মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের প্রভাব, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০১:৩৩:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩
  • / ২৬৫ Time View

ড. মো: আব্দুস সোবহান:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি সকল স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য এক প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ, যার প্রতিটি শব্দ এক একটি পুস্তকসম। এ ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, স্বাধীনতার প্রস্ততি নেয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়, প্রাণ বিসর্জন দেয়া, চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে নেয়া ইত্যাদি সম্ভব হয়েছিল। তাই ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ভাষণ (সোহরাব গনি দুলাল, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মিরপুর কুষ্টিয়া, ২০২২)।

এখন এ ভাষণের উপর একটু আলোকপাত করা যাক:

এ ভাষণে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নির্যাতন ও বাংলাদেশের মানুষের রক্তঝরার কথা চিত্রায়িত হয়েছে।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতেই পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যায়ভাবে এবং বিনা কারণে বাংলার মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুলি ও রক্তপাত করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা সমঝোতা না করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হতাহত করেছে। এরূপ রক্তের করুণ ইতিহাস পুরা পাকিস্তানী শাসনকাল জুড়ে বিরাজমান ছিলো। সর্বোপরী ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে জাতির পিতা পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক ২৩ বছর যাবৎ পাকিস্তানী শাসকদের বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মানুষের স্বেচ্ছায় যোগদান এবং দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী যুদ্ধে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ সকলের সহযোগিতা করার প্রয়াস পেয়েছে।

এ ভাষণে বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছে

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করার অল্পদিন পরই তা বাতিল করা হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান অন্যায়ভাবে মার্শাল-ল জারি করেন এবং বাংলার মানুষদেরকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তানীরা সরকার গঠন করতে দেননি। এ বৈষম্য অনিয়ম ও অন্যায় জাতির সম্মুখে তুলে ধরেছেন। তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, আমি দেশের মানুষের অধিকার চাই। যা থেকে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলার মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বষ্ণিত করেছে এটি জাতির পিতা তাঁর এ ভাষণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সহায়তা করেছে।

পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন

মিথ্যা দোষ চাপানো, মিথ্যা আশ্বাস দেয়া, মিথ্যা কথা বলা ও ছল-চাতুরী করা ছিলো পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের কৌশল। এছাড়া নিয়ম মোতাবেক কাজ না করে পেশীশক্তির ব্যবহার করা ছিলো পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অন্যতম হাতিয়ার। যা কখনও বাংলার জনগণ পছন্দ করেনি। পাকিস্তানীরা যে বিভিন্নভাবে বাংলার মানুষের সঙ্গে কূটকৌশল ও প্রতারণা করছেন তা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জাতির সম্মূখে তুলে ধরেছেন। যা থেকে এক ধরনের সচেতনাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার মানুষ নিজেদেরকে স্বাধীন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।

পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলার মানুষের প্রতি কৃত অবহেলা তুলে ধরেছেন

একটি রাষ্ট্রের সকল সদস্য সমমর্যাদা ও সম্মান পাবে, এটাই কাম্য। কিন্তু দেখা গেছে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের মানুষকে অবহেলার চোখে দেখতো এবং সামান্য কারণে গুলি চালিয়ে বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলার মানুষকে ক্ষমতা না দিয়ে বাংলার মানুষের প্রতি অবিচার করেছে। যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণে ফুঁটে উঠেছে। প্রকারন্তরে এ অবহেলা ও অসম্মানের চিত্রায়ন জাতিকে সংঘঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছে। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়ক হয়েছে।

৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে যুদ্ধের প্রস্ততির নির্দেশ পাওয়া গেছে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলার মানুষকে ক্ষমতা দিবেন না এবং যুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য তিনি ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে বলেছেন। বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্ততি নেয়ার কথা বলেছেন। যেমন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেছেন; ভাতে মারা, পানিতে মারার কথা বলেছেন। যা ছিলো স্পষ্ট যুদ্ধ প্রস্ততির নির্দেশনা।

এদেশের মানুষ যে অকুতোভয় ও পরাক্রমশীল সে কথা বলেছেন:

বাংলার মানুষকে এবং জাতিকে জাগানোর লক্ষ্যে তাদের অসীম সাহস, শক্তি ও বীরত্বকে কাজে খাঁটানোর নিমিত্তে তিনি বলেছেন আমাদেরকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। দমন, নিপীড়ন বা চাপ প্রয়োগ করে এদেশের মানুষকে বশীভূত করে রাখা যাবে না। এরূপ প্রেষণা বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংঘঠিত হতে সহায়তা করেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তা অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ যে বাংলার মানুষের তা বুঝিয়েছেন :

বাংলাদেশের শিল্প, রেডিও, টিভি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিতান্তই বাংলার মানুষের প্রতিষ্ঠান। এগুলো বাংলার মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভাল করবে। এ গুলোর উপর বাংলার মানুষের একান্ত অধিকার রয়েছে। এগুলোতে নিজেদের কথা মানুষের হৃদয়ের কথা বলা এবং এগুলোতে ধর্মঘট বা কাজ বন্ধ করতে বলে তিনি বাংলার মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন এবং এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে দেশাত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।

সংগ্রাম পরিষদ গড়ার কথা বলেছেন:

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে সকল গ্রামে ও মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে বলেছেন। যার দ্বারা তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংঘটিত হতে নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বাধীনতার কথা ও মুক্তির কথা বলেছেন:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি চেয়েছেন। পরাধীন জাতির মধ্যে অনেক হীনমন্যতা কাজ করে। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা থাকে না। তাই তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি চেয়েছেন। সর্বশেষে তিনি জাতিকে আরও ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করার কথা বলেছেন এবং স্বাধীনতার কথাটি বলেছেন।

দেশাত্ববোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির ও স্বাধীনতা অর্জনে স্পষ্ট নির্দেশনা:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষণের ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই এবং স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে তিনি ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী শাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সর্বশেষে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম বলেছেন। যা স্বাধীনতা যুদ্ধের স্পষ্ট ডাক হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে জাতি স্বাধীনতার জন্য করণীয়, প্রয়োজনীয় প্রেরণা ও দিক নির্দেশনা পেয়ে যায়। এ ভাষণ স্বাধীনতা আনায়নে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনে যে প্রভাব ফেলে তার উপর কিছুটা আলোচনা করা হলো।

সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করন :

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে পুরা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। বয়স, ধর্ম ও বর্ণ এক্ষেত্রে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাইতো দেখা যায় বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা স্বতস্ফূর্তভাবে দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।

স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা ও প্রস্ততি :

জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণের পরই মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় ও সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য দিক নির্দেশনা পেয়ে যায়। সমগ্র জাতি দেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে প্রস্ততি নিতে শুরু করে। এ প্রস্ততির মধ্যে মানসিক প্রস্ততি, যুব সমাজকে সংঘটিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ, যুদ্ধ যাত্রা, প্রতিরোধ করার অভিপ্রায়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি অর্ন্তভুক্ত ছিলো। যা পুলিশ বাহিনী, সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, সাংবাদিক, পেশাজীবি, ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ কর্তৃক প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ এ নির্দেশনার ফলস্বরূপ।

যুদ্ধে অংশগ্রহণ:

এ ভাষণের ফলে ঠিক যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বাঁশির ডাকের মত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, জেলে, কৃষক, মজুর, শ্রমিক তথা আপমার জনগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাইতো দেখা যায়, কর্ণেল তাহের, মেজর মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল) সহ ১০-১২ জন সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তানী কারাগার থেকে প্রহরারত রক্ষীদের চোখে ধুলা দিয়ে দূর্গম পথে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্ভূতকরণ:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের কারনেই মুক্তিপাগল মানুষ এক বিরাট প্রেরণা ও প্রেষণা পায়। দেখা যায়, ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান তার স্ত্রী ও শিশু কন্যাদেরকে রেখে পাকিস্তানী পাইলটকে পরাস্ত করে যুদ্ধ বিমান নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা দেন।

প্রাণ বিসর্জন:

এত অল্প দিনে এত বেশী রক্ত ঝরা, এত বেশী মৃত্যু আর কোন যুদ্ধে দেখা যায়নি। দেখা গেছে অধিকাংশ যুদ্ধ ক্ষেত্রে অসম যুদ্ধ হয়েছে। ২৫ শে মার্চের কাল রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানী ট্যাংক, কামান, মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে বীর পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন। এরূপ প্রাণ বিসর্জন ও আত্মত্যাগ ৭ই মার্চের ভাষণের অনুপ্রেরণার ফসল।

স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করন:

পাকিস্তানীদের অপশাসন, নিপীড়ন, শোষন, অসম্মান, দুর্ব্যবহার, গণতন্ত্রহীনতা, অমানবিক আচরন ইত্যাদি এ ভাষণ থেকে চিত্রায়িত হয়েছে। যা সমগ্র জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গতে উদ্ভূত করে এবং জনমতে স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা জাগ্রত করে।

৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষের মাঝে এক আন্দোলন সৃষ্টি হয় ঃ

এ ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলার মুক্তি পাগল মানুষের হৃদয়ে, মনে ও শরীরে এক আন্দোলন তৈরি করেছিল। যে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপাগল মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ, দখলদার পাকিস্তানী ও তাদের দোসরদের অসহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রেষণা ও তাদের কাজে সহায়তা করতে উদ্ভুদ্ধ করেছিলো এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর পরাজয় তরান্বিত করেছিল।

যুদ্ধকালীন অনুপ্রেরণা:

এ ভাষণ রণক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার কাছে দিলো এক শক্তি। মুক্তিযোদ্ধারা রণক্ষেত্রে এ ভাষণ, ভাষণের কথা ও শব্দমালা মনে করে অসীম শক্তি, সাহস, প্রেরণা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। যা দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে সহায়ক হয়েছিল।

আমরা যে এক অদম্য ও সাহসী জাতি তা বুঝিয়েছেন:

বাংলার মানুষ অসীম সাহসী এবং অদম্য ও এদেশের মানুষের মধ্যে অনেক বীরত্ব আছে জাতির পিতার এ ভাষণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। “আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না”। এটা নিৎসন্দেহে আমাদের বীরত্ব ও সাহসীকতার ইঙ্গিত করে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে আমাদের রক্তদান, আন্দোলন ও ইতিহাসের কথা তুলে ধরে আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও যোগ্যতার কথা তুলে ধরেছেন। যেটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনা:

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ছিলো তৎকালীন সময়ের অন্যতম এক শক্তিশালী বাহিনী ও ঐ বাহিনীর সদস্যেরা ছিলো নিয়মিত সদস্য। এ জাতীয় কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অনিয়মিত, গেরিলা ও কিছু নিয়মিত সদস্য নিয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে জয় পাওয়া অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। তাই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন এবং দ্রুততম সময়ে যুদ্ধজয় করতে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ এদেশের জনগণকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত, আন্দোলিত করে ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। এ উচ্চারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। তাই এ ভাষণের প্রচ্ছন্ন প্রভাবে আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করেছি কাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা । এর মাধ্যমে অবসান হয়েছিল দীর্ঘ কালের বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের এক করুণ অধ্যায়।

লেখক: ড. মো: আব্দুস সোবহান (পিপিএম)
কমান্ড্যান্ট (অতিরিক্ত ডিআইজি)
পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙ্গমাটি।

Please Share This Post in Your Social Media

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের প্রভাব, গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

Update Time : ০১:৩৩:২৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩

ড. মো: আব্দুস সোবহান:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) এক গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি সকল স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য এক প্রামাণ্য দলিলস্বরূপ, যার প্রতিটি শব্দ এক একটি পুস্তকসম। এ ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়, স্বাধীনতার প্রস্ততি নেয়, যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ হয়, প্রাণ বিসর্জন দেয়া, চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে নেয়া ইত্যাদি সম্ভব হয়েছিল। তাই ৭ই মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার ভাষণ (সোহরাব গনি দুলাল, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার, মিরপুর কুষ্টিয়া, ২০২২)।

এখন এ ভাষণের উপর একটু আলোকপাত করা যাক:

এ ভাষণে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক নির্যাতন ও বাংলাদেশের মানুষের রক্তঝরার কথা চিত্রায়িত হয়েছে।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণের শুরুতেই পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের কথা তুলে ধরেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক অন্যায়ভাবে এবং বিনা কারণে বাংলার মানুষের উপর অত্যাচার, নির্যাতন, গুলি ও রক্তপাত করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ৬ই মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষ তৎকালীন পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে সমঝোতার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তারা সমঝোতা না করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী ও রংপুরে গুলি চালিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হতাহত করেছে। এরূপ রক্তের করুণ ইতিহাস পুরা পাকিস্তানী শাসনকাল জুড়ে বিরাজমান ছিলো। সর্বোপরী ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে জাতির পিতা পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক ২৩ বছর যাবৎ পাকিস্তানী শাসকদের বাংলাদেশের মানুষের নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরেছেন। যা বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে মানুষের স্বেচ্ছায় যোগদান এবং দীর্ঘ নয় মাস ব্যাপী যুদ্ধে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাসহ সকলের সহযোগিতা করার প্রয়াস পেয়েছে।

এ ভাষণে বাংলার মানুষের অধিকারের কথা বলা হয়েছে

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করার অল্পদিন পরই তা বাতিল করা হয়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান অন্যায়ভাবে মার্শাল-ল জারি করেন এবং বাংলার মানুষদেরকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও তৎকালীন আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তানীরা সরকার গঠন করতে দেননি। এ বৈষম্য অনিয়ম ও অন্যায় জাতির সম্মুখে তুলে ধরেছেন। তিনি তার ভাষণে উল্লেখ করেছেন আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাইনা, আমি দেশের মানুষের অধিকার চাই। যা থেকে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে। পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলার মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বষ্ণিত করেছে এটি জাতির পিতা তাঁর এ ভাষণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে বাংলার মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছে এবং স্বতস্ফূর্তভাবে হানাদার পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সহায়তা করেছে।

পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের এবং বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন

মিথ্যা দোষ চাপানো, মিথ্যা আশ্বাস দেয়া, মিথ্যা কথা বলা ও ছল-চাতুরী করা ছিলো পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের কৌশল। এছাড়া নিয়ম মোতাবেক কাজ না করে পেশীশক্তির ব্যবহার করা ছিলো পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অন্যতম হাতিয়ার। যা কখনও বাংলার জনগণ পছন্দ করেনি। পাকিস্তানীরা যে বিভিন্নভাবে বাংলার মানুষের সঙ্গে কূটকৌশল ও প্রতারণা করছেন তা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে জাতির সম্মূখে তুলে ধরেছেন। যা থেকে এক ধরনের সচেতনাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলার মানুষ নিজেদেরকে স্বাধীন হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।

পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলার মানুষের প্রতি কৃত অবহেলা তুলে ধরেছেন

একটি রাষ্ট্রের সকল সদস্য সমমর্যাদা ও সম্মান পাবে, এটাই কাম্য। কিন্তু দেখা গেছে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশের মানুষকে অবহেলার চোখে দেখতো এবং সামান্য কারণে গুলি চালিয়ে বাংলার মানুষকে হত্যা করেছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলার মানুষকে ক্ষমতা না দিয়ে বাংলার মানুষের প্রতি অবিচার করেছে। যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণে ফুঁটে উঠেছে। প্রকারন্তরে এ অবহেলা ও অসম্মানের চিত্রায়ন জাতিকে সংঘঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছে। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়ক হয়েছে।

৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে যুদ্ধের প্রস্ততির নির্দেশ পাওয়া গেছে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, তৎকালীন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলার মানুষকে ক্ষমতা দিবেন না এবং যুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য তিনি ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সমগ্র জাতিকে যুদ্ধের প্রস্ততি নিতে বলেছেন। বিশেষ করে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্ততি নেয়ার কথা বলেছেন। যেমন প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তুলতে বলেছেন; ভাতে মারা, পানিতে মারার কথা বলেছেন। যা ছিলো স্পষ্ট যুদ্ধ প্রস্ততির নির্দেশনা।

এদেশের মানুষ যে অকুতোভয় ও পরাক্রমশীল সে কথা বলেছেন:

বাংলার মানুষকে এবং জাতিকে জাগানোর লক্ষ্যে তাদের অসীম সাহস, শক্তি ও বীরত্বকে কাজে খাঁটানোর নিমিত্তে তিনি বলেছেন আমাদেরকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। দমন, নিপীড়ন বা চাপ প্রয়োগ করে এদেশের মানুষকে বশীভূত করে রাখা যাবে না। এরূপ প্রেষণা বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংঘঠিত হতে সহায়তা করেছে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে তা অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ যে বাংলার মানুষের তা বুঝিয়েছেন :

বাংলাদেশের শিল্প, রেডিও, টিভি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিতান্তই বাংলার মানুষের প্রতিষ্ঠান। এগুলো বাংলার মানুষের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় দেখভাল করবে। এ গুলোর উপর বাংলার মানুষের একান্ত অধিকার রয়েছে। এগুলোতে নিজেদের কথা মানুষের হৃদয়ের কথা বলা এবং এগুলোতে ধর্মঘট বা কাজ বন্ধ করতে বলে তিনি বাংলার মানুষকে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেছেন এবং এর মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে দেশাত্ববোধ জাগ্রত হয়েছে। যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনয়নে বড় ভূমিকা রেখেছে।

সংগ্রাম পরিষদ গড়ার কথা বলেছেন:

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণে সকল গ্রামে ও মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তুলতে বলেছেন। যার দ্বারা তিনি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে ও সংঘটিত হতে নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বাধীনতার কথা ও মুক্তির কথা বলেছেন:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি চেয়েছেন। পরাধীন জাতির মধ্যে অনেক হীনমন্যতা কাজ করে। তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা থাকে না। তাই তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি চেয়েছেন। সর্বশেষে তিনি জাতিকে আরও ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করার কথা বলেছেন এবং স্বাধীনতার কথাটি বলেছেন।

দেশাত্ববোধ, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির ও স্বাধীনতা অর্জনে স্পষ্ট নির্দেশনা:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষণের ও নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরেছেন, স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন বিকল্প নাই এবং স্বাধীনতা অর্জনের নিমিত্তে তিনি ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানী শাসন কর্তৃক প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সর্বশেষে এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম বলেছেন। যা স্বাধীনতা যুদ্ধের স্পষ্ট ডাক হিসাবে প্রতীয়মান হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ থেকে জাতি স্বাধীনতার জন্য করণীয়, প্রয়োজনীয় প্রেরণা ও দিক নির্দেশনা পেয়ে যায়। এ ভাষণ স্বাধীনতা আনায়নে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনে যে প্রভাব ফেলে তার উপর কিছুটা আলোচনা করা হলো।

সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করন :

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দলমত নির্বিশেষে পুরা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায়। বয়স, ধর্ম ও বর্ণ এক্ষেত্রে কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। তাইতো দেখা যায় বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা স্বতস্ফূর্তভাবে দলে দলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন।

স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা ও প্রস্ততি :

জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণের পরই মূলত পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভাজন এবং বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় ও সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য দিক নির্দেশনা পেয়ে যায়। সমগ্র জাতি দেশ স্বাধীন করার নিমিত্তে প্রস্ততি নিতে শুরু করে। এ প্রস্ততির মধ্যে মানসিক প্রস্ততি, যুব সমাজকে সংঘটিত করা, অস্ত্র সংগ্রহ, যুদ্ধ যাত্রা, প্রতিরোধ করার অভিপ্রায়, প্রশিক্ষণ ইত্যাদি অর্ন্তভুক্ত ছিলো। যা পুলিশ বাহিনী, সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, সাংবাদিক, পেশাজীবি, ছাত্র-শিক্ষক ও সাধারণ মানুষের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৭১ সালে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পুলিশ কর্তৃক প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ এ নির্দেশনার ফলস্বরূপ।

যুদ্ধে অংশগ্রহণ:

এ ভাষণের ফলে ঠিক যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার বাঁশির ডাকের মত স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী, জেলে, কৃষক, মজুর, শ্রমিক তথা আপমার জনগণ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তাইতো দেখা যায়, কর্ণেল তাহের, মেজর মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল) সহ ১০-১২ জন সামরিক কর্মকর্তা পাকিস্তানী কারাগার থেকে প্রহরারত রক্ষীদের চোখে ধুলা দিয়ে দূর্গম পথে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

যুদ্ধে অংশগ্রহণে উদ্ভূতকরণ:

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের কারনেই মুক্তিপাগল মানুষ এক বিরাট প্রেরণা ও প্রেষণা পায়। দেখা যায়, ফ্লাইট লে. মতিউর রহমান তার স্ত্রী ও শিশু কন্যাদেরকে রেখে পাকিস্তানী পাইলটকে পরাস্ত করে যুদ্ধ বিমান নিয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে রওনা দেন।

প্রাণ বিসর্জন:

এত অল্প দিনে এত বেশী রক্ত ঝরা, এত বেশী মৃত্যু আর কোন যুদ্ধে দেখা যায়নি। দেখা গেছে অধিকাংশ যুদ্ধ ক্ষেত্রে অসম যুদ্ধ হয়েছে। ২৫ শে মার্চের কাল রাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে পাকিস্তানী ট্যাংক, কামান, মেশিনগানসহ অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে বীর পুলিশ সদস্যরা থ্রি নট থ্রি রাইফেল ও বন্দুক দিয়ে যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন। এরূপ প্রাণ বিসর্জন ও আত্মত্যাগ ৭ই মার্চের ভাষণের অনুপ্রেরণার ফসল।

স্বাধীনতার স্পৃহা জাগ্রত করন:

পাকিস্তানীদের অপশাসন, নিপীড়ন, শোষন, অসম্মান, দুর্ব্যবহার, গণতন্ত্রহীনতা, অমানবিক আচরন ইত্যাদি এ ভাষণ থেকে চিত্রায়িত হয়েছে। যা সমগ্র জাতিকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙ্গতে উদ্ভূত করে এবং জনমতে স্বাধীনতা ও মুক্তির স্পৃহা জাগ্রত করে।

৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষের মাঝে এক আন্দোলন সৃষ্টি হয় ঃ

এ ঐতিহাসিক ভাষণ বাংলার মুক্তি পাগল মানুষের হৃদয়ে, মনে ও শরীরে এক আন্দোলন তৈরি করেছিল। যে আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপাগল মানুষকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ, দখলদার পাকিস্তানী ও তাদের দোসরদের অসহযোগিতা ও মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রেষণা ও তাদের কাজে সহায়তা করতে উদ্ভুদ্ধ করেছিলো এবং পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর পরাজয় তরান্বিত করেছিল।

যুদ্ধকালীন অনুপ্রেরণা:

এ ভাষণ রণক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত মুক্তিযোদ্ধার কাছে দিলো এক শক্তি। মুক্তিযোদ্ধারা রণক্ষেত্রে এ ভাষণ, ভাষণের কথা ও শব্দমালা মনে করে অসীম শক্তি, সাহস, প্রেরণা ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। যা দেশ মাতৃকাকে মুক্ত করতে সহায়ক হয়েছিল।

আমরা যে এক অদম্য ও সাহসী জাতি তা বুঝিয়েছেন:

বাংলার মানুষ অসীম সাহসী এবং অদম্য ও এদেশের মানুষের মধ্যে অনেক বীরত্ব আছে জাতির পিতার এ ভাষণের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন। “আমাদেরকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না”। এটা নিৎসন্দেহে আমাদের বীরত্ব ও সাহসীকতার ইঙ্গিত করে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে আমাদের রক্তদান, আন্দোলন ও ইতিহাসের কথা তুলে ধরে আমাদের সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও যোগ্যতার কথা তুলে ধরেছেন। যেটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

চূড়ান্ত বিজয় ছিনিয়ে আনা:

পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ছিলো তৎকালীন সময়ের অন্যতম এক শক্তিশালী বাহিনী ও ঐ বাহিনীর সদস্যেরা ছিলো নিয়মিত সদস্য। এ জাতীয় কোন শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অনিয়মিত, গেরিলা ও কিছু নিয়মিত সদস্য নিয়ে ৯ মাস যুদ্ধ করে জয় পাওয়া অকল্পনীয় ও অসম্ভব ব্যাপার ছিলো। তাই চূড়ান্ত বিজয় অর্জন এবং দ্রুততম সময়ে যুদ্ধজয় করতে ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ এদেশের জনগণকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত, আন্দোলিত করে ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠের ঘোষণা” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ছিল মূলত স্বাধীনতার ডাক। এ উচ্চারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু কেবল স্বাধীনতার চূড়ান্ত আহ্বানটি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখাও দিয়েছিলেন। তাই এ ভাষণের প্রচ্ছন্ন প্রভাবে আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জন করেছি কাক্সিক্ষত বিজয় ও স্বাধীনতা । এর মাধ্যমে অবসান হয়েছিল দীর্ঘ কালের বৈষম্য, শোষণ ও নিপীড়নের এক করুণ অধ্যায়।

লেখক: ড. মো: আব্দুস সোবহান (পিপিএম)
কমান্ড্যান্ট (অতিরিক্ত ডিআইজি)
পুলিশ স্পেশাল ট্রেনিং স্কুল (পিএসটিএস), বেতবুনিয়া, রাঙ্গমাটি।