করোনার চিকিৎসায় চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধের ব্যবহার

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৬:৩৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর ২০২০
  • / ১২২ Time View

ডেস্ক রিপোর্টঃ আমার ব্যাক পেইন আছে। সমস্যাটাকে ‘লাম্বাগো সায়াটিকা’ হিসেবে সনাক্ত করেছিলেন বাংলাদেশের ডাক্তার ইদ্রিস। তিনি আমাকে কিছু ওষুধ দিয়েছিলেন, শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিছু ব্যায়াম। তাঁর দেওয়া ওষুধ খেয়ে ও ব্যায়াম করে উপকার পেয়েছিলাম। সেই থেকে যখন যেখানে যাই, ডাক্তার ইদ্রিসের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ সঙ্গে রাখি। ২০১২ সালে যখন চীনে আসি, তখনও আমার সঙ্গে কিছু ওষুধ ছিল; বলা বাহুল্য, এখনও আছে।

আমার ব্যাক পেইন আছে মানে এই নয় যে, এই ব্যথা আমাকে সারাক্ষণ ভোগায়। মেরুদণ্ডের সমস্যা। চলাফেরায় অসাবধান হলে মাঝে মাঝে এই ব্যথা জেকে ধরে। তখন সপ্তাহখানেক বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়, ওষুধ খেতে হয়। সপ্তাহখানেক পর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। চীনে আসার পর, বিগত আট বছরে, যতদূর মনে পড়ে, মোট দু’বার আমাকে ব্যাক পেইনের কারণে শয্যাশায়ী হতে হয়েছিল। আমার ব্যাক পেইনের খবর শুনে আমাদের সবার প্রিয় চীনা মুরুব্বি ম্যাডাম লিউ (আমরা যাকে ‘লিউ আপা’ বলে ডাকি) আমাকে আকুপাংচার চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, আকুপাংচার শরীরের যে-কোনো ব্যথা সারাতে পারে।

একদিন লিউ আপাই নিয়ে গেলেন ডাক্তার ওয়াং ফু চুয়াংয়ের কাছে। লম্বা একহারা গড়ন ভদ্রলোকের। আশি ছাড়িয়েছেন কবেই। তারপরও ঋজু ভঙ্গিতে হাঁটেন, কম্পনহীন হাতে রোগীদের কান কাটেন। কান কাটার বিষয়টা তাঁর নিজস্ব স্টাইল, নিজের আবিষ্কার। সুঁই ফোটানোর আগে তিনি রোগীদের কানের ভিতরের অংশে ছোট ছুরি দিয়ে অসংখ্য আঁচড় দেন। এতে সামান্য রক্ত বের হয়। সেই ক্ষতস্থানটি আবার তুলোয় ওষুধ মেখে ঢেকে দেন। আমি ডাক্তার চুয়াংয়ের নাম দিয়েছি ‘কান কাটার ডাক্তার’।

ডাক্তার ওয়াং ফু চুয়াংয়ের কাছে আমি টানা কয়েক সপ্তাহ গিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে তিন দিনের সেশান। কান কাটার পর সুঁই ফোটানো। প্রতিবারই মনে হয়, আর যাবো না! কান কাটার চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে সুঁই ফোটানোর চ্যালেঞ্জ। দুই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সহজ কাজ নয় মোটেই। অন্তত আমার কাছে। কিন্তু আধা ঘন্টার একেকটা সেশান শেষ হবার পর শরীরে যে ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তা আমাকে আবার ডাক্তারের চেম্বারে টেনে নিয়ে যেতো। ডাক্তার চুয়াংয়ের আকুপাংচার থেকে আমি উপকৃত হয়েছি। শেষ কবে আমাকে ব্যাক পেইনের কারণে শয্যাশায়ী হতে হয়েছিল, চট করে বলতে পারব না।

আকুপাংচারে ওষুধ খেতে হয়নি। কিন্তু প্রোস্টেটের সমস্যায় একবার আমাকে চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ (ট্রাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিন—টিসিএম) খেতে হয়েছিল। প্রতিদিন প্রায় ৪০টি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল! সমস্যা দূর হয়েছিল। সর্বশেষ গত মাসে (সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে) গলার বাম দিকে ব্যথা শুরু হলে আমাকে যেতে হয় বেইজিং ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালে। সেখানে আমাকে দেখলেন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লি ক্য লিন। তিনি আমার গলার আল্ট্রা সাউন্ড করালেন, ব্লাড টেস্ট করালেন। কিছু পাওয়া গেল না। তিনি বললেন: ‘তোমার তো কোনো সমস্যা নেই!’ আমি বললাম: ‘কিন্তু ব্যথা তো আছে!’ তিনি হাসলেন, বললেন: ‘তোমাকে আমি কিছু চীনা ওষুধ দিচ্ছি। এক সপ্তাহ খাও। ব্যথা সেরে যাওয়ার কথা। না সারলে আবার আমার কাছে আসবে।’ প্রতিদিন ৯টি করে ক্যাপসুল। চার দিন খাওয়ার পর ব্যথা উধাও! ডাক্তার লিনের কাছে আমাকে আর যেতে হয়নি।

চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ (টিসিএম)-এর ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। চীনারা প্রাচীনকাল থেকেই এই ওষুধ ব্যবহার করে আসছে। প্রাচীনকালে চারটি ক্ষেত্রে চীন বেশ এগিয়েছিল: জ্যোতিঃশ্রাস্ত্র (অ্যাস্ট্রোনমি), কৃষিবিজ্ঞান (অ্যাগ্রোনমি), গণিতশাস্ত্র (অ্যারিথম্যাটিক), ও টিসিএম। আধুনিক চীনে টিসিএম ছাড়া বাকি তিনটি শাখার চীনা চরিত্র হারিয়ে গেছে। টিসিএম এখনও এর প্রাচীন চরিত্র অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছে। আধুনিক চিকিৎসা-ব্যবস্থার জোয়ারে ভেসে যায়নি টিসিএম। এটি বরং দিন দিন উন্নত হচ্ছে। হয়তো টিকে থাকার তাগিদেই! আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি টিসিএম ব্যবহার করা হচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকমের কম হওয়ার পেছনে যেসব কারণ ক্রিয়াশীল ছিল, সেগুলোর একটি হচ্ছে টিসিএম-এর সফল প্রয়োগ।

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস রোগের চিকিৎসায় টিসিএম-এর সাফল্য বিদেশি চিকিৎসকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, একটি চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধের কথা উল্লেখ করা যায়। এই ওষুধটি আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসকে পরিষ্কার (ক্লিন) করে, বিষমুক্ত (টক্সিনমুক্ত) করে। এই বিশেষ ওষুধটি মহামারি চলাকালেই আবিষ্কার করেন চীনের টিসিএম গবেষকরা এবং চীনের কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করে সুফল পান। এখন তো এই ওষুধটি ইতালি, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড রোগের চিকিৎসায় সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তথ্যটি জানিয়েছেন বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব চায়নিজ মেডিসেনের উপ-প্রধান ওয়াং ওয়েই।

থিয়েনচিন ইউনিভার্সিটি অব ট্রাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট চাং পো লি জানান, কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগকৃত আরেকটি টিসিএম হচ্ছে ‘লিয়ানহুয়া-ছিংওয়েন’ ক্যাপসুল। দশটিরও বেশি দেশে এই ওষুধটি বাজারজাত করার অনুমতি পাওয়া গেছে। তা ছাড়া, বেশ কয়েকটি দেশে এই ওষুধ বিনামূল্যে দান করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও জানান, এই ক্যাপসুলটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বর্তমানে কাজ করছেন এবং চীনা গবেষকদের অভিজ্ঞতালব্ধ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত গভীর আগ্রহ নিয়ে খতিয়ে দেখছেন।

পশ্চিমা মিডিয়া মহামারি মোকাবিলায় চীনের অবিশ্বাস্য সাফল্য নিয়ে কথা বলতে দৃশ্যত লজ্জা পায়। তারা মহামারি মোকাবিলায় সাফল্যের উদাহরণ দিতে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের নাম উল্লেখ করতেই বরং সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ এসব দেশ চীনা মডেল অনুসরণ করেই মহামারি মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছে! সিঙ্গাপুরে তো চীনা আকুচাংচার কোভিড রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের অনুমতি পায় গত ৫ মে। এই তথ্যটি একটি ভিডিও-কনফারেন্সে জানান সিঙ্গাপুর চায়নিজ ফিজিশিয়ানস অ্যাসোসিয়েশানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কুও টং হো। তিনি জানান, কোভিড-১৯ রোগ মোকাবিলায় চীনা ওষুধ ও কৌশল সিঙ্গাপুরে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ন্যাশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান অব ট্রাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিনের হিসেব অনুসারে, চীন ৮০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে কোভিড-১৯ রোগসংশ্লিষ্ট টিসিএম থেরাপি, কার্যকর প্রেসক্রিপশান, ও ক্লিনিকাল অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে।

চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ (টিসিএম) তার নিজগুণেই বিশ্বের অনেক দেশে ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ৭৮টি দেশের ২৪০টির বেশি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে টিসিএম কোর্স চালু হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত এসব কোর্সে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজারের বেশি। এদিকে, চীনের অভ্যন্তরের টিসিএম কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিবছর এসব কলেজে গড়ে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। পাশাপাশি, গেল বছরের শেষ নাগাদ পর্যন্ত, ৯০টি দেশে ৩৮৮টি টিসিএম সমবায় প্রকল্প চালু করেছে চীন। এ ছাড়া, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করছে—এমন বেশকিছু দেশে ৩০টি টিসিএম কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজও করছে চীন। এসব কেন্দ্রে আকুপাংচারসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা পাবেন সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষ।

চায়না একাডেমি অব চায়নিজ মেডিকেল সায়েন্সেস-এর প্রধান গবেষক লিউ পাওইয়ান সম্প্রতি বলেন: ‘নভেল করোনাভাইরাস মহামারি টিসিএম-কে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার নতুন সুযোগ করে দিয়েছে।’ তিনি যথার্থই বলেছেন। মহামারি মোকাবিলায় চীনে ও চীনের বাইরে টিসিএমের সফল প্রয়োগ, চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধকে আরও জনপ্রিয় করবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
alimulh@yahoo.com

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

করোনার চিকিৎসায় চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধের ব্যবহার

Update Time : ০৬:৩৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর ২০২০

ডেস্ক রিপোর্টঃ আমার ব্যাক পেইন আছে। সমস্যাটাকে ‘লাম্বাগো সায়াটিকা’ হিসেবে সনাক্ত করেছিলেন বাংলাদেশের ডাক্তার ইদ্রিস। তিনি আমাকে কিছু ওষুধ দিয়েছিলেন, শিখিয়ে দিয়েছিলেন কিছু ব্যায়াম। তাঁর দেওয়া ওষুধ খেয়ে ও ব্যায়াম করে উপকার পেয়েছিলাম। সেই থেকে যখন যেখানে যাই, ডাক্তার ইদ্রিসের প্রেসক্রাইব করা ওষুধ সঙ্গে রাখি। ২০১২ সালে যখন চীনে আসি, তখনও আমার সঙ্গে কিছু ওষুধ ছিল; বলা বাহুল্য, এখনও আছে।

আমার ব্যাক পেইন আছে মানে এই নয় যে, এই ব্যথা আমাকে সারাক্ষণ ভোগায়। মেরুদণ্ডের সমস্যা। চলাফেরায় অসাবধান হলে মাঝে মাঝে এই ব্যথা জেকে ধরে। তখন সপ্তাহখানেক বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়, ওষুধ খেতে হয়। সপ্তাহখানেক পর আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা। চীনে আসার পর, বিগত আট বছরে, যতদূর মনে পড়ে, মোট দু’বার আমাকে ব্যাক পেইনের কারণে শয্যাশায়ী হতে হয়েছিল। আমার ব্যাক পেইনের খবর শুনে আমাদের সবার প্রিয় চীনা মুরুব্বি ম্যাডাম লিউ (আমরা যাকে ‘লিউ আপা’ বলে ডাকি) আমাকে আকুপাংচার চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, আকুপাংচার শরীরের যে-কোনো ব্যথা সারাতে পারে।

একদিন লিউ আপাই নিয়ে গেলেন ডাক্তার ওয়াং ফু চুয়াংয়ের কাছে। লম্বা একহারা গড়ন ভদ্রলোকের। আশি ছাড়িয়েছেন কবেই। তারপরও ঋজু ভঙ্গিতে হাঁটেন, কম্পনহীন হাতে রোগীদের কান কাটেন। কান কাটার বিষয়টা তাঁর নিজস্ব স্টাইল, নিজের আবিষ্কার। সুঁই ফোটানোর আগে তিনি রোগীদের কানের ভিতরের অংশে ছোট ছুরি দিয়ে অসংখ্য আঁচড় দেন। এতে সামান্য রক্ত বের হয়। সেই ক্ষতস্থানটি আবার তুলোয় ওষুধ মেখে ঢেকে দেন। আমি ডাক্তার চুয়াংয়ের নাম দিয়েছি ‘কান কাটার ডাক্তার’।

ডাক্তার ওয়াং ফু চুয়াংয়ের কাছে আমি টানা কয়েক সপ্তাহ গিয়েছি। প্রতি সপ্তাহে তিন দিনের সেশান। কান কাটার পর সুঁই ফোটানো। প্রতিবারই মনে হয়, আর যাবো না! কান কাটার চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সঙ্গে সুঁই ফোটানোর চ্যালেঞ্জ। দুই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়া সহজ কাজ নয় মোটেই। অন্তত আমার কাছে। কিন্তু আধা ঘন্টার একেকটা সেশান শেষ হবার পর শরীরে যে ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হয়, তা আমাকে আবার ডাক্তারের চেম্বারে টেনে নিয়ে যেতো। ডাক্তার চুয়াংয়ের আকুপাংচার থেকে আমি উপকৃত হয়েছি। শেষ কবে আমাকে ব্যাক পেইনের কারণে শয্যাশায়ী হতে হয়েছিল, চট করে বলতে পারব না।

আকুপাংচারে ওষুধ খেতে হয়নি। কিন্তু প্রোস্টেটের সমস্যায় একবার আমাকে চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ (ট্রাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিন—টিসিএম) খেতে হয়েছিল। প্রতিদিন প্রায় ৪০টি ট্যাবলেট ও ক্যাপসুল! সমস্যা দূর হয়েছিল। সর্বশেষ গত মাসে (সেপ্টেম্বরের শুরুর দিকে) গলার বাম দিকে ব্যথা শুরু হলে আমাকে যেতে হয় বেইজিং ফ্রেন্ডশিপ হসপিটালে। সেখানে আমাকে দেখলেন নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লি ক্য লিন। তিনি আমার গলার আল্ট্রা সাউন্ড করালেন, ব্লাড টেস্ট করালেন। কিছু পাওয়া গেল না। তিনি বললেন: ‘তোমার তো কোনো সমস্যা নেই!’ আমি বললাম: ‘কিন্তু ব্যথা তো আছে!’ তিনি হাসলেন, বললেন: ‘তোমাকে আমি কিছু চীনা ওষুধ দিচ্ছি। এক সপ্তাহ খাও। ব্যথা সেরে যাওয়ার কথা। না সারলে আবার আমার কাছে আসবে।’ প্রতিদিন ৯টি করে ক্যাপসুল। চার দিন খাওয়ার পর ব্যথা উধাও! ডাক্তার লিনের কাছে আমাকে আর যেতে হয়নি।

চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ (টিসিএম)-এর ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। চীনারা প্রাচীনকাল থেকেই এই ওষুধ ব্যবহার করে আসছে। প্রাচীনকালে চারটি ক্ষেত্রে চীন বেশ এগিয়েছিল: জ্যোতিঃশ্রাস্ত্র (অ্যাস্ট্রোনমি), কৃষিবিজ্ঞান (অ্যাগ্রোনমি), গণিতশাস্ত্র (অ্যারিথম্যাটিক), ও টিসিএম। আধুনিক চীনে টিসিএম ছাড়া বাকি তিনটি শাখার চীনা চরিত্র হারিয়ে গেছে। টিসিএম এখনও এর প্রাচীন চরিত্র অনেকটাই ধরে রাখতে পেরেছে। আধুনিক চিকিৎসা-ব্যবস্থার জোয়ারে ভেসে যায়নি টিসিএম। এটি বরং দিন দিন উন্নত হচ্ছে। হয়তো টিকে থাকার তাগিদেই! আজকাল অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি টিসিএম ব্যবহার করা হচ্ছে সাফল্যের সঙ্গে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনে কোভিড-১৯ মহামারিতে মৃতের সংখ্যা অবিশ্বাস্যরকমের কম হওয়ার পেছনে যেসব কারণ ক্রিয়াশীল ছিল, সেগুলোর একটি হচ্ছে টিসিএম-এর সফল প্রয়োগ।

কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাস রোগের চিকিৎসায় টিসিএম-এর সাফল্য বিদেশি চিকিৎসকদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। উদাহরণস্বরূপ, একটি চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধের কথা উল্লেখ করা যায়। এই ওষুধটি আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসকে পরিষ্কার (ক্লিন) করে, বিষমুক্ত (টক্সিনমুক্ত) করে। এই বিশেষ ওষুধটি মহামারি চলাকালেই আবিষ্কার করেন চীনের টিসিএম গবেষকরা এবং চীনের কোভিডে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে প্রয়োগ করে সুফল পান। এখন তো এই ওষুধটি ইতালি, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোভিড রোগের চিকিৎসায় সফলভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তথ্যটি জানিয়েছেন বেইজিং ইউনিভার্সিটি অব চায়নিজ মেডিসেনের উপ-প্রধান ওয়াং ওয়েই।

থিয়েনচিন ইউনিভার্সিটি অব ট্রাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট চাং পো লি জানান, কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় সাফল্যের সঙ্গে প্রয়োগকৃত আরেকটি টিসিএম হচ্ছে ‘লিয়ানহুয়া-ছিংওয়েন’ ক্যাপসুল। দশটিরও বেশি দেশে এই ওষুধটি বাজারজাত করার অনুমতি পাওয়া গেছে। তা ছাড়া, বেশ কয়েকটি দেশে এই ওষুধ বিনামূল্যে দান করেছে চীনা কর্তৃপক্ষ। তিনি আরও জানান, এই ক্যাপসুলটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা বর্তমানে কাজ করছেন এবং চীনা গবেষকদের অভিজ্ঞতালব্ধ সংশ্লিষ্ট তথ্য-উপাত্ত গভীর আগ্রহ নিয়ে খতিয়ে দেখছেন।

পশ্চিমা মিডিয়া মহামারি মোকাবিলায় চীনের অবিশ্বাস্য সাফল্য নিয়ে কথা বলতে দৃশ্যত লজ্জা পায়। তারা মহামারি মোকাবিলায় সাফল্যের উদাহরণ দিতে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরের নাম উল্লেখ করতেই বরং সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ এসব দেশ চীনা মডেল অনুসরণ করেই মহামারি মোকাবিলায় সাফল্য দেখিয়েছে! সিঙ্গাপুরে তো চীনা আকুচাংচার কোভিড রোগের চিকিৎসায় ব্যবহারের অনুমতি পায় গত ৫ মে। এই তথ্যটি একটি ভিডিও-কনফারেন্সে জানান সিঙ্গাপুর চায়নিজ ফিজিশিয়ানস অ্যাসোসিয়েশানের ভাইস-প্রেসিডেন্ট কুও টং হো। তিনি জানান, কোভিড-১৯ রোগ মোকাবিলায় চীনা ওষুধ ও কৌশল সিঙ্গাপুরে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। ন্যাশনাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশান অব ট্রাডিশনাল চায়নিজ মেডিসিনের হিসেব অনুসারে, চীন ৮০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে কোভিড-১৯ রোগসংশ্লিষ্ট টিসিএম থেরাপি, কার্যকর প্রেসক্রিপশান, ও ক্লিনিকাল অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে।

চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধ (টিসিএম) তার নিজগুণেই বিশ্বের অনেক দেশে ইতোমধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ৭৮টি দেশের ২৪০টির বেশি কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটে টিসিএম কোর্স চালু হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত এসব কোর্সে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩৫ হাজারের বেশি। এদিকে, চীনের অভ্যন্তরের টিসিএম কলেজগুলোতে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। প্রতিবছর এসব কলেজে গড়ে ১০ হাজারের বেশি বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছে। পাশাপাশি, গেল বছরের শেষ নাগাদ পর্যন্ত, ৯০টি দেশে ৩৮৮টি টিসিএম সমবায় প্রকল্প চালু করেছে চীন। এ ছাড়া, ‘এক অঞ্চল, এক পথ’ উদ্যোগে অংশগ্রহণ করছে—এমন বেশকিছু দেশে ৩০টি টিসিএম কেন্দ্র গড়ে তোলার কাজও করছে চীন। এসব কেন্দ্রে আকুপাংচারসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা পাবেন সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষ।

চায়না একাডেমি অব চায়নিজ মেডিকেল সায়েন্সেস-এর প্রধান গবেষক লিউ পাওইয়ান সম্প্রতি বলেন: ‘নভেল করোনাভাইরাস মহামারি টিসিএম-কে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ার নতুন সুযোগ করে দিয়েছে।’ তিনি যথার্থই বলেছেন। মহামারি মোকাবিলায় চীনে ও চীনের বাইরে টিসিএমের সফল প্রয়োগ, চীনা ঐতিহ্যবাহী ওষুধকে আরও জনপ্রিয় করবে, এ কথা বলাই বাহুল্য।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)।
alimulh@yahoo.com