ফেসবুকের কল্যাণে ১৭ বছর পর বাবা-মাকে খুঁজে পেলেন তানিয়া

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০২:৩০:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ জানুয়ারী ২০২১
  • / ২৪৭ Time View
বিডি সমাচার ডেস্ক:

তানিয়ার বয়স আট বছর। বাবার সঙ্গে ঢাকা দেখতে আসে। ফুফুর বাসা থেকে একদিন বেড়িয়ে যায়। বাড়ি খুঁজে না পেয়ে ছুটে যায় ফুফাতো বোনের স্কুলে। কিন্তু স্কুলের দারোয়ান স্কুলে ঢুকতে দেয়নি। এরপর বদলে যায় তানিয়ার জীবন পথ।

একদিনের জন্য তানিয়ার ঠায় হয় এক পরিবারে। পরের দিন আরেকটি পরিবার তাকে নিয়ে যায়, মেয়ে হিসেবেই বড় করে তোলে। বিয়ে দেয়। তানিয়ার কোলজুড়ে আসে দুই সন্তান। তবে বাবা-মাকে হারানোর বেদনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। কথা হলেই এ নিয়ে গল্প জুড়ে দেয় স্বামীসহ অন্যদের সঙ্গে।
.
কথা প্রসঙ্গেই স্বামী আনোয়ার হোসেন ও তার এক বন্ধু তানিয়ার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এ চোখ, ওই চোখ হয়ে নজরে আসে শত মাইল দূরে থাকা বাবা-মায়ের। ১৭ বছর পর তানিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার তাদের। এ যেন নতুন জীবনের শুরু।
.
স্বামী-সন্তান নিয়ে তানিয়া যাচ্ছে বাবার বাড়ি। এটি সিনেমার কোনো গল্প নয়। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া পশ্চিমপাড়ার তানিয়া আক্তারের বাস্তব জীবনের গল্প এটি। রোববার (১০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে স্বামী সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে যাচ্ছেন তানিয়া।
.
তানিয়াসহ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার একটি বাস কাউন্টারে কর্মরত মো: সুন্দর আলী ২০০৪ সালে তার সাত বছর বয়সী মেয়ে তানিয়ার আবদার মেটাতে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে সুন্দর আলীর বোনের বাড়িতে ছিলেন তারা। সবার অজান্তে তানিয়া একদিন বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বাসা চিনতে না পেরে সে ছুটে যায় ফুফাতো বোনের স্কুলে। সেখানকার দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেয়নি। রাস্তা ঘাট না চেনায় এক পর্যায়ে একটি বাসে করে সংসদ ভবনের কাছে আসে তানিয়া।
.
সেখানে একটি দোকানে টেলিভিশন দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়। তখন বাসায় যেতে তানিয়া অনেক কান্নাকাটি করে। কিন্তু ঠিকানা বলতে না পারায় এক হিন্দু লোক তাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। পরদিন তানিয়াকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে সে অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করা হয়।
.
তানিয়া বলেন, ‘এক পর্যায়ে কলাবাগান এলাকায় আরজুদা খাতুন মিলন ও তার ছেলে রিপনের সাথে দেখা হলে তারা বিষয়টি জেনে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর থেকে ওই বাড়িতে আমি বড় হতে থাকি। রিপনকে আমি বাবা বলে ডাকি। খুব আদর যত্ন করতেন তারা। ওই পরিবার থেকেই আমার বিয়ে হয়।
.
তানিয়া জানায়, রিপনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা উপজেলার রায়তলা গ্রাম। তানিয়ার স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর এলাকার শান্তিনগরের আনোয়ার হোসেন জানান, রিপন নামে ওই ব্যক্তি তার পূর্ব পরিচিত। সব কিছু জেনে শুনেই তিনি তানিয়াকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে এখন এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তানিয়া প্রায়ই বাবা-মাকে হারানোর কথা বলতো। এ অবস্থায় তিনি ও এক বন্ধু তানিয়ার ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
.
সেই সূত্র ধরেই বিষয়টি জানতে পেরে তানিয়ার বাবা-মা শনিবার রাতে আখাউড়ায় ছুটে আসেন। ১৭ বছর পর নিজেদের তানিয়ার সঙ্গে বাবা-মায়ের দেখা হলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জড়ো হন এলাকার লোকজন। আনন্দের অশ্রু তখন সবার চোখে। দিনভর অতীত স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন পরিবারের লোকজন।
.
তানিয়ার ছোট বোন সোনিয়া খানম বলেন, ‘বোনের ছোট বেলার অনেক স্মৃতি মনে আছে। বোনকে হারানোর পর সব সময় মন খারাপ থাকতো। ভাবতাম বোনকে বুঝি কখনও পাব না। তবে আম্মা প্রায়ই বলতো এই দেশটা ছোট। একদিন না একদিন আমি আমার মেয়েকে ঠিকই ফিরে পাবো। বোনকে পেয়ে আমরা খুশি।

তানিয়ার বাবা সুন্দর আলী রোববার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বলেন, ‘প্রতিবেশী রুমা নামে একজন ফেসবুকে তানিয়ার বিষয় নিয়ে লেখালেখির কথা আমাদেরকে জানায়। এরই সূত্র ধরে ঠিকানা বের করে মেয়ের বাড়িতে আসি। এখন মেয়ে ও তার স্বামী সন্তান নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। এভাবে মেয়েকে খুঁজে পাবো কখনো ভাবিনি।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

ফেসবুকের কল্যাণে ১৭ বছর পর বাবা-মাকে খুঁজে পেলেন তানিয়া

Update Time : ০২:৩০:২২ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১১ জানুয়ারী ২০২১
বিডি সমাচার ডেস্ক:

তানিয়ার বয়স আট বছর। বাবার সঙ্গে ঢাকা দেখতে আসে। ফুফুর বাসা থেকে একদিন বেড়িয়ে যায়। বাড়ি খুঁজে না পেয়ে ছুটে যায় ফুফাতো বোনের স্কুলে। কিন্তু স্কুলের দারোয়ান স্কুলে ঢুকতে দেয়নি। এরপর বদলে যায় তানিয়ার জীবন পথ।

একদিনের জন্য তানিয়ার ঠায় হয় এক পরিবারে। পরের দিন আরেকটি পরিবার তাকে নিয়ে যায়, মেয়ে হিসেবেই বড় করে তোলে। বিয়ে দেয়। তানিয়ার কোলজুড়ে আসে দুই সন্তান। তবে বাবা-মাকে হারানোর বেদনা এখনো তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। কথা হলেই এ নিয়ে গল্প জুড়ে দেয় স্বামীসহ অন্যদের সঙ্গে।
.
কথা প্রসঙ্গেই স্বামী আনোয়ার হোসেন ও তার এক বন্ধু তানিয়ার হারিয়ে যাওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এ চোখ, ওই চোখ হয়ে নজরে আসে শত মাইল দূরে থাকা বাবা-মায়ের। ১৭ বছর পর তানিয়ার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার তাদের। এ যেন নতুন জীবনের শুরু।
.
স্বামী-সন্তান নিয়ে তানিয়া যাচ্ছে বাবার বাড়ি। এটি সিনেমার কোনো গল্প নয়। গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া পশ্চিমপাড়ার তানিয়া আক্তারের বাস্তব জীবনের গল্প এটি। রোববার (১০ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থেকে স্বামী সন্তান নিয়ে বাবার বাড়িতে যাচ্ছেন তানিয়া।
.
তানিয়াসহ পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার একটি বাস কাউন্টারে কর্মরত মো: সুন্দর আলী ২০০৪ সালে তার সাত বছর বয়সী মেয়ে তানিয়ার আবদার মেটাতে ঢাকায় নিয়ে আসেন। ঢাকার আগারগাঁওয়ে সুন্দর আলীর বোনের বাড়িতে ছিলেন তারা। সবার অজান্তে তানিয়া একদিন বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বাসা চিনতে না পেরে সে ছুটে যায় ফুফাতো বোনের স্কুলে। সেখানকার দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেয়নি। রাস্তা ঘাট না চেনায় এক পর্যায়ে একটি বাসে করে সংসদ ভবনের কাছে আসে তানিয়া।
.
সেখানে একটি দোকানে টেলিভিশন দেখতে দেখতে রাত হয়ে যায়। তখন বাসায় যেতে তানিয়া অনেক কান্নাকাটি করে। কিন্তু ঠিকানা বলতে না পারায় এক হিন্দু লোক তাকে তার বাসায় নিয়ে যায়। পরদিন তানিয়াকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে সে অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজি করা হয়।
.
তানিয়া বলেন, ‘এক পর্যায়ে কলাবাগান এলাকায় আরজুদা খাতুন মিলন ও তার ছেলে রিপনের সাথে দেখা হলে তারা বিষয়টি জেনে আমাকে তাদের বাসায় নিয়ে আসেন। এরপর থেকে ওই বাড়িতে আমি বড় হতে থাকি। রিপনকে আমি বাবা বলে ডাকি। খুব আদর যত্ন করতেন তারা। ওই পরিবার থেকেই আমার বিয়ে হয়।
.
তানিয়া জানায়, রিপনের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কসবা উপজেলার রায়তলা গ্রাম। তানিয়ার স্বামী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া পৌর এলাকার শান্তিনগরের আনোয়ার হোসেন জানান, রিপন নামে ওই ব্যক্তি তার পূর্ব পরিচিত। সব কিছু জেনে শুনেই তিনি তানিয়াকে বিয়ে করেন। তাদের ঘরে এখন এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তানিয়া প্রায়ই বাবা-মাকে হারানোর কথা বলতো। এ অবস্থায় তিনি ও এক বন্ধু তানিয়ার ছবি দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
.
সেই সূত্র ধরেই বিষয়টি জানতে পেরে তানিয়ার বাবা-মা শনিবার রাতে আখাউড়ায় ছুটে আসেন। ১৭ বছর পর নিজেদের তানিয়ার সঙ্গে বাবা-মায়ের দেখা হলে এক আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জড়ো হন এলাকার লোকজন। আনন্দের অশ্রু তখন সবার চোখে। দিনভর অতীত স্মৃতি নিয়ে কথা বলেন পরিবারের লোকজন।
.
তানিয়ার ছোট বোন সোনিয়া খানম বলেন, ‘বোনের ছোট বেলার অনেক স্মৃতি মনে আছে। বোনকে হারানোর পর সব সময় মন খারাপ থাকতো। ভাবতাম বোনকে বুঝি কখনও পাব না। তবে আম্মা প্রায়ই বলতো এই দেশটা ছোট। একদিন না একদিন আমি আমার মেয়েকে ঠিকই ফিরে পাবো। বোনকে পেয়ে আমরা খুশি।

তানিয়ার বাবা সুন্দর আলী রোববার সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে বলেন, ‘প্রতিবেশী রুমা নামে একজন ফেসবুকে তানিয়ার বিষয় নিয়ে লেখালেখির কথা আমাদেরকে জানায়। এরই সূত্র ধরে ঠিকানা বের করে মেয়ের বাড়িতে আসি। এখন মেয়ে ও তার স্বামী সন্তান নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি। এভাবে মেয়েকে খুঁজে পাবো কখনো ভাবিনি।