“মায়া” সভ্যতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ১২:৩৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ নভেম্বর ২০২১
  • / ৪৪৭ Time View
মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন:

মানুষের ইতিহাস কি বা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন ১০ হাজার আবার কেউ বলেন ২০ হাজার বছর,কেউবা বলেন আরো পুরোনো। নতুন আবিস্কার পাল্টে দেয় পুরোনো ধারনাকে। অনেকের মতে আদিম মানুষ যখন লিখতে শিখেছিল ,যখন থেকে তারা পাথরে ,গাছের পাতায় সেই সময়ের মানুষের জীবন যাত্রা প্রনালী, তাদের চিন্তা ভাবনা, লিখে রেখে গেছে তখন থেকেই মানুষের ইতিহাসের শুরু আর তার আগের সময় হল প্রাগৈতিহাসিক কাল।

প্রাচীন সভ্যতা মানেই রহস্যে ঘেরা আদি মানববসতি, তাদের সংস্কৃতি, রোমাঞ্চকর ইতিহাস সবমিলিয়ে পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ।পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম মায়া সভ্যতা। এটি শুধু প্রাচীনই নয় বরং সভ্যতার মধ্যে সব থেকে বেশি রহস্যে ঘেরা রয়েছে মায়া সভ্যতা। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা এই স্যেতার রহস্য উন্মোচনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আদিমতম সময়ে মানুষ ছিল যাযাবর। খেয়ে পরে বাচতে তারা ঘুরে বেড়াত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে।

জন্তু জানোয়ারদের মত কোন স্থানের খাবার ফুরিয়ে গেলে তারা রওয়ানা দিত অন্য দিকে। তখন মানুষ চাষাবাস শেখেনি, ফসল ফলাতে শেখেনি , পশুপালন শেখেনি। আগুনের ব্যবহার বা রাধতে শেখেনি তাই খাবার দাবার কাঁচাই খেত, ঘর বাড়ী ছিল না ,তাই বাস করত পাহাড়ের গুহায়, গাছের ডালে। ভাষার ব্যবহার শেখেনি তাই যোগাযোগ ছিল অসংগঠিত শব্দের মাধ্যমে বা দেহভঙ্গীর মাধ্যমে । জন্তু জানোয়ারদের হাত থেকে বাচতে, শিকার করতে, ঘরবাড়ী বানাতে দরকার পড়ল অস্ত্রের আর প্রথম অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছিল পাথর। সেই শুরু হল প্রস্তর যুগ । পুরোনো প্রস্তর যুগের পর এল নতুন প্রস্তর যুগ, এর পর এল ধাতুর যুগ তাম্রযুগ ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি। একে একে সব কিছুই আয়ত্ব করল মানুষ। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল, চাষাবাদ শিখল, আগুনের ব্যবহার শিখল, ধাতু গলিয়ে তৈরী করল অস্ত্র, গড়ে তুলল শহর,গড়ে উঠল সভ্যতা।

ডারউইনের মতে ভাষার উৎপত্তি এবং আগুনের ব্যাবহার এই দুটো জিনিস ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের মাইল ফলক। ভাষা উৎপত্তির ফলে আদিম সে যুগের অনেক কিছুই সে সময়ের মানুষেরা লিখে রেখে গেছেন। ভাষা লেখার গোড়ার দিকে যখন কোন অক্ষর ছিল না তারা মনের ভাব লিপিবদ্ধ করত ছবি দিয়ে। ছবি দিয়ে লেখার এই পদ্ধতি যেমনটি পাওয়া যায় ব্যাবিলনের “হাম্মুরাব্বি’র নিয়মাবলী” বা পিরামিডের দেওয়ালে তা হল চিত্রলিপি । পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গায় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন যুগের সে সভ্যতা। নদীকে ঘিরে এই সমস্ত সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কারন হল খাওয়ার জন্য, গৃহস্থালী কাজের জন্য, কৃষিকাজের জন্য নৌ পরিবহনের জন্য নদী ছিল বিশেষ উপযোগী।

পরাক্রমশালী মায়ানরা ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে সেকোনুস্ক অঞ্চলে তারা বসতি স্থাপন করে। এরপর তারা ধীরে ধীরে পুরো মেসো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে ও বিশাল বিশাল স্থাপত্য
কার্যের শুরু করে। তারা শুধু মধ্য আমেরিকার পরাক্রমশালী জাতিই ছিল না, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষদের তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল। যখন অন্য মানুষেরা জানত না সভ্যতা কী, কীভাবে আবাস গড়তে হয়, সেসময়ই মায়ানরা গড়ে তুলেছিল উঁচু উঁচু স্থাপনা, এগিয়ে গিয়েছিল জ্ঞান আর বিজ্ঞানে। উদ্ভাবন করেছিল এমন অনেক কিছু, যা ঐ সময়ের তো বটেই, বর্তমান মানুষদের কাছেও বিস্ময়ের ব্যাপার। এসব অঞ্চলজুড়ে তাদের শিলালিপি, মৃৎশিল্প ও স্থাপত্য কলার বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়।

আমাজনের ২ মিলিয়ন বর্গমাইল আয়তনের বিশাল জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতা, পৃথিবীর ইতিহাসে যা মায়া সভ্যতা নামে পরিচিত। হাজার হাজার বছর পুরনো এ সভ্যতাকে

আমেরিকাতে স্প্যানিশদের আসার আগে সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতা হিসেবে ধরা হয়। তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত সভ্যতা ছিল এ মায়া সভ্যতা। মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো, গুয়াতেমালা,হন্দুরাস, বেলিজ, এবং এল সালভাদর, এই ৫ দেশে প্রায় তিন সহস্রাব্দী্রও বেশী সময় জুড়ে গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। এই এলাকায় শিকারী যাযাবর মানুষদের বসবাসের সাক্ষ্য পাওয়া যায় ১১ হাজার বছর আগে থেকে। মায়া সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন মেলে ২৬০০ খৃস্টপুর্বাব্দে মেক্সিকোর ইয়াকাটুন উপদ্বীপে। প্রায় একই সময়ে বেলিজের কুয়েলোতে মায়া বসতি গড়ে উঠেছিল=। তৃতীয় খৃস্টাব্দ এ প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন ৩ লক্ষ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তন ছিল মায়া এলাকার।পুরোনো ওলমেক এবং এজটেক সভ্যতার উপর গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যশিল্প,অঙ্ক শাস্ত্র, চিত্রলিপির ব্যবহার, ক্যালেন্ডার বা দিনপঞ্জীর ব্যাবহার প্রভৃতিতে মায়ারা বিশেষ অবদান রেখেছিল। জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাস, রাস্তাঘাট তৈরী, জলাধার নির্মান, বুনন,মৃত্তিকা শিল্প প্রভৃতিতেও মায়ারা ছিল সমান দক্ষ।

মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল ২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ । এ সময় এ অঞ্চলে ৪০টিরও বেশি শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে যার কিছু কিছুর জনসংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি ছিল। এই সময়ে বড়-ধরনের নির্মাণকার্য, শিল্পকর্মের উন্নয়ন ও কৃষির অভাবনীয় বিকাশ সাধন হয়েছিল। তারা পাথরের বিশাল অবকাঠামো দিয়ে শহর নির্মাণ করেছিল। প্রত্যেক মায়া নগররাষ্ট্রে একটা করে স্থানীয় রাজা বা আহাও থাকতেন।

তিনি বসবাস করতেন রাজপ্রাসাদে। তার সঙ্গে বিশাল রাজপরিবারও ওই রাজপ্রাসাদে থাকত। প্রত্যেক রাজপ্রাসাদের উত্তর প্রান্তে থাকত একটা বাণিজ্য কুঠি, বড় রাস্তা এবং দক্ষিণ প্রান্তে থাকত পিরামিড এবং কৃষিজমি। মায়া সভ্যতায় বিভিন্ন রাজ্যের মাঝে সংঘাতের ঘটনাও দেখা যায়। আর এ বিষয়টি দেখা গেছে হলমুলের ক্ষেত্রে। হলমুল শহরটি তেমন বড় কিংবা বিখ্যাত নয় টিকালের মতো। ২০০০ সাল পর্যন্ত এ শহরটি সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানলেও সেভাবে গুরুত্ব দেননি।

মায়া সভ্যতা বিখ্যাত হয়ে আছে তাদের স্থাপত্যশিল্প, বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি, পিরামিড আর মূর্তিগুলোর জন্য। এখনও মায়া সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের তৈরি পিরামিড, ঘরবাড়ি, প্রাসাদ আর অট্টালিকা। তারা এসব ঘরবাড়ি বানাত লাইমস্টোন নামের এক ধরনের পাথর দিয়ে। আর সেই পাথরগুলোকে সুন্দর মসৃণ করতে ব্যবহার করতো সিমেন্টের মতো একধরনের পদার্থ। আর সেগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হাজার হাজার শ্রমিক দিনের পর দিন পরিশ্রম করত। তবেই না তৈরি হতো বিশাল বিশাল আর সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি-পিরামিড-প্রাসাদ-অট্টালিকা। মায়ানদের শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণের পদ্ধতি ও ভাষাও ছিল অদ্ভুত। তারা একটার পর আরেকটা বর্ণ লিখত না। এমনকি লেখার জন্য তারা কোনো বর্ণই ব্যবহার করত না; লিখত ছবি বা লোগো দিয়ে।  শুধু তাই না, মায়ানরা সেই সময়েই গণিতে ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বেশ অবদান রেখেছিল মায়ানরা। খালি চোখেই গ্রহ নক্ষত্রদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে হিসেব করে তাদের গতি-প্রকৃতি তারাই প্রথম নির্ণয় করেছিল। তারা সূর্য ও আকাশের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি নির্ভুল বর্ষপঞ্জিকা বানাতে পেরেছিল যা তাদের কৃষিতে সহায়তা করত।

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম মায়ারাই ১ বছরে ৩৬৫ দিন আছে তা আবিষ্কার করতে পেরেছিল। মায়ানরা বৃহস্পতি, মঙ্গল একং বুধ গ্রহ সম্পর্কেও নানা তথ্য সংগ্রহ করেছিল। অর্থাৎ, হাজার বছর আগেই মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তারা নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল, তা-ও আবার খ্রিস্টপূর্ব সময়েই! ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকেই মায়ানদের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে নয়, নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করে নিয়েছিল তারা।

মায়ানরা খেলাধুলাপ্রেমী ছিল। তাদের প্রতিটি শহরেই বল কোর্ট থাকত। এই বল কোর্টগুলোর আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে আজকের দিনের স্টেডিয়াম। মায়ানরা তাদের বিভিন্ন উৎসবে এই বল কোর্টে খেলার আয়োজন করত। বল কোর্টগুলো দেব-দেবীর পায়ের কাছাকাছি তৈরি করা হতো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। মায়ানরা পক-এ-টক নামে একটা খেলা খেলত। মায়ানরা তাদের নিজস্ব চেষ্টায় আজকের দিনের মতো বাউন্সি বল আবিষ্কার করে ফেলেছিলো সে সময়েই।

মায়ানদের চিকিৎসাবিদ্যা অনেক আধুনিক ছিল। তারা শরীরের ক্ষত মানুষের চুল দিয়েই সেলাই করে ফেলত। দাঁতের গর্ত পূরণ করা, এমনকি নকল পা লাগানোতেও পারদর্শী ছিলেন তারা। ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ‘পোকা’ধরা দাঁতে চুন বা ধাতব ফিলিং করতে পারদর্শী ছিলেন প্রাচীন মায়া সভ্যতার চিকিৎসকরা। মায়ানরা প্রকৃতি থেকে ব্যথানাশক জরি-বুটি সংগ্রহ করত। সেই সব গাছ-গাছড়া তারা পূজায় ব্যবহার করত ধর্মীয় রীতি অনুসারে, আবার ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করত রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য, কিংবা সুস্থ করার জন্য। মায়ানরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে তাদের আরাধ্য দেবতা ভেবে পূজা করত। আর এই পূজার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নরবলি দেওয়া। তারা তাদের আরাধ্য দেবতাদের খুশি করার জন্য নরবলি দিত।

সোজা কথায় মানুষ কোরবানি দিত! আর এই বলি দেওয়া হতো তাদের নিজেদের গোষ্ঠীর কাউকে নয়, অন্য গোত্রের মানুষের। মায়ানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর চিচেন ইতজা ছিল নরবলিরও অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। এই শহরে দুটি প্রধান প্রাকৃতিক জলাধার ছিল, ওগুলো থেকে পুরো শহরে খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হতো। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটি শিনত সাগ্রাড, সেটাতেই বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলি করা হতো। আর এ কারণেই এই জলাধারটির আরেক নাম ছিল উৎসর্গের জলাধার। মায়ানরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত বিনিময় প্রথায়, তখনো টাকা পয়সার প্রচলন ছিল না। এ ছাড়া তারা লবণ পাথরেরও বিকিকিনি করত। আর তাদের এ বাণিজ্য নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করত।

শিশুর জন্মের কয়েক মাসের পর থেকেই তার কপালের উপর ভারী সমতল পাথর বা ধাতব বস্তু চেপে রাখা হত টানা কয়েক বছর। এই ফলে কপালের গড়ন পাল্টে চ্যাপ্টা, প্রায় সমতল আকার নিত। এই প্রথা চালু ছিল বিশেষত সম্ভ্রান্ত রাজ বংশের মধ্যেই। অন্যভাবে বলতে গেলে, অভিজাত মায়ান পরিবারে মায়েরা শিশুদের কপাল ঘষত যাতে চ্যাপ্টা কপাল হয়। মায়া সভ্যতার প্রায় বেশির ভাগ মানুষের চোখ ট্যারা ছিল।

প্রচলিত কিছু ধর্ম বিশ্বাসের কারণে একটি শিশুর জন্মের পর থেকেই তার চোখের খুব কাছে কোনও বস্তুকে নিয়মিত ধরে রাখা হত যত দিন না দু’চোখের মণি দুটি স্থায়িভাবে পাশাপাশি চলে আসে কিংবা দু’টি চোখ ট্যারা হয়ে যায়। মায়া সভ্যতায় সদ্যোজাত শিশুর নামকরণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি অনুসরণ করা হত। বছরের যে দিনে শিশুর জন্ম হচ্ছে সেই দিনটির নাম অনুসারে শিশুর নামকরণ করা হত। জন্মের সময়ের ফারাক অনুযায়ী একই দিনে জন্মানো শিশুদের নামেরও কিছু ফারাক থাকতো। মায়া সভ্যতায় সদ্যোজাত শিশুর নামকরণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি অনুসরণ করা হত। মায়ান সভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ৯০০-১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।কী কারণে মায়া সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল।

কেউ বলেন, মহামারির কারণে, কেউ বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় খাবারের অপর্যাপ্ততার কারণে,আবার কেউ বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে একসঙ্গে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৪৫০ সালে পুরো মধ্য আমেরিকায় বিপ্লব সংঘঠিত হয়।তখন মায়ানরা আরো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মায়া সভ্যতার কিছু অংশ আবার স্প্যানিশরা দখল করে নেয়। শেষমেশ ১৬৯৭ সালে এসে পুরো মায়া সভ্যতাই স্প্যানিয়ার্ডদের দখলে আসে।

মায়ানরা এখনও পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়নি। ওদের পূর্বপুরুষদের স্থাপনাগুলো যেমন সগৌরবে এখনো দাড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকে, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে, তেমনি এখনও মধ্য আমেরিকায় প্রায় ৬০-৭০লাখ মায়ান বাস করছে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, (তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

Please Share This Post in Your Social Media

“মায়া” সভ্যতা

Update Time : ১২:৩৮:৪৭ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ নভেম্বর ২০২১
মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন:

মানুষের ইতিহাস কি বা কবে থেকে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন ১০ হাজার আবার কেউ বলেন ২০ হাজার বছর,কেউবা বলেন আরো পুরোনো। নতুন আবিস্কার পাল্টে দেয় পুরোনো ধারনাকে। অনেকের মতে আদিম মানুষ যখন লিখতে শিখেছিল ,যখন থেকে তারা পাথরে ,গাছের পাতায় সেই সময়ের মানুষের জীবন যাত্রা প্রনালী, তাদের চিন্তা ভাবনা, লিখে রেখে গেছে তখন থেকেই মানুষের ইতিহাসের শুরু আর তার আগের সময় হল প্রাগৈতিহাসিক কাল।

প্রাচীন সভ্যতা মানেই রহস্যে ঘেরা আদি মানববসতি, তাদের সংস্কৃতি, রোমাঞ্চকর ইতিহাস সবমিলিয়ে পূর্বপুরুষদের সম্পর্কে জানার প্রবল আগ্রহ।পৃথিবীর প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যতম মায়া সভ্যতা। এটি শুধু প্রাচীনই নয় বরং সভ্যতার মধ্যে সব থেকে বেশি রহস্যে ঘেরা রয়েছে মায়া সভ্যতা। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা এই স্যেতার রহস্য উন্মোচনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আদিমতম সময়ে মানুষ ছিল যাযাবর। খেয়ে পরে বাচতে তারা ঘুরে বেড়াত এক স্থান থেকে আরেক স্থানে।

জন্তু জানোয়ারদের মত কোন স্থানের খাবার ফুরিয়ে গেলে তারা রওয়ানা দিত অন্য দিকে। তখন মানুষ চাষাবাস শেখেনি, ফসল ফলাতে শেখেনি , পশুপালন শেখেনি। আগুনের ব্যবহার বা রাধতে শেখেনি তাই খাবার দাবার কাঁচাই খেত, ঘর বাড়ী ছিল না ,তাই বাস করত পাহাড়ের গুহায়, গাছের ডালে। ভাষার ব্যবহার শেখেনি তাই যোগাযোগ ছিল অসংগঠিত শব্দের মাধ্যমে বা দেহভঙ্গীর মাধ্যমে । জন্তু জানোয়ারদের হাত থেকে বাচতে, শিকার করতে, ঘরবাড়ী বানাতে দরকার পড়ল অস্ত্রের আর প্রথম অস্ত্র হিসেবে হাতে তুলে নিয়েছিল পাথর। সেই শুরু হল প্রস্তর যুগ । পুরোনো প্রস্তর যুগের পর এল নতুন প্রস্তর যুগ, এর পর এল ধাতুর যুগ তাম্রযুগ ব্রোঞ্জ যুগ ইত্যাদি। একে একে সব কিছুই আয়ত্ব করল মানুষ। ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তারা যাযাবর বৃত্তি ছেড়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করল, চাষাবাদ শিখল, আগুনের ব্যবহার শিখল, ধাতু গলিয়ে তৈরী করল অস্ত্র, গড়ে তুলল শহর,গড়ে উঠল সভ্যতা।

ডারউইনের মতে ভাষার উৎপত্তি এবং আগুনের ব্যাবহার এই দুটো জিনিস ছিল মানব সভ্যতার ইতিহাসের মাইল ফলক। ভাষা উৎপত্তির ফলে আদিম সে যুগের অনেক কিছুই সে সময়ের মানুষেরা লিখে রেখে গেছেন। ভাষা লেখার গোড়ার দিকে যখন কোন অক্ষর ছিল না তারা মনের ভাব লিপিবদ্ধ করত ছবি দিয়ে। ছবি দিয়ে লেখার এই পদ্ধতি যেমনটি পাওয়া যায় ব্যাবিলনের “হাম্মুরাব্বি’র নিয়মাবলী” বা পিরামিডের দেওয়ালে তা হল চিত্রলিপি । পৃথিবীর বিভিন্ন যায়গায় গড়ে উঠেছিল প্রাচীন যুগের সে সভ্যতা। নদীকে ঘিরে এই সমস্ত সভ্যতাই গড়ে উঠেছিল কারন হল খাওয়ার জন্য, গৃহস্থালী কাজের জন্য, কৃষিকাজের জন্য নৌ পরিবহনের জন্য নদী ছিল বিশেষ উপযোগী।

পরাক্রমশালী মায়ানরা ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে সেকোনুস্ক অঞ্চলে তারা বসতি স্থাপন করে। এরপর তারা ধীরে ধীরে পুরো মেসো আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে ও বিশাল বিশাল স্থাপত্য
কার্যের শুরু করে। তারা শুধু মধ্য আমেরিকার পরাক্রমশালী জাতিই ছিল না, পৃথিবীর অন্য প্রান্তের মানুষদের তুলনায় কয়েক ধাপ এগিয়ে ছিল। যখন অন্য মানুষেরা জানত না সভ্যতা কী, কীভাবে আবাস গড়তে হয়, সেসময়ই মায়ানরা গড়ে তুলেছিল উঁচু উঁচু স্থাপনা, এগিয়ে গিয়েছিল জ্ঞান আর বিজ্ঞানে। উদ্ভাবন করেছিল এমন অনেক কিছু, যা ঐ সময়ের তো বটেই, বর্তমান মানুষদের কাছেও বিস্ময়ের ব্যাপার। এসব অঞ্চলজুড়ে তাদের শিলালিপি, মৃৎশিল্প ও স্থাপত্য কলার বিভিন্ন নিদর্শন পাওয়া যায়।

আমাজনের ২ মিলিয়ন বর্গমাইল আয়তনের বিশাল জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক রহস্যময় প্রাচীন সভ্যতা, পৃথিবীর ইতিহাসে যা মায়া সভ্যতা নামে পরিচিত। হাজার হাজার বছর পুরনো এ সভ্যতাকে

আমেরিকাতে স্প্যানিশদের আসার আগে সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতা হিসেবে ধরা হয়। তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক ও উন্নত সভ্যতা ছিল এ মায়া সভ্যতা। মধ্য আমেরিকার মেক্সিকো, গুয়াতেমালা,হন্দুরাস, বেলিজ, এবং এল সালভাদর, এই ৫ দেশে প্রায় তিন সহস্রাব্দী্রও বেশী সময় জুড়ে গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। এই এলাকায় শিকারী যাযাবর মানুষদের বসবাসের সাক্ষ্য পাওয়া যায় ১১ হাজার বছর আগে থেকে। মায়া সভ্যতার প্রাচীনতম নিদর্শন মেলে ২৬০০ খৃস্টপুর্বাব্দে মেক্সিকোর ইয়াকাটুন উপদ্বীপে। প্রায় একই সময়ে বেলিজের কুয়েলোতে মায়া বসতি গড়ে উঠেছিল=। তৃতীয় খৃস্টাব্দ এ প্রায় নিরবিচ্ছিন্ন ৩ লক্ষ ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তন ছিল মায়া এলাকার।পুরোনো ওলমেক এবং এজটেক সভ্যতার উপর গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। জ্যোতির্বিদ্যা, স্থাপত্যশিল্প,অঙ্ক শাস্ত্র, চিত্রলিপির ব্যবহার, ক্যালেন্ডার বা দিনপঞ্জীর ব্যাবহার প্রভৃতিতে মায়ারা বিশেষ অবদান রেখেছিল। জঙ্গল পরিস্কার করে চাষাবাস, রাস্তাঘাট তৈরী, জলাধার নির্মান, বুনন,মৃত্তিকা শিল্প প্রভৃতিতেও মায়ারা ছিল সমান দক্ষ।

মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ ছিল ২৫০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ । এ সময় এ অঞ্চলে ৪০টিরও বেশি শহর প্রতিষ্ঠা লাভ করে যার কিছু কিছুর জনসংখ্যা ৫০ হাজারেরও বেশি ছিল। এই সময়ে বড়-ধরনের নির্মাণকার্য, শিল্পকর্মের উন্নয়ন ও কৃষির অভাবনীয় বিকাশ সাধন হয়েছিল। তারা পাথরের বিশাল অবকাঠামো দিয়ে শহর নির্মাণ করেছিল। প্রত্যেক মায়া নগররাষ্ট্রে একটা করে স্থানীয় রাজা বা আহাও থাকতেন।

তিনি বসবাস করতেন রাজপ্রাসাদে। তার সঙ্গে বিশাল রাজপরিবারও ওই রাজপ্রাসাদে থাকত। প্রত্যেক রাজপ্রাসাদের উত্তর প্রান্তে থাকত একটা বাণিজ্য কুঠি, বড় রাস্তা এবং দক্ষিণ প্রান্তে থাকত পিরামিড এবং কৃষিজমি। মায়া সভ্যতায় বিভিন্ন রাজ্যের মাঝে সংঘাতের ঘটনাও দেখা যায়। আর এ বিষয়টি দেখা গেছে হলমুলের ক্ষেত্রে। হলমুল শহরটি তেমন বড় কিংবা বিখ্যাত নয় টিকালের মতো। ২০০০ সাল পর্যন্ত এ শহরটি সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানলেও সেভাবে গুরুত্ব দেননি।

মায়া সভ্যতা বিখ্যাত হয়ে আছে তাদের স্থাপত্যশিল্প, বিশাল বিশাল ঘরবাড়ি, পিরামিড আর মূর্তিগুলোর জন্য। এখনও মায়া সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের তৈরি পিরামিড, ঘরবাড়ি, প্রাসাদ আর অট্টালিকা। তারা এসব ঘরবাড়ি বানাত লাইমস্টোন নামের এক ধরনের পাথর দিয়ে। আর সেই পাথরগুলোকে সুন্দর মসৃণ করতে ব্যবহার করতো সিমেন্টের মতো একধরনের পদার্থ। আর সেগুলো দিয়ে ঘরবাড়ি তৈরি করতে হাজার হাজার শ্রমিক দিনের পর দিন পরিশ্রম করত। তবেই না তৈরি হতো বিশাল বিশাল আর সুন্দর সুন্দর সব ঘরবাড়ি-পিরামিড-প্রাসাদ-অট্টালিকা। মায়ানদের শুধু ঘরবাড়ি নির্মাণের পদ্ধতি ও ভাষাও ছিল অদ্ভুত। তারা একটার পর আরেকটা বর্ণ লিখত না। এমনকি লেখার জন্য তারা কোনো বর্ণই ব্যবহার করত না; লিখত ছবি বা লোগো দিয়ে।  শুধু তাই না, মায়ানরা সেই সময়েই গণিতে ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেও বেশ অবদান রেখেছিল মায়ানরা। খালি চোখেই গ্রহ নক্ষত্রদের চলাফেরা পর্যবেক্ষণ করে হিসেব করে তাদের গতি-প্রকৃতি তারাই প্রথম নির্ণয় করেছিল। তারা সূর্য ও আকাশের পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি নির্ভুল বর্ষপঞ্জিকা বানাতে পেরেছিল যা তাদের কৃষিতে সহায়তা করত।

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম মায়ারাই ১ বছরে ৩৬৫ দিন আছে তা আবিষ্কার করতে পেরেছিল। মায়ানরা বৃহস্পতি, মঙ্গল একং বুধ গ্রহ সম্পর্কেও নানা তথ্য সংগ্রহ করেছিল। অর্থাৎ, হাজার বছর আগেই মায়ানরা জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। তারা নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল, তা-ও আবার খ্রিস্টপূর্ব সময়েই! ধারণা করা হয়, খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী থেকেই মায়ানদের ক্যালেন্ডার প্রচলিত ছিল। অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে নয়, নিজেদের প্রয়োজনে নিজেরাই নিজেদের ক্যালেন্ডার তৈরি করে নিয়েছিল তারা।

মায়ানরা খেলাধুলাপ্রেমী ছিল। তাদের প্রতিটি শহরেই বল কোর্ট থাকত। এই বল কোর্টগুলোর আধুনিক সংস্করণ হচ্ছে আজকের দিনের স্টেডিয়াম। মায়ানরা তাদের বিভিন্ন উৎসবে এই বল কোর্টে খেলার আয়োজন করত। বল কোর্টগুলো দেব-দেবীর পায়ের কাছাকাছি তৈরি করা হতো তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে। মায়ানরা পক-এ-টক নামে একটা খেলা খেলত। মায়ানরা তাদের নিজস্ব চেষ্টায় আজকের দিনের মতো বাউন্সি বল আবিষ্কার করে ফেলেছিলো সে সময়েই।

মায়ানদের চিকিৎসাবিদ্যা অনেক আধুনিক ছিল। তারা শরীরের ক্ষত মানুষের চুল দিয়েই সেলাই করে ফেলত। দাঁতের গর্ত পূরণ করা, এমনকি নকল পা লাগানোতেও পারদর্শী ছিলেন তারা। ভাঙা হাড় জোড়া দেওয়া থেকে শুরু করে ‘পোকা’ধরা দাঁতে চুন বা ধাতব ফিলিং করতে পারদর্শী ছিলেন প্রাচীন মায়া সভ্যতার চিকিৎসকরা। মায়ানরা প্রকৃতি থেকে ব্যথানাশক জরি-বুটি সংগ্রহ করত। সেই সব গাছ-গাছড়া তারা পূজায় ব্যবহার করত ধর্মীয় রীতি অনুসারে, আবার ঔষধ হিসেবেও ব্যবহার করত রোগীকে অজ্ঞান করার জন্য, কিংবা সুস্থ করার জন্য। মায়ানরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে তাদের আরাধ্য দেবতা ভেবে পূজা করত। আর এই পূজার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল নরবলি দেওয়া। তারা তাদের আরাধ্য দেবতাদের খুশি করার জন্য নরবলি দিত।

সোজা কথায় মানুষ কোরবানি দিত! আর এই বলি দেওয়া হতো তাদের নিজেদের গোষ্ঠীর কাউকে নয়, অন্য গোত্রের মানুষের। মায়ানদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর চিচেন ইতজা ছিল নরবলিরও অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। এই শহরে দুটি প্রধান প্রাকৃতিক জলাধার ছিল, ওগুলো থেকে পুরো শহরে খাওয়ার পানি সরবরাহ করা হতো। এদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যেটি শিনত সাগ্রাড, সেটাতেই বৃষ্টির দেবতার উদ্দেশ্যে নরবলি করা হতো। আর এ কারণেই এই জলাধারটির আরেক নাম ছিল উৎসর্গের জলাধার। মায়ানরা ব্যবসা-বাণিজ্য করত বিনিময় প্রথায়, তখনো টাকা পয়সার প্রচলন ছিল না। এ ছাড়া তারা লবণ পাথরেরও বিকিকিনি করত। আর তাদের এ বাণিজ্য নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, অন্যান্য জনগোষ্ঠীর সঙ্গেও তারা ব্যবসা-বাণিজ্য করত।

শিশুর জন্মের কয়েক মাসের পর থেকেই তার কপালের উপর ভারী সমতল পাথর বা ধাতব বস্তু চেপে রাখা হত টানা কয়েক বছর। এই ফলে কপালের গড়ন পাল্টে চ্যাপ্টা, প্রায় সমতল আকার নিত। এই প্রথা চালু ছিল বিশেষত সম্ভ্রান্ত রাজ বংশের মধ্যেই। অন্যভাবে বলতে গেলে, অভিজাত মায়ান পরিবারে মায়েরা শিশুদের কপাল ঘষত যাতে চ্যাপ্টা কপাল হয়। মায়া সভ্যতার প্রায় বেশির ভাগ মানুষের চোখ ট্যারা ছিল।

প্রচলিত কিছু ধর্ম বিশ্বাসের কারণে একটি শিশুর জন্মের পর থেকেই তার চোখের খুব কাছে কোনও বস্তুকে নিয়মিত ধরে রাখা হত যত দিন না দু’চোখের মণি দুটি স্থায়িভাবে পাশাপাশি চলে আসে কিংবা দু’টি চোখ ট্যারা হয়ে যায়। মায়া সভ্যতায় সদ্যোজাত শিশুর নামকরণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি অনুসরণ করা হত। বছরের যে দিনে শিশুর জন্ম হচ্ছে সেই দিনটির নাম অনুসারে শিশুর নামকরণ করা হত। জন্মের সময়ের ফারাক অনুযায়ী একই দিনে জন্মানো শিশুদের নামেরও কিছু ফারাক থাকতো। মায়া সভ্যতায় সদ্যোজাত শিশুর নামকরণের ক্ষেত্রে একটি বিশেষ রীতি অনুসরণ করা হত। মায়ান সভ্যতা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে ৯০০-১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে।কী কারণে মায়া সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল।

কেউ বলেন, মহামারির কারণে, কেউ বলেন, জনসংখ্যার তুলনায় খাবারের অপর্যাপ্ততার কারণে,আবার কেউ বলেন, পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে একসঙ্গে অনেক মানুষ মারা গিয়েছিল। ১৪৫০ সালে পুরো মধ্য আমেরিকায় বিপ্লব সংঘঠিত হয়।তখন মায়ানরা আরো ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে যায়। মায়া সভ্যতার কিছু অংশ আবার স্প্যানিশরা দখল করে নেয়। শেষমেশ ১৬৯৭ সালে এসে পুরো মায়া সভ্যতাই স্প্যানিয়ার্ডদের দখলে আসে।

মায়ানরা এখনও পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায়নি। ওদের পূর্বপুরুষদের স্থাপনাগুলো যেমন সগৌরবে এখনো দাড়িয়ে আছে পৃথিবীর বুকে, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হয়ে, তেমনি এখনও মধ্য আমেরিকায় প্রায় ৬০-৭০লাখ মায়ান বাস করছে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বজায় রেখে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, (তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।