বেকারত্ব ও হতাশার জালে তরুণ সমাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৩:৫৫:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মে ২০২১
  • / ২৮৬ Time View
ড. কামরুল হাসান হীরা:
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে করে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তা আমাদের কাছে অজানা। একই সঙ্গে দেশে অর্থশালী ব্যক্তির সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় দেশের কর্মসংস্থানের সংখ্যা কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
.
সাম্প্রতিকালের মহামারী অতীতের সকল পরিস্থিতিকে হার মানিয়েছে। ২০২০ ইং সালের সংক্রমিত কোভিড – ১৯ বা করোনা ভাইরাসের ফলে জনমনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে তা যেন থামছেইনা। দিন দিন নতুন নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। পৃথিবীজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেদক টিকা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। তবে সস্থির আশ্বাস একটাই সরকার করোনা প্রতিষেদক টিকা প্রদানে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
.
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও করোনাকালীন সময় তা অনেকটা মন্থর গতিতে এগোচ্ছে। পাশাপাশি, দেশের সামাজিক ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়। গত এক দশকে সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছে সেই তুলনায় বেকার সমস্যা নিরসনে সরকারেরপক্ষ থেকে তেমন কোন মহাপরিকল্পনা বা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে এক্ষেত্রে আইসিটি খাতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকলেও সময়োপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
সরকারি ও বেসরকারি হিসাব মতে দেশে মোট বেকার যুবকের সংখ্যা নির্ধারণে নানা মতভেদ রয়েছে।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ ২০১৬ -১৭ অনুযায়ী সরকারি হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে যে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা আছে তা আগামী কয়েক বছরে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, বেসরকারি হিসাবে মোট বেকার যুবকের সংখ্যা অনেক বেশি যা দুশ্চন্তার কারণ বটে । যেমন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে বাংলাদেশ মোট বেকার যুবকের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ।
.
তবে দেশের মোট বেকার যুবকের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ তরুণী। অনেকে উন্নত চাকরি পাওয়ার জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, আবার অনেকে কিছুই করেননা শুধুই বেকার সময় পার করছেন। সরকারি হিসাবে এদের সবাই কর্মক্ষম বেকার না হলেও এদেরকে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
.
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে সম্পদ ও আবাস ভূমির তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও বেকার বা বেকারত্বের বৃদ্ধির হার অনেকটাই অস্বাভাবিক।
.
অন্যদিকে, মোট জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের যোগান অনেক কম। এই কম সংখ্যক কর্মসংস্থানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষায় থাকেন। অপেক্ষারত এ সকল যুবকরা একদিকে যেমন সময় ও অর্থ ব্যায় করেন ঠিক তার বিপরীতে চাকুরী না পাওয়ার নিদারুন কষ্ট, নিরাশা ও হতাশা তাদেরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।সময়ের পরিক্রমায় সাময়িক হতাশা বেকার যুবকদের মাঝে বাড়িয়ে দেয় দুশ্চিন্তার পাহাড় । এভাবে চলতে থাকলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতে বড় ধরণের বিপদের মুখে পরবে। বেকারত্ব একটি সামাজিক অভিশাপ হলেও ইহা আমাদের জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা, দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি একটি নেতিবাচক দিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
.
সামগ্রিকভাবে বলা যায় দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সরকারের সার্বিক উন্নয়ন নানান প্রশ্ন বানে জজ্জরিত হয়। পাশাপাশি, অর্থনীতিক উন্নয়নের তুলনায় বেকারত্বের অনুপাত বেশি হলে দেশের উন্নয়ন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। তাছাড়া, দীর্ঘ করোনাকালীন সময়ে বেকারত্বের হার প্রায় অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।  সর্বনাশা করোনা ভাইরাসের কারণে গত এক বছরে দেশে নিম্ন পেশার মানুষদের মধ্যে চাকুরী হারানোর মহাউৎসব চলছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
.
প্রকৃতপক্ষে, দেশের চাকুরীর বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে মানুষ তাদের ভবিষ্যত নিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আছে দেশের গুণীজনরা মনে করেন ছেলে-মেয়েদের হতাশার মূল কারণ মানসম্মত কর্মসংস্থানের ভারসাম্যহীনতা। এই ভারসাম্যহীনতা শুধু শহরকেন্দ্রিক নয় বরং গ্রামীণ জীবনেও এর প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে সকল তরুণ-তরুণী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরির বাজারে ঘুরোঘুরি করছেন তাদের একটা বড় অংশ বেকার।
.
করোনাকালীন সময়ে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অভিবাবক ও চাকুরী পত্যাশীদের মাঝে নানা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। বেকার থাকার মানসিক চাপ বা বেকারত্ব কালীন কঠিন বাস্তবতা আমাদের অনেক কিছু শেখায়। গত কয়েক বছরে দেশে শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। শিক্ষিত বেকার যুবকের পাশাপাশি অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেকার যুবকরাও চাকুরী না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন। বর্তমান সময়ে চাকরি পাওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেও বেশির ভাগ চাকরি প্রত্যাশীরা হতাশাগ্রস্থ। আবার অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগ না হওয়া কিংবা চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতাকে নিজেদের অদক্ষতা হিসেবে মনে করেন।
.
বেকারত্বের হতাশা যুব সমাজের মধ্যে নানান দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তোলে। লেখাপড়া শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগ না হওয়া অথবা প্রত্যাশিত চাকরি না পাওয়া বাস্তব জীবনে হতাশার অন্যতম কারণ। হতাশাগ্রস্ত বেশিরভাগ যুবক নিজেদেরকে আড়ালে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একটা সময় নিজেদের মধ্যে বিষন্নতা তৈরি হয়। এই বিষন্নতা থেকে অপরাধ বা অপরাধ মূলক আচরণ বা অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আবার অনেকক্ষেত্রে হতাশাগ্রস্থ ছেলেমেয়েরা নানাপ্রকার অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এসকল অপরাধ গুলোর মধ্যে মাদক সেবন, ছিনতাই, মারামারি, আত্মহত্যা এমনকি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
.
মানব জীবনে ব্যক্তিগত কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার ও হিংসাকে একত্রে ষড়রিপু বলা হয়। এই ষড়রিপুর যেকোনো একটি অপরাধ সংঘটনের কারণ হিসাবে ধরা হয়। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা নানান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কিংবা অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের সম্মুখীন হই। এসকল ঘটনা আমাদের স্বাবাভিক জীবন যাপন এমনকি মন-মানসিকতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। কোন কোন সময় মানুষ অজান্তেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বেকার জীবন একধরণের হীনমন্যতা বা হতাশার সমষ্টি।
.
উদাহরণ দিয়ে বলা যায় বেকার যুবকদের একটা বিরাট অংশ হতাশাগ্রস্ত এবং মরণনেশা নামক মাদকে আসক্ত। সামাজিক যোগাযোগে পারস্পারিক অসহযোগিতা এবং নিষ্ক্রিয়তা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার প্রধান কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। বেকারত্বের পাশাপাশি আমাদের সমাজে বেকার যুবক-যুবতীরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নিজের অজান্তেই নানাপ্রকার অনলাইন ভিত্তিক অপরাধে জড়িয়ে যান। এই অপরাধ দমনে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে।
.
এ বিষয়ে সরকার মহোদয় অধিক গুরুত্ব সহকারে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। ইহা চিরন্তন সত্য যে যৌবন মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পাশাপাশি, স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়েতে মেধাবী, দক্ষ এবং যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মত তরুণ সমাজ গড়ে তোলা অতীব জরুরী। দেশের লক্ষ্য লক্ষ বেকারদের নিয়ে সরকার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোর আলাপ আলোচনা গোলটেবিল বৈঠক, সভা, সেমিনার, ইত্যাদি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না রেখে তা বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।
.
শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ বেকারদের নিয়ে বর্তমান সরকার কতটা কাজ করছেন তার সদুত্তর হয়তো আমাদের জানা নেই। কিন্তু, সরকার চাইলেই বেকার যুবকদের নিয়ে কাজ করতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার বা উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার যুবককে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ সহ দক্ষ জনবল তৈরি করে দেশে ফেরত আনতে পারলে ভবিষ্যতে তারা কর্মক্ষম জনবল তৈরি করতে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
.
এহেন পরিস্থিতিতে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের মেগা পকল্পগুলোর মত দেশের বেকার সমস্যা নিরসনে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে পারলে আগামী কয়েক বছরে আমাদের অর্থনীতি একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে। একইসাথে, আন্তর্জাতিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশের সর্বত্র তরুণ সমাজকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা অধিক প্রয়োজন।
.
লেখক: গবেষক ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

Please Share This Post in Your Social Media

বেকারত্ব ও হতাশার জালে তরুণ সমাজ

Update Time : ০৩:৫৫:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৬ মে ২০২১
ড. কামরুল হাসান হীরা:
নিত্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধি যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে করে ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতি কোথায় গিয়ে পৌঁছায় তা আমাদের কাছে অজানা। একই সঙ্গে দেশে অর্থশালী ব্যক্তির সংখ্যা যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় দেশের কর্মসংস্থানের সংখ্যা কি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
.
সাম্প্রতিকালের মহামারী অতীতের সকল পরিস্থিতিকে হার মানিয়েছে। ২০২০ ইং সালের সংক্রমিত কোভিড – ১৯ বা করোনা ভাইরাসের ফলে জনমনে যে আতঙ্ক বিরাজ করছে তা যেন থামছেইনা। দিন দিন নতুন নতুন আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। পৃথিবীজুড়ে করোনা ভাইরাসের প্রতিষেদক টিকা নিয়েও চলছে নানা জল্পনা কল্পনা। তবে সস্থির আশ্বাস একটাই সরকার করোনা প্রতিষেদক টিকা প্রদানে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
.
বাংলাদেশের রপ্তানি খাতে অর্থনৈতিক উন্নতি হলেও করোনাকালীন সময় তা অনেকটা মন্থর গতিতে এগোচ্ছে। পাশাপাশি, দেশের সামাজিক ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা লক্ষ্য করা যায়। গত এক দশকে সরকার দেশের সার্বিক উন্নয়নে যে ভূমিকা রেখেছে সেই তুলনায় বেকার সমস্যা নিরসনে সরকারেরপক্ষ থেকে তেমন কোন মহাপরিকল্পনা বা উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তবে এক্ষেত্রে আইসিটি খাতে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ বা সম্ভাবনা থাকলেও সময়োপযোগী শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের অভাব প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
সরকারি ও বেসরকারি হিসাব মতে দেশে মোট বেকার যুবকের সংখ্যা নির্ধারণে নানা মতভেদ রয়েছে।  বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ ২০১৬ -১৭ অনুযায়ী সরকারি হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লক্ষ। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে যে কর্মক্ষম বেকারের সংখ্যা আছে তা আগামী কয়েক বছরে দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু, বেসরকারি হিসাবে মোট বেকার যুবকের সংখ্যা অনেক বেশি যা দুশ্চন্তার কারণ বটে । যেমন, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার মতে বাংলাদেশ মোট বেকার যুবকের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ।
.
তবে দেশের মোট বেকার যুবকের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার পেছনে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। দেশের মোট জনসংখ্যার একটা বিরাট অংশ স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তরুণ তরুণী। অনেকে উন্নত চাকরি পাওয়ার জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, আবার অনেকে কিছুই করেননা শুধুই বেকার সময় পার করছেন। সরকারি হিসাবে এদের সবাই কর্মক্ষম বেকার না হলেও এদেরকে নিষ্ক্রিয় জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
.
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে সম্পদ ও আবাস ভূমির তুলনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি। দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলেও বেকার বা বেকারত্বের বৃদ্ধির হার অনেকটাই অস্বাভাবিক।
.
অন্যদিকে, মোট জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থানের যোগান অনেক কম। এই কম সংখ্যক কর্মসংস্থানে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত যুবক বিভিন্ন সেক্টরে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষায় থাকেন। অপেক্ষারত এ সকল যুবকরা একদিকে যেমন সময় ও অর্থ ব্যায় করেন ঠিক তার বিপরীতে চাকুরী না পাওয়ার নিদারুন কষ্ট, নিরাশা ও হতাশা তাদেরকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।সময়ের পরিক্রমায় সাময়িক হতাশা বেকার যুবকদের মাঝে বাড়িয়ে দেয় দুশ্চিন্তার পাহাড় । এভাবে চলতে থাকলে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতে বড় ধরণের বিপদের মুখে পরবে। বেকারত্ব একটি সামাজিক অভিশাপ হলেও ইহা আমাদের জীবনের অতীব গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কেননা, দেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি একটি নেতিবাচক দিক হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
.
সামগ্রিকভাবে বলা যায় দেশে বেকার যুবকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলে সরকারের সার্বিক উন্নয়ন নানান প্রশ্ন বানে জজ্জরিত হয়। পাশাপাশি, অর্থনীতিক উন্নয়নের তুলনায় বেকারত্বের অনুপাত বেশি হলে দেশের উন্নয়ন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। তাছাড়া, দীর্ঘ করোনাকালীন সময়ে বেকারত্বের হার প্রায় অনেক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।  সর্বনাশা করোনা ভাইরাসের কারণে গত এক বছরে দেশে নিম্ন পেশার মানুষদের মধ্যে চাকুরী হারানোর মহাউৎসব চলছে। কর্মহীন মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।
.
প্রকৃতপক্ষে, দেশের চাকুরীর বাজারে এক ধরনের স্থবিরতা নেমে এসেছে। দুশ্চিন্তার বিষয় এই যে মানুষ তাদের ভবিষ্যত নিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আছে দেশের গুণীজনরা মনে করেন ছেলে-মেয়েদের হতাশার মূল কারণ মানসম্মত কর্মসংস্থানের ভারসাম্যহীনতা। এই ভারসাম্যহীনতা শুধু শহরকেন্দ্রিক নয় বরং গ্রামীণ জীবনেও এর প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে সকল তরুণ-তরুণী উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চাকরির বাজারে ঘুরোঘুরি করছেন তাদের একটা বড় অংশ বেকার।
.
করোনাকালীন সময়ে বেকারত্বের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় অভিবাবক ও চাকুরী পত্যাশীদের মাঝে নানা দুশ্চিন্তা কাজ করছে। বেকার থাকার মানসিক চাপ বা বেকারত্ব কালীন কঠিন বাস্তবতা আমাদের অনেক কিছু শেখায়। গত কয়েক বছরে দেশে শিক্ষিত বেকার যুবকের সংখ্যা বেড়েই চলছে। শিক্ষিত বেকার যুবকের পাশাপাশি অল্পশিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেকার যুবকরাও চাকুরী না পাওয়ায় হতাশায় ভুগছেন। বর্তমান সময়ে চাকরি পাওয়ার জন্য বারবার চেষ্টা করেও বেশির ভাগ চাকরি প্রত্যাশীরা হতাশাগ্রস্থ। আবার অনেকেই কর্মসংস্থানের সুযোগ না হওয়া কিংবা চাকরি না পাওয়ার ব্যর্থতাকে নিজেদের অদক্ষতা হিসেবে মনে করেন।
.
বেকারত্বের হতাশা যুব সমাজের মধ্যে নানান দুশ্চিন্তা বাড়িয়ে তোলে। লেখাপড়া শেষে কর্মসংস্থানের সুযোগ না হওয়া অথবা প্রত্যাশিত চাকরি না পাওয়া বাস্তব জীবনে হতাশার অন্যতম কারণ। হতাশাগ্রস্ত বেশিরভাগ যুবক নিজেদেরকে আড়ালে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। একটা সময় নিজেদের মধ্যে বিষন্নতা তৈরি হয়। এই বিষন্নতা থেকে অপরাধ বা অপরাধ মূলক আচরণ বা অপরাধ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। আবার অনেকক্ষেত্রে হতাশাগ্রস্থ ছেলেমেয়েরা নানাপ্রকার অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন। এসকল অপরাধ গুলোর মধ্যে মাদক সেবন, ছিনতাই, মারামারি, আত্মহত্যা এমনকি মানুষ হত্যার মতো জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়েন।
.
মানব জীবনে ব্যক্তিগত কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার ও হিংসাকে একত্রে ষড়রিপু বলা হয়। এই ষড়রিপুর যেকোনো একটি অপরাধ সংঘটনের কারণ হিসাবে ধরা হয়। প্রাত্যহিক জীবনে আমরা নানান অস্বস্তিকর পরিস্থিতি কিংবা অস্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের সম্মুখীন হই। এসকল ঘটনা আমাদের স্বাবাভিক জীবন যাপন এমনকি মন-মানসিকতায় বিরূপ প্রভাব ফেলে। কোন কোন সময় মানুষ অজান্তেই অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন। বেকার জীবন একধরণের হীনমন্যতা বা হতাশার সমষ্টি।
.
উদাহরণ দিয়ে বলা যায় বেকার যুবকদের একটা বিরাট অংশ হতাশাগ্রস্ত এবং মরণনেশা নামক মাদকে আসক্ত। সামাজিক যোগাযোগে পারস্পারিক অসহযোগিতা এবং নিষ্ক্রিয়তা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার প্রধান কারণ বলে ধরে নেওয়া হয়। বেকারত্বের পাশাপাশি আমাদের সমাজে বেকার যুবক-যুবতীরা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে নিজের অজান্তেই নানাপ্রকার অনলাইন ভিত্তিক অপরাধে জড়িয়ে যান। এই অপরাধ দমনে বাংলাদেশে সাইবার অপরাধ দমন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হিমশিম খাচ্ছে।
.
এ বিষয়ে সরকার মহোদয় অধিক গুরুত্ব সহকারে যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা গুরুতর চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। ইহা চিরন্তন সত্য যে যৌবন মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তোলা সম্ভব। পাশাপাশি, স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়েতে মেধাবী, দক্ষ এবং যোগ্য নেতৃত্ব দেওয়ার মত তরুণ সমাজ গড়ে তোলা অতীব জরুরী। দেশের লক্ষ্য লক্ষ বেকারদের নিয়ে সরকার এবং বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলোর আলাপ আলোচনা গোলটেবিল বৈঠক, সভা, সেমিনার, ইত্যাদি পর্যন্ত সীমাবদ্ধ না রেখে তা বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।
.
শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থ বেকারদের নিয়ে বর্তমান সরকার কতটা কাজ করছেন তার সদুত্তর হয়তো আমাদের জানা নেই। কিন্তু, সরকার চাইলেই বেকার যুবকদের নিয়ে কাজ করতে পারেন। সরকারি কর্মকর্তা- কর্মচারীদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার বা উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার যুবককে একটি প্রজেক্টের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ও উচ্চতর প্রশিক্ষণ সহ দক্ষ জনবল তৈরি করে দেশে ফেরত আনতে পারলে ভবিষ্যতে তারা কর্মক্ষম জনবল তৈরি করতে এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।
.
এহেন পরিস্থিতিতে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে সরকারের মেগা পকল্পগুলোর মত দেশের বেকার সমস্যা নিরসনে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে পারলে আগামী কয়েক বছরে আমাদের অর্থনীতি একটা শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারবে। একইসাথে, আন্তর্জাতিক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে দেশের সর্বত্র তরুণ সমাজকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা অধিক প্রয়োজন।
.
লেখক: গবেষক ও আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।