মাদক থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৬:৪১:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২২
  • / ২৫৯ Time View

মহসিন হোসেন:

মাদক সম্পর্কে জানেন না বিশ্বের এমন কি কেউ আছে? মাদকের ভয়াবহতা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাদকের সর্বাত্মক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। মাদকের স্বর্গরাজ্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবস্থিত। এসব দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে মাদক পাচারের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ব্যবহার করার কারণে মাদকের বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

মাদকের নেশা সর্বনাশা। জীবনবিনাশী মাদক আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর থেকে শুরু করে সব শ্রেণীপেশার মানুষকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যা ভাবলেই রীতিমতো গা শিউরে ওঠে। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই মাদকের প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়। কিন্তু রমরমা বাণিজ্য বন্ধ হয় না। একশ্রেণীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত নারীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কেউ কেউ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। হাত বাড়ালেই আইস, হেরোইন, গাঁজা, বিভিন্ন ধরনের মাদক পাওয়া যাচ্ছে।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মাদক সেবন, কারবার ও পাচারের অন্যতম রুট। চোখের সামনেই তরুণ প্রজন্মকে মাদক গিলে খাচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

ঢাকার অলি গলিতে মাদকের অবাধ বাণিজ্য চলছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের বহু জায়গায় তরুণ-তরুণীদের মাদক সেবন করতে দেখা যায়। মাদকের ভয়াবহতা কত নিষ্ঠুর কত বেদনাদায়ক হতে পারে তা ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। তরুণরা দেশ ও জাতির সৃজনশীল পথের আলোর দিশারি। অথচ কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তরুণদের মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স্থিতিশীলতা। ভাঙছে অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন। মাদকের আগ্রাসনে শুধু পরিবার ধ্বংস হয় না। একটি দেশও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ চীন। ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত সময়ে চীন আর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন ও ফান্সের মধ্যে আফিম যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। ব্রিটিশরা চীনে একচেটিয়াভাবে আফিমের ব্যবসা করত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আফিমের ব্যবসা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছিল। চীন সরকার চোরাচালানের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করলেও ব্রিটিশ সরকার আফিম ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে চীন হারলেও তাদের নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। চীনারা আফিমের কুফল অনুধান করতে পারে। মাদক কিভাবে একটি দেশ ও জাতিকে বিনষ্ট করে তা আফিম যুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে চীন আজ বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশে বেড়েছে মাদকের ব্যবহার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার করেছে। আর এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ ও বিদেশি মদ, প্যাথেড্রিন, ডিনেচার্ড স্পিরিট, ভাং, বিয়ার, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন (টিডি জেসিক ইঞ্জেকশন), কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বায়োজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইস পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন।

মাদকের ভয়াবহতা শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করে তা নয় মাদকসেবীর জীবনকে ধ্বংস করে বিভিন্নভাবে। কিডনি, লিভার, ফুসফুস নষ্ট করে দেওয়া, রক্তচাপ বাড়ানো ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকেও নষ্ট করে। গড়ে বছরে দেড় লাখ মাদকসেবীর মৃত্যু ঘটে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। পরিকল্পিতভাবে কোনো কোনো দেশকে ধ্বংস করার জন্য মাদকের নেশা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের সবার জানা আছে। ক্ষমতা, দুর্নীতি, মাদক আর জুয়ার মেলবন্ধন বাংলাদেশকেও কি সেদিকে ধাবিত করছে?

তাই মাদকের প্রবেশ ও ব্যবসা রোধে কঠোর পদক্ষেপের বিকল্প নেই। কাজেই মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব না হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকার পরও মাদকের অবৈধ প্রবেশ ও ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চাহিদার কারণেই এমনটি হচ্ছে। তাছাড়া শর্ষের মধ্যে ভূত এ কারণেও এক্ষেত্রে সুফল মিলছে না। মাদকের বিস্তার রোধে সরকারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও জরুরি।মাদকের বিষয়ে কোন আপোষ নাই, মাদক নির্মূলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, বিডি সমাচার ২৪ ডটকম।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

মাদক থেকে যুবসমাজকে রক্ষা করতে হবে

Update Time : ০৬:৪১:৪৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২২

মহসিন হোসেন:

মাদক সম্পর্কে জানেন না বিশ্বের এমন কি কেউ আছে? মাদকের ভয়াবহতা লিখে বা বলে শেষ করা যাবে না। মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হলেও বাংলাদেশ ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে মাদকের সর্বাত্মক আগ্রাসনের শিকারে পরিণত হয়েছে। মাদকের স্বর্গরাজ্য গোল্ডেন ক্রিসেন্ট আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত এবং আন্তর্জাতিক মাদকদ্রব্য উৎপাদনকারী অঞ্চল মিয়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সমন্বয়ে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গলের দক্ষিণ-পূর্ব কোনে অবস্থিত। এসব দেশ থেকে আন্তর্জাতিকভাবে মাদক পাচারের জন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ট্রানজিট ব্যবহার করার কারণে মাদকের বিস্তার রোধ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

মাদকের নেশা সর্বনাশা। জীবনবিনাশী মাদক আগামী দিনের দেশ গড়ার কারিগর থেকে শুরু করে সব শ্রেণীপেশার মানুষকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। যা ভাবলেই রীতিমতো গা শিউরে ওঠে। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই মাদকের প্রতিবেদন মুদ্রিত হয়। কিন্তু রমরমা বাণিজ্য বন্ধ হয় না। একশ্রেণীর ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, উচ্চবিত্ত নারীসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কেউ কেউ নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন। হাত বাড়ালেই আইস, হেরোইন, গাঁজা, বিভিন্ন ধরনের মাদক পাওয়া যাচ্ছে।দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ মাদক সেবন, কারবার ও পাচারের অন্যতম রুট। চোখের সামনেই তরুণ প্রজন্মকে মাদক গিলে খাচ্ছে। কিন্তু প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না।

ঢাকার অলি গলিতে মাদকের অবাধ বাণিজ্য চলছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আশপাশের বহু জায়গায় তরুণ-তরুণীদের মাদক সেবন করতে দেখা যায়। মাদকের ভয়াবহতা কত নিষ্ঠুর কত বেদনাদায়ক হতে পারে তা ভুক্তভোগী পরিবার ছাড়া অন্য কেউ অনুধাবন করতে পারে না। তরুণরা দেশ ও জাতির সৃজনশীল পথের আলোর দিশারি। অথচ কিছু বিকারগ্রস্ত মানুষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে তরুণদের মাদকের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ফলে তারা নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, বিনষ্ট হচ্ছে সামাজিক স্থিতিশীলতা। ভাঙছে অসংখ্য পরিবারের স্বপ্ন। মাদকের আগ্রাসনে শুধু পরিবার ধ্বংস হয় না। একটি দেশও ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যার জ্বলন্ত উদাহরণ চীন। ১৮৩৯ সাল থেকে ১৮৪২ সাল পর্যন্ত সময়ে চীন আর সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন ও ফান্সের মধ্যে আফিম যুদ্ধ সঙ্ঘটিত হয়। ব্রিটিশরা চীনে একচেটিয়াভাবে আফিমের ব্যবসা করত।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে আফিমের ব্যবসা ভয়াবহভাবে বেড়ে গিয়েছিল। চীন সরকার চোরাচালানের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করলেও ব্রিটিশ সরকার আফিম ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে চীনের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধে চীন হারলেও তাদের নৈতিক বিজয় অর্জিত হয়। চীনারা আফিমের কুফল অনুধান করতে পারে। মাদক কিভাবে একটি দেশ ও জাতিকে বিনষ্ট করে তা আফিম যুদ্ধের ইতিহাস পড়লেই বোঝা যায়। মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে চীন আজ বিশ্বের পরাশক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশে বেড়েছে মাদকের ব্যবহার। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত ২৪ ধরনের মাদক উদ্ধার করেছে। আর এসব মাদকের মধ্যে রয়েছে ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজা, চোলাই মদ ও বিদেশি মদ, প্যাথেড্রিন, ডিনেচার্ড স্পিরিট, ভাং, বিয়ার, তাড়ি, বুপ্রেনরফিন (টিডি জেসিক ইঞ্জেকশন), কোডিন ট্যাবলেট, ফার্মেন্টেড ওয়াশ (জাওয়া), বুপ্রেনরফিন (বায়োজেসিক ইঞ্জেকশন), মরফিন, আইস পিল, ভায়াগ্রা, সানাগ্রা, টলুইন, পটাসিয়াম পারম্যাঙ্গানেট ও মিথাইল-ইথাইল কিটোন।

মাদকের ভয়াবহতা শুধু সামাজিক, পারিবারিক ও আর্থিক জীবনকে ধ্বংস করে তা নয় মাদকসেবীর জীবনকে ধ্বংস করে বিভিন্নভাবে। কিডনি, লিভার, ফুসফুস নষ্ট করে দেওয়া, রক্তচাপ বাড়ানো ও সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতাকেও নষ্ট করে। গড়ে বছরে দেড় লাখ মাদকসেবীর মৃত্যু ঘটে বলে বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে। পরিকল্পিতভাবে কোনো কোনো দেশকে ধ্বংস করার জন্য মাদকের নেশা ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা আমাদের সবার জানা আছে। ক্ষমতা, দুর্নীতি, মাদক আর জুয়ার মেলবন্ধন বাংলাদেশকেও কি সেদিকে ধাবিত করছে?

তাই মাদকের প্রবেশ ও ব্যবসা রোধে কঠোর পদক্ষেপের বিকল্প নেই। কাজেই মাদকদ্রব্য ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব না হলে সমাজে অপরাধ প্রবণতা আরও বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকার পরও মাদকের অবৈধ প্রবেশ ও ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, চাহিদার কারণেই এমনটি হচ্ছে। তাছাড়া শর্ষের মধ্যে ভূত এ কারণেও এক্ষেত্রে সুফল মিলছে না। মাদকের বিস্তার রোধে সরকারকে অবশ্যই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলাও জরুরি।মাদকের বিষয়ে কোন আপোষ নাই, মাদক নির্মূলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে।

লেখক : সম্পাদক, বিডি সমাচার ২৪ ডটকম।