অবৈধ গেটই মরণফাঁদ

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ১০:৫৯:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ অগাস্ট ২০২২
  • / ১৬২ Time View

 

‘রাস্তা বানাইছি, এখন তোরা গেট বানাবি। গেটম্যানও নিয়োগ দিবি। বেশি বাড়াবাড়ি করবি না। করলে তোর খবর আছে।’ কথাগুলো একজন জনপ্রতিনিধির। তিনি এভাবে হুমকিধমকির সুরে বলছিলেন রেলের সাবেক একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে। ওই কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ বৈধ গেটও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন যদি আপনারা এভাবে নতুন রাস্তা বানিয়ে গেট দাবি করেন, তাহলে আমরা কী করব। এতে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের সাবেক এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সোমবার  কাছে এমন তথ্য তুলে ধরে বলেন, তিনি দায়িত্বে থাকাবস্থায় এ ধরনের শত শত অবৈধ রেলগেট বন্ধ করার জন্য এলজিইডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও অনেক জনপ্রনিধিকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কথা শোনেননি। নানা কারণে আমরাও কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারিনি। কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করলেও তা আমলে নেয়নি। একপর্যায়ে আমরা হাল ছেড়ে দিই। তিনি মনে করেন, রেলগেটগুলোয় যত দুর্ঘটনা ঘটছে, এর ৯০ শতাংশ লেভেল ক্রসিংয়ে। যার বেশির ভাগই অবৈধ।

এদিকে রেলভবন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে রেলওয়ের ২ হাজার ৮২২টি গেটের মধ্যে অবৈধ গেটের সংখ্যা ১ হাজার ৩৫৪টি। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয়-এসব গেটের ২২৫৮টি অরক্ষিত। অর্থাৎ কোনো গেটম্যান নেই। শুধু তাই নয়, দুই পাশের লোহার ব্যারিকেডও নেই। এমনকি বৈধ গেটের মধ্যে ৯০৪টি গেটও অরক্ষিত। মাত্র গেটম্যান আছে ৫৬৪টিতে। তাও তাদের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ী কর্মচারী। স্থায়ী আছেন মাত্র ৩৩১ জন। একটি গেটে ন্যূনপক্ষে ৬ জন গেটম্যান থাকার কথা। অথচ সে হারে কোথাও লোকবল নেই। প্রয়োজন রয়েছে ১৬ হাজার ৯৩২ জনের। সে তুলনায় এর ধারেকাছে জনবল নেই।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রেলে মোট দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটে লেভেল ক্রসিংগুলোয়। কিন্তু ট্রেন নিজে নিজে দুর্ঘটনায় পড়ে না। সড়ক যান লাইনের ওপরে উঠে দুর্ঘটনা সৃষ্টি করে। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী লেভেল ক্রসিং পারাপারের সময় যানবাহনের চালক ও পথচারীরা উভয় পাশ দেখে নিজ দায়িত্বে রেললাইন পার হবেন। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে রেলকে দায়ী করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ট্রেন কাউকে ধাক্কা দেয় না, বরং বাইরে থেকে এসে ট্রেনকে ধাক্কা দেওয়া হয়।’

রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার বলেন, ‘অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা গেলে রেল দুর্ঘটনা কমে আসবে। আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি বন্ধ করতে, পারিনি। এমনকি আমরা এ ধরনের কিছু অবৈধ গেট বন্ধ করে দিতে দুই পাশে লৌহার বেড়া দেওয়া ছাড়াও রাস্তা কেটে দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারিনি। রাতের আঁধারে এসব বেড়া তুলে ফেলা হয়।’

গত শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাই লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১১ শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর ঘটেনি। এ দুর্ঘটনার পর রেলগেটগুলোর চরম অব্যবস্থাপনার বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জে লেভেল ক্রসিংয়ে বর-কনেসহ ১২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট ঝিনাইদহের লেভেল ক্রসিংয়ে মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এদিকে রেলের অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯ মাসে (২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর ২৮ জুলাই পর্যন্ত) লেভেল ক্রসিংয়ে ১১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩ জন ট্রেনযাত্রীসহ ৮৯ জনের (সড়ক যান যাত্রী) নির্মম মৃত্যু হয়। গত এক যুগে রেলে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৯৬টি, যার মধ্যে শুধু লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে ৯৩৬টি।

রেলওয়ের তথ্য, মোট দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটে বৈধ কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে। এসব দুর্ঘটনায় ৪৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে লেভেলক্রসিং প্রাণ কেড়েছে ৫১৬ জনের। এছাড়া প্রতিবছর গড়ে শুধু লেভেল ক্রসিং প্রাণ কেড়েছে ৪৪ জন করে। পুঙ্গুত্ব করে দিচ্ছে নিহত সংখ্যার দ্বিগুণের বেশি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক সাবেক মহাপরিচালক জানান, ‘লেভেল ক্রসিং যথাযথ উন্নয়ন, অবৈধগুলোকে বন্ধ করা কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে না তৈরি করতে পারে, সেই বিষয়ে রেলপথ বিভাগ কিংবা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কারওরই আগ্রহ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। লেভেল ক্রসিং নিয়ে রাজনৈতিক খেলা আছে। অবৈধগুলো বন্ধ করতে গিয়ে আমার ওপর বারবার হুমকি এসেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যেসব মন্ত্রী দায়িত্বে আসছেন, তারাও কিছু করতে পারেননি। রাজনৈতিক বিষয় হলেও মন্ত্রীরা কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। ওনারা ডিজিদের ওপর চাপিয়ে দেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন ডিজি বলেন, ‘কারও নাম বলব না, নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বললেই ঝামেলায় পড়তে হয়। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জেনে রাখেন। শুধু অবৈধ গেট বেশি থাকার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে রেল তার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী বেশি গতিতে চলতে পারছে না। অর্থাৎ কম গতিতে ট্রেন চালানো হচ্ছে প্রতিটি রুটে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু অত্যাধুনিক কোচ-ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজেই আসছে না। এক যুগ আগে যে গতি নিয়ে ট্রেন চলত, এখন গতি আরও কমিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। নতুন আনা ইঞ্জিন-কোচের গতি ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার। বর্তমানে গড়ে মাত্র ৬৮ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলছে। অতিরিক্ত লেভেল ক্রসিং এবং জরাজীর্ণ লাইনের কারণে ট্রেনের প্রকৃত গতি উঠানো সম্ভব হচ্ছে না।’

রেলওয়ের সাবেক আরও একজন মহাপরিচালক সোমবার বলেন, ‘অবৈধ লেভেল ক্রসিং যারা তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন এলজিইডি, সওজ, পৌরসভার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’ ২০১৩ সালে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে অনুমোদনহীন ক্রসিং ও দুর্ঘটনার ফিরিস্তি দিয়ে একটি চিঠি লেখেন। আজও সেই চিঠি অনুযায়ী সমাধান হয়নি। বন্ধ হয়নি অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো।’

এ বিষয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা রেলওয়ের পক্ষ থেকে বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতেই যথাযথ প্রহরী দিতে পারছি না। অবৈধগুলো আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে। যারা এসব তৈরি করেছে, আমরা লিখিত আকারে জানাচ্ছি বন্ধ করতে, কিংবা যথাযথভাবে গেট নির্মাণ করে প্রহরী নিয়োগ করতে। কিন্তু কোনো বিষয়ই কানে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।’ তিনি জানান, নতুন করে একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বৈধগুলোয় সেন্সর পদ্ধতিতে বেশকিছু গেটে বিশেষ অ্যালার্ম স্থাপন করা হবে। এর ফলে ট্রেন প্রায় এক কিলোমিটার দূরে থাকাবস্থায় গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বেজে উঠবে।’ যুগান্তর

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

অবৈধ গেটই মরণফাঁদ

Update Time : ১০:৫৯:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২ অগাস্ট ২০২২

 

‘রাস্তা বানাইছি, এখন তোরা গেট বানাবি। গেটম্যানও নিয়োগ দিবি। বেশি বাড়াবাড়ি করবি না। করলে তোর খবর আছে।’ কথাগুলো একজন জনপ্রতিনিধির। তিনি এভাবে হুমকিধমকির সুরে বলছিলেন রেলের সাবেক একজন পদস্থ কর্মকর্তাকে। ওই কর্মকর্তা জনপ্রতিনিধিকে বোঝানোর চেষ্টা করে বলেন, ‘আমাদের অধিকাংশ বৈধ গেটও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এখন যদি আপনারা এভাবে নতুন রাস্তা বানিয়ে গেট দাবি করেন, তাহলে আমরা কী করব। এতে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলের সাবেক এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সোমবার  কাছে এমন তথ্য তুলে ধরে বলেন, তিনি দায়িত্বে থাকাবস্থায় এ ধরনের শত শত অবৈধ রেলগেট বন্ধ করার জন্য এলজিইডির চিফ ইঞ্জিনিয়ার ছাড়াও অনেক জনপ্রনিধিকে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা কথা শোনেননি। নানা কারণে আমরাও কোনো আইনি পদক্ষেপ নিতে পারিনি। কয়েকজনের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করলেও তা আমলে নেয়নি। একপর্যায়ে আমরা হাল ছেড়ে দিই। তিনি মনে করেন, রেলগেটগুলোয় যত দুর্ঘটনা ঘটছে, এর ৯০ শতাংশ লেভেল ক্রসিংয়ে। যার বেশির ভাগই অবৈধ।

এদিকে রেলভবন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে রেলওয়ের ২ হাজার ৮২২টি গেটের মধ্যে অবৈধ গেটের সংখ্যা ১ হাজার ৩৫৪টি। সবচেয়ে অবাক হওয়ার বিষয়-এসব গেটের ২২৫৮টি অরক্ষিত। অর্থাৎ কোনো গেটম্যান নেই। শুধু তাই নয়, দুই পাশের লোহার ব্যারিকেডও নেই। এমনকি বৈধ গেটের মধ্যে ৯০৪টি গেটও অরক্ষিত। মাত্র গেটম্যান আছে ৫৬৪টিতে। তাও তাদের বেশির ভাগ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় অস্থায়ী কর্মচারী। স্থায়ী আছেন মাত্র ৩৩১ জন। একটি গেটে ন্যূনপক্ষে ৬ জন গেটম্যান থাকার কথা। অথচ সে হারে কোথাও লোকবল নেই। প্রয়োজন রয়েছে ১৬ হাজার ৯৩২ জনের। সে তুলনায় এর ধারেকাছে জনবল নেই।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে রেলপথমন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘রেলে মোট দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটে লেভেল ক্রসিংগুলোয়। কিন্তু ট্রেন নিজে নিজে দুর্ঘটনায় পড়ে না। সড়ক যান লাইনের ওপরে উঠে দুর্ঘটনা সৃষ্টি করে। রেলওয়ে আইন অনুযায়ী লেভেল ক্রসিং পারাপারের সময় যানবাহনের চালক ও পথচারীরা উভয় পাশ দেখে নিজ দায়িত্বে রেললাইন পার হবেন। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটলে রেলকে দায়ী করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ট্রেন কাউকে ধাক্কা দেয় না, বরং বাইরে থেকে এসে ট্রেনকে ধাক্কা দেওয়া হয়।’

রেলওয়ের মহাপরিচালক ডিএন মজুমদার বলেন, ‘অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো বন্ধ করা গেলে রেল দুর্ঘটনা কমে আসবে। আমরা বহুবার চেষ্টা করেছি বন্ধ করতে, পারিনি। এমনকি আমরা এ ধরনের কিছু অবৈধ গেট বন্ধ করে দিতে দুই পাশে লৌহার বেড়া দেওয়া ছাড়াও রাস্তা কেটে দিয়েছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আটকাতে পারিনি। রাতের আঁধারে এসব বেড়া তুলে ফেলা হয়।’

গত শুক্রবার চট্টগ্রামের মীরসরাই লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ১১ শিক্ষার্থীর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর ঘটেনি। এ দুর্ঘটনার পর রেলগেটগুলোর চরম অব্যবস্থাপনার বিষয়টি ফের সামনে এসেছে। এর আগে ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জে লেভেল ক্রসিংয়ে বর-কনেসহ ১২ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২০১৪ সালের ১ আগস্ট ঝিনাইদহের লেভেল ক্রসিংয়ে মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু হয়। এদিকে রেলের অপারেশন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১৯ মাসে (২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২-এর ২৮ জুলাই পর্যন্ত) লেভেল ক্রসিংয়ে ১১৬টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৩ জন ট্রেনযাত্রীসহ ৮৯ জনের (সড়ক যান যাত্রী) নির্মম মৃত্যু হয়। গত এক যুগে রেলে মোট দুর্ঘটনা ঘটেছে ৯৯৬টি, যার মধ্যে শুধু লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটে ৯৩৬টি।

রেলওয়ের তথ্য, মোট দুর্ঘটনার ৯০ শতাংশই ঘটে বৈধ কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিংয়ে। এসব দুর্ঘটনায় ৪৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে লেভেলক্রসিং প্রাণ কেড়েছে ৫১৬ জনের। এছাড়া প্রতিবছর গড়ে শুধু লেভেল ক্রসিং প্রাণ কেড়েছে ৪৪ জন করে। পুঙ্গুত্ব করে দিচ্ছে নিহত সংখ্যার দ্বিগুণের বেশি।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ের এক সাবেক মহাপরিচালক জানান, ‘লেভেল ক্রসিং যথাযথ উন্নয়ন, অবৈধগুলোকে বন্ধ করা কিংবা অবৈধ লেভেল ক্রসিং যাতে না তৈরি করতে পারে, সেই বিষয়ে রেলপথ বিভাগ কিংবা রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কারওরই আগ্রহ নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। লেভেল ক্রসিং নিয়ে রাজনৈতিক খেলা আছে। অবৈধগুলো বন্ধ করতে গিয়ে আমার ওপর বারবার হুমকি এসেছে। রেলপথ মন্ত্রণালয়ে যেসব মন্ত্রী দায়িত্বে আসছেন, তারাও কিছু করতে পারেননি। রাজনৈতিক বিষয় হলেও মন্ত্রীরা কোনো দায়িত্ব নিতে চান না। ওনারা ডিজিদের ওপর চাপিয়ে দেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাবেক একজন ডিজি বলেন, ‘কারও নাম বলব না, নিজের পরিচয় দিয়ে কথা বললেই ঝামেলায় পড়তে হয়। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা জেনে রাখেন। শুধু অবৈধ গেট বেশি থাকার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে রেল তার ক্যাপাসিটি অনুযায়ী বেশি গতিতে চলতে পারছে না। অর্থাৎ কম গতিতে ট্রেন চালানো হচ্ছে প্রতিটি রুটে।’ তিনি বলেন, ‘শুধু অত্যাধুনিক কোচ-ইঞ্জিন আনা হচ্ছে। কিন্তু কোনো কাজেই আসছে না। এক যুগ আগে যে গতি নিয়ে ট্রেন চলত, এখন গতি আরও কমিয়ে ট্রেন চালাতে হচ্ছে। নতুন আনা ইঞ্জিন-কোচের গতি ১২০ থেকে ১৩০ কিলোমিটার। বর্তমানে গড়ে মাত্র ৬৮ কিলোমিটার গতি নিয়ে ট্রেন চলছে। অতিরিক্ত লেভেল ক্রসিং এবং জরাজীর্ণ লাইনের কারণে ট্রেনের প্রকৃত গতি উঠানো সম্ভব হচ্ছে না।’

রেলওয়ের সাবেক আরও একজন মহাপরিচালক সোমবার বলেন, ‘অবৈধ লেভেল ক্রসিং যারা তৈরি করেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা উচিত। তিনি যখন দায়িত্বে ছিলেন, তখন এলজিইডি, সওজ, পৌরসভার সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।’ ২০১৩ সালে এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলীকে অনুমোদনহীন ক্রসিং ও দুর্ঘটনার ফিরিস্তি দিয়ে একটি চিঠি লেখেন। আজও সেই চিঠি অনুযায়ী সমাধান হয়নি। বন্ধ হয়নি অবৈধ লেভেল ক্রসিংগুলো।’

এ বিষয়ে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা রেলওয়ের পক্ষ থেকে বৈধ লেভেল ক্রসিংগুলোতেই যথাযথ প্রহরী দিতে পারছি না। অবৈধগুলো আরও ভয়ানক হয়ে উঠছে। যারা এসব তৈরি করেছে, আমরা লিখিত আকারে জানাচ্ছি বন্ধ করতে, কিংবা যথাযথভাবে গেট নির্মাণ করে প্রহরী নিয়োগ করতে। কিন্তু কোনো বিষয়ই কানে নিচ্ছে না সংশ্লিষ্টরা।’ তিনি জানান, নতুন করে একটি প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। বৈধগুলোয় সেন্সর পদ্ধতিতে বেশকিছু গেটে বিশেষ অ্যালার্ম স্থাপন করা হবে। এর ফলে ট্রেন প্রায় এক কিলোমিটার দূরে থাকাবস্থায় গেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বেজে উঠবে।’ যুগান্তর