্তিমান জাহান্নাম। ২। চাকরি পরিবর্তন করা যায় কিন্তু চরিত্র পরিবর্তন করা যায় না। ৩। জীবনে সবকিছু বুদ্ধি দিয়ে বিবেচনা করা যায় না । মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সামর্থ্য এত সীমিত যে, তা দিয়ে জীবনের জটিলতাগুলো অনুধাবন পর্যন্ত করা যায় না সমাধানতো বহু দূরের ব্যাপার। ৪। কাপড় বেশি টানা হেঁচড়া করলে ছিঁড়ে যায়। একইভাবে স্বামী স্ত্রী পরস্পরের ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য বা হেয় করলে তাদের সম্পর্কটা নষ্টের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। ৫। বিয়ে শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি ইহকাল ও পরকালের জীবনকে সাজানোর জন্য দুজনের পার্টনারশিপ।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, মাস্টার্স,
বাংলাদেশ গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ।