মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন:
গাঙ্গেয় অববাহিকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। উর্বর পলল-সমৃদ্ধ ছোট্ট এই দেশটি ভূ-
বৈচিত্র্য ও রূপবৈচিত্র্যের বিচারে পৃথিবীতে এক অনন্য দেশ। বাংলাদেশের ভূ-বৈচিত্র্যের এক অনন্য স্বতন্ত্র
দিক হচ্ছে হাওর। বাংলাদেশের বিশাল অংশ হাওর এলাকা হিসেবে পরিচিত। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল তথা
কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও ব্রাক্ষণবাড়িয়া অর্থাৎ এ সাতটি জেলার
প্রায় ৮ দশমিক ৫৮ লাখ হেক্টর জমি নিয়ে হাওর অঞ্চল গঠিত। যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।দেশে ছোট বড় ৩শ৯৫ টি হাওর রয়েছে।
হাওরাঞ্চল জাতীয়ভাবে পরিচিতি এবং উন্নয়ন কার্যক্রমে গুরুত্ব পায় বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার
জন্য । হাওরবাসির মূখে হাসি ফোটাতে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন তিনি। তার কল্যানেই হাওরাঞ্চলের অনেক জায়গায় প্রথম বারের মত বিদ্যুতের সংযোগ দেয়া হয়েছে;সম্প্রসারণ কার্যক্রমও চলমান । ২০৩২ সালের মধ্যে হাওরের ৯০% গ্রাম বিদ্যুতের আওতায় আসবে । হাওরের মানুষের জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া দিতে বর্তমান সরকারের আরেক যুগান্তরকারি পদক্ষেপ হচ্ছে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা । সরকারের লক্ষ্য বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি অঞ্চলের জনগণের টেকসই জীবনমান উন্নয়ন। হাওর ও জলাভূমি অঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা, বন্যা ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে জনগণের উন্নত জীবনযাত্রারমান বৃদ্ধি করা।
শুস্ক মৌসুমে দিগন্তজোড়া সবুজ পতিত গো-চারণ ভূমি, বর্ষায় সমুদ্রসম স্বচ্ছ জলরাশির চিত্র । স্বাধীনতার পর
বঙ্গবন্ধু সরকার জার্মানী হতে বিশেষ বিমানে করে হাজার হাজার সেচের পাম্প এনেছিল। পাম্পগুলো বিএডিসির
মাধ্যমে সরবরাহ করেছেন; ইরি ধানের বীজ, কলের লাঙ্গল, সার, ফ্রি কীটনাশক বিতরণ, আর বিমান থেকে কীটনাশক ছিটানোর ফলে হাওরাঞ্চলের পতিত জমি হয়ে উঠে সবুজ শ্যামল ‘শস্য ভান্ডার’। হাওর এলাকা পরিণত হয় ‘খাদ্য উদ্ধৃত অঞ্চল হিসাবে।
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশ গড়ার সাথে হাওরের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু ‘হাওর উন্নয়ন বোর্ড’ এর প্রধান কার্যালয়
কিশোরগঞ্জে স্থাপনের করলেন । প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০১ সালে ‘হাওর ও জলাশয় উন্নয়ন বোর্ড’
পুনঃগঠন করেন । দ্বিতীয় মেয়াদে হাওর উন্নয়নে ২০১২ সালে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকার ‘হাওর মাস্টার প্লান’ প্রণয়ন করেন আন্তঃগ্রাম (Inter village communication) না হয়ে অন্তঃগ্রাম (Internal village
communication) যোগাযোগ হচ্ছে ‘ডুবা সড়ক’র মাধ্যমে । হাওরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ১৪ টি খাল খননের
উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আগামী দিনের ‘খাদ্য ভান্ডার’ হিসাবে হাওরকে গড়ে তুলার লক্ষ্যে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়
কর্তৃক হাওরে বিভিন্ন উন্নয়ন আর আয় বৃদ্ধিমূলক কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে ।
দেশে উত্তোলিত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রায় ৯০% আহরিত হয় হাওরের চারিপার হতে। এ গ্যাস হাওরের বুক চিড়ে
দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। হাওর থেকে সারা দেশে নির্মাণ সামগ্রী পাথর, বালু, কয়লা, ধান ও মাছ সরবরাহ করা হয়। উন্নয়নমূখী সকল প্রতিষ্ঠান কে হাওর উন্নয়নে সম্পৃক্ত করতে চাচ্ছে সরকার । তাঁরই অংশ হিসাবে মিটামনে একটি সেনানীবাস স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। বিভিন্ন সাহায্য, অনুদান, ভাতা, কাজের মাধ্যমে খাদ্য কর্মসূচী চালুর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরী করা হয়েছে । দারিদ্র হ্রাস পায় অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য ফিরে আসে।
বর্ষাকালে বিচ্ছিন্ন থাকা হাওর অঞ্চলে জন্য হচ্ছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, যোগাযোগে হচ্ছে উড়াল সেতুও।
পাশাপাশি সাব মার্সিবল সড়ক ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ব্রিজ কালভার্ট নির্মাণ হবে। এ লক্ষে হাওরে ঘেরা
সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনা জেলাকে ঘিরে ‘হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন’ নামে একটি
প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর জন্য তিন হাজার ৪৯০ কোটি টাকার প্রাক্কলিত এ প্রকল্পটি জুন ২০২৫ মেয়াদে
বাস্তবায়ন হবে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে হাওরবাসি তাঁদের অবস্থান সুদৃঢ করেছে, নেতৃত্ব দিচ্ছে । দেশের
হাওরাঞ্চলের জলমহাল রয়েছে ২৮ হাজার। বিল রয়েছে ৬ হাজার ৩শ; হাওর৩শ ৯৫ টি । সর্বোপরি সিলেট,
সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কিয়দাংশ এ সকল জেলার প্রায়
পাঁচ হাজার হাওর-বাওর, বিল-ঝিল নিয়ে গঠিত হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে হাওরের রয়েছে বিশাল প্রভাব। হাওর পাড়ের মানুষের দৈনন্দিন জীবন হাওর দ্বারা প্রভাবিত। এ অঞ্চলের মানুষের চিন্তা-চেতনা, মেধা-মনন, সাংস্কৃতিক কর্মকার্ন্ড, অর্থনৈতিক প্রাণ চাঞ্চল্য সবকিছু হাওর কেন্দ্রিক। তাই এই সমস্ত ক্ষেত্রে হাওর এলাকার সাথে দেশের অন্যান্য এলাকার রয়েছে বৈসাদৃশ্য। হাওরে বসবাসরত মানুষজন প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করেই বেঁচে আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ২০৫০ সাল নাগাদ হাওর অঞ্চলে পানির উচ্চতা প্রাক-বর্ষা মৌসুমে দশমিক ৩ থেকে দশমিক ৬ মিটার পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং সময় থাকতেই হাওরের জন্য নিতে হবে পরিকল্পিত কর্মসূচি, যে কর্মসূচি হবে উন্নত পৃথিবীর পানিবেষ্টিত জনপদের মতো জীবনবান্ধব। এ এলাকার জীবন ব্যবস্থায় যার অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের ভিত্তি কেবলই পানি আর পানি, তখন পানি সহায়ক কর্মকান্ড যেমন ধান চাষ, মৎস্য চাষ, হাঁস চাষ, নৌকা যোগাযোগ ইত্যাদি এই অঞ্চলের মূল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড।
সময় পরিক্রমায় জীবিকার ধরণেও পরিবর্তন হয়। হাওর এলাকার এ সমস্ত দিক চিন্তা করে হাওর কেন্দ্রিক
উন্নয়ন ভাবনা প্রথম শুরু হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মাধ্যমে। হাওর ও জলাভূমি এলাকার
জনগণের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে হাওর উন্নয়ন বোর্ড
গঠনের নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে হাওর উন্নয়ন
বোর্ড গঠন করা হয় কিন্তু হাওর এলাকার সাধারণ মানুষের জীবন মান উন্নয়নের যে স্বপ্ন নিয়ে জাতির পিতা হাওর উন্নয়ন বোর্ড গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন তা অকার্যকর হয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর বোর্ডটি বিলুপ্ত করা হয়। হাওর,হাওরবাসি ও জলাভূমি উন্নয়ন স্থবির হয়ে পড়ে। জাতির পিতার পর হাওর এলাকার উন্নয়নের সুবাতাস আবার আসতে থাকে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার মাধ্যমে। তিনি ২০০১ সালের ১০ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ড’ এবং বোর্ডের ‘কার্যনির্বাহী কমিটি’ গঠন করা হয়। পরে হাওর ও জলাভূমি এলাকার উন্নয়নে ব্যাপক গতিশীলতা আনয়নের লক্ষ্যে ২০১৪ সালে হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডকে অধিদপ্তর ঘোষণার নির্দেশ প্রদান করেন। হাওর এলাকার মানুষের সার্বিক উন্নয়নের কথা বিবেচনায় নিয়ে তার সভাপতিত্বে বাংলাদেশ হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় হাওর এলাকার জনজীবন, জীবিকা, পরিবেশ-প্রতিবেশসহ সার্বিক উন্নয়নের জন্য ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত মোট ২০ বছর মেয়াদি একটি হাওর মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে।
‘মাছে ভাতে বাঙ্গালি’ আজন্ম কালের প্রবাদ। দেশের মৎস্য সম্পদের একটি বড় অংশ হাওরেই উৎপাদিত হয়।
দেশের মোট মাছের ২০ থেকে ২৫ শতাংশ যোগান দেয় হাওর। রপ্তানি খাতের মধ্যে মৎস্য অন্যতম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মৎস্য খাত দ্বিতীয়। হাওরাঞ্চলের জলরাশিতে পাওয়া যায় বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নানা জাতের মাছ। মৎস্য বিজ্ঞানীদের ভাষায় হাওর হলো মাদার ফিসারী। বাংলাদেশের মোট ধান উৎপাদনের প্রায় ১৬ শতাংশ আসে হাওর থেকে যার মূল্য জাতীয় আয়ের প্রায় ৬-৮ ভাগ এবং মোট উৎপাদিত ফসলের ৭৯ দশমিক ৫ শতাংশ হচ্ছে বোরো ধান।
মার্চ ২০১৭ সালের আগাম বন্যা এবং পাহাড়ী ঢলের প্রভাবে হাওর অঞ্চলে ব্যাপক ফসল ও সম্পদের ক্ষতির ফলে সরকার হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত যথাক্রমে প্রায় ১৫৩ কোটি ও ৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়। ফলশ্রুতিতে হাওরে ফসলের বাম্পার ফলন হয়। ফলে সরকারকে ২০১৭ সালের ন্যায় খাদ্য আমদানী করতে হয়নি।
হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। আগাম বন্যার কারণে হাওরে প্রায়শঃই ধান
উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কৃষকরা দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে পড়ে। প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি
সম্পন্ন কর্মতৎপরতার কারনে ২০১৭ সালের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত আকস্মিক ঝড়ে হাওরের ক্ষতি ক্রমেই
হ্রাস পেয়েছে। হাওর হচ্ছে সারা বাংলাদেশের জন্য একটি ইকোসিস্টেম সার্ভিসের আধার। বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুনামগঞ্জের টাংগুয়ার হাওর পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম। ২০০০ সালের ৬ জানুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাংগুয়ার হাওরকে ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রায় ১শ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত এ হাওরটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মিঠা পানির জলাভূমি। এটি সুন্দরবনের পরই বাংলাদেশের
দ্বিতীয় রামসার স্থান। পরিবেশবাদীদের গবেষণা রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বে বিপন্ন প্রায় বিরল প্রজাতির ২ শতাধিক
পাখি এবং বিপন্ন ১শ৫০ প্রজাতি মাছের সমাগম এ হাওরে। টাংগুয়ায় রয়েছে স্তণ্যপায়ী দুর্লভ জলজ প্রাণী গাঙ্গেয় ডলফিন (শুশুক), খেঁকশিয়াল, উঁদ, বনরুই, গন্ধগোকুল, জংলি বিড়াল। উদ্ভিদের মধ্যে নলখাগড়া, হিজল, করচ, বরুন, রেইনট্রি, পদ্ম, বুরো গোলাপসহ ২শ প্রজাতির অধিক দেখা মেলে।
বাংলাদেশের বিশেষ করে সুনামগঞ্জ জেলার হাওরগুলোর ইকো ট্যুরিজমও হতে পারে। হতে পারে বিকল্প কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের অন্যতম খাত। হাওর এলাকায় প্রয়োজন স্বাস্থ্যসম্মত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার ব্যবহা।
অশিক্ষা, অজ্ঞতা হাওর জনপদকে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে। সুনামগঞ্জ হাওরে শিশুদের জন্য শিক্ষা মাধ্যম শুধু জ্ঞানার্জনের জন্য হলেই চলবে না, শিক্ষা হতে হবে জীবনমুখী ও বাস্তবভিত্তিক। শিক্ষার মাধ্যমে যেন
শিক্ষার্থী তার আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গীর ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে পারে। আশাব্যঞ্জক হলো বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনের সাথে সাথে বর্তমান যুগে ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষায় অংশ গ্রহণের হার
বেড়েছে। প্রতি বছর পাহাড়ি ঢলে প্রচুর পরিমাণে সিলিকা বালি, পলিমাটি হাওর, খাল ও নদীতে এসে জমা হচ্ছে যা বছরে প্রায় ১দশমিক ৪ বিলিয়ন টন এর সাথে ধান ও হাওরের গাছপালার-আগাছা পঁচাও যুক্ত হচ্ছে। এসকল কারণে হাওর, খাল ও নদীর নাব্যতা নষ্ট হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে একদিকে যেমন হাওরের পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে অন্যদিকে পানি ধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। হাওর এলাকার স্বাভাবিক নৌ যোগাযোগ বর্ষা মৌসুমে ঠিক থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে ব্যাহত হচ্ছে। হাওর, খাল ও নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ফ্ল্যাশ ফ্লাড বা পাহাড়ি ঢল ও সামান্য আগাম বৃষ্টির পানিতে হাওরের ধান পানিতে ডুবে যাচ্ছে, কৃষকের ধান নষ্ট হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানকল্পে হাওর, খাল ও নদীকে জাতীয় খনন বা ন্যাশনাল ড্রেজিং বা ক্যাপাটাল ড্রেজিং এর আওতায় নেয়া হয়েছে। হাওর, খাল ও নদীর গভীরতা নিশ্চিত করা গেলে হাওর এলাকার মানুষের যোগাযোগের সহজলভ্যতা নিশ্চিত হবে সাথে সাথে যোগযোগ ব্যয়ও অনেকাংশে কমে যাবে।
হাওর, খাল, ও নদী প্রাথমিক ভাবে পাহাড়ি ঢল, আগাম বন্যা ও অতি বৃষ্টি পানি ধারন করে দুর্যোগের প্রাথমিক
ধাক্কা থেকে হাওরের ফসল রক্ষা করা যাবে। হাওর এলাকায় যে কয়টি নদী ও খাল রয়েছে তা যেন হাওরের অতিরিক্ত পানি এবং বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের পানি দ্রুত চলে যেতে পারে সেজন্য কিশোরগঞ্জ-ভৈরব পর্যন্ত নদীতে ড্রেজিং এর মাধ্যমে নাব্যতানিশ্চিত করতে হবে যাতে পানি নামার স্বাভাবিক পথ সারা বছর ঠিক থাকে। মেইনটিন্যান্স ড্রেজিং অব্যাহত রাখতে হবে অতি বৃষ্টি ও আগাম পাহাড়ি ঢলের হাত থেকে হাওরের ফসল রক্ষা করা যাবে। নদী, খাল ও হাওরের নাব্যতা নিশ্চিত করা গেলে পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশীয় মাছের বিলুপ্তি দূর করা যাবে। যা ইতোমধ্যে হাওরে বিলুপ্ত মিঠা পানির প্রায় ১শ টি প্রজাতির মাছের জাত পুনঃউৎপাদন করা যাবে।
হাওরে বিদ্যমান গাছপালাও মানুষের জ্বালানি কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে হাওরের পরিবেশের ভারসাম্য ও
প্রতিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। হাওরের এ সমস্যা স্বল্প সময়ে সমাধানের জন্য পতিত জমি, বোর ফসল
সংগ্রহের পর পতিত জমি ও ফসল রক্ষার জন্য হাওরের যে বাঁধ রয়েছে তার উপর ধইঞ্চ্যা চাষ করা যেতে পারে।
ধইঞ্চ্যা দ্রুত বর্ধনশীল হওয়ায় স্বল্প সময়ে হাওরে পানি আসার আগে তা জ্বালানী হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী
হবে। ধইঞ্চ্যা গাছের বীজ গো খাদ্য হিসেবে উৎকৃষ্ট যার ফলে গো খাদ্যের সংকট কিছুটা নিরসন হবে। অন্যদিকে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের উপর ধইঞ্চ্যা গাছ রোপন করার কারণে হাওর রক্ষা বাঁধ টেকসই ও মুজবুত হবে সাথে সাথে হাওরের পরিবেশ সুরক্ষা হবে। তাছাড়া ধইঞ্চ্যা গাছের পাতা উৎকৃষ্ট (কম্পোস্ট) জৈব সার হওয়ায় ধান চাষে কম সারের প্রয়োজন হবে। ধইঞ্চ্যা চাষ শস্যার্বতন হিসেবেও কাজ করবে। হাওরের পরিবেশ রক্ষা ও জ্বালানী সমস্যা সমাধানকল্পে দীর্ঘ মেয়াদে হাওরে পানি সহনীয় হিজল করচ, তাল ও কদম গাছ লাগানো যেতে পারে।
এক্ষেত্রে হাওর রক্ষা বাঁধ ও সরকারি পতিত জমিতে বৃক্ষরোপনের জন্য সমবায়ের মাধ্যমে স্থানীয় অংশীজনের
সক্রিয় অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে হাওর ও হাওরের পরিবেশ রক্ষায় স্থানীয় জনগন উৎসাহ পাবে এবং সংকটাপন্ন জীববৈচ্যিতের উন্নয়ন গতিশীল হবে। যা হাওরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি, শীতকালীন হাওরে আগত পরিযায়ী পাখিদের নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিতকরণ এবং হাওরের বজ্রপাতে প্রাণহানী কিছুটা দূর করতে সহায়ক হবে।
অসীম সম্ভাবনা বুকে ধারণ করে জেগে আছে হাওর। দুর্গম এলাকার এ সংগ্রামী মানুষ দুর্যোগ-দুর্বিপাকে দুর্বিসহ
জীবন পার করে থাকে। বর্তমান সরকার হাওরের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচী হাতে নিয়েছে। রাষ্ট্র যদি হাওরের এ
অপর সম্ভাবনা ও সুযোগকে কাজে লাগায়, তাহলে একদিকে যেমন হাওরবাসী উপকৃত হবে, তেমনি দেশ অর্থনীতিতে আরও সমৃদ্ধিশালী অগ্রসরমান হবে। হাওরই হতে পারে আরেক অর্থনৈতিক অঞ্চলের উপযুক্ত পরিবেশ। শুকনা ও বর্ষায় হাওরাঞ্চলের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বহুমুখী ও পরিকল্পিত উপায়ে উদ্যোগ বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিলে খুলে যাবে অপার সম্ভাবনাময় দুয়ার। এই হাওরাঞ্চলের উন্নয়নকে জাতীয় উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করা হলে স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে ১০ বছরের বেশি সময় লাগবেনা।
তবে আশার কথা বর্তমান সরকার হাওরাঞ্চল বিশেষ করে সুনামগঞ্জ এর দিরাই-শাল্লা-আজমিরীগঞ্জ আঞ্চলিক
সড়ক একনেক এ অনুমোদন এর মাধ্যমে হাওরবাসী নতুন স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে।
লেখক: পিআরও, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।