সংগঠন ও বাঙালি

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ১১:৪০:২১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১
  • / ১৬৪ Time View

সংগঠন ও বাঙালি

লেখক: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ ঢাবি প্রতিনিধি:

অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার পেছনের কারনগুলো অনুসন্ধান করেছেন এমন একজন বাঙালি যিনি নিজেই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’র ন্যায় একটি সুসংহত সংগঠন। বর্ণাঢ্য পেশাগত জীবনের সুদীর্ঘ সময় জুড়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্জিত বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন বাস্তব প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ ব্যাখ্যা করায় শুধু সমালোচনামূলক বা সমস্যাধর্মী গ্রন্থ-রূপকে ছাড়িয়ে, বইটি তাই লাভ করেছে  দার্শনিক-গ্রন্থের মর্যাদা।

সুচিন্তিত যুক্তিশীলতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর বাস্তব নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, সাংগঠনিক পশ্চাৎপদতা বাঙালিকে কীভাবে জাতীয় উন্নতির উচ্চ শিখড়ে আরোহণ থেকে বিরত রেখেছে। সুশৃঙ্খল সংগঠন গড়ে তোলার পথে বাঙালির বিপত্তিসমূহ উৎঘাটন করতে গিয়ে লেখক খুঁজে পেয়েছেন আত্মপরতা আর পরশ্রীকাতরতায় পরিপূর্ণ বাঙালি চরিত্রকে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের ন্যায় নিজ জাতির চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি উন্মোচনে একটুও পিছুপা হন নি মননশীল এবং সংস্কারধর্মী এই লেখক। চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দাম্ভিক বাঙালির চিরচেনা স্বভাব, “পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়ে পরিপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠভাবে জানে না এমন বাঙালি এই পৃথিবীতে নেই “!

প্রসঙ্গক্রমে আরেকজান বাঙালি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে উক্তিটি উল্লেখ করতে হয় তা হলো, ” যার যোগ্যতা যত কম, তার আড়ম্বর তত বেশি “।

আর এই অযোগ্য, দাম্ভিক বাঙালিরা নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকাতে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে চায় যেকোনো মহৎ কর্মপরিকল্পনাকে ! লেখকের মতে,  সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অযোগ্য ব্যাক্তিদের নেতিবাচক আচরণই চূড়ান্তভাবে বিপর্যয় ঘটায় একটি সংগঠনের। ব্যাক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে অসামান্য সফলতার দেখা মিললেও সামষ্টিক অর্জনের সীমা তাই প্রায় শুন্যের কোটায় !

স্বাধীন-সার্বোভৌম রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মধ্যে বসবাস না করার অভিজ্ঞতাও যে বাঙালিকে সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে একেবারে অদক্ষ করে রেখেছে তাও অনুধাবন করেছেন লেখক। ১৯৪৭ এ বঙ্গদেশ যে এত সহজে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং আজ আবধি যে জার্মানি,ভিয়েতনাম বা কোরিয়ার মতো পুনরেকত্রীকরণের তীব্র আকুতি বেগবান হয়ে উঠেনি তার কারণও একই – অখণ্ড অঞ্চলভিত্তিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দীর্ঘমেয়াদে বসবাসের ঐতিহ্য বা ইতিহাস না থাকা

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র আঞ্চলিকতার প্রবণতা এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের ভেতর জেগে ওঠা জেলাকেন্দ্রিকতাও জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তোলার পিছনে একটি বড় অন্তরায়। আজ অব্দি লক্ষ্য করা যায় যে, ” যখন যে জেলার নেতা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হন, তখন প্রায় পুরোপুরি সে জেলাটাই দেশের ক্ষমতায় এসে পড়ে” !

অন্যদিকে জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায়, চরমভাবাপন্ন দেশসমূহের ন্যায় বাঙালিকে জীবিকার তাগিদে বা অন্যান্য প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হতে হয় নি।

পরনির্ভরশীল বাঙালির আরেকটি বৈশিষ্ট্য লেখক উৎঘাটন করেছেন গভীর বেদনায়, স্রোতের জলে গা ভাসিয়ে দেওয়া  এ মনোভাবের কারনে সত্য-মিথ্যা, ঠিক-বেঠিক বিচার না করেই একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বাঙালি, ফলে পস্তাতে হয় চূড়ান্তভাবে । শুধু তাই নয়, পরনির্ভরশীল হয়ে অলসভাবে বসে বসে অন্যের কর্মপরিকল্পনাকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার ! যার ফলে কোনো ব্যাতিক্রমধর্মী, সংগ্রামী বাঙালি সংগঠনের পিছনে নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ করলেও শেষ পর্যন্ত হতাশার অতল সাগরে ডুবে যেতে হয় তাকে ।

স্বভাবতই অযোগ্য ও ভীরু ব্যাক্তিরা হীনমন্যতায় ভোগে। আপাতভাবে সবকিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ভান করে বড় বড় কথা বলে এই হীনমন্যতার কারনেই। “প্রতিটি জিনিসকেই মনে করে নিজের অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর। তার চাহনিই হয়ে পড়ে নেতিবাচক”। আর এ কারনে কোনো জ্বলজ্বলে বা বিকাশমান সংগঠনের জন্য সে হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। “নিষ্ঠুর ও নির্বিবেক আচরণে পৃথিবীর যাবতীয় সাফল্যকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে খানখান করার জন্য এরা অবাধ নির্মমতা নিয়ে প্রতীক্ষা করে” । আর এটা না করতে পারলে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

১৯৮৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ করে লেখক বলেন,সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অষ্ট্রেলিয়ার সিভিল সার্ভিসের পুনর্বিন্যাসে সহায়তা করে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাদেরকে এ দেশে খুব চিন্তিত আর বিচলিত লাগছিল। একজন তো লেখককে বলেই বসলেন, “আমাদের এতদিনের বিদ্যাবুদ্ধি সব তোমাদের দেশে এসে বানচাল হতে বসলো,কিছুতেই তোমাদের দেশের সিভিল সার্ভিসের  সমস্যাটা বুঝে উঠতে পারছি না ” !

নিজ জাতির মধ্যে থেকে প্রাপ্ত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে লেখক হাসতে হাসতে জবাব দেন, “কেবল তোমার দেশ নয়,সারা পৃথিবীর সব দেশের অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করলেও এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল অসুবিধা বুঝতে পারবে না।  আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মৃত্যু ঘটে নিঃশব্দে আগত আততায়ীর অদৃশ্য ছুরির আঘাতে”।আর এই আততায়ী হলো সেসকল ব্যর্থ ও হীনমন্যতায় ভোগা ব্যাক্তিবর্গ।

সংগঠন বিমুখতা যে কোনো ভালো মানুষকে ‘ভালো মানুষে’র স্বীকৃতি দিতে পারে না তাও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে দৃষ্টিগোচর করা হয়েছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান একবার তাঁর সাক্ষাৎকারে যেমনটি বলেছেন,” আপনি হয়তো মনে করছেন, আমি ভালো লোক,শিক্ষিত লোক, জ্ঞানী লোক, আমি জনগণের ভালো চাই। কিন্তু আপনি তো কিছু করছেন না, সমস্যাটা ওখানেই। আপনার নির্বাচিত প্রতিনিধি যা কিছু খারাপ কাজ করছেন, তা তিনি করতে পারছেন কারণ আপনারা তাকে তা করতে দিচ্ছেন”

বাঙালির সৌজন্যকে পাকিস্তানীরা যেন দুর্বলতা ভেবে ভুল না করে, সে কথা বোঝাতে শেখ মুজিবুর রহমান একবার বলেছিলেন,“বাঙালি যেমন কোমল হতে জানে, তেমনি জানে কঠিন হতে। বর্ষার বৃষ্টিভেজা মাটির মতো সে যেমন নরম, বৈশাখের তপ্ত কঠিন ভয়ংকর মাটির মতো সে আবার কঠিন”। লেখক মনে করেন, শেখ মুজিব বাঙালিকে ঠিকই বুঝেছিলেন।” এই আমাদের চিরকালের বাঙালি – অযৌক্তিক, অতিশয়োক্তিময় এবং একরৈখিক। এজন্যই কোনো বিতর্ক করতে গিয়ে দুজন বুদ্ধিজীবী সেই বিতর্ককে ব্যাক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যান নি, এমন উদাহরণ খুবই কম আছে”। সুবিজ্ঞ, বিচক্ষণ, চিন্তাশীল পণ্ডিতদের মধ্যকার ভারসাম্যপূর্ণ সহনশীলতা, স্থিরতা, ধীরতা তখন কোথায় যায় ?

এই মানসিক ভারসাম্যের অভাব বাঙালির জন্য আরেকটি ভীতির কারণ। মনে রাখা প্রয়োজন, “উত্তেজনা শক্তি নহে, দুর্বলতা। উত্তেজিত মূহুর্তে মানুষ সবচেয়ে শক্তিহীন। কারণ এ সময় বুদ্ধি লোপ পায়, থাকে কেবল বাচালতা, তারল্য আর অপরিণতি। আর বাঙালি চিরকাল এই উত্তেজনাকেই আবেগ বলে সম্মান জানিয়ে আসছে। উত্তেজিত, উচ্ছ্বাসিত হওয়াকেই শক্তিশালী হওয়া ভেবে আত্মপ্রসাদ পেয়ে চলছে” !  এজন্য একনাগাড়ে বা নিয়মিতভাবে কোনো কর্মে আত্মনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয় বাঙালি।

বাংলার রাষ্টীয় সংগঠন বা সরকার ব্যবস্থা সম্বন্ধেও লেখক আলোকপাত করেছেন বিশেষজ্ঞের ন্যায়। লক্ষ্য করেছেন, বাঙালি স্বপ্ন দেখে গণতন্ত্রের, কিন্তু স্বস্তি বোধ করে একনায়কতন্ত্রে। আর আমরা নিজের চেয়ে কাউকে বড় ভাবতে এতটাই অনিচ্ছুক(সত্য এর যত বিরুদ্ধেই হোক না কেন) যে তুলনামূলকভাবে শ্রেয় ব্যাক্তি কে নেতা বলে মেনে নিয়ে, তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে অপমানবোধ করি ; আর ফাটল ধরে সংগঠনে।

লেখক আরও উপলব্ধি করেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থাকে বাতিল করে যে ব্যাক্তিনির্ভর রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তা তিনি করেছিলেন বাংলায় তার সুদীর্ঘ এবং বিচিত্র রাজনৈতিক জীবনের অর্জিত প্রজ্ঞার কারনে। বাঙালির ‘নীচ’ মূল্যবোধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যর্থ হতে বাধ্য করে।  তবে এটাও ঠিক যে, শেখ মুজিব পরবর্তী সামরিক শাসকবর্গ এই রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক ব্যাবস্থার সকল সুবিধাকে নিজেদের অনুকূলে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে আজও এ ব্যবস্থা বাঙালির মনে জাগিয়ে তোলে চরম বিতৃষ্ণা।

গভীর চিন্তাশক্তির ফলে লেখক আরো অনুভব করেন, “আমরা এখনও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যতটুকু সুফল পাচ্ছি তা এজন্য যে খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা, দুজনের কেউই প্রকৃৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ শাসন করছেন না,  তারা দেশ চালাচ্ছেন বংশানুক্রমিক নৃপতিদের মতো।তাদের ক্ষমতা মূলত যোগ্যতাগত নয়, উত্তরাধিকারগত”। দলের ভেতর তাদের বিকল্প না থাকায় তারা যা খুশি করতে পারেন এবং নিজ দল ও দেশবাসীকে দিয়ে তা অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন।

তাছাড়া সুদীর্ঘ দেড় হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসনের প্রভাব তো রয়েছেই। রাজতন্ত্র এখনো রয়ে গিয়েছে বাঙালির অস্থি-মজ্জায়। তাই, বাঙালি এখনো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীকে (রাজতন্ত্রের স্বরূপ হিসেবে) চেনে। আর ন্যায়বিচার বা অন্যায়ের প্রতিকার পেতে চায় সরকার বা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনযন্ত্রের বদলে মন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের হস্তক্ষেপে।

সংগঠন হলো জীবনের ওপর মানুষের বিজয়ের প্রতিষ্ঠা ও উচ্চতর সমৃদ্ধির সন্ধান। সংগঠনের জন্য যে আত্মোৎসর্গ তা ব্যাক্তিগত বিনিয়োগ নয়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো সুপণ্ডিত, জাতি গঠনের একজন মহান কারিগর যেহেতু নিজ জাতির  আত্মসমালোচনায় নেমেছেন, এটির গুরুত্ব আমাদের অনুধাবন করতে হবে। লেখকের প্রচেষ্টা ও শ্রম কেবল তখনই সার্থক হবে যখন, বাঙালি আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তার চারিত্রিক সংশোধনের সংগ্রামে নেমে আত্মপরতা’কে অতিক্রম করে জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে।

Please Share This Post in Your Social Media

সংগঠন ও বাঙালি

Update Time : ১১:৪০:২১ অপরাহ্ন, রবিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১

সংগঠন ও বাঙালি

লেখক: আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

মুহাম্মদ ইমাম-উল-জাননাহ ঢাবি প্রতিনিধি:

অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে বাঙালির সাংগঠনিক দুর্বলতার পেছনের কারনগুলো অনুসন্ধান করেছেন এমন একজন বাঙালি যিনি নিজেই গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, ‘বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে’র ন্যায় একটি সুসংহত সংগঠন। বর্ণাঢ্য পেশাগত জীবনের সুদীর্ঘ সময় জুড়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে অর্জিত বিচিত্র অভিজ্ঞতার আলোকে বিভিন্ন বাস্তব প্রেক্ষাপটে সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহ ব্যাখ্যা করায় শুধু সমালোচনামূলক বা সমস্যাধর্মী গ্রন্থ-রূপকে ছাড়িয়ে, বইটি তাই লাভ করেছে  দার্শনিক-গ্রন্থের মর্যাদা।

সুচিন্তিত যুক্তিশীলতা, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর বাস্তব নিদর্শনসমূহ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লেখক দেখিয়েছেন, সাংগঠনিক পশ্চাৎপদতা বাঙালিকে কীভাবে জাতীয় উন্নতির উচ্চ শিখড়ে আরোহণ থেকে বিরত রেখেছে। সুশৃঙ্খল সংগঠন গড়ে তোলার পথে বাঙালির বিপত্তিসমূহ উৎঘাটন করতে গিয়ে লেখক খুঁজে পেয়েছেন আত্মপরতা আর পরশ্রীকাতরতায় পরিপূর্ণ বাঙালি চরিত্রকে। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের ন্যায় নিজ জাতির চারিত্রিক দোষ-ত্রুটি উন্মোচনে একটুও পিছুপা হন নি মননশীল এবং সংস্কারধর্মী এই লেখক। চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দাম্ভিক বাঙালির চিরচেনা স্বভাব, “পৃথিবীর প্রতিটি বিষয়ে পরিপূর্ণ ও সর্বশ্রেষ্ঠভাবে জানে না এমন বাঙালি এই পৃথিবীতে নেই “!

প্রসঙ্গক্রমে আরেকজান বাঙালি, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের যে উক্তিটি উল্লেখ করতে হয় তা হলো, ” যার যোগ্যতা যত কম, তার আড়ম্বর তত বেশি “।

আর এই অযোগ্য, দাম্ভিক বাঙালিরা নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকাতে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলতে চায় যেকোনো মহৎ কর্মপরিকল্পনাকে ! লেখকের মতে,  সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অযোগ্য ব্যাক্তিদের নেতিবাচক আচরণই চূড়ান্তভাবে বিপর্যয় ঘটায় একটি সংগঠনের। ব্যাক্তিগত অর্জনের ক্ষেত্রে অসামান্য সফলতার দেখা মিললেও সামষ্টিক অর্জনের সীমা তাই প্রায় শুন্যের কোটায় !

স্বাধীন-সার্বোভৌম রাষ্ট্রীয় সংগঠনের মধ্যে বসবাস না করার অভিজ্ঞতাও যে বাঙালিকে সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে একেবারে অদক্ষ করে রেখেছে তাও অনুধাবন করেছেন লেখক। ১৯৪৭ এ বঙ্গদেশ যে এত সহজে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল এবং আজ আবধি যে জার্মানি,ভিয়েতনাম বা কোরিয়ার মতো পুনরেকত্রীকরণের তীব্র আকুতি বেগবান হয়ে উঠেনি তার কারণও একই – অখণ্ড অঞ্চলভিত্তিক, রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় দীর্ঘমেয়াদে বসবাসের ঐতিহ্য বা ইতিহাস না থাকা

রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে তীব্র আঞ্চলিকতার প্রবণতা এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের ভেতর জেগে ওঠা জেলাকেন্দ্রিকতাও জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় সংগঠন গড়ে তোলার পিছনে একটি বড় অন্তরায়। আজ অব্দি লক্ষ্য করা যায় যে, ” যখন যে জেলার নেতা রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হন, তখন প্রায় পুরোপুরি সে জেলাটাই দেশের ক্ষমতায় এসে পড়ে” !

অন্যদিকে জলবায়ু নাতিশীতোষ্ণ হওয়ায়, চরমভাবাপন্ন দেশসমূহের ন্যায় বাঙালিকে জীবিকার তাগিদে বা অন্যান্য প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হতে হয় নি।

পরনির্ভরশীল বাঙালির আরেকটি বৈশিষ্ট্য লেখক উৎঘাটন করেছেন গভীর বেদনায়, স্রোতের জলে গা ভাসিয়ে দেওয়া  এ মনোভাবের কারনে সত্য-মিথ্যা, ঠিক-বেঠিক বিচার না করেই একটা কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে বাঙালি, ফলে পস্তাতে হয় চূড়ান্তভাবে । শুধু তাই নয়, পরনির্ভরশীল হয়ে অলসভাবে বসে বসে অন্যের কর্মপরিকল্পনাকে প্রশ্নবানে বিদ্ধ করতে বাঙালির জুড়ি মেলা ভার ! যার ফলে কোনো ব্যাতিক্রমধর্মী, সংগ্রামী বাঙালি সংগঠনের পিছনে নিজের সর্বস্ব বিনিয়োগ করলেও শেষ পর্যন্ত হতাশার অতল সাগরে ডুবে যেতে হয় তাকে ।

স্বভাবতই অযোগ্য ও ভীরু ব্যাক্তিরা হীনমন্যতায় ভোগে। আপাতভাবে সবকিছুকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার ভান করে বড় বড় কথা বলে এই হীনমন্যতার কারনেই। “প্রতিটি জিনিসকেই মনে করে নিজের অস্তিত্বের জন্য ক্ষতিকর। তার চাহনিই হয়ে পড়ে নেতিবাচক”। আর এ কারনে কোনো জ্বলজ্বলে বা বিকাশমান সংগঠনের জন্য সে হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। “নিষ্ঠুর ও নির্বিবেক আচরণে পৃথিবীর যাবতীয় সাফল্যকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে খানখান করার জন্য এরা অবাধ নির্মমতা নিয়ে প্রতীক্ষা করে” । আর এটা না করতে পারলে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

১৯৮৩ সালের একটি ঘটনার উল্লেখ করে লেখক বলেন,সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দুজন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অষ্ট্রেলিয়ার সিভিল সার্ভিসের পুনর্বিন্যাসে সহায়তা করে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাদেরকে এ দেশে খুব চিন্তিত আর বিচলিত লাগছিল। একজন তো লেখককে বলেই বসলেন, “আমাদের এতদিনের বিদ্যাবুদ্ধি সব তোমাদের দেশে এসে বানচাল হতে বসলো,কিছুতেই তোমাদের দেশের সিভিল সার্ভিসের  সমস্যাটা বুঝে উঠতে পারছি না ” !

নিজ জাতির মধ্যে থেকে প্রাপ্ত দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে লেখক হাসতে হাসতে জবাব দেন, “কেবল তোমার দেশ নয়,সারা পৃথিবীর সব দেশের অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করলেও এ দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল অসুবিধা বুঝতে পারবে না।  আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর মৃত্যু ঘটে নিঃশব্দে আগত আততায়ীর অদৃশ্য ছুরির আঘাতে”।আর এই আততায়ী হলো সেসকল ব্যর্থ ও হীনমন্যতায় ভোগা ব্যাক্তিবর্গ।

সংগঠন বিমুখতা যে কোনো ভালো মানুষকে ‘ভালো মানুষে’র স্বীকৃতি দিতে পারে না তাও যুক্তিগ্রাহ্যভাবে দৃষ্টিগোচর করা হয়েছে। অধ্যাপক রেহমান সোবহান একবার তাঁর সাক্ষাৎকারে যেমনটি বলেছেন,” আপনি হয়তো মনে করছেন, আমি ভালো লোক,শিক্ষিত লোক, জ্ঞানী লোক, আমি জনগণের ভালো চাই। কিন্তু আপনি তো কিছু করছেন না, সমস্যাটা ওখানেই। আপনার নির্বাচিত প্রতিনিধি যা কিছু খারাপ কাজ করছেন, তা তিনি করতে পারছেন কারণ আপনারা তাকে তা করতে দিচ্ছেন”

বাঙালির সৌজন্যকে পাকিস্তানীরা যেন দুর্বলতা ভেবে ভুল না করে, সে কথা বোঝাতে শেখ মুজিবুর রহমান একবার বলেছিলেন,“বাঙালি যেমন কোমল হতে জানে, তেমনি জানে কঠিন হতে। বর্ষার বৃষ্টিভেজা মাটির মতো সে যেমন নরম, বৈশাখের তপ্ত কঠিন ভয়ংকর মাটির মতো সে আবার কঠিন”। লেখক মনে করেন, শেখ মুজিব বাঙালিকে ঠিকই বুঝেছিলেন।” এই আমাদের চিরকালের বাঙালি – অযৌক্তিক, অতিশয়োক্তিময় এবং একরৈখিক। এজন্যই কোনো বিতর্ক করতে গিয়ে দুজন বুদ্ধিজীবী সেই বিতর্ককে ব্যাক্তিগত শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যান নি, এমন উদাহরণ খুবই কম আছে”। সুবিজ্ঞ, বিচক্ষণ, চিন্তাশীল পণ্ডিতদের মধ্যকার ভারসাম্যপূর্ণ সহনশীলতা, স্থিরতা, ধীরতা তখন কোথায় যায় ?

এই মানসিক ভারসাম্যের অভাব বাঙালির জন্য আরেকটি ভীতির কারণ। মনে রাখা প্রয়োজন, “উত্তেজনা শক্তি নহে, দুর্বলতা। উত্তেজিত মূহুর্তে মানুষ সবচেয়ে শক্তিহীন। কারণ এ সময় বুদ্ধি লোপ পায়, থাকে কেবল বাচালতা, তারল্য আর অপরিণতি। আর বাঙালি চিরকাল এই উত্তেজনাকেই আবেগ বলে সম্মান জানিয়ে আসছে। উত্তেজিত, উচ্ছ্বাসিত হওয়াকেই শক্তিশালী হওয়া ভেবে আত্মপ্রসাদ পেয়ে চলছে” !  এজন্য একনাগাড়ে বা নিয়মিতভাবে কোনো কর্মে আত্মনিয়োগ করতে ব্যর্থ হয় বাঙালি।

বাংলার রাষ্টীয় সংগঠন বা সরকার ব্যবস্থা সম্বন্ধেও লেখক আলোকপাত করেছেন বিশেষজ্ঞের ন্যায়। লক্ষ্য করেছেন, বাঙালি স্বপ্ন দেখে গণতন্ত্রের, কিন্তু স্বস্তি বোধ করে একনায়কতন্ত্রে। আর আমরা নিজের চেয়ে কাউকে বড় ভাবতে এতটাই অনিচ্ছুক(সত্য এর যত বিরুদ্ধেই হোক না কেন) যে তুলনামূলকভাবে শ্রেয় ব্যাক্তি কে নেতা বলে মেনে নিয়ে, তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করতে অপমানবোধ করি ; আর ফাটল ধরে সংগঠনে।

লেখক আরও উপলব্ধি করেন, শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় ব্রিটিশ সংসদীয় ব্যবস্থাকে বাতিল করে যে ব্যাক্তিনির্ভর রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন, তা তিনি করেছিলেন বাংলায় তার সুদীর্ঘ এবং বিচিত্র রাজনৈতিক জীবনের অর্জিত প্রজ্ঞার কারনে। বাঙালির ‘নীচ’ মূল্যবোধ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যর্থ হতে বাধ্য করে।  তবে এটাও ঠিক যে, শেখ মুজিব পরবর্তী সামরিক শাসকবর্গ এই রাষ্ট্রপতিকেন্দ্রিক ব্যাবস্থার সকল সুবিধাকে নিজেদের অনুকূলে নিষ্ঠুরভাবে ব্যবহার করেছেন। যার ফলশ্রুতিতে আজও এ ব্যবস্থা বাঙালির মনে জাগিয়ে তোলে চরম বিতৃষ্ণা।

গভীর চিন্তাশক্তির ফলে লেখক আরো অনুভব করেন, “আমরা এখনও সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যতটুকু সুফল পাচ্ছি তা এজন্য যে খালেদা জিয়া বা শেখ হাসিনা, দুজনের কেউই প্রকৃৃতপক্ষে গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশ শাসন করছেন না,  তারা দেশ চালাচ্ছেন বংশানুক্রমিক নৃপতিদের মতো।তাদের ক্ষমতা মূলত যোগ্যতাগত নয়, উত্তরাধিকারগত”। দলের ভেতর তাদের বিকল্প না থাকায় তারা যা খুশি করতে পারেন এবং নিজ দল ও দেশবাসীকে দিয়ে তা অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন।

তাছাড়া সুদীর্ঘ দেড় হাজার বছরের রাজতান্ত্রিক শাসনের প্রভাব তো রয়েছেই। রাজতন্ত্র এখনো রয়ে গিয়েছে বাঙালির অস্থি-মজ্জায়। তাই, বাঙালি এখনো প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রীকে (রাজতন্ত্রের স্বরূপ হিসেবে) চেনে। আর ন্যায়বিচার বা অন্যায়ের প্রতিকার পেতে চায় সরকার বা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনযন্ত্রের বদলে মন্ত্রী বা সরকারপ্রধানের হস্তক্ষেপে।

সংগঠন হলো জীবনের ওপর মানুষের বিজয়ের প্রতিষ্ঠা ও উচ্চতর সমৃদ্ধির সন্ধান। সংগঠনের জন্য যে আত্মোৎসর্গ তা ব্যাক্তিগত বিনিয়োগ নয়।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো সুপণ্ডিত, জাতি গঠনের একজন মহান কারিগর যেহেতু নিজ জাতির  আত্মসমালোচনায় নেমেছেন, এটির গুরুত্ব আমাদের অনুধাবন করতে হবে। লেখকের প্রচেষ্টা ও শ্রম কেবল তখনই সার্থক হবে যখন, বাঙালি আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তার চারিত্রিক সংশোধনের সংগ্রামে নেমে আত্মপরতা’কে অতিক্রম করে জাতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হবে।