নতুন বিশ্বব্যবস্থায় সংকট ও কোভিডের আন্তর্জাতিকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৫:৪৮:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ জুলাই ২০২০
  • / ৩২৭ Time View
প্রফেসর অসিত বরণ দাশ:

পঁচাত্তর বছর আগে যুদ্ধের মধ্যেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘ নামে বিশ্ব শান্তির রূপরেখা তৈরি করেছিল। জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পরে উইনস্টন চার্চিল যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সাথে যৌথ আলোচনায় বিশ্ব নিরাপত্তায় নতুন সংস্থা গঠনের বিষয়টি প্রথম উঠে আসে। পরে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টায় চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিনের তৈরি রূপরেখার ভিত্তিতে ২৬ জুন, ১৯৪৫ তারিখে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তির মর্যাদা দেয়া হয়েছিল।

বর্তমান বিশ্ব নেতৃবৃন্দেরও একই ধরণের একটি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ‘দ্য ইকনমিস্ট’-এর এক্সিকউটিভ এডিটর ডানিয়েল ফ্রাঙ্কলিন [The Economist, Special report, Jun 18th 2020 edition]। ২৬ মে, ২০২০ তারিখ প্রকাশিত ‘দ্য ইকনমিস্ট’ এর ‘world after covid-19, how economies can rebound’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় এবং ইস্টার ডুফ্লো (নোবেল বিজয়ী ) দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি ‘কোভিড-১৯ মার্শাল পরিকল্পনা’র কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। কোভিড-এর মতো একটি মহামারি যুদ্ধের মতোই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সঠিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বিস্ময়করভাবে তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারলেও দ্ররিদ্রতম দেশগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হবে। তবে ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, যদি কোভিডের ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় তাহলে কৌশলি অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্য নীতিমালা কার্যকর থাকলে বিশ্ব তার পূর্বাবস্থানে ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন অর্থায়নে মার্শাল প্লানের অধীনে জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স কর্তৃক তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতিই হলো বাজার অর্থনীতিগুলোর পূর্ববর্তী দক্ষতায় ফিরে আসার বড় প্রমাণ। আর যদি না হয় তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সত্যিকার অর্থে, কোভিডের মতো একটি যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অভিন্ন বৈশি্বক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এটি একপ্রকার অসম্ভব, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক বিশৃঙ্খল পরিবেশে রূপ নিয়েছে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থা ও কোভিডের আন্তর্জাতিকতা :

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের ইতিহাসকে তিন পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রথমটি ছিল ‘দ্বিমেরু কেন্দ্রিক’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠা-া লড়াই। নিরাপত্তা পরিষদের শীতল ভূমিকা সত্ত্বেও জাতিসংঘ এ সময় বিশেষত শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রগুলো বিস্তারে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল, যা তার সনদেও উল্লেখ নেই।

দ্বিতীয় পর্বে, ১৯৯০ তে কমিউনিজমের পতনের পর সবেমাত্র ঠা-া লড়াই থেকে উঠে আসা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে একটি সংক্ষিপ্ত একমেরু ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছিলা। জাতিসংঘ ১৯৯১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কুয়েতের মুক্তিকে অনুমোদন দেয়। গণ-নৃশংসতার বিপরীতে জনগণকে ‘রক্ষা করার দায়িত্ব’ এই নীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তান সংশ্লিষ্টতায় যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা ক্লান্ত। প্রতিশোধপরায়ণ রাশিয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা চীন ক্রমাগতভাবে মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের প্রতিফলনস্বরূপ নিরাপত্তা পরিষদ অনেকটাই স্থবির। তৃতীয় পর্যায় হলো অস্থিরতা। মি. গুতেরেস-এর মতে, ‘পৃথিবী এখনো বহুমুখি নয়, এটি মূলত বিশৃঙ্খল’।

একুশ শতকের শুরুতে বিশ্বায়নের বর্তমান মডেলটি রূপ নিয়েছিল। এই মডেলটি এমন এক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, পুরানো বাজার অর্থনীতির দেশগুলো তাদের নিজস্ব উৎপাদন চীনে স্থানান্তর ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। ফলে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদারীকরণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ ও চীন নিজেদের অবস্থানকে এতটাই শক্তিশালী করেছিল যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি অর্থনীতির দেশগুলো তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় যাবার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিল। প্রসঙ্গত, সোভিয়েত পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংগঠনের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে আসছে।

কোভিড মহামারি এমন এক সময় হানা দেয় যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ও উদীয়মান পরাশক্তিগুলো বাণিজ্য ও প্রযুক্তি থেকে শুরু করে এশিয়ায় অর্থায়ন এবং এশিয়ায় আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার পর্যন্ত তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিশ্বব্যবস্থা অনেকটাই ঘোলাটে। জাতিসংঘ সনদে সমস্ত সদস্যের সার্বভৌম সাম্যের নীতি স্বীকৃত হলেও বৃহৎ শক্তিগুলো কর্তৃক নীতিসমূহ উপেক্ষিত হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতি পি-৫ (নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রসমূহ)-এর সম্মানবোধ দিন দিন কমছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি ছাড়াই ইরাক আক্রমণ করে। রাশিয়া ইউক্রেনের একটি অংশ দখলে নিয়েছে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত অঞ্চল দখল করেছে। লিবিয়ার উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত। রাশিয়ার আচরণ উদ্বেগজনক। সাধারণভাবে পি-৫ জাতিসংঘের নীতিসমূহ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও সিরিয়ার পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারকে সঠিক মনে করা পি-৫-এর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

অতীতে বিশ্বব্যাপী যে কোনো আর্থিক সংকট মোকাবেলায় বিশ্ব নেতৃত্ব যে ভূমিকা রেখেছিল, কোভিড সংকটে তা কার্যত অনুপস্থিত। ২০০৮ সালে আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় যুক্তরাষ্ট্র জি-২০-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবস্থাগ্রহণের পদক্ষেপ নিয়েছিল। ২০১৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স থেকে চীন ও কিউবা পর্যন্ত দেশগুলো পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা সংকট মোকাবেলায় একটি বিচ্ছিন্ন বহুপক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু কোভিড-১৯ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দেশগুলোকে একত্র করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদও কোভিড-১৯ নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যদিও মার্চের শেষে প্রথম ভার্চুয়াল জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশের নেতৃবৃন্দ কোভিড-১৯-এর বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দেন। আরও সংকটের বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার হুমকি। এতে বিশ্ব সংস্থাসমূহের অস্তিত্ব সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে এবং কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে।

কোভিড-১৯ চীনে স্বল্প প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনীতিতে যে সামান্য প্রভাব ফেলেছিল, পশ্চিমা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে চীন তা দ্রুত কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিতে নতুন করে গতি সঞ্চার করেছে। কোভিডের সম্ভাব্য ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের প্রভাব মোকাবেলায় চীন তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বলয় তৈরির লক্ষ্যে সে তার মিত্র ও আধা মিত্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। চীনা বিলিয়নার জ্যাক মা ও তার ফাউ-েশন আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশকে ২০,০০০ টেস্টিং কিট, ১,০০,০০০ মাস্ক এবং ১,০০০ ইউনিট প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম দেয়ার ঘোষণা দেয়। সামগ্রিকভাবে ঐক্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আবেদন সত্ত্বেও কোভিড মহামারি নিয়ে একটি বিভাজিত ভূরাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ তুলে নিতে মার্কিন অস্বীকৃতি এ বিভাজনকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্বরাজনীতির এই বিশৃঙ্খলা বিস্ময়কর কিছু নয়, যা নাটকীয়ভাবে বিশ্বকে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে নিয়ে গেছে। অর্থনীতির কথাই ধরা যাক। ২০০০ সাল থেকে বৈশি্বক জিডিপিতে চায়নার অংশীদারিত্ব ৪% থেকে ১৬%-এ উন্নীত হয়েছে। এর প্রযুক্তি জায়েন্ট যেমন : আলিবাবা, টেনসেন্ট এবং হাওয়াই চায়নার ডিজিটাল অবকাঠামোকে বিশেষত বহির্বিশ্বে উদীয়মান বাজারগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানীকারক দেশ। ২০০০ সাল থেকে চীন আফ্রিকার সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সমূহে ১৪০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ প্রদান করেছে। তাই সে নিজেকে মার্কিন কর্তৃত্ব থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে রক্ষাকারী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে।

কোভিড সংকটে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মহামারির কারণ হিসেবে দায়ী করছে এবং অন্যদিকে কোভিডকে দক্ষভাবে মোকাবেলায় সক্ষম একটি দেশের স্বীকৃতি চীন আদায় করে নিতে পেরেছে। বর্তমানে বৈশি্বক নেতৃত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার অর্থই হবে চীনের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়া। যেমন : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ প্রদান স্থগিতকরণ ও সরে আসার হুমকির বিপরীতে চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বাড়তি ৩ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা দেয়। এ ধরণের ঘটনা স্পষ্টতই বিশ্ব সংস্থাগুলোর অস্তিত্বে হুমকি তৈরি করবে।

তবে এটি অস্বীকার উপায় নেই যে, ২০০৮-০৯ সংকটের দশ বছর পর কোভিড-১৯ মহামারিটি বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মডেলের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করছে। ফলে অনেক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মূলত উৎপাদন ও সরবরাহের লাইন পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে। বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন শিল্প শেষ পর্যন্ত হতে পারে এক অনলাইন বাহন। অনেক দেশ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে স্থানীয় উৎপাদন পুনরুদ্ধার বা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করতে পারার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে দেশীয় উৎপাদকদের রাষ্ট্রীয় সহায়তার নীতি আবার জনপ্রিয়তা পাবে, একটি নির্ভরযোগ্য দেশীয় বাজার তৈরি হবে, যা সংঘাত আর বিশ্ববাণিজ্য থেকে আসা চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর কম নির্ভরশীল হবে।

সর্বোপরি কোভিডের আন্তর্জাতিকতা যে প্রশ্নটি বিশ্বের সামনে এনে দিয়েছে, তা হলো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের লাগাম কার হাতে, যুক্তরাষ্ট্র না চীনের হাতে থাকবে। বিশ্ব বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় ইতোমধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী তৈরি পণ্য এবং শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সরবরাহ চেইনের প্রায় ৭০% ইতোমধ্যে চীনের দখলে। কোভিডের আন্তর্জাতিকতার আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, বাণিজ্য চুক্তি এবং জলবায়ু উন্নয়ন ও কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের মতো বৈশি্বক উদ্যোগগুলোর উপর অর্থ সংকটের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে। ফলে চীনের সামনে অবারিত হবে নিজের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করার।

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্রকল্প সাহায্য, কারিগরি সাহায্য, বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চীন ইতোমধ্যে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ২০১৫ সালে চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস-এর সদস্য রাষ্ট্র চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও সাউথ আফ্রিকা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে তা শক্তিশালী হলে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ দুর্বল হয়ে পড়বে, যা প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কমাবে। বিশ্বের অনেক দেশই নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি চীনমুখী করে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হবে। কোভিড পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কূটনীতিতেও পরিবর্তন আসবে, এরকমটাই মনে করা হয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিডের প্রভাব :

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্বের প্রায় সব প্রধান অর্থনীতিতে বিরাট ধস নেমেছে, যেটাকে বলা হচ্ছে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চাইতেও ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিয়া জর্জিয়েভা এক সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত করেই বলেছেন, অর্থনৈতিক মন্দায় প্রবেশ করেছি আমরা। ১৯৩০-এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্ব অর্থনীতি পড়েনি। এটি ২০০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও কঠিন হবে। আইএমএফ-এর মতে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হবে ৩%। আর যদি মহামারি দীর্ঘায়িত হয়, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগি্নপরীক্ষার সম্মুখীন হবে এবং ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।

আগের অর্থনেতিক সংকটগুলোর সাথে কোভিড সংকটের পার্থক্য রয়েছে। অতীতের অনেক সংকটে জন মেনার্ড কীনসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করা হয়েছিল, যে তত্ত্বের মূল কথা হলো মন্দা কাটাতে সরকারকেই বেশি করে অর্থ খরচ করতে হবে, যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে এবং ব্যবসা বাণিজ্য চাঙ্গা হয়। কিন্তু কোভিড সংকটে সরকার নিজেই সব অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ করে দিয়েছে, অর্থাৎ সরকারের নীতির লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনীতিকে আপাতত নির্জীব রাখা। লকডাউন উঠে গিয়ে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু হলেও সরকারি ব্যয়ের এই কার্যক্রম অনেকদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে। এই অর্থনৈতিক নীতিই হলো ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, অর্থাৎ অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ আগামী বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে যে অর্থনৈতিক রূপান্তর হয়েছিল সেটাও সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া হয়নি। ইউরোপে মার্শাল প্লান বাস্তবায়নে মার্কিন অর্থায়ন এবং যুদ্ধ পরবর্তী ভিয়েতনামের উচ্চ কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির সফলতা এর বড় প্রমাণ।

উপসংহার :

বর্তমান কোভিড সংকটের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ, বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকার কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তৃতীয় একটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে বিশ্বকে নিরাপদ রাখা। এর দ্বিতীয় মহাসচিব দ্যাগ হামারস্কোল্ড বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ তৈরি করা হয়েছিলো মানবজাতিকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, মানবতাকে নরক থেকে বাঁচানোর জন্য।’ কিন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি ভারসাম্যমূলক বিশ্ব ব্যবস্থায় ফিরে আনাই হচ্ছে জাতিসংঘের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য পরাশক্তি ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রয়োজন হলেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ থেকে এ ধরণের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ ভ্যাকসিন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং সর্বাধিক দুর্বল দেশগুলোকে সমর্থন দিতে বিশ্বের একসাথে কাজ করা দরকার। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলে বলেছেন, বাইবেলে বর্ণিত আসন্ন দুর্ভিক্ষ এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার, কারণ একটি চ্যালেঞ্জ কোনও দেশই নিজের দ্বারা মোকাবেলা করতে পারে না। পারমাণবিক বিস্তারের ঝুঁকি বাড়ছে। তার মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই মানব সভ্যতা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।

কোভিড-১৯ একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। কোভিড সংকটে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা দেশগুলোকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলবে, ফলে বৈশি্বক নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হবে বলে ধারণা করা হয়। এ ধরণের শূন্যতার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বিশ্ব সাধারণত মার্কিন নেতৃত্বের সন্ধান করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান যুদ্ধে ক্লান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং ‘একলা চলো’ নীতি বর্তমানে এই শূন্যতা পূরণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের আধিপত্য নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, কিন্তু কেবল চীনের একক আধিপত্যে বৈশি্বক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি ও বজায় রাখা সত্যিকার অর্থে কঠিন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের ভেতর সব কিছুতে দ্রুত চীনের উপর নির্ভরতা হ্রাসের প্রচেষ্টা দেখা যেতে পারে। বিদ্যমান ভারসাম্যহীন বাজার ব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হতে পারে। তবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে জাতীয় ও বৈশি্বক উন্নয়নের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি নতুন ভারসাম্য খুঁজে পেতেই হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উচিত হবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যতদিন না একটি নতুন ভারসাম্য পয়েন্ট খুঁজে পাওয়া যায়।

লেখক : অধ্যক্ষ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

নতুন বিশ্বব্যবস্থায় সংকট ও কোভিডের আন্তর্জাতিকতা

Update Time : ০৫:৪৮:২০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৫ জুলাই ২০২০
প্রফেসর অসিত বরণ দাশ:

পঁচাত্তর বছর আগে যুদ্ধের মধ্যেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ জাতিসংঘ নামে বিশ্ব শান্তির রূপরেখা তৈরি করেছিল। জাপান কর্তৃক পার্ল হারবার আক্রমণের কয়েক সপ্তাহ পরে উইনস্টন চার্চিল যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলে হোয়াইট হাউজে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের সাথে যৌথ আলোচনায় বিশ্ব নিরাপত্তায় নতুন সংস্থা গঠনের বিষয়টি প্রথম উঠে আসে। পরে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টায় চার্চিল, রুজভেল্ট এবং স্ট্যালিনের তৈরি রূপরেখার ভিত্তিতে ২৬ জুন, ১৯৪৫ তারিখে জাতিসংঘ সনদ স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই জাতিসংঘের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিজয়ী শক্তির মর্যাদা দেয়া হয়েছিল।

বর্তমান বিশ্ব নেতৃবৃন্দেরও একই ধরণের একটি উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন ‘দ্য ইকনমিস্ট’-এর এক্সিকউটিভ এডিটর ডানিয়েল ফ্রাঙ্কলিন [The Economist, Special report, Jun 18th 2020 edition]। ২৬ মে, ২০২০ তারিখ প্রকাশিত ‘দ্য ইকনমিস্ট’ এর ‘world after covid-19, how economies can rebound’ শিরোনামে একটি নিবন্ধে অভিজিৎ বন্দোপাধ্যায় এবং ইস্টার ডুফ্লো (নোবেল বিজয়ী ) দরিদ্র দেশগুলোর জন্য একটি ‘কোভিড-১৯ মার্শাল পরিকল্পনা’র কথা বলেছেন। তাঁরা মনে করেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে যাচ্ছে। কোভিড-এর মতো একটি মহামারি যুদ্ধের মতোই, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সঠিক নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে বিস্ময়করভাবে তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে পারলেও দ্ররিদ্রতম দেশগুলোর সাহায্যের প্রয়োজন হবে। তবে ইতিহাসের আলোকে বলা যায়, যদি কোভিডের ভ্যাকসিন বা চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয় তাহলে কৌশলি অর্থনৈতিক ও জনস্বাস্থ্য নীতিমালা কার্যকর থাকলে বিশ্ব তার পূর্বাবস্থানে ফিরে আসার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন অর্থায়নে মার্শাল প্লানের অধীনে জার্মানি, জাপান, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স কর্তৃক তাদের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতিই হলো বাজার অর্থনীতিগুলোর পূর্ববর্তী দক্ষতায় ফিরে আসার বড় প্রমাণ। আর যদি না হয় তাহলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সত্যিকার অর্থে, কোভিডের মতো একটি যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের জন্য বিশ্ব নেতৃবৃন্দের অভিন্ন বৈশি্বক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় এটি একপ্রকার অসম্ভব, যেখানে আন্তর্জাতিক রাজনীতি এক বিশৃঙ্খল পরিবেশে রূপ নিয়েছে।

নতুন বিশ্বব্যবস্থা ও কোভিডের আন্তর্জাতিকতা :

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস জাতিসংঘের ইতিহাসকে তিন পর্বে বিভক্ত করেছেন। প্রথমটি ছিল ‘দ্বিমেরু কেন্দ্রিক’ অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠা-া লড়াই। নিরাপত্তা পরিষদের শীতল ভূমিকা সত্ত্বেও জাতিসংঘ এ সময় বিশেষত শান্তিরক্ষার ক্ষেত্রগুলো বিস্তারে যথেষ্ট সক্রিয় ছিল, যা তার সনদেও উল্লেখ নেই।

দ্বিতীয় পর্বে, ১৯৯০ তে কমিউনিজমের পতনের পর সবেমাত্র ঠা-া লড়াই থেকে উঠে আসা যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যে একটি সংক্ষিপ্ত একমেরু ব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছিলা। জাতিসংঘ ১৯৯১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন কুয়েতের মুক্তিকে অনুমোদন দেয়। গণ-নৃশংসতার বিপরীতে জনগণকে ‘রক্ষা করার দায়িত্ব’ এই নীতি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য এবং আফগানিস্তান সংশ্লিষ্টতায় যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা ক্লান্ত। প্রতিশোধপরায়ণ রাশিয়া এবং অর্থনৈতিকভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা চীন ক্রমাগতভাবে মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। বৃহৎ শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বের প্রতিফলনস্বরূপ নিরাপত্তা পরিষদ অনেকটাই স্থবির। তৃতীয় পর্যায় হলো অস্থিরতা। মি. গুতেরেস-এর মতে, ‘পৃথিবী এখনো বহুমুখি নয়, এটি মূলত বিশৃঙ্খল’।

একুশ শতকের শুরুতে বিশ্বায়নের বর্তমান মডেলটি রূপ নিয়েছিল। এই মডেলটি এমন এক ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল যে, পুরানো বাজার অর্থনীতির দেশগুলো তাদের নিজস্ব উৎপাদন চীনে স্থানান্তর ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হবে। ফলে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদারীকরণের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, পশ্চিম ইউরোপ ও চীন নিজেদের অবস্থানকে এতটাই শক্তিশালী করেছিল যে, ক্ষুদ্র ও মাঝারি অর্থনীতির দেশগুলো তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় যাবার সক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছিল। প্রসঙ্গত, সোভিয়েত পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনীতির একক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ ও এর অঙ্গ সংগঠন, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা সহ বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সংগঠনের উপর কর্তৃত্ব বজায় রেখে আসছে।

কোভিড মহামারি এমন এক সময় হানা দেয় যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং বিশ্বের প্রভাবশালী ও উদীয়মান পরাশক্তিগুলো বাণিজ্য ও প্রযুক্তি থেকে শুরু করে এশিয়ায় অর্থায়ন এবং এশিয়ায় আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার পর্যন্ত তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। বিশ্বব্যবস্থা অনেকটাই ঘোলাটে। জাতিসংঘ সনদে সমস্ত সদস্যের সার্বভৌম সাম্যের নীতি স্বীকৃত হলেও বৃহৎ শক্তিগুলো কর্তৃক নীতিসমূহ উপেক্ষিত হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। নিরাপত্তা পরিষদের সিদ্ধান্তের প্রতি পি-৫ (নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রসমূহ)-এর সম্মানবোধ দিন দিন কমছে। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের অনুমতি ছাড়াই ইরাক আক্রমণ করে। রাশিয়া ইউক্রেনের একটি অংশ দখলে নিয়েছে। চীন দক্ষিণ চীন সাগরে বিতর্কিত অঞ্চল দখল করেছে। লিবিয়ার উপর অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষিত। রাশিয়ার আচরণ উদ্বেগজনক। সাধারণভাবে পি-৫ জাতিসংঘের নীতিসমূহ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কথা থাকলেও সিরিয়ার পক্ষে রাশিয়ার সমর্থন এবং রাসায়নিক অস্ত্রের ব্যবহারকে সঠিক মনে করা পি-৫-এর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

অতীতে বিশ্বব্যাপী যে কোনো আর্থিক সংকট মোকাবেলায় বিশ্ব নেতৃত্ব যে ভূমিকা রেখেছিল, কোভিড সংকটে তা কার্যত অনুপস্থিত। ২০০৮ সালে আর্থিক বিপর্যয়ের কারণে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দায় যুক্তরাষ্ট্র জি-২০-এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবস্থাগ্রহণের পদক্ষেপ নিয়েছিল। ২০১৪ সালে, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স থেকে চীন ও কিউবা পর্যন্ত দেশগুলো পশ্চিম আফ্রিকার ইবোলা সংকট মোকাবেলায় একটি বিচ্ছিন্ন বহুপক্ষীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু কোভিড-১৯ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের দেশগুলোকে একত্র করতে ব্যর্থ হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদও কোভিড-১৯ নিয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। যদিও মার্চের শেষে প্রথম ভার্চুয়াল জি-২০ সম্মেলনে বিশ্বের শীর্ষ ২০ অর্থনীতির দেশের নেতৃবৃন্দ কোভিড-১৯-এর বিপর্যয় থেকে ঘুরে দাঁড়াতে ৫ ট্রিলিয়ন ডলার দেয়ার ঘোষণা দেন। আরও সংকটের বিষয় হলো, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার হুমকি। এতে বিশ্ব সংস্থাসমূহের অস্তিত্ব সংকটে পড়ার শঙ্কা রয়েছে এবং কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে।

কোভিড-১৯ চীনে স্বল্প প্রাণহানির পাশাপাশি অর্থনীতিতে যে সামান্য প্রভাব ফেলেছিল, পশ্চিমা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে চীন তা দ্রুত কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিতে নতুন করে গতি সঞ্চার করেছে। কোভিডের সম্ভাব্য ব্যাপক প্রাদুর্ভাবের প্রভাব মোকাবেলায় চীন তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক পরিম-লে বলয় তৈরির লক্ষ্যে সে তার মিত্র ও আধা মিত্র দেশগুলোর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। চীনা বিলিয়নার জ্যাক মা ও তার ফাউ-েশন আফ্রিকা মহাদেশের ৫৪টি দেশকে ২০,০০০ টেস্টিং কিট, ১,০০,০০০ মাস্ক এবং ১,০০০ ইউনিট প্রতিরক্ষামূলক সরঞ্জাম দেয়ার ঘোষণা দেয়। সামগ্রিকভাবে ঐক্যের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আবেদন সত্ত্বেও কোভিড মহামারি নিয়ে একটি বিভাজিত ভূরাজনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ইরানের বিরুদ্ধে আরোপিত অবরোধ তুলে নিতে মার্কিন অস্বীকৃতি এ বিভাজনকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্বরাজনীতির এই বিশৃঙ্খলা বিস্ময়কর কিছু নয়, যা নাটকীয়ভাবে বিশ্বকে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে নিয়ে গেছে। অর্থনীতির কথাই ধরা যাক। ২০০০ সাল থেকে বৈশি্বক জিডিপিতে চায়নার অংশীদারিত্ব ৪% থেকে ১৬%-এ উন্নীত হয়েছে। এর প্রযুক্তি জায়েন্ট যেমন : আলিবাবা, টেনসেন্ট এবং হাওয়াই চায়নার ডিজিটাল অবকাঠামোকে বিশেষত বহির্বিশ্বে উদীয়মান বাজারগুলোতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। চীন বিশ্বের বৃহত্তম রপ্তানীকারক দেশ। ২০০০ সাল থেকে চীন আফ্রিকার সরকার ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সমূহে ১৪০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ প্রদান করেছে। তাই সে নিজেকে মার্কিন কর্তৃত্ব থেকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে রক্ষাকারী হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে চাইছে।

কোভিড সংকটে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মহামারির কারণ হিসেবে দায়ী করছে এবং অন্যদিকে কোভিডকে দক্ষভাবে মোকাবেলায় সক্ষম একটি দেশের স্বীকৃতি চীন আদায় করে নিতে পেরেছে। বর্তমানে বৈশি্বক নেতৃত্ব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসার অর্থই হবে চীনের জন্য একটি বড় সুযোগ তৈরি করে দেয়া। যেমন : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ প্রদান স্থগিতকরণ ও সরে আসার হুমকির বিপরীতে চীন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বাড়তি ৩ কোটি ডলার দেয়ার ঘোষণা দেয়। এ ধরণের ঘটনা স্পষ্টতই বিশ্ব সংস্থাগুলোর অস্তিত্বে হুমকি তৈরি করবে।

তবে এটি অস্বীকার উপায় নেই যে, ২০০৮-০৯ সংকটের দশ বছর পর কোভিড-১৯ মহামারিটি বর্তমান আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক মডেলের দুর্বলতাগুলো প্রকাশ করছে। ফলে অনেক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান মূলত উৎপাদন ও সরবরাহের লাইন পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে। বাণিজ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং বিনোদন শিল্প শেষ পর্যন্ত হতে পারে এক অনলাইন বাহন। অনেক দেশ গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে স্থানীয় উৎপাদন পুনরুদ্ধার বা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে কাজ করতে পারার সম্ভাবনা রয়েছে। এতে দেশীয় উৎপাদকদের রাষ্ট্রীয় সহায়তার নীতি আবার জনপ্রিয়তা পাবে, একটি নির্ভরযোগ্য দেশীয় বাজার তৈরি হবে, যা সংঘাত আর বিশ্ববাণিজ্য থেকে আসা চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর কম নির্ভরশীল হবে।

সর্বোপরি কোভিডের আন্তর্জাতিকতা যে প্রশ্নটি বিশ্বের সামনে এনে দিয়েছে, তা হলো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি ও রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের লাগাম কার হাতে, যুক্তরাষ্ট্র না চীনের হাতে থাকবে। বিশ্ব বাজার দখলের প্রতিযোগিতায় ইতোমধ্যে চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে অনেকটাই এগিয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী তৈরি পণ্য এবং শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল সরবরাহ চেইনের প্রায় ৭০% ইতোমধ্যে চীনের দখলে। কোভিডের আন্তর্জাতিকতার আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, বাণিজ্য চুক্তি এবং জলবায়ু উন্নয়ন ও কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের মতো বৈশি্বক উদ্যোগগুলোর উপর অর্থ সংকটের কারণে পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে ব্যর্থ হবে। ফলে চীনের সামনে অবারিত হবে নিজের ক্ষমতাকে আরো শক্তিশালী করার।

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্রকল্প সাহায্য, কারিগরি সাহায্য, বিনিয়োগসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চীন ইতোমধ্যে নিজেদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। ২০১৫ সালে চীনের নেতৃত্বে ব্রিকস-এর সদস্য রাষ্ট্র চীন, রাশিয়া, ভারত, ব্রাজিল ও সাউথ আফ্রিকা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক নামে যে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে তা শক্তিশালী হলে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ দুর্বল হয়ে পড়বে, যা প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাকে কমাবে। বিশ্বের অনেক দেশই নিজেদের পররাষ্ট্রনীতি চীনমুখী করে ঢেলে সাজাতে বাধ্য হবে। কোভিড পরবর্তী দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কূটনীতিতেও পরিবর্তন আসবে, এরকমটাই মনে করা হয়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে কোভিডের প্রভাব :

মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে বিশ্বের প্রায় সব প্রধান অর্থনীতিতে বিরাট ধস নেমেছে, যেটাকে বলা হচ্ছে ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের চাইতেও ভয়াবহ। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ) প্রধান ক্রিস্টালিয়া জর্জিয়েভা এক সংবাদ সম্মেলনে নিশ্চিত করেই বলেছেন, অর্থনৈতিক মন্দায় প্রবেশ করেছি আমরা। ১৯৩০-এর দশকের বিশ্বমন্দার পর এরকম খারাপ অবস্থায় আর বিশ্ব অর্থনীতি পড়েনি। এটি ২০০৯ সালের বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার চেয়েও কঠিন হবে। আইএমএফ-এর মতে, এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি সংকুচিত হবে ৩%। আর যদি মহামারি দীর্ঘায়িত হয়, বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন দেশের সরকার আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অগি্নপরীক্ষার সম্মুখীন হবে এবং ধনী দেশগুলোর অর্থনীতি ২০২২ সালের আগে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা যাবে না।

আগের অর্থনেতিক সংকটগুলোর সাথে কোভিড সংকটের পার্থক্য রয়েছে। অতীতের অনেক সংকটে জন মেনার্ড কীনসের অর্থনৈতিক তত্ত্বের সফল প্রয়োগ করা হয়েছিল, যে তত্ত্বের মূল কথা হলো মন্দা কাটাতে সরকারকেই বেশি করে অর্থ খরচ করতে হবে, যাতে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ে এবং ব্যবসা বাণিজ্য চাঙ্গা হয়। কিন্তু কোভিড সংকটে সরকার নিজেই সব অর্থনৈতিক কর্মকা- বন্ধ করে দিয়েছে, অর্থাৎ সরকারের নীতির লক্ষ্যই হচ্ছে অর্থনীতিকে আপাতত নির্জীব রাখা। লকডাউন উঠে গিয়ে পুরোদমে অর্থনৈতিক কর্মকা- শুরু হলেও সরকারি ব্যয়ের এই কার্যক্রম অনেকদিন পর্যন্ত বজায় থাকবে। এই অর্থনৈতিক নীতিই হলো ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের মতে, বাজার অর্থনীতির যে রমরমা অবস্থা বহু দশক ধরে দেখা গেছে, তার জায়গায় এক ধরণের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা, অর্থাৎ অর্থনীতিতে সরকারি খাতের ব্যাপকতর অংশগ্রহণ আগামী বছরগুলোতে দেখা যেতে পারে। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে যে অর্থনৈতিক রূপান্তর হয়েছিল সেটাও সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া হয়নি। ইউরোপে মার্শাল প্লান বাস্তবায়নে মার্কিন অর্থায়ন এবং যুদ্ধ পরবর্তী ভিয়েতনামের উচ্চ কেন্দ্রীভূত অর্থনীতির সফলতা এর বড় প্রমাণ।

উপসংহার :

বর্তমান কোভিড সংকটের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ, বিশেষত নিরাপত্তা পরিষদের ভূমিকার কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করলেও জাতিসংঘের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো তৃতীয় একটি বিশ্বযুদ্ধ থেকে বিশ্বকে নিরাপদ রাখা। এর দ্বিতীয় মহাসচিব দ্যাগ হামারস্কোল্ড বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ তৈরি করা হয়েছিলো মানবজাতিকে স্বর্গে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, মানবতাকে নরক থেকে বাঁচানোর জন্য।’ কিন্ত বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি ভারসাম্যমূলক বিশ্ব ব্যবস্থায় ফিরে আনাই হচ্ছে জাতিসংঘের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য পরাশক্তি ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রসমূহের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের প্রয়োজন হলেও বিশ্ব নেতৃবৃন্দ থেকে এ ধরণের কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ ভ্যাকসিন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং সর্বাধিক দুর্বল দেশগুলোকে সমর্থন দিতে বিশ্বের একসাথে কাজ করা দরকার। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রধান ডেভিড বিসলে বলেছেন, বাইবেলে বর্ণিত আসন্ন দুর্ভিক্ষ এড়াতে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়েও সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার, কারণ একটি চ্যালেঞ্জ কোনও দেশই নিজের দ্বারা মোকাবেলা করতে পারে না। পারমাণবিক বিস্তারের ঝুঁকি বাড়ছে। তার মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এবারই মানব সভ্যতা সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে।

কোভিড-১৯ একটি নতুন চ্যালেঞ্জ। কোভিড সংকটে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টা দেশগুলোকে আত্মকেন্দ্রিক করে তুলবে, ফলে বৈশি্বক নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হবে বলে ধারণা করা হয়। এ ধরণের শূন্যতার অভিজ্ঞতা বিবেচনায় বিশ্ব সাধারণত মার্কিন নেতৃত্বের সন্ধান করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্য ও আফগানিস্তান যুদ্ধে ক্লান্ত যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এবং ‘একলা চলো’ নীতি বর্তমানে এই শূন্যতা পূরণে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও বিশ্ব অর্থনীতিতে চীনের আধিপত্য নতুন মেরুকরণের সম্ভাবনা তৈরি করেছে, কিন্তু কেবল চীনের একক আধিপত্যে বৈশি্বক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য তৈরি ও বজায় রাখা সত্যিকার অর্থে কঠিন। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্বের ভেতর সব কিছুতে দ্রুত চীনের উপর নির্ভরতা হ্রাসের প্রচেষ্টা দেখা যেতে পারে। বিদ্যমান ভারসাম্যহীন বাজার ব্যবস্থাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হতে পারে। তবে বিশ্ব সম্প্রদায়কে জাতীয় ও বৈশি্বক উন্নয়নের অগ্রাধিকারগুলোর মধ্যে একটি নতুন ভারসাম্য খুঁজে পেতেই হবে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশগুলোর উচিত হবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, যতদিন না একটি নতুন ভারসাম্য পয়েন্ট খুঁজে পাওয়া যায়।

লেখক : অধ্যক্ষ, চাঁদপুর সরকারি কলেজ।