চীনে আইনের শাসন বনাম অপরাধ

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৫:১৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ নভেম্বর ২০২০
  • / ১৬৫ Time View

আটাশ বছর আগে, ১৯৯২ সালের ২০ মার্চ, চীনের নানচিং চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন নানচিং চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়) ছাত্রী লিন-কে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিল মা চিয়াং। চতুর মা চিয়াং ঘটনার পর পরই আত্মগোপন করে। পুলিশ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে ১৫ শতাধিক মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে তখন অপরাধীকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়।

২৮ বছর পর, গত ফেব্রুয়ারিতে, নানচিং পুলিশ একটি ক্লু পায়। ফেইসিয়ান কাউন্টির পুলিশ জানায়, তারা এমন একজন অপরাধীর খোঁজ পেয়েছেন, যে লিনের হত্যাকারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হতে পারে। নানচিং পুলিশ উক্ত অপরাধীর আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে সকল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। এই প্রক্রিয়ায় মা চিয়াংকে চিহ্নিত করা হয় ওই অপরাধীর কাজিন হিসেবে; মা চিয়াংয়ের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পুলিশের কাছে লিনের খুনীর ডিএনএ নমুনা আগে থেকেই ছিল। খুনীর ডিএনএ-র সঙ্গে মিলে যায় মা চিয়াংয়ের ডিএনএ। ধরা পরে মা চিয়াং। সম্প্রতি (গত মাস তথা অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে) আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

মা চিয়াংয়ের বয়স এখন ৫৪ বছর। পুলিশ যখন তার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে, তখনই সে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দেয়। কারণ, এখন আর নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে। সে জানে যে, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপন করে থাকা এখন আর সম্ভব নয়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, ২৮ বছর আগেও মোটামুটি একই ভাবনা তার মনে খেলেছিল। চীনের পুলিশ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল স্পষ্ট। সে জানতো যে, পুলিশ লিনের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা কখনও পরিত্যাগ করবে না। এর মানে যে-কোনো দিন সে ধরা পড়তে পারে। আর ধরা পড়া মানেই মৃত্যুদণ্ড! বলতে গেলে, মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়েই সে চলাফেরা করতো। একসময় বিয়ে করে মা চিয়াং; একটা বড় কোম্পানিতে গাড়িচালক হিসেবে দীর্ঘকাল কাজও করে। কিন্তু একদিন ধরা পড়তে হতে পারে, মেনে নিতে হতে পারে মৃত্যুদণ্ডকে- এই চিন্তা তাকে বিরত রাখে সন্তান নেওয়া থেকে।

‘অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে’- এই বিশ্বাস কি চীনাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমিয়েছে? আমার তাই ধারণা। নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের শান্তি-সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। চীনভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা সর্ম্পকে জেনেছি তার লেখা বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়ে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নয়াচীন প্রতিষ্ঠার খুব অল্প সময়ের মধ্যে চীনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতির কথা তিনি লিখে গেছেন। বস্তুত, সেই উন্নতি ঘটেছিল দেশকে নিরাপদ করার, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ বাড়ানোর সরকারি সদিচ্ছার কারণে। আর সরকারি সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মাধ্যমে। শুধু আইন করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়নি, আইনের প্রয়োগ ও প্রচার-প্রচারণার ওপরও বরাবরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে যখন যেমন প্রয়োজন তখন তেমন সংস্কার চালানো হয়েছে; চালানো হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দায়িত্ব নেওয়ার পর তো দেশজুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো ‘জিহাদ’ চলছে! এসব কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর।

তবে কি শুধু প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে? শুধু এ কারণেই কি চীনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঈর্ষণীয়ভাবে ভালো? না, তা নয়। আরও কারণ আছে। ১৪০ কোটি মানুষের একটা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতোটা উন্নয়ন স্রেফ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করেই সম্ভব হয়েছে- এমনটা অন্তত আমি মনে করি না। আমার মনে হয়, এর পেছনে বেশকিছু সামাজিক কারণও ক্রিয়াশীল ছিল ও আছে।

আমার ছেলে বেইজিংয়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় গ্রেডে পড়ে। প্রথম গ্রেড থেকেই সে স্কুলে অংক, বিজ্ঞান, ইংরেজি, চীনা ভাষা পড়ছে। নিয়মিত খেলাধুলা ও সংস্কৃতির চর্চাও আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম গ্রেড থেকে সে আরেকটি বিষয় পড়ছে, আর সেটি হচ্ছে: নৈতিকতা বা মোরালিটি! রীতিমতো নৈতিকতার ওপর বাচ্চাদের উপযোগী সচিত্র পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয় শ্রেণীকক্ষে!! কী শেখানো হয়? পিতামাতার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, সহপাঠীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার আদব-কায়দা কী, খেলার মাঠের আদব কী হবে, প্রবীণদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত, একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা কি, ইত্যাদি বিষয়গুলো গ্রেড ওয়ান থেকেই শেখানো হয়। ছেলে এখন দ্বিতীয় গ্রেডে উঠেছে। নৈতিকতার গ্রন্থটিও খানিকটা মোটা হয়েছে।

চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ। এখানে সরকারিভাবে কোনো ধর্মকে প্রমোট করা হয় না (আবার কাউকে ধর্ম পালনে বাধাও দেওয়া হয় না)। সরকারি স্কুলে তাই ধর্মীয় শিক্ষা নেই। কিন্তু নৈতিকতার শিক্ষা আছে একেবারে প্রথম গ্রেড থেকেই। আর আমরা জানি পৃথিবীর সকল ধর্মই নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, বিশেষ করে ইসলাম। আমার ছেলে স্কুলে নৈতিকতার যে-শিক্ষা পাচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই আসলে ইসলামেরই শিক্ষা! সে যখন কোনো ছোট-খাটো অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে, তখন আমি তাকে এই বলে চার্জ করি: ‘তোমার স্কুলে নৈতিকতার ক্লাসে কি শিক্ষক এমনটা করতে বলেন?’ ছেলে আমার লজ্জা পায় এবং সেই কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। আসলে, চীনারা ছোটবেলা থেকেই ভালো মানুষ হবার, ভালো নাগরিক হবার শিক্ষা পায় বিদ্যালয়গুলোতে। তারা ছোটবেলা থেকেই আইন মেনে চলার, সামাজিক নর্ম অনুসরণ করার শিক্ষা পায়। চীনের সামাজিক রীতিনীতি, নর্মের ওপর আবার কনফুসিয়াসের মতবাদ, তাওবাদ ইত্যাদির প্রভাবও অনস্বীকার্য। একটি উদাহরণ দিই: চীনের প্রাচীন আধ্যাত্মিক গুরু কনফুসিয়াস পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি এমনকি এমনটাও বলেছেন যে, পিতামাতার বয়স হলে সন্তানের উচিত নয় তাদেরকে ফেলে দূরে কোথাও যাওয়া!

চীনারা ছোটবেলা থেকেই পিতামাতাকে, গুরুজনকে সম্মান করার শিক্ষাটা হাতেকলমে পায়। আবার উল্টোভাবে, পিতামাতাও সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো জীবন নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। এ কথা সত্য যে, গুটিকতক ব্যতিক্রম ছাড়া, পৃথিবীর সব কালচারে, সব দেশে সন্তানের জন্য পিতামাতা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন বা ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকেন। চীনে একথা যেন একটু বেশিই প্রযোজ্য। এই সেদিনও চীনে ‘এক সন্তান নীতি’ কার্যকর ছিল। সকল পিতামাতাই চাইতেন তাদের একটি মাত্র সন্তানকে ভালো মানুষ, ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। শুধু পিতামাতা নন, পরিবারের দাদা-দাদি, নানা-নানিরাও আছেন! একটি শিশুর পেছনে বলতে গেলে ৬টি মানুষের যত্ন ও প্রচেষ্টা! আমার বিশ্বাস, ‘এক সন্তান নীতি’ চীনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চীনের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনেও এই নীতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে আমি মনে করি। এখন অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, প্রয়োজনের তাগিদেই, চীনে ‘দুই সন্তান নীতি’ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা বলা বোধকরি বাড়িয়ে বলা হবে না যে, ১৪০ কোটি মানুষের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই যে প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে ‘এক সন্তান নীতি’র ইতিবাচক প্রভাব কাজ করেছে।

মা চিয়াং খুন করে দীর্ঘ ২৮ বছর পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল বা থাকতে পেরেছিল তৎকালে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে। ২৮ বছর পর সেই প্রযুক্তির কারণেই তাকে ধরা পড়তে হয়েছে ও শাস্তি পেতে হয়েছে। বস্তুত, চীনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও ভূমিকা রাখছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ দমনে ও অপরাধী ধরতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে সাফল্যের সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের প্রায় সর্বত্র সিসি ক্যামেরার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা যায়। পথে-ঘাটে-অফিসে-আদালতে-ব্যাংকে-বাজারে কোথাও অপরাধ করে পার পাওয়া মুশকিল। কোনো-না-কোনো ক্যামেরায় আপনি ধরা পড়বেনই! এসব ক্যামেরা আবার গোপন কিছু নয়, বরং প্রকাশ্যেই সেগুলো ইন্সটল করা। অধিকাংশ জায়গায় আবার ক্যামেরার সাইন দেওয়া থাকে। সেই সাইনগুলো যেন বলছে: ‘আমি কিন্তু সব দেখছি! অপরাধ করো না, বাছা!!’ অন্যভাবে বললে, এসব ক্যামেরা, বিভিন্ন আইন ও তার প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে অপরাধ করা থেকে বিরত রাখা, অপরাধ করতে তাদের অনুৎসাহিত করা।

শুরু করেছিলাম নারী-নির্যাতনের একটি ঘটনা দিয়ে। অন্য সকল অপরাধের মতো, নারী-নির্যাতনের ঘটনাও চীনে এখন খুব কমই ঘটে। বিগত ৮ বছরে আমি বেইজিংয়ের রাস্তায় ইভ-টিজিংয়ের কোনো ঘটনা দেখিনি বা শুনিনি। চায়না কমিউনিকেশান ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময় আমাকে সপ্তাহে একদিন ভোরে মানে রাশ আওয়ারে পাতাল রেলে চড়তে হতো। রাশ আওয়ারে বেইজিংয়ের পাতালরেলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। নারী-পুরুষ গাদাগাদি করে ট্রেনে চড়ে। কোনোদিন কোনো মেয়েকে শুনিনি ইভ-টিজিংয়ের অভিযোগ তুলতে! সেদিন আমার এক নারী সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম: চীনে মেয়েদের নিরাপত্তা কেমন? তিনি বললেন: ‘জন্মের পর থেকেই এমনটা দেখছি। আমি কখনও ইভ-টিজিংয়ের শিকার হইনি বা কাউকে হতেও দেখিনি। আসলে, সমাজে মেয়েরা অনেক সম্মানের পাত্র, তাদেরকে কোনোভাবেই অসম্মান করা যাবে না- এটা এখন চীনা সমাজের নর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বেইজিংয়ের রাস্তায় অনেক রাতেও মেয়েরা নির্ভয়ে চলাফেরা করে। আমি একজন বিদেশি হিসেবে গভীর রাতে নির্ভয়ে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে ভয় পাই না। আমার ছেলেটিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি এই ভেবে নিশ্চিত থাকতে পারি যে, সে স্কুলে সর্বোচ্চ যত্ন পাবে ও নিরাপদ থাকবে। কিছুদিন আগে ছেলেকে স্কুল থেকে সময়মতো আনতে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। ছেলের শিক্ষিকা ঠিক পনেরো মিনিট পর ফোন দিলেন। পড়িমরি করে ছুটলেন ছেলের মা। স্কুলগেটে গিয়ে দেখেন ছেলেকে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন ক্লাসটিচার! ছেলেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দেননি!

দীর্ঘ ৮ বছরের অভিজ্ঞতা আমার। দেশি-বিদেশি যাদেরকে চিনি, তারা সবাই নিজেদেরকে চীনে নিরাপদ ভাবেন। ডাকাতের ভয়, ছিনতাইকারীর ভয়, মাস্তানের ভয় তাদের নেই। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, চীনে রাস্তা-ঘাটে পুলিশ গিজগিজ করে! বেইজিংয়ের রাস্তায় বের হলে আপনি পুলিশের দেখা পাবেন খুব কমই। ইউরোপে ও আমেরিকায়ও আমি এমনটা দেখেছি। রাস্তায় সহসা পুলিশ দেখা যায় না। তবে, কোনো অপরাধ ঘটলে, কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে, মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির হয়। বেইজিংসহ চীনের অবস্থাও এমনই।

চীনে নারী-পুরুষ-শিশু-প্রবীণ-দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তাবোধ উল্লেখ করার মতো। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, চীনে অপরাধ হয় না। হয়, তবে সংখ্যার বিচারে তা বেশি নয়। আর যখন কোনো ধরনের অপরাধ বাড়তে শুরু করে, তখন তা কমিয়ে আনতে সম্ভাব্য সবধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। একটি উদাহরণ দিই: গত দু’বছর ধরে চীনে কিশোর-অপরাধ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সংখ্যার বিচারে তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবে সরকার এই প্রবণতা কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চীনের বর্তমান আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো ছেলে বা মেয়ে কোনো বড় অপরাধ করলেও তার কোনো শাস্তি নেই। কিন্তু ১৪ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। নতুন আইনে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে করা বড় অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হবে। নতুন আইনের খসড়া ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক বলে থাকেন, চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা তথা আইনের শাসনের জন্য অনুকূল। পাশাপাশি রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, চীনা জনগণের আইন মেনে চলার প্রবণতাও। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে ছোটবেলা থেকেই চীনারা শেখে, যার প্রভাব তাদের গোটা জীবনেই লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া, চীনাদের ওপর প্রাচীন সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার প্রভাবও অস্বীকার করা যাবে না।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)
alimul@yahoo.com

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

চীনে আইনের শাসন বনাম অপরাধ

Update Time : ০৫:১৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৪ নভেম্বর ২০২০

আটাশ বছর আগে, ১৯৯২ সালের ২০ মার্চ, চীনের নানচিং চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয়ের (তৎকালীন নানচিং চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়) ছাত্রী লিন-কে ধর্ষণের পর হত্যা করেছিল মা চিয়াং। চতুর মা চিয়াং ঘটনার পর পরই আত্মগোপন করে। পুলিশ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে ১৫ শতাধিক মানুষকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কিন্তু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে তখন অপরাধীকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়।

২৮ বছর পর, গত ফেব্রুয়ারিতে, নানচিং পুলিশ একটি ক্লু পায়। ফেইসিয়ান কাউন্টির পুলিশ জানায়, তারা এমন একজন অপরাধীর খোঁজ পেয়েছেন, যে লিনের হত্যাকারীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হতে পারে। নানচিং পুলিশ উক্ত অপরাধীর আত্মীয়-স্বজনদের সম্পর্কে সকল তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। এই প্রক্রিয়ায় মা চিয়াংকে চিহ্নিত করা হয় ওই অপরাধীর কাজিন হিসেবে; মা চিয়াংয়ের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পুলিশের কাছে লিনের খুনীর ডিএনএ নমুনা আগে থেকেই ছিল। খুনীর ডিএনএ-র সঙ্গে মিলে যায় মা চিয়াংয়ের ডিএনএ। ধরা পরে মা চিয়াং। সম্প্রতি (গত মাস তথা অক্টোবর মাসের মাঝামাঝিতে) আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়।

মা চিয়াংয়ের বয়স এখন ৫৪ বছর। পুলিশ যখন তার ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে, তখনই সে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার কথা ভেবেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সে চিন্তা বাদ দেয়। কারণ, এখন আর নিজেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। প্রযুক্তির উন্নতি ঘটেছে। সে জানে যে, পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে আত্মগোপন করে থাকা এখন আর সম্ভব নয়। ইন্টারেস্টিং বিষয় হচ্ছে, ২৮ বছর আগেও মোটামুটি একই ভাবনা তার মনে খেলেছিল। চীনের পুলিশ সম্পর্কে তার ধারণা ছিল স্পষ্ট। সে জানতো যে, পুলিশ লিনের হত্যাকারীকে খুঁজে বের করার চেষ্টা কখনও পরিত্যাগ করবে না। এর মানে যে-কোনো দিন সে ধরা পড়তে পারে। আর ধরা পড়া মানেই মৃত্যুদণ্ড! বলতে গেলে, মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়েই সে চলাফেরা করতো। একসময় বিয়ে করে মা চিয়াং; একটা বড় কোম্পানিতে গাড়িচালক হিসেবে দীর্ঘকাল কাজও করে। কিন্তু একদিন ধরা পড়তে হতে পারে, মেনে নিতে হতে পারে মৃত্যুদণ্ডকে- এই চিন্তা তাকে বিরত রাখে সন্তান নেওয়া থেকে।

‘অপরাধ করলে শাস্তি পেতে হবে’- এই বিশ্বাস কি চীনাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা কমিয়েছে? আমার তাই ধারণা। নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চীনের শান্তি-সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিলেন। চীনভ্রমণের সেই অভিজ্ঞতা সর্ম্পকে জেনেছি তার লেখা বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’ পড়ে। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে নয়াচীন প্রতিষ্ঠার খুব অল্প সময়ের মধ্যে চীনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির নাটকীয় উন্নতির কথা তিনি লিখে গেছেন। বস্তুত, সেই উন্নতি ঘটেছিল দেশকে নিরাপদ করার, জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ বাড়ানোর সরকারি সদিচ্ছার কারণে। আর সরকারি সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছিল প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠার মাধ্যমে। শুধু আইন করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়নি, আইনের প্রয়োগ ও প্রচার-প্রচারণার ওপরও বরাবরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে যখন যেমন প্রয়োজন তখন তেমন সংস্কার চালানো হয়েছে; চালানো হয়েছে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং দায়িত্ব নেওয়ার পর তো দেশজুড়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রীতিমতো ‘জিহাদ’ চলছে! এসব কর্মকাণ্ডের ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর।

তবে কি শুধু প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করেই দায়িত্ব শেষ করা হয়েছে? শুধু এ কারণেই কি চীনের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঈর্ষণীয়ভাবে ভালো? না, তা নয়। আরও কারণ আছে। ১৪০ কোটি মানুষের একটা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এতোটা উন্নয়ন স্রেফ আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগ করেই সম্ভব হয়েছে- এমনটা অন্তত আমি মনে করি না। আমার মনে হয়, এর পেছনে বেশকিছু সামাজিক কারণও ক্রিয়াশীল ছিল ও আছে।

আমার ছেলে বেইজিংয়ের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দ্বিতীয় গ্রেডে পড়ে। প্রথম গ্রেড থেকেই সে স্কুলে অংক, বিজ্ঞান, ইংরেজি, চীনা ভাষা পড়ছে। নিয়মিত খেলাধুলা ও সংস্কৃতির চর্চাও আছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম গ্রেড থেকে সে আরেকটি বিষয় পড়ছে, আর সেটি হচ্ছে: নৈতিকতা বা মোরালিটি! রীতিমতো নৈতিকতার ওপর বাচ্চাদের উপযোগী সচিত্র পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয় শ্রেণীকক্ষে!! কী শেখানো হয়? পিতামাতার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, সহপাঠীদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, রাস্তা-ঘাটে চলাফেরার আদব-কায়দা কী, খেলার মাঠের আদব কী হবে, প্রবীণদের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিত, একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতার প্রয়োজনীয়তা কি, ইত্যাদি বিষয়গুলো গ্রেড ওয়ান থেকেই শেখানো হয়। ছেলে এখন দ্বিতীয় গ্রেডে উঠেছে। নৈতিকতার গ্রন্থটিও খানিকটা মোটা হয়েছে।

চীন সমাজতান্ত্রিক দেশ। এখানে সরকারিভাবে কোনো ধর্মকে প্রমোট করা হয় না (আবার কাউকে ধর্ম পালনে বাধাও দেওয়া হয় না)। সরকারি স্কুলে তাই ধর্মীয় শিক্ষা নেই। কিন্তু নৈতিকতার শিক্ষা আছে একেবারে প্রথম গ্রেড থেকেই। আর আমরা জানি পৃথিবীর সকল ধর্মই নৈতিকতার শিক্ষা দেয়, বিশেষ করে ইসলাম। আমার ছেলে স্কুলে নৈতিকতার যে-শিক্ষা পাচ্ছে, সেগুলোর বেশিরভাগই আসলে ইসলামেরই শিক্ষা! সে যখন কোনো ছোট-খাটো অনাকাঙ্ক্ষিত কাজ করে, তখন আমি তাকে এই বলে চার্জ করি: ‘তোমার স্কুলে নৈতিকতার ক্লাসে কি শিক্ষক এমনটা করতে বলেন?’ ছেলে আমার লজ্জা পায় এবং সেই কাজ থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করে। আসলে, চীনারা ছোটবেলা থেকেই ভালো মানুষ হবার, ভালো নাগরিক হবার শিক্ষা পায় বিদ্যালয়গুলোতে। তারা ছোটবেলা থেকেই আইন মেনে চলার, সামাজিক নর্ম অনুসরণ করার শিক্ষা পায়। চীনের সামাজিক রীতিনীতি, নর্মের ওপর আবার কনফুসিয়াসের মতবাদ, তাওবাদ ইত্যাদির প্রভাবও অনস্বীকার্য। একটি উদাহরণ দিই: চীনের প্রাচীন আধ্যাত্মিক গুরু কনফুসিয়াস পিতামাতার সঙ্গে ভালো ব্যবহারের ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন। তিনি এমনকি এমনটাও বলেছেন যে, পিতামাতার বয়স হলে সন্তানের উচিত নয় তাদেরকে ফেলে দূরে কোথাও যাওয়া!

চীনারা ছোটবেলা থেকেই পিতামাতাকে, গুরুজনকে সম্মান করার শিক্ষাটা হাতেকলমে পায়। আবার উল্টোভাবে, পিতামাতাও সন্তানের জন্য সবচেয়ে ভালো জীবন নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। এ কথা সত্য যে, গুটিকতক ব্যতিক্রম ছাড়া, পৃথিবীর সব কালচারে, সব দেশে সন্তানের জন্য পিতামাতা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন বা ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকেন। চীনে একথা যেন একটু বেশিই প্রযোজ্য। এই সেদিনও চীনে ‘এক সন্তান নীতি’ কার্যকর ছিল। সকল পিতামাতাই চাইতেন তাদের একটি মাত্র সন্তানকে ভালো মানুষ, ভালো নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে। শুধু পিতামাতা নন, পরিবারের দাদা-দাদি, নানা-নানিরাও আছেন! একটি শিশুর পেছনে বলতে গেলে ৬টি মানুষের যত্ন ও প্রচেষ্টা! আমার বিশ্বাস, ‘এক সন্তান নীতি’ চীনে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। চীনের অবিশ্বাস্য অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনেও এই নীতি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে বলে আমি মনে করি। এখন অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, প্রয়োজনের তাগিদেই, চীনে ‘দুই সন্তান নীতি’ গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা বলা বোধকরি বাড়িয়ে বলা হবে না যে, ১৪০ কোটি মানুষের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই যে প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে, তার পেছনে ‘এক সন্তান নীতি’র ইতিবাচক প্রভাব কাজ করেছে।

মা চিয়াং খুন করে দীর্ঘ ২৮ বছর পুলিশের ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিল বা থাকতে পেরেছিল তৎকালে প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে। ২৮ বছর পর সেই প্রযুক্তির কারণেই তাকে ধরা পড়তে হয়েছে ও শাস্তি পেতে হয়েছে। বস্তুত, চীনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারও ভূমিকা রাখছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ দমনে ও অপরাধী ধরতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করছে সাফল্যের সঙ্গে। উদাহরণস্বরূপ, চীনের প্রায় সর্বত্র সিসি ক্যামেরার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা যায়। পথে-ঘাটে-অফিসে-আদালতে-ব্যাংকে-বাজারে কোথাও অপরাধ করে পার পাওয়া মুশকিল। কোনো-না-কোনো ক্যামেরায় আপনি ধরা পড়বেনই! এসব ক্যামেরা আবার গোপন কিছু নয়, বরং প্রকাশ্যেই সেগুলো ইন্সটল করা। অধিকাংশ জায়গায় আবার ক্যামেরার সাইন দেওয়া থাকে। সেই সাইনগুলো যেন বলছে: ‘আমি কিন্তু সব দেখছি! অপরাধ করো না, বাছা!!’ অন্যভাবে বললে, এসব ক্যামেরা, বিভিন্ন আইন ও তার প্রয়োগের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে অপরাধ করা থেকে বিরত রাখা, অপরাধ করতে তাদের অনুৎসাহিত করা।

শুরু করেছিলাম নারী-নির্যাতনের একটি ঘটনা দিয়ে। অন্য সকল অপরাধের মতো, নারী-নির্যাতনের ঘটনাও চীনে এখন খুব কমই ঘটে। বিগত ৮ বছরে আমি বেইজিংয়ের রাস্তায় ইভ-টিজিংয়ের কোনো ঘটনা দেখিনি বা শুনিনি। চায়না কমিউনিকেশান ইউনিভার্সিটিতে খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময় আমাকে সপ্তাহে একদিন ভোরে মানে রাশ আওয়ারে পাতাল রেলে চড়তে হতো। রাশ আওয়ারে বেইজিংয়ের পাতালরেলে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। নারী-পুরুষ গাদাগাদি করে ট্রেনে চড়ে। কোনোদিন কোনো মেয়েকে শুনিনি ইভ-টিজিংয়ের অভিযোগ তুলতে! সেদিন আমার এক নারী সহকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম: চীনে মেয়েদের নিরাপত্তা কেমন? তিনি বললেন: ‘জন্মের পর থেকেই এমনটা দেখছি। আমি কখনও ইভ-টিজিংয়ের শিকার হইনি বা কাউকে হতেও দেখিনি। আসলে, সমাজে মেয়েরা অনেক সম্মানের পাত্র, তাদেরকে কোনোভাবেই অসম্মান করা যাবে না- এটা এখন চীনা সমাজের নর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

বেইজিংয়ের রাস্তায় অনেক রাতেও মেয়েরা নির্ভয়ে চলাফেরা করে। আমি একজন বিদেশি হিসেবে গভীর রাতে নির্ভয়ে ফাঁকা রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করতে ভয় পাই না। আমার ছেলেটিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আমি এই ভেবে নিশ্চিত থাকতে পারি যে, সে স্কুলে সর্বোচ্চ যত্ন পাবে ও নিরাপদ থাকবে। কিছুদিন আগে ছেলেকে স্কুল থেকে সময়মতো আনতে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। ছেলের শিক্ষিকা ঠিক পনেরো মিনিট পর ফোন দিলেন। পড়িমরি করে ছুটলেন ছেলের মা। স্কুলগেটে গিয়ে দেখেন ছেলেকে নিয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন ক্লাসটিচার! ছেলেকে এক মুহূর্তের জন্য চোখের আড়াল হতে দেননি!

দীর্ঘ ৮ বছরের অভিজ্ঞতা আমার। দেশি-বিদেশি যাদেরকে চিনি, তারা সবাই নিজেদেরকে চীনে নিরাপদ ভাবেন। ডাকাতের ভয়, ছিনতাইকারীর ভয়, মাস্তানের ভয় তাদের নেই। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, চীনে রাস্তা-ঘাটে পুলিশ গিজগিজ করে! বেইজিংয়ের রাস্তায় বের হলে আপনি পুলিশের দেখা পাবেন খুব কমই। ইউরোপে ও আমেরিকায়ও আমি এমনটা দেখেছি। রাস্তায় সহসা পুলিশ দেখা যায় না। তবে, কোনো অপরাধ ঘটলে, কোনো বিশেষ ঘটনা ঘটলে, মুহূর্তের মধ্যে পুলিশ এসে হাজির হয়। বেইজিংসহ চীনের অবস্থাও এমনই।

চীনে নারী-পুরুষ-শিশু-প্রবীণ-দেশি-বিদেশি নির্বিশেষে সবার নিরাপত্তাবোধ উল্লেখ করার মতো। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, চীনে অপরাধ হয় না। হয়, তবে সংখ্যার বিচারে তা বেশি নয়। আর যখন কোনো ধরনের অপরাধ বাড়তে শুরু করে, তখন তা কমিয়ে আনতে সম্ভাব্য সবধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। একটি উদাহরণ দিই: গত দু’বছর ধরে চীনে কিশোর-অপরাধ ধীরে ধীরে বাড়ছে। সংখ্যার বিচারে তা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়, তবে সরকার এই প্রবণতা কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চীনের বর্তমান আইনে ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো ছেলে বা মেয়ে কোনো বড় অপরাধ করলেও তার কোনো শাস্তি নেই। কিন্তু ১৪ বছরের কম বয়সীদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সরকার নতুন আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে যাচ্ছে। নতুন আইনে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোর-কিশোরীদেরকে ইচ্ছাকৃতভাবে করা বড় অপরাধের জন্য শাস্তি পেতে হবে। নতুন আইনের খসড়া ইতোমধ্যে অনুমোদন করা হয়েছে।

অনেক বিশ্লেষক বলে থাকেন, চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা তথা আইনের শাসনের জন্য অনুকূল। পাশাপাশি রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, চীনা জনগণের আইন মেনে চলার প্রবণতাও। আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে ছোটবেলা থেকেই চীনারা শেখে, যার প্রভাব তাদের গোটা জীবনেই লক্ষ্য করা যায়। তা ছাড়া, চীনাদের ওপর প্রাচীন সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার প্রভাবও অস্বীকার করা যাবে না।
লেখক : বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)
alimul@yahoo.com