জাতিবিদ্যাবিদ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
- Update Time : ১০:৫৯:৫৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১২ ডিসেম্বর ২০২২
- / 239
জাতিবিদ্যাবিদ আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী‘র সাথে আমার স্মৃতি জমা হয়েছে অনেক। আর সেসব স্মৃতির প্রায় সবই গুরুত্বপূর্ণ বলেই আমি মনে করি। কারণ, আমি কখনো অহেতুক সময় নষ্ট করতে তাঁর কাছে যাইনি। বলা চলে নিজে থেকেও খুব একটা যাইনি। কখনো তিনি ফোন করেছেন কিংবা কখনো আমার কাজের জায়গা থেকে বলা হয়েছে যেতে।
গত কয়েক বছর তিনি অসুস্থতার সাথেই বসবাস করছিলেন। এসময়ের মধ্যে একবার কেবল হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে বিডিনিউজ২৪ এ তাঁকে নিয়ে একটা কলামও লিখেছিলাম। সে লেখাটি আমি যাওয়ার আগেই নাকি তিনি পাঠ করেছিলেন। কেউ একজন প্রিন্ট করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে খুব আবেগ তাড়িত হয়েই অনেক কথা বলেছিলেন। তারমধ্যে একটি কথা আমার কানে খুব বেজেছিলো-‘আমাকে নিয়ে কেউ লেখে না। আমিই কেবল লিখি। আপনি আমাকে নিয়ে অত্যন্ত আবেগী একটি কলাম লিখেছেন।‘
আমি জানিনা তিনি ঠিক বলেছিলেন কিনা। উনাকে নিয়ে লেখালেখি কি হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই। তবে তিনি যে সবসময় আলোচনা-সমালোচনার তুঙ্গে থাকেন সে কথা আমরা সবাই জানি। এখন প্রশ্ন হলো কেন তিনি আলোচনায় থাকতেন বা থাকেন?
তিনি একাধারে ছিলেন, সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি এবং মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর এই যে বহুমুখিতা তাও আলোচনার একটা কারণ। কলামিস্ট হিসেবে তিনি পাঠকদের মাঝে সমধিক পরিচিত। যদিও একুশের গানের রচয়িতা হিসেবে তাঁর পরিচিতি সর্বমহলে। এই গানটির জন্য বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ যতকাল বেঁচে থাকবে ততকাল তিনিও অমর হয়ে রইবেন।
তবে কলামিস্ট হিসেবে তিনি সব সময় আলোচনা-সমালোচনায় ছিলেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। অধিকাংশ কলামে তিনি অতীত ইতিহাসকে দাঁড় করিয়ে নতুন ইতিহাস কিংবা নতুন পথের নির্দেশনা দিতেন। এ কাজটি করতে গিয়ে তিনি আলোচনা-সমালোচনায় সব সময় তুঙ্গে ছিলেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে তাঁর যে স্মৃতি তা একটা শ্রেণির গাত্রদাহের কারণ হয়েছে সব সময়। তারপরও তিনি সত্য ইতিহাস থেকে সরে যাননি কখনো।
এই সত্যভাষ্যের কারণে তিনি কেবল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রের রোষানলেই পড়েননি, খোদ আওয়ামী ঘরনা এমনকি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সমালোচনার শিকারও হয়েছিলেন। তাঁর অনেক লেখা আছে যাতে তিনি সরকারকে একটা নির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করতেন। তাতে সরকার কি ভুলত্রুটি করছে তা নিয়ে বিশেষভাবে আলোপকপাত করতেন তিনি। তাঁর একথাগুলো অনেকসময় সরকার প্রধান কিংবা দলের নেতারা পছন্দ করতেন না। এক সময় এসব কারণে ওনাকে বলতে শুনেছি,‘শেখ হাসিনা আমার ফোন ধরেন না‘। জানি না শেষ পর্যন্ত এমন ছিল কিনা।
এই যে আলোচনা-সমালোচনা এসব থেকে দূরে সরে কিছু কাজ করতে চাইতেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। ওনার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও কর্মনির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন। এর জন্য তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। নিয়ত অসুস্থতার সাথে লড়াই করেও তিনি কাজে নিমগ্ন ছিলেন।
আমাকে বহুবার বলেছিলেন, তিনি একটা সাহিত্য পত্রিকা করতে চান। আমি যেন তাঁর সাথে থাকি। আমাকে নির্বাহী সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন। পরিকল্পনা ছিল সে পত্রিকায় দুই বাংলার লেখকরা লিখবেন। তাঁর এই প্রবল ইচ্ছেটিও অসম্পূর্ণই রয়ে গেল।
ওনার সর্বশেষ যে ইচ্ছেটি ছিল তার সাথে আমি পুরোপুরি যুক্ত ছিলাম। একদিন বাংলা টিভির পরিচালক ড. দিনাক সোহানী পিংকী আমাকে ফোনে জানালেন, গাফ্ফার চৌধুরী তাঁর আত্মজীবনী লিখতে চান, এতে আমি যেন সহায়তা করি। তার পরদিনই ফোন করলেন গাফ্ফার চৌধুরীর ছোট মেয়ে বিনিতা চৌধুরী। বললেন‘ বাবা কথা বলতে চান‘।
গাফ্ফার ভাই যথারীতি বলতে থাকলেন, ‘আপনাকে ফোন না করলেতো আসেন না।‘ আমি বললাম, গাফ্ফার ভাই আমি খুব শীঘ্রই আসব। বললেন, আসেন, আপনার সাথে জরুরি কথা আছে। আমি ছাব্বিশ জানুয়ারী ২০২২ এ গাফ্ফার ভাইয়ের বাসায় যাই। কথার শুরুতেই বললেন, ‘মিলটন আপনি বিভিন্ন সময় বলেছিলেন, আত্মজীবনী লেখার কথা। বিভিন্ন কারণে বিষয়টি আমি এড়িয়ে গেলেও এখন কাজটি করতে চাই। আমার হাতে বেশি সময় নেই। ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছে। এরমধ্যে কাজটি করতে হবে। এ কাজ আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।‘
আমি বলেছিলাম,‘ আমি কেন গাফ্ফার ভাই, আরো কতজন আছেন আমার চেয়ে ভালো করতে পারবেন।‘ তিনি তাতে রাজি হলেন না। আমাকেই কাজটি করতে হবে। সেদিন এ পর্যন্তই। বেশি কথা বলতে পারিনি। অন্যান্য বিষয়ে কথা হয়েছে কিন্তু জীবনীগ্রন্থ বিষয়ে তিনি আর কথা বলেননি। কারণ একই সময়ে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন, তিনি এতো বেশি কথা বলছিলেন, আমাদের কথা বলার সুযোগ থাকল না আর। এক পর্যায়ে আমি উঠে চলে এলাম। আসার সময় বলেছিলাম, আবার শীঘ্রই যাব।
কথামতো এক সপ্তাহ পরেই আবার গিয়েছিলাম। সেদিন কেউ ছিল না। আমি, উনি এবং মেয়ে বিনিতা চৌধুরী। অবশ্য পাশে অন্য মেয়ে সম্ভবত তনিমা কিংবা চিনু চৌধুরী ছিলেন। আমরা কথা শুরু করি। আমি জানালাম কাজটি কিভাবে শুরু করা যেতে পারে এবং কোন প্রক্রিয়ায় কাজটি হবে। আমার সব কথা শুনে গাফ্ফার (ভাই) চৌধুরী বললেন, শুরু করেন। কথা হলো আমি সপ্তাহে দুইদিন সারাদিন কাজ করব ওনার সাথে। রেকর্ড করা হবে সব কথা। পরে আমি সেগুলো লিখিত রূপ দেব। গাফ্ফার ভাই আবারো বললেন, ‘এতো সময় পাবেনতো? আমার কিন্তু বেশি সময় নেই।‘ আমি প্রয়োজনে আরো বেশি সময় দেব বলেও প্রতিশ্রুতি দিলাম।
সব ঠিকঠাক, কাজ শুরু করব। কিন্তু কাজের প্রক্রিয়া নিয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেন বিনিতা চৌধুরী। তিনি চাননা কোনো কথা রেকর্ড হোক। হাতে লিখতে হবে এবং সব লেখা তাদের বাসায় রেখে আসতে হবে। বাইরে নেয়া যাবে না। আমি সরাসরি বললাম, আমি সে কাজ করব না। আপ টু দ্য মার্ক না হলে আমি সে কাজ করতে চাই না। আমার কাজের যে প্রক্রিয়া বলেছি তা থেকে একটু এদিক সেদিক হলেও আমি করব না। গাফ্ফার ভাই রাজি হলেন, বললেন, বিনু তুমি যেভাবে বলছ সেভাবে ভালো কাজ হবে না। মিলটন যেভাবে বলছে সেভাবেই কাজটি হতে হবে।
কিন্তু কিছুতেই বিনু রাজি হলেন না। জিজ্ঞেস করলাম কেন হবে না? এবার বিনু মুখ খুললেন-‘দেখুন আপনাকে অনেকদিন ধরে চিনি। বাবাও আপনাকে খুব পছন্দ করেন। পিংকী আপা আপনার সম্পর্কে আমাকে বলেছেন। সব ঠিক আছে, কিন্তু আমরা বাবার অটোবায়োগ্রাফির কোনো রেকর্ড বাইরে যেতে দিতে চাই না। বাবাকে অনেকে ব্যবহার করেছে। আমরা আর চাই না।‘ উদাহরণ হিসেবে গাজিপুরের মেয়র কেলেঙ্কারির ঘটনায় গাফ্ফার ভাইয়ের নাম ভাঙ্গিয়ে কেউ একজন ধান্দা করেছে বলেও জানালেন।
আমি বললাম, এসবের সাথে গাফফার ভাইয়ের আত্মজীবনীর সম্পর্ক কি? তারপরও বিনু কিছুতেই রাজি হলেন না। বললেন, ‘বাবা চান আপনি কাজটা করে দেন। আমরাও চাই। কিন্তু কোনো রেকর্ড করা যাবে না। কোনো লেখা বাইরে নেয়া যাবে না।‘ আমি এক কথাই বললাম, প্রশ্নই আসে না। আমি এভাবে কাজ করব না। কারণ কাজটি অত্যন্ত নীচু মানের একটি কাজ হবে। এমন কাজের সাথে আমি যুক্ত হতে চাই না।‘ গাফ্ফার ভাই আবার মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু হলো না।
তখন আমি একটু রাগতস্বরেই বলেছিলাম, ‘দেখুন বিনু আপা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আপনি নিজের বাবা হিসেবে দেখবেন না অন্তত এ কাজের জন্য। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাথে যুক্ত পুরো বাংলাদেশ, বাংলা ভাষা, বাংলাদেশের শিল্প-সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ইতিহাস। তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশ হওয়া পুরো জাতীর জন্য একটি প্রামান্য দলিল। আপনি যেভাবে বলছেন, সেভাবে এ কাজ হবে না। আর যদি না হয়, তাহলে কখনো আমি যদি স্মৃতিচারণ করি বলব, আপনার জন্যই গাফ্ফার চৌধুরীর জীবনী লেখা হয়নি। এই দায় আপনি কিভাবে এড়াবেন।‘ আমি ফিরে আসার আগে বলেছিলেন, পরে ভেবে জানাবেন।
আমি আর কোনো ফোন পাইনি। আমি ফিরে আসার কিছুদিন পর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আবার নেয়া হলো হাসপাতালে। এরমধ্যেই তেরো এপ্রিল (২০২২) মারা গেলেন বিনিতা চৌধুরী। আমরা জানতাম তিনি দীর্ঘদিন দূরারোগ্য ক্যান্সারে ভুগছিলেন। কিন্তু তাকে দেখলে মনে হতো না। এতো স্বভাবিক থাকতেন। আমি গেলেই চা করে আনতেন। দীর্ঘদিন দেখে আসছিলাম, বিনিতাই গাফ্ফার চৌধুরীকে দেখাশুনা করতেন। তার মৃত্যুর পর গাফ্ফার ভাই মানসিকভাবে আরো ভেঙ্গে পড়াটাই ছিল স্বাভাবিক। ফলে চিকিৎসকের বেঁধে দেয়া সময়ের আগেই তিনি চলে গেলেন।
তিনি চলে যাবেন আমরা যেমন জানতাম, তিনিও জানতেন। সবচেয়ে আবাক করা বিষয় হলো, তিনি যে চলে যাবেন তা বলার ক্ষেত্রে কোনো রকমের ভয়ভীতি তাঁর মধ্যে দেখিনি। চলে যাওটাই যে স্বাভাবিক তাই তিনি মনে করতেন।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর চলে যাওয়াকে কি একটি অধ্যায়ের শেষ বলব? না বলব না। কারণ তিনি এক জীবনে যা সৃষ্টি করেছেন এবং যা রেখে গেছেন তার চর্চা হবে মহাকাল ধরে। অতএব তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলি কি করে! তিনি রয়েছেন, থাকবেন তাঁর কর্মের মধ্যে। সে কর্মে আমরা বারবার দম দেব, দম নেব। কোথাও কোথাও থেকে থোকা থোকা স্মৃতি তুলে এনে রেখে দেব আমাদের রচনায়। দেখব ইতিহাস কিভাবে কথা কয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মধ্যে একটা শিশু বসবাস করত। কারণ সবকিছুকে সহজভাবে দেখার এবং সহজভাবে করার একটা বিরল মন ছিল তাঁর। একটা বিষয় আমি সব সময় লক্ষ্য করেছি, কাউকে তিনি না বলতেন না। যে কোনো অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেলেই হাজির হতেন। দীর্ঘ অসুস্থতায় লাঠি ভর দিয়ে চলে আসতেন অনুষ্ঠানে। এক সময লাঠি ভর করে হাঁটার ক্ষমতাও হারালেন। তাতেও তিনি দমে যাননি। হুইল চেয়ারে করে উপস্থিত হতেন অনুষ্ঠানে। কেই হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড কটূ কথা বলেছেন, তিনি শুনেছেনও, তারপরও সেই ব্যক্তিকে মন্দ কোনো কথা বলতেন না তিনি।
আমি লন্ডনে আসি ২০০৭ সালের প্রথমে। শিল্প-সাহিত্য করি। এ অনুষ্ঠান সে অনুষ্ঠানে যাই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে তুমুল কাজ করি। এসব অনুষ্ঠানের কোনো কোনোটিতে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীও উপস্থিত থাকতেন। কিন্তু কখনো আমি তাঁর সামনে যাইনি। এটি হয়তো আমার পাঠক কিংবা বন্ধুরা জানেন- আমি নিজে থেকে বিখ্যাত মানুষদের সাথে কথা বলতে পারি না। কেন জানি আমাকে দিয়ে হয় না। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর বেলায়ও আমার তাই হয়েছিল।
সম্ভবত ২০১৪ সালের কোনো এক সময় পূর্ব লন্ডনের মন্টিফিউরি সেন্টারে একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছি। সে অনুষ্ঠানে তিনিও ছিলেন। অনুষ্ঠান শেষে ফিরে আসছি। হঠাৎ পেছন থেকে দেখি কেউ একজন হাত টেনে ধরেছেন। দেখি গাফ্ফার ভাই। আমি যারপরনাই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম। বললেন-‘সবাই আমার সাথে এসে কথা বলে, পরিচিত হয়, তাদের বই দিয়ে যায়। আপনি কখনো আসলেনও না আপনার কোনো বইও দিলেন না।‘ আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। উনি যে আমাকে চেনেন তাও জানতাম না। পেছন থেকে কবি শামীম আজাদ কথাগুলো শুনছিলেন। তিনি এসে আমাকে বকা দিলেন। বললেন, যেন ওনার বাসায় গিয়ে বই দিয়ে আসি। এই হলেন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। সেদিন থেকে আমি তাঁর প্রতি অবনত থেকেছি।
আমি ২০০৭ সালে লন্ডনে এলেও ২০১৪ সালের এই দীর্ঘ সময়ে বহু অনুষ্ঠানে উনাকে দেখেছি। অনুষ্ঠানে উনাকে ঘিরে থাকে মানুষ। কিন্তু আমার সে ভাগ্য বা ইচ্ছে হয়নি কখনো। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে প্রয়োজনে উনার সাথে আমার কথা হতো, দেখাও হতো। এক সময় আমার প্রকাশিত ক‘টি গ্রন্থ উনাকে বাসায় দিয়ে এসেছিলাম। পাঠ করে সে কি প্রসংশসা! আমি বললাম, গাফ্ফার ভাই আসলেই কি লেখা কিছু হয়েছে, নাকি খুশি করার জন্য বলছেন। উনি সিরিয়াস পাঠকের মতো বললেন, ‘সমসাময়িক সময়ে আপনি অন্যতম কবি। তবে আপনার গদ্য আমার খুব ভালো লেগেছে।‘
আরেকবার হলো কি, সাজিয়া ¯স্নিগ্ধা নামের এক তরুণী ফোনে বললেন, গাফ্ফার ভাই আমাকে যেতে বলেছেন। ¯স্নিগ্ধা তখন গাফ্ফার ভাইয়ের অনুরিকনের কাজ করতেন সম্ভবত। তার ক‘দিন পরেই গেলাম। কথা প্রসঙ্গে গাফ্ফার ভাই বললেন, তাঁকে দৈনিক জনকন্ঠ থেকে বলা হয়েছে একজন তরুণ লেখককে নিয়ে লিখতে। সেজন্য তিনি আমার একটা সাক্ষাৎকার নেবেন। আমারতো বিস্ময়ের আর সীমা থাকল না। গাফ্ফার চৌধুরী নেবেন আমার সাক্ষাৎকার! যে কথা সে কাজ। তিনি বাংলাসাহিত্যের নানান খুঁটিনাটি বিষয়ে আমাকে প্রশ্ন করতে থাকলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-বিভিন্ন যুগের প্রভাব, আধুনিক যুগ, বিশ্বসাহিত্য কিছুই বাদ গেলো না। পরে তিনি বলেছিলেন সে লেখাটি জনকন্ঠ ছাপিয়েছে। আমি আর সংগ্রহ করিনি। করা উচিত ছিলো। এটা আমার জীবনের জন্য একটি বড় ঘটনা। এই প্রসঙ্গের অবতারণা করলাম এটা বুঝানোর জন্য যে, শিল্প-সাহিত্যের প্রতি আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর আমৃত্যু লালিত্য ভালোবাসাকে বোঝার জন্য।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সাক্ষাৎকার দেয়া লেখক, সাংবাদিক। তিনি এ বিষয়ে ভীষণ বিরক্ত হতেন শেষের দিকে। বলতেন, সবার একই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে তিনি বিরক্ত। নতুন কিছু বলতে চান। সে নতুন কথা কি হতে পারে। সবইতো বলা হয়ে গেছে। আমি একবার বললাম, গাফ্ফার ভাই আপনি এখন থেকে নতুন কথাই বলবেন। নাটক লিখতে থাকুন। তাই শেষদিকে এসে প্রায়ই বলতেন তিনি নাটক তৈরি করতে চান। আমি সবকিছু বাদ দিয়ে তাঁর একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়ে কথা বলার আগ্রহ পোষণ করেছিলাম। বলবেনও বলেছিলেন। ব্যক্তিগত মানে যা তিনি আগে কোথাও বলেননি। জিজ্ঞেস করেছিলেন কেন। বলেছিলাম বিখ্যাতদের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জানার একটা সুপ্ত বাসনা আছে পাঠকের মধ্যে। আপনি না হয় পাঠকদের সে আনন্দ দিলেন। তাতে অন্তত নতুন কিছু বলা হবে। আমার কথা শুনে তিনি শিশুর মতো খিলখিল করে হেসে উঠেছিলেন।
এভাবে বিভিন্ন সময় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী অনেক অজানা কথাই বলেছিলেন, যা তিনি কখনো কাউকে বলেননি, কোনো লেখায় প্রকাশ করেননি। কারণ তিনি মনে করতেন এসব বলে ফেললে অনেকে রুষ্ট হতে পারেন। তাছাড়া অন্যের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা রয়েছে তাও প্রকাশ করতেন।
তিনি অবলীলায় মানুষকে বিশ্বাস করতেন। সেই বিশ্বাসের জন্য তিনি বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। যে কথাটি তাঁর কন্যা বিনু আত্মজীবনী লেখার বিষয়ে বলেছিলেন। তারপরও তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি। শেষ পর্যন্ত মানুষকেই বিশ্বাস করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত কাজে ডুবে ছিলেন। প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যেও বিছানা থেকে লেখা পাঠিয়েছেন বিভিন্ন পত্রিকায়। অনলাইনে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ফলে অসুস্থতা তাঁকে কর্মকাণ্ড থেকে দূরে সরাতে পারেনি। আমি তাঁর এমন প্রাণশক্তি দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
তাঁকে অনুরসরণ করার মতো অনেক উদারহরণ রয়েছে। আমি তাঁর কলাম অনুসরণ করা শুরু করি নব্বই দশকের শুরু থেকে। তাঁর কলাম পড়ে কলাম লেখা শিখেছি। তিনি নেই এখন, কিন্তু তাঁর কাজ থেকে আজীবন শিখে যাব, সে সুযোগ তিনি রেখে গেছেন আমাদের জন্য।
লেখক: মিলটন রহমান, কবি, কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক।