আধুনিকতায় বিলীন গরুর লাঙ্গল জোয়ালের হাল- চাষ!

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৫:১৪:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ জানুয়ারী ২০২১
  • / ২১৩ Time View
এনামুল হক:
কৃষি প্রধান বাংলাদেশ আর এই দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষক। কৃষি কাজে কৃষকেরা কামারের তৈরি কাঠের লাঙ্গল, জোয়াল এবং বাঁশের মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন।যুগের পর যুগ ধরে কৃষকেরা কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি-যন্ত্রপাতি এবং জোড়া গরু দিয়ে হালচাষ করে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনে এসেছে নানারকম পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে কৃষিতে এবং কৃষির ছোঁয়ায় দেখা যায় বেশ পরিবর্তন।তাই তো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা তাল-তরকারির চাষাবাদ করে থাকেন প্রতিনিয়ত।
.
পাওয়ার টিলার ও যান্ত্রিক হাল সময়মত না পাওয়ায় এবং অল্প জমি চাষ করতে না আসায় তাল তরকারি চাষাবাদ করতে পারছে না অনেক কৃষক। সে কারণে অনেক কৃষকেরা মৌসুমি ফসল চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে।
.
কথা হয় শান্তিরাম ইউনিয়নের কৃষক তারা মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, গরুর হাল না থাকায় আগের মত তাল তরকারি চাষাবাদ করতে পারছি না। আজ থেকে ১৫ বছর আগে তিনি খন্ড খন্ড উচু এক বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রকার তাল তরকারি চাষাবাদ করে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ করত। পাওয়ার টিলার দিয়ে খন্ড খন্ড জমি চাষ কষ্টকর এবং টিলার মালিকরা জমি চাষ করতে না আসায় সময় মত তাল তরকারি আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারনে তিনি তাল তরকারি চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছে।
.
গরুর হালের মালিক আব্দুল কাদের জানান, গরুসহ প্রতিটি উপকরনের দাম এখন অনেক বেশি। সে কারনে গরুর হাল এখন পোশায় না। শুধু মাত্র মৌসুমি তাল তরকারি এবং বীজতলা চাষাবাদের জন্য গরুর হাল দরকার হয়। তাই তো আর দেখা মেলেনা উপজেলার গ্রাম অঞ্চলে রোজ সকালে কৃষকের হাতে জোড়া গরুর দড়ি আর কাঁধে লাঙল-জোয়াল, মই নিয়ে মাঠে যেতে কৃষকদের। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য জোড়া গরু, লাঙল, জোয়াল দিয়ে হাল চাষ। কৃষিপ্রধান এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জোড়া গরু, লাঙল, জোয়াল ও মই। বাংলাদেশে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে গরুর হাল চাষের পরিবর্তনে বর্তমানে পাওয়ার টিলার অথবা ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করা হয়। ১৫-২০ বছর আগেও দেশের সব অঞ্চলে কৃষকেরা গরু পালন করত হাল চাষ করার জন্য।
.
.
অন্যদিকে কিছু মানুষ হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন যা কিনা রুটি-রুজির পথ ছিল তাদের। উল্লেখ্য, তিল, সরিষা, কলাই, গম, ভুট্টাসহ অনেক ফসলের চাষের জন্য হালচাষ ব্যবহার করতেন। এছাড়াও অনেকেই নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত এবং হালচাষের গরু দিয়ে দরিদ্র কৃষকেরা জমি চাষ করে ফিরে পেত পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা।
.
ইতোপূর্বে দেখা যেত, ভোরবেলা কৃষকেরা লাঙ্গল, জোয়াল আর গরু নিয়ে যেত জমিতে হাল চাষের জন্য কিন্তু যেখানে বিজ্ঞানের নতুনত্ব আবিষ্কারই বলে দিচ্ছে দিন বদলের ইঙ্গিত। গাইছে পালাবদলের গান, ঠিক তখনই গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ অম্লান। কেনইবা হবে না! এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর এখন জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে হচ্ছে জমি চাষাবাদ। গরু দিয়ে হাল চাষ বিলুপ্ত হওয়ায় তো কৃষকেরা এখন বর্তমানে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন আবার কেউবা কর্ম না পেয়ে রয়েছেন বেকার। কালক্রমে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু, লাঙ্গল, জোয়াল দিয়ে জমিতে হাল চাষ।
.
সর্বানন্দ ইউনিয়নের মধ্যে সাহাবাজ মাষ্টার পাড়া গ্রামের কৃষক আবু সাইদ মোল্লা বলেন, ছোট বেলায় হাল চাষের কাজ করেছি এবং আমার বাড়িতে হাল চাষের জন্যে বলদ গরু ছিল ৩-৪ জোড়া। আর জমি চাষের জন্য ব্যবহার হতো ১ জোড়া বলদ। কাঠ লোহার সংমিশ্রণে তৈরি লাঙল, জোয়াল, মই, গরুর মুখে টোনা ইত্যাদি।
.
আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করতে জমিতে গরুর গোবর জমিতে পড়ত এতে জমিতে জৈব সার হত ও জমিতে ফসল উৎপাদন ভালো হতো।বিজ্ঞানের নতুনত্ব আবিষ্কারের ফলে নতুন নতুন মেশিন এসেছে সেই মেশিন দিয়ে এখানকার কৃষকেরা জমি চাষাবাদ করে কিন্তু যাদের অর্থের অভাব টাকা পয়সা নেই যে মেশিন কিনে জমি চাষাবাদ করতে পারবে, তাদের দিন চরম বিপাকে। তাই এখনো সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।
.
উপজেলার অপর কৃষক মজিবর রহমান জানান, এক জোড়া বলদ গরুর লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০/৬০ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতমানের যন্ত্রপাতির চেয়েও গরুর লাঙ্গলের চাষ অনেক গভীর হয় ও জমিতে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশক অনেকটাই সাশ্রয় পায়।
.
তিনি আরো বলেন, যদি খুব কষ্ট হতো তবুও গরু দিয়ে হাল চাষ করতে খুব উৎফুল্ল লাগত। হাজারো চেষ্টার পরেও ফিরে পাব না আর সেই পুরনো স্মৃতি মধুর দিনগুলো। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সৈয়দ রেজা-ই মাহমুদ বলেন, ‘গরুর হাল এখন বিলুপ্ত প্রায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গরুর হাল খুব বেশি দেখা যায় না। তবে বীজতলা এবং তাল তরকারি জমি চাষের জন্য গরুর প্রয়োজন। গরুর হালচাষ বাঙ্গালীর ঐতিহ্য তবে পরিবর্তনের ছোয়ায় তা আর দেখা যায়না।
.
লেখক: সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি,বিডি সমাচার ২৪ ডটকম।
Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

আধুনিকতায় বিলীন গরুর লাঙ্গল জোয়ালের হাল- চাষ!

Update Time : ০৫:১৪:১৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ১১ জানুয়ারী ২০২১
এনামুল হক:
কৃষি প্রধান বাংলাদেশ আর এই দেশের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষক। কৃষি কাজে কৃষকেরা কামারের তৈরি কাঠের লাঙ্গল, জোয়াল এবং বাঁশের মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন।যুগের পর যুগ ধরে কৃষকেরা কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি-যন্ত্রপাতি এবং জোড়া গরু দিয়ে হালচাষ করে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। কিন্তু বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের ফলে কৃষকদের জীবনে এসেছে নানারকম পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে কৃষিতে এবং কৃষির ছোঁয়ায় দেখা যায় বেশ পরিবর্তন।তাই তো গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষকেরা তাল-তরকারির চাষাবাদ করে থাকেন প্রতিনিয়ত।
.
পাওয়ার টিলার ও যান্ত্রিক হাল সময়মত না পাওয়ায় এবং অল্প জমি চাষ করতে না আসায় তাল তরকারি চাষাবাদ করতে পারছে না অনেক কৃষক। সে কারণে অনেক কৃষকেরা মৌসুমি ফসল চাষাবাদে আগ্রহ হারাচ্ছে।
.
কথা হয় শান্তিরাম ইউনিয়নের কৃষক তারা মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, গরুর হাল না থাকায় আগের মত তাল তরকারি চাষাবাদ করতে পারছি না। আজ থেকে ১৫ বছর আগে তিনি খন্ড খন্ড উচু এক বিঘা জমিতে বিভিন্ন প্রকার তাল তরকারি চাষাবাদ করে বছরে প্রায় ৪০ হাজার টাকা লাভ করত। পাওয়ার টিলার দিয়ে খন্ড খন্ড জমি চাষ কষ্টকর এবং টিলার মালিকরা জমি চাষ করতে না আসায় সময় মত তাল তরকারি আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। সে কারনে তিনি তাল তরকারি চাষাবাদ ছেড়ে দিয়েছে।
.
গরুর হালের মালিক আব্দুল কাদের জানান, গরুসহ প্রতিটি উপকরনের দাম এখন অনেক বেশি। সে কারনে গরুর হাল এখন পোশায় না। শুধু মাত্র মৌসুমি তাল তরকারি এবং বীজতলা চাষাবাদের জন্য গরুর হাল দরকার হয়। তাই তো আর দেখা মেলেনা উপজেলার গ্রাম অঞ্চলে রোজ সকালে কৃষকের হাতে জোড়া গরুর দড়ি আর কাঁধে লাঙল-জোয়াল, মই নিয়ে মাঠে যেতে কৃষকদের। দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার হাজার বছরের ঐতিহ্য জোড়া গরু, লাঙল, জোয়াল দিয়ে হাল চাষ। কৃষিপ্রধান এদেশের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে জোড়া গরু, লাঙল, জোয়াল ও মই। বাংলাদেশে বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে গরুর হাল চাষের পরিবর্তনে বর্তমানে পাওয়ার টিলার অথবা ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করা হয়। ১৫-২০ বছর আগেও দেশের সব অঞ্চলে কৃষকেরা গরু পালন করত হাল চাষ করার জন্য।
.
.
অন্যদিকে কিছু মানুষ হাল চাষকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়ে ছিলেন যা কিনা রুটি-রুজির পথ ছিল তাদের। উল্লেখ্য, তিল, সরিষা, কলাই, গম, ভুট্টাসহ অনেক ফসলের চাষের জন্য হালচাষ ব্যবহার করতেন। এছাড়াও অনেকেই নিজের জমির পাশাপাশি অন্যের জমিতে হাল চাষ করে তাদের জীবিকা নির্বাহ করত এবং হালচাষের গরু দিয়ে দরিদ্র কৃষকেরা জমি চাষ করে ফিরে পেত পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা।
.
ইতোপূর্বে দেখা যেত, ভোরবেলা কৃষকেরা লাঙ্গল, জোয়াল আর গরু নিয়ে যেত জমিতে হাল চাষের জন্য কিন্তু যেখানে বিজ্ঞানের নতুনত্ব আবিষ্কারই বলে দিচ্ছে দিন বদলের ইঙ্গিত। গাইছে পালাবদলের গান, ঠিক তখনই গরুর লাঙল দিয়ে চাষাবাদ অম্লান। কেনইবা হবে না! এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর এখন জমি চাষের প্রয়োজন হলেই অল্প সময়ের মধ্যেই পাওয়ার টিলারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে হচ্ছে জমি চাষাবাদ। গরু দিয়ে হাল চাষ বিলুপ্ত হওয়ায় তো কৃষকেরা এখন বর্তমানে অন্য পেশায় ঝুঁকছেন আবার কেউবা কর্ম না পেয়ে রয়েছেন বেকার। কালক্রমে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে গরু, লাঙ্গল, জোয়াল দিয়ে জমিতে হাল চাষ।
.
সর্বানন্দ ইউনিয়নের মধ্যে সাহাবাজ মাষ্টার পাড়া গ্রামের কৃষক আবু সাইদ মোল্লা বলেন, ছোট বেলায় হাল চাষের কাজ করেছি এবং আমার বাড়িতে হাল চাষের জন্যে বলদ গরু ছিল ৩-৪ জোড়া। আর জমি চাষের জন্য ব্যবহার হতো ১ জোড়া বলদ। কাঠ লোহার সংমিশ্রণে তৈরি লাঙল, জোয়াল, মই, গরুর মুখে টোনা ইত্যাদি।
.
আগে গরু দিয়ে হাল চাষ করতে জমিতে গরুর গোবর জমিতে পড়ত এতে জমিতে জৈব সার হত ও জমিতে ফসল উৎপাদন ভালো হতো।বিজ্ঞানের নতুনত্ব আবিষ্কারের ফলে নতুন নতুন মেশিন এসেছে সেই মেশিন দিয়ে এখানকার কৃষকেরা জমি চাষাবাদ করে কিন্তু যাদের অর্থের অভাব টাকা পয়সা নেই যে মেশিন কিনে জমি চাষাবাদ করতে পারবে, তাদের দিন চরম বিপাকে। তাই এখনো সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।
.
উপজেলার অপর কৃষক মজিবর রহমান জানান, এক জোড়া বলদ গরুর লাঙ্গল দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৫০/৬০ শতাংশ জমি চাষ করা সম্ভব। বর্তমানে বিজ্ঞানের উন্নতমানের যন্ত্রপাতির চেয়েও গরুর লাঙ্গলের চাষ অনেক গভীর হয় ও জমিতে মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি ও ফসলের চাষাবাদ করতে সার, কীটনাশক অনেকটাই সাশ্রয় পায়।
.
তিনি আরো বলেন, যদি খুব কষ্ট হতো তবুও গরু দিয়ে হাল চাষ করতে খুব উৎফুল্ল লাগত। হাজারো চেষ্টার পরেও ফিরে পাব না আর সেই পুরনো স্মৃতি মধুর দিনগুলো। উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ সৈয়দ রেজা-ই মাহমুদ বলেন, ‘গরুর হাল এখন বিলুপ্ত প্রায়। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গরুর হাল খুব বেশি দেখা যায় না। তবে বীজতলা এবং তাল তরকারি জমি চাষের জন্য গরুর প্রয়োজন। গরুর হালচাষ বাঙ্গালীর ঐতিহ্য তবে পরিবর্তনের ছোয়ায় তা আর দেখা যায়না।
.
লেখক: সুন্দরগঞ্জ (গাইবান্ধা) প্রতিনিধি,বিডি সমাচার ২৪ ডটকম।