‘নদী ভাঙন আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে’: জলবায়ু বিপর্যয়ে বাড়ছে বন্যা ও নদী ভাঙন

বীর সাহাবী
  • Update Time : ১০:৩৮:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ অগাস্ট ২০২৩
  • / 47

বন্যায় কুড়িগ্রাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলায বাড়িঘর সব তলিয়ে গেছে। ছবি- বীর সাহাবী

শফিক মিয়াজির বয়স বর্তমানে ৪৫ বছর। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। তিনি এক সময় সপরিবারে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নারায়ণপুরে বসবাস করতো। কিন্তু ২০১৫ সালের ভয়াবহ বন্যা শফিকের জীবন উলট পালট কর দেয়। বন্যা তার ঘরবাড়ি সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সে বাধ্য হয়ে রাজধানী ঢাকায় চলে আসে।

চার জনকের অভিভাবক তার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করে মিরপুর ৭ নম্বর ভোলা বস্তিতে থাকতে শুরু করেন। আর পেশা হিসেবে বেছে নেন রিকশা চালানো।

শফিক মিয়াজি আক্ষেপ করে বলেন, গ্রামে আমি ছোট খাট একটা ব্যবসা করতাম। এর মাধ্যমে ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু ২০১৫ সালের বন্যা আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে।’

‘বন্যা আমার বসত ভিটাসহ আমার কিছু গবাদি পশু ছিল সেগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমি অন্যত্র গিয়ে পরিবারের সবার জীবন কোনো রকম বাঁচিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এখানে আমার পরিচিত একজন এই বস্তিতে থাকেন। তিনিই আমাকে এখানে থাকার সকল বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এখানে কোনো রকম রিকশা চালিয়ে বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।’

শফিকের মতো অনেকেই ২০১৫ সালের বন্যায় নিজেদের সহায় সম্বল হারিয়ে অনত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

২০১৪ সালে ঝড়ের সময় ভোলা জেলার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছে। গত এক দশকে দুর্যোগের কারণে প্রায় ১৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। (ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন/এলামি)

প্রতি বছর বন্যায় বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ মতে, বিগত ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত বন্যায় দেশে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ ১ লাখ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা। বিবিএস জানায়, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ১১টি প্রধান দুর্যোগের বিপরীতে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে খানা ধরে ধরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই জরিপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। জলবায়ু পরিবর্তনের অনুঘটক যেমন, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, কার্বন নিঃসরণ, গ্রিন হাউজ গ্যাস প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

শফিকের মতো ভোলা বস্তিতে বসবাস করা হোসেন আলীর সঙ্গে কথা হয় বাণিজ্য প্রতিদিনের। হোসেন আলী অবশ্য এই বস্তিতে এসেছেন দক্ষিণের জেলা ভোলা থেকে। সে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে তার সব হারিয়ে এই বস্তিতে এসে ঠাঁই নিয়েছে।

হোসেন জানান, ভোলার জেলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডে পাশ দিয়েই বহমান তেতুলিয়া নদীর পাশে তার বসতবাড়ি ছিল। যা এখন শুধুই অতীত।

মনে অনেকটা কষ্ট নিয়ে হোসেন বলেন, ‘এক সময় আমার নিজের বাড়ি ছিল। আমার সুখের সংসার ছিল। কত স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়ে বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হবে। কিন্তু একন সবই অতীত। নদী আমার সব স্বপ্ন নষ্ট করে দিয়েছে ‘

‘আমার বাপ দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল ১ হাজার শতকের ওপরে। এই সব সম্পত্তি নদী ভাঙনে শেষ হয়ে গেছে। আমার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সম্পত্তি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে আসি।’

এই বস্তিতে অধিকাংশ লোক ভোলা জেলা বলে জানান হোসেন। তারা সবাই নদী ভাঙনের ফলে নিঃস্ব হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

নদীভাঙনে বছরে বাস্তুচ্যুত ২৫ হাজার মানুষ

নদীভাঙনে দেশে প্রতি বছর বিলীন হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি। এর সঙ্গে প্রতি বছর বাস্তচ্যুত হচ্ছে ২৫ হাজার মানুষ। তারা জমি, ভিটেমাটি হারিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে বিভিন্ন শহরে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশে ১৯৭৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান দুই নদী পদ্মা-যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে যমুনায় বিলীন হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর, আর পদ্মায় ৬৩ হাজার ৫৫৮ হেক্টর। গড়ে প্রতি বছর ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি বিলীন হচ্ছে। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি, বসতবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ ও অবকাঠামো।

ভোলা বস্তি রাজধানী ঢাকার বস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই বস্তির বেশির ভাগ মানুষ ভোলা জেলার। নদী ভাঙনের ফলে দিন দিন এই বস্তিতে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। (ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন/লেন্স কালচার)

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দুর্যোগবিষয়ক পরিসংখ্যান (বিডিআরএস) বলছে, ‘২০২১ : ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেকটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদী ও উপকূলের ভাঙনে ক্ষতির শিকার হওয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া নদী ও উপকূলের ভাঙনে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

বাড়ছে বাল্যবিবাহের হার 

নদী ভাঙন ও অতি বন্যার ফলে বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে দিন দিন আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে বাল্যবিবাহের হার। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের ভরনপোষনের দায়িত্ব থেকে অনেকটা রেহাই পেতে কন্যা সন্তানদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। রাজধানীর কড়াইল বস্তির ফারজানা আক্তারের বয়স ২২ বছর। তার ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। তার ২ ছেলে এবং একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।

ফারজানা জানান, বন্যায় তার বাবা সবকিছু হারিয়ে এই বস্তিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের ভরনপোষণ করতে কষ্ট হলে তাকে ১৬ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। নিজের মত না থাকা সত্বেও পরিবারের কথা চিন্তা করে তাকে বিয়ে করতে হয়।

‘আমার এখনি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কী আর করার! পরিবারের কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে হয়েছে। তবে আমি চাই আমার ছেলেমেয়েকে যেন আমার মতো ভাগ্য বরণ করতে না হয়।

২০২৪-এর মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ৪১ দশমিক ৬। ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ: এ প্রোফাইল অব প্রগ্রেস ইন বাংলাদেশ’ জানাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক।

বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ অনুসারে বাংলাদেশে একজন নারীর বিবাহের বৈধ বয়স  নূন্যতম ১৮ এবং পুরুষের ২১। তবে এই আইনের লংঘন প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে। ইউনিসেফের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি আর বিশ্বে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম

জলবায়ু সংকটের ফলে তীব্র খরার সৃষ্টি হলে সুপেয় পানি সংগ্রহে কয়েক মাইল দূরত্বে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। (ছবি: বীর সাহাবী)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ বছরের আগে মেয়েদের মধ্যে বিয়ের হার বেড়ে গেছে। বিয়ে করা মানুষের অধিকার, তবে সেটি হলো ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর হলে এবং মেয়েদের ১৮ বছর। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের অবস্থার উন্নতি না হয়ে অবনতি হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোয় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।’

আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন-এর একটি প্রতিবেদনে “বাল্যবিবাহ-জলবায়ু হটস্পট দেশ” হিসেবে বিবেচিত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে বলা হয়, ২০৫০  সালের মধ্যে এসব দেশের প্রায় ৪০ মিলিয়ন মেয়ে জলবায়ু সংকটের কারণে বাল্যবিবাহের মতো কঠোর বাস্তবতার  মুখোমুখি হবার মতো চরম ঝুঁকিতে থাকতে পারে।

জলবায়ু ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান

জলবায়ু ঝুঁকির দিক থেকে সবচেয়ে আগে রয়েছ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতি। বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র ০.৪৭% হলেও ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

ভোলা বস্তির সুমি আক্তার বর্ণনা দিচ্ছেন কীভাবে তার জমি, ঘরবাড়ি সব হারিয়ে ভোলা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। (ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন/লেন্স কালচার)

২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ক্লাইমেট ট্রাস্ট তহবিল গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রায় ৮০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media


‘নদী ভাঙন আমার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে’: জলবায়ু বিপর্যয়ে বাড়ছে বন্যা ও নদী ভাঙন

Update Time : ১০:৩৮:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২ অগাস্ট ২০২৩

শফিক মিয়াজির বয়স বর্তমানে ৪৫ বছর। তিন মেয়ে ও এক ছেলের জনক তিনি। তিনি এক সময় সপরিবারে কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল নারায়ণপুরে বসবাস করতো। কিন্তু ২০১৫ সালের ভয়াবহ বন্যা শফিকের জীবন উলট পালট কর দেয়। বন্যা তার ঘরবাড়ি সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সে বাধ্য হয়ে রাজধানী ঢাকায় চলে আসে।

চার জনকের অভিভাবক তার সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য চিন্তা করে মিরপুর ৭ নম্বর ভোলা বস্তিতে থাকতে শুরু করেন। আর পেশা হিসেবে বেছে নেন রিকশা চালানো।

শফিক মিয়াজি আক্ষেপ করে বলেন, গ্রামে আমি ছোট খাট একটা ব্যবসা করতাম। এর মাধ্যমে ভালোই চলছিল সবকিছু। কিন্তু ২০১৫ সালের বন্যা আমার জীবনটাই বদলে দিয়েছে।’

‘বন্যা আমার বসত ভিটাসহ আমার কিছু গবাদি পশু ছিল সেগুলোও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। আমি অন্যত্র গিয়ে পরিবারের সবার জীবন কোনো রকম বাঁচিয়ে ঢাকায় চলে আসি। এখানে আমার পরিচিত একজন এই বস্তিতে থাকেন। তিনিই আমাকে এখানে থাকার সকল বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। এখানে কোনো রকম রিকশা চালিয়ে বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যতের জন্য লড়াই করে যাচ্ছি।’

শফিকের মতো অনেকেই ২০১৫ সালের বন্যায় নিজেদের সহায় সম্বল হারিয়ে অনত্র চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।

২০১৪ সালে ঝড়ের সময় ভোলা জেলার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে যাচ্ছে। গত এক দশকে দুর্যোগের কারণে প্রায় ১৫ মিলিয়ন বাংলাদেশি বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। (ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন/এলামি)

প্রতি বছর বন্যায় বাংলাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপ মতে, বিগত ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত বন্যায় দেশে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যার আর্থিক পরিমাণ ১ লাখ এক হাজার ৮৮ কোটি টাকা। বিবিএস জানায়, বাংলাদেশের ৬৪ জেলার ১১টি প্রধান দুর্যোগের বিপরীতে দুর্যোগপ্রবণ এলাকা থেকে খানা ধরে ধরে ডিজিটাল পদ্ধতিতে দীর্ঘ প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই জরিপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা। জলবায়ু পরিবর্তনের অনুঘটক যেমন, তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত, কার্বন নিঃসরণ, গ্রিন হাউজ গ্যাস প্রভৃতির ওপর ভিত্তি করে জরিপটি পরিচালনা করা হয়।

শফিকের মতো ভোলা বস্তিতে বসবাস করা হোসেন আলীর সঙ্গে কথা হয় বাণিজ্য প্রতিদিনের। হোসেন আলী অবশ্য এই বস্তিতে এসেছেন দক্ষিণের জেলা ভোলা থেকে। সে নদী ভাঙনের কবলে পড়ে তার সব হারিয়ে এই বস্তিতে এসে ঠাঁই নিয়েছে।

হোসেন জানান, ভোলার জেলার সদর উপজেলার ভেদুরিয়া ইউনিয়নের ৫ ও ৬ নং ওয়ার্ডে পাশ দিয়েই বহমান তেতুলিয়া নদীর পাশে তার বসতবাড়ি ছিল। যা এখন শুধুই অতীত।

মনে অনেকটা কষ্ট নিয়ে হোসেন বলেন, ‘এক সময় আমার নিজের বাড়ি ছিল। আমার সুখের সংসার ছিল। কত স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়ে বড় হয়ে মানুষের মত মানুষ হবে। কিন্তু একন সবই অতীত। নদী আমার সব স্বপ্ন নষ্ট করে দিয়েছে ‘

‘আমার বাপ দাদার পৈত্রিক সম্পত্তি ছিল ১ হাজার শতকের ওপরে। এই সব সম্পত্তি নদী ভাঙনে শেষ হয়ে গেছে। আমার সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। সম্পত্তি বলতে আর কিছুই অবশিষ্ট রাখেনি। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে ঢাকায় চলে আসি।’

এই বস্তিতে অধিকাংশ লোক ভোলা জেলা বলে জানান হোসেন। তারা সবাই নদী ভাঙনের ফলে নিঃস্ব হয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছেন।

নদীভাঙনে বছরে বাস্তুচ্যুত ২৫ হাজার মানুষ

নদীভাঙনে দেশে প্রতি বছর বিলীন হচ্ছে ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি। এর সঙ্গে প্রতি বছর বাস্তচ্যুত হচ্ছে ২৫ হাজার মানুষ। তারা জমি, ভিটেমাটি হারিয়ে অসহায় জীবনযাপন করছে বিভিন্ন শহরে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের ‘ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্ল্যান অব বাংলাদেশ (২০২৩-২০৫০)’ প্রতিবেদনের তথ্য মতে, দেশে ১৯৭৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত প্রধান দুই নদী পদ্মা-যমুনার ভাঙনে বিলীন হয়েছে ১ লাখ ৫৭ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমি। এর মধ্যে যমুনায় বিলীন হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৬৫ হেক্টর, আর পদ্মায় ৬৩ হাজার ৫৫৮ হেক্টর। গড়ে প্রতি বছর ৩ হাজার ২০০ হেক্টরের বেশি জমি বিলীন হচ্ছে। নদীভাঙনে বিলীন হচ্ছে কৃষিজমি, বসতবাড়ি, রাস্তা, বাঁধ ও অবকাঠামো।

ভোলা বস্তি রাজধানী ঢাকার বস্তিগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি। এই বস্তির বেশির ভাগ মানুষ ভোলা জেলার। নদী ভাঙনের ফলে দিন দিন এই বস্তিতে মানুষের সংখ্যা বেড়েই চলছে। (ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন/লেন্স কালচার)

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দুর্যোগবিষয়ক পরিসংখ্যান (বিডিআরএস) বলছে, ‘২০২১ : ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড ন্যাচারাল ডিজাস্টার পারসপেকটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে নদী ও উপকূলের ভাঙনে ক্ষতির শিকার হওয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। এ ছাড়া নদী ও উপকূলের ভাঙনে ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে ক্ষতি হয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা।

বাড়ছে বাল্যবিবাহের হার 

নদী ভাঙন ও অতি বন্যার ফলে বাস্তুচ্যুতদের মধ্যে দিন দিন আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে বাল্যবিবাহের হার। অভিভাবকরা তাদের মেয়েদের ভরনপোষনের দায়িত্ব থেকে অনেকটা রেহাই পেতে কন্যা সন্তানদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছেন। রাজধানীর কড়াইল বস্তির ফারজানা আক্তারের বয়স ২২ বছর। তার ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। তার ২ ছেলে এবং একটি মেয়ে সন্তান রয়েছে।

ফারজানা জানান, বন্যায় তার বাবা সবকিছু হারিয়ে এই বস্তিতে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তাদের ভরনপোষণ করতে কষ্ট হলে তাকে ১৬ বছর বয়সেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়। নিজের মত না থাকা সত্বেও পরিবারের কথা চিন্তা করে তাকে বিয়ে করতে হয়।

‘আমার এখনি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু কী আর করার! পরিবারের কথা চিন্তা করে বিয়ে করতে হয়েছে। তবে আমি চাই আমার ছেলেমেয়েকে যেন আমার মতো ভাগ্য বরণ করতে না হয়।

২০২৪-এর মার্চে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩’ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে ১৮ বছরের আগে বিয়ের হার ৪১ দশমিক ৬। ইউনিসেফ প্রকাশিত ‘এন্ডিং চাইল্ড ম্যারেজ: এ প্রোফাইল অব প্রগ্রেস ইন বাংলাদেশ’ জানাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার সর্বাধিক।

বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯ অনুসারে বাংলাদেশে একজন নারীর বিবাহের বৈধ বয়স  নূন্যতম ১৮ এবং পুরুষের ২১। তবে এই আইনের লংঘন প্রতিনিয়তই চোখে পড়ে। ইউনিসেফের মতে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশেই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি আর বিশ্বে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম

জলবায়ু সংকটের ফলে তীব্র খরার সৃষ্টি হলে সুপেয় পানি সংগ্রহে কয়েক মাইল দূরত্বে গিয়ে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। (ছবি: বীর সাহাবী)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাইনুল ইসলাম বলেন, ‘১৫ বছরের আগে মেয়েদের মধ্যে বিয়ের হার বেড়ে গেছে। বিয়ে করা মানুষের অধিকার, তবে সেটি হলো ছেলেদের ক্ষেত্রে ২১ বছর হলে এবং মেয়েদের ১৮ বছর। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে বাল্যবিবাহের অবস্থার উন্নতি না হয়ে অবনতি হয়েছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোয় অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে।’

আন্তর্জাতিক সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেন-এর একটি প্রতিবেদনে “বাল্যবিবাহ-জলবায়ু হটস্পট দেশ” হিসেবে বিবেচিত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনটিতে সতর্ক করে বলা হয়, ২০৫০  সালের মধ্যে এসব দেশের প্রায় ৪০ মিলিয়ন মেয়ে জলবায়ু সংকটের কারণে বাল্যবিবাহের মতো কঠোর বাস্তবতার  মুখোমুখি হবার মতো চরম ঝুঁকিতে থাকতে পারে।

জলবায়ু ঝুঁকিতে বাংলাদেশের অবস্থান

জলবায়ু ঝুঁকির দিক থেকে সবচেয়ে আগে রয়েছ বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতি। বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র ০.৪৭% হলেও ক্লাইমেট ভালনারেবল ইনডেক্স অনুযায়ী বিশ্বের ১৯২টি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম।

ভোলা বস্তির সুমি আক্তার বর্ণনা দিচ্ছেন কীভাবে তার জমি, ঘরবাড়ি সব হারিয়ে ভোলা বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছে। (ছবি: মোহাম্মদ পনির হোসেন/লেন্স কালচার)

২০০৯ সালে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের একটি ক্লাইমেট ট্রাস্ট তহবিল গঠন করা হয়। এ পর্যন্ত ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রায় ৮০০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগজনিত ক্ষয়ক্ষতি প্রশমনকে প্রাধান্য দিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।