বিজয়ের স্মৃতি

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৫:৫৭:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০
  • / ২৫৩ Time View

খুররম মমতাজ:

একাত্তরের ডিসেম্বর মাস, ১৬ তারিখ। ঢাকার অদূরে রুহিতপুর গ্রাম। গ্রামের স্কুলে ক্যাম্প করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। দলে আছে বিশ-বাইশজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দলে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি আর আমার বন্ধু মঞ্জুও আছি। আমরা দু’জনেই তখন ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে রুহিতপুর গ্রামের অনেক বাড়িতে গোপনে ট্রেনিং দেয়া হতো মুক্তিপাগল তরুণ ছেলেদের। তিন-চারজনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এরা থাকত বাড়িগুলোতে। দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হওয়া ছিল নিষেধ। রাতে হারিকেনের আলোয় শুরু হতো ট্রেনিং। শেখানো হতো গ্রেনেড, স্মল আর্মস আর এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার। তিনজনের এমনই একটি ছোট দলে সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকা থেকে এই গ্রামে এসেছিলাম ফুলার রোডের আমরা তিনজন- আমি, মঞ্জু আর মোহন।

রাতের আঁধারে উঠানে হতো লেফ্ট-রাইট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত ট্রেনিং। আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোটখাটো আর দুবলা-পাতলা। ভারি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল কাঁধে নিয়ে বারবার মাটিতে শুয়ে পজিশন নিতে হতো ট্রেনিংয়ের সময়। কাজটা বেশ কঠিন ছিল আমার জন্য। একনাগাড়ে কয়েকবার করার পর হাঁপিয়ে যেতাম। কিন্তু ঘরের ভেতর প্রশিক্ষক যখন গ্রেনেড কিংবা স্টেনগানের অংশগুলো খুলে খুলে দেখাতেন, হারিকেনের আলোয় চকচক করত কালো ইস্পাত, তখন আমার বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠত। মনে হতো এসব ছোট ছোট অস্ত্র দিয়েই একদিন ঠিক হবে- কার জয় কার পরাজয়।

সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং শেষে সেবার ফিরে গিয়েছিলাম ঢাকায়, বাবা-মা ভাই-বোনের মাঝে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফ্ল্যাটে। অবরুদ্ধ ঢাকা শহর তখন শত্রুপুরি। পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন যাকে খুশি তুলে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলছে, পুরো শহর তাদের দখলে। তবে বিদেশী সাংবাদিকদের মাধ্যমে ততদিনে এই খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে যে পাকিস্তানী জান্তা ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে পূর্ব-পাকিস্তানে। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করছে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়। এদিকে পাকিস্তানী জান্তা মরিয়া হয়ে প্রমাণ করতে চাচ্ছে এসব সত্য নয়, এখানে সবকিছু ঠিকঠাক আছে- মুক্তিযুদ্ধ অথবা মুক্তিযোদ্ধা বলে কিছু নাই, সব ভারতের অপপ্রচার।

২৯ আগস্ট রাতে গ্রেফতার হয় ঢাকা শহরে সক্রিয় ক্র্যাক প্লাটুনের দল, যার সদস্য ছিল রুমি-বদি-জুয়েলরা। গ্রেফতার হয়ে যান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের বিখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ। এর আগে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে ঢাকা শহরে গেরিলা দলগুলো ছোট-বড় অনেক সফল অপারেশন চালায়। এর উদ্দেশ্য ছিল একদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যতিব্যস্ত রাখা, তাদের রাতের ঘুম দিনের আরাম হারাম করে দেয়া। অন্যদিকে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের জানান দেয়া যে এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করছে সারাদেশ- এমনকি রাজধানী ঢাকা শহরেও গেরিলারা দিনে দুপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে- একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে পাওয়ার স্টেশনে, টিভি সেন্টারে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই উপস্থিতি জানান দেয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল, যাতে বিশ্ব-জনমত আমাদের পক্ষে থাকে।

এরকম কিছু উদ্দেশ্য সামনে রেখে ডিআইটি ভবনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যার ওপরতলায় ছিল টিভি স্টুডিও এবং এ্যান্টেনা, উড়িয়ে দেয়া হয় সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, বোমা ফাটানো হয় হোটেল ইন্টারকনে, এখন যেটা শেরাটন হোটেল- এটাই ছিল সেই সময় ঢাকা শহরে একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের হোটেল- এই হোটেলে থাকতেন বিদেশী সাংবাদিকরা এবং আন্তর্জাতিক ডেলিগেট।

রুমিদের দলটি গ্রেফতার হওয়ার পর কিছুদিনের জন্য থমকে যায় ঢাকা শহরে গেরিলাদের কর্মকাণ্ড। কিন্তু তা মাত্র দু-তিন সপ্তাহের জন্য। তারপরই আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে অনেকগুলো দল একসঙ্গে। সেপ্টেম্বরের শেষে আবার শোনা যায় গেরিলাদের নিঃশঙ্ক পদচারণা, শোনা যেতে থাকে এখানে ওখানে বিস্ফোরণের শব্দ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে তারা আঘাত হানতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনীর দুর্গে।

এর একটা মনস্তাত্ত্বিক দিকও ছিল। অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের বন্দী বাসিন্দারা তখন বিষ্ফোরণের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে থাকত, উদগ্রীব হয়ে থাকত। এই শব্দ তাদের সাহস জোগাতো, মনে আশা-ভরসা দিত যে তাদের দামাল ছেলেরা ঘুমিয়ে নেই, জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ একে বলতেন ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’- মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।

সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শুরু হলো ঢাকা শহরে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের দ্বিতীয় ঢেউ। ছোট-বড় অনেক গেরিলা দল একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের নির্দেশ দেয়া হলো সুযোগমতো বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা ফাটাও, শত্রুর দুর্গে আঘাত হানো যে যেখানে পার। আমাদের দলটাকেও একটা অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হলো। আমরা থাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়- আমি, মঞ্জু, মোহন, মোমিন- ফুলার রোডের বিচ্ছুরা। এখান থেকে হোটেল ইন্টারকন বেশি দূরে নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিস্ফোরণ হলে হোটেলে থাকা বিদেশী সাংবাদিকরা তা শুনতে পাবে। এই উদ্দেশ্যে সলিমুল্লাহ হলের পূর্ব দিকের ট্রান্সফর্মারটি ওড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। আমরা তা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম শব-ই-বরাতের রাতে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হলো, কেঁপে উঠল সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নেমে এলো অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতরে ছুটতে ছুটতে আমার বন্ধু চাপা গলায় বলে উঠলো, ‘শ-ই-বরাতের বাজি ফোটালাম! জয় বাংলা!’

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আমি আর মঞ্জু আবার এলাম রুহিতপুর ক্যাম্পে। সেখানে আগে থেকেই ছিল অনেক মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। হাড় কাঁপানো শীত। রাতের বেলা বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু-হু করে ঠাণ্ডা বাতাস আসে। টিনের চালে হিম আর কুয়াশা। মেঝেতে খড়ের বিছানা পাতা।

নানারকম কথা শোনা যায়। চূড়ান্ত আঘাত হানা হবে ঢাকার ওপর। পাকবাহিনীর শেষ দুর্গ এখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। ঢাকার পতন হলেই বিজয় হবে আমাদের। সেই লক্ষ্যে ঢাকার চারপাশে জড়ো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে। ছিন্নবস্ত্র নগ্নপায়ে আছে তারা। তাদের পেটে খাবার নাই, গায়ে গরম কাপড় নাই। গত নয় মাস এক আস্তানা থেকে আরেক আস্তানায়, এক ঘাঁটি থেকে আরেক ঘাঁটিতে ছুটেছে তারা। পথে ভয় শঙ্কা আর মৃত্যু ছিল পায়ে পায়ে, ছায়ার মতো। প্রতি মুহূর্তে শত্রুর আঘাত কিংবা পাল্টা আঘাতের চিন্তা। অথবা নিঃশব্দে পিছু হটে যাওয়া। কখনও দিনে কখনও রাতের অন্ধকারে। মুখে তাদের একটাই উচ্চারণ- ‘জয় বাংলা’ আর বুকের ভেতরে একটাই স্বপ্ন ‘স্বাধীনতা’।

ক্যাম্পে আমরা অপেক্ষা করি নির্দেশের। কবে নির্দেশ আসবে- ঢাকা চলো। নির্দেশ আর আসে না। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল ক্যাম্পে। প্রথমে ফিসফিস গুঞ্জন, তারপর সবাই বলতে থাকে, ‘স্বাধীন! স্বাধীন! স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা!’ ঢাকা থেকে খবর এসেছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে আজই। রেসকোর্স ময়দানে। চলো চলো, ঢাকা চলো সবাই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম আমরা। তবে, যে খবর এসেছে তা কতটুকু সত্য কে জানে। প্রতিদিনই সত্য-মিথ্যা নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে। তাই ব্যাগের ভেতরে নেয়া হলো স্টেনগান আর গ্রেনেড।

ছয়জনের দলটা চলেছে গ্রামের পথে হনহনিয়ে। দু’পাশে হলুদ কার্পেটের মতো সর্ষের ক্ষেত। তার ওপর এসে পড়েছে ডিসেম্বরের শেষ বিকেলের নরম রোদ। সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে দেখা গেল একটা নৌকাও নাই। জনহীন নদীর তীর- পার হবো কীভাবে? শেষমেশ বহু খোঁজাখুঁজির পর নৌকা আর মাঝি দু’টোই পাওয়া গেল। কোনাকুনি নদী পাড়ি দিচ্ছে মাঝি। অন্ধকার রাত। কালো জলে ছপাস ছপাস দাঁড়ের শব্দ। একটু পরেই ওপারে পৌঁছে যাব আমরা। কিন্তু কী অপেক্ষা করছে ওখানে আমাদের জন্য? আনন্দ, বেদনা, দুঃখ নাকি হতাশা…?

যুদ্ধ শেষে ফুলার রোডে ফিরে জানতে পারলাম অনেক কিছু- জানা গেল শহীদ শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের কথা। তাদের মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবা আছেন, ডাক্তার মোর্তজা আছেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আছেন- যাদের আমরা প্রতিদিন দেখেছি ফুলার রোডের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সকাল-বিকেল। তাদের হত্যা করেছে আলবদর বাহিনী। আবার শিক্ষক নামের কলঙ্ক এমন কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন শান্তি কমিটিতে। তারা সহায়তা করেছেন আলবদর বাহিনীকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষ দুটি ধারা তখন থেকেই শুরু হলো। স্বাধীনতার পর বিপক্ষ শক্তি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল, ঘাপটি মেরে ছিল। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর তারা আবার প্রকাশ্যে এলো। যতই দিন গড়াল ততই স্পষ্ট হলো পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন।

স্বাধীনতার পর পার হয়ে গেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী। আজকে আবার সেই দিনটি এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব আমরা। এখন হিসেব-নিকেশ মেলাবার পালা। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাদের বিচার হয়েছে বাংলার মাটিতে। বিচারে শাস্তি হয়েছে, শাস্তি কার্যকর হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম এর ভেতর দিয়ে মুক্তযুদ্ধ-বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরতরে পরাজিত হলো। কিন্তু তা হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যায় সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছে ‘দেশবিরোধী দুষ্কৃতকারী’, বাঙালী মেয়েদের বলেছে ‘গণিমতের মাল’- সেই শক্তি আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে দেশে। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেছে- এমন এক সময় যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছে সারাদেশ।

বঙ্গবন্ধুবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এখনই সময়।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

বিজয়ের স্মৃতি

Update Time : ০৫:৫৭:২৬ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২০

খুররম মমতাজ:

একাত্তরের ডিসেম্বর মাস, ১৬ তারিখ। ঢাকার অদূরে রুহিতপুর গ্রাম। গ্রামের স্কুলে ক্যাম্প করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল। দলে আছে বিশ-বাইশজন মুক্তিযোদ্ধা। তাদের দলে কনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি আর আমার বন্ধু মঞ্জুও আছি। আমরা দু’জনেই তখন ঢাকা কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র।

সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে রুহিতপুর গ্রামের অনেক বাড়িতে গোপনে ট্রেনিং দেয়া হতো মুক্তিপাগল তরুণ ছেলেদের। তিন-চারজনের ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে এরা থাকত বাড়িগুলোতে। দিনের বেলা বাড়ি থেকে বের হওয়া ছিল নিষেধ। রাতে হারিকেনের আলোয় শুরু হতো ট্রেনিং। শেখানো হতো গ্রেনেড, স্মল আর্মস আর এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার। তিনজনের এমনই একটি ছোট দলে সেপ্টেম্বর মাসেই ঢাকা থেকে এই গ্রামে এসেছিলাম ফুলার রোডের আমরা তিনজন- আমি, মঞ্জু আর মোহন।

রাতের আঁধারে উঠানে হতো লেফ্ট-রাইট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলত ট্রেনিং। আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোটখাটো আর দুবলা-পাতলা। ভারি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল কাঁধে নিয়ে বারবার মাটিতে শুয়ে পজিশন নিতে হতো ট্রেনিংয়ের সময়। কাজটা বেশ কঠিন ছিল আমার জন্য। একনাগাড়ে কয়েকবার করার পর হাঁপিয়ে যেতাম। কিন্তু ঘরের ভেতর প্রশিক্ষক যখন গ্রেনেড কিংবা স্টেনগানের অংশগুলো খুলে খুলে দেখাতেন, হারিকেনের আলোয় চকচক করত কালো ইস্পাত, তখন আমার বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠত। মনে হতো এসব ছোট ছোট অস্ত্র দিয়েই একদিন ঠিক হবে- কার জয় কার পরাজয়।

সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং শেষে সেবার ফিরে গিয়েছিলাম ঢাকায়, বাবা-মা ভাই-বোনের মাঝে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফ্ল্যাটে। অবরুদ্ধ ঢাকা শহর তখন শত্রুপুরি। পাকিস্তানী সৈন্যরা যখন যাকে খুশি তুলে নিয়ে যাচ্ছে, মেরে ফেলছে, পুরো শহর তাদের দখলে। তবে বিদেশী সাংবাদিকদের মাধ্যমে ততদিনে এই খবর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে যে পাকিস্তানী জান্তা ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে পূর্ব-পাকিস্তানে। পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করছে। তারা স্বাধীন বাংলাদেশ চায়। এদিকে পাকিস্তানী জান্তা মরিয়া হয়ে প্রমাণ করতে চাচ্ছে এসব সত্য নয়, এখানে সবকিছু ঠিকঠাক আছে- মুক্তিযুদ্ধ অথবা মুক্তিযোদ্ধা বলে কিছু নাই, সব ভারতের অপপ্রচার।

২৯ আগস্ট রাতে গ্রেফতার হয় ঢাকা শহরে সক্রিয় ক্র্যাক প্লাটুনের দল, যার সদস্য ছিল রুমি-বদি-জুয়েলরা। গ্রেফতার হয়ে যান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানের বিখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ। এর আগে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে ঢাকা শহরে গেরিলা দলগুলো ছোট-বড় অনেক সফল অপারেশন চালায়। এর উদ্দেশ্য ছিল একদিকে পাকিস্তানী সৈন্যদের ব্যতিব্যস্ত রাখা, তাদের রাতের ঘুম দিনের আরাম হারাম করে দেয়া। অন্যদিকে ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের জানান দেয়া যে এই দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। স্বাধীনতার জন্য প্রাণপণ যুদ্ধ করছে সারাদেশ- এমনকি রাজধানী ঢাকা শহরেও গেরিলারা দিনে দুপুরে পাকিস্তানী সৈন্যদের নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে- একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটাচ্ছে পাওয়ার স্টেশনে, টিভি সেন্টারে এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই উপস্থিতি জানান দেয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছিল, যাতে বিশ্ব-জনমত আমাদের পক্ষে থাকে।

এরকম কিছু উদ্দেশ্য সামনে রেখে ডিআইটি ভবনে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যার ওপরতলায় ছিল টিভি স্টুডিও এবং এ্যান্টেনা, উড়িয়ে দেয়া হয় সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, বোমা ফাটানো হয় হোটেল ইন্টারকনে, এখন যেটা শেরাটন হোটেল- এটাই ছিল সেই সময় ঢাকা শহরে একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের হোটেল- এই হোটেলে থাকতেন বিদেশী সাংবাদিকরা এবং আন্তর্জাতিক ডেলিগেট।

রুমিদের দলটি গ্রেফতার হওয়ার পর কিছুদিনের জন্য থমকে যায় ঢাকা শহরে গেরিলাদের কর্মকাণ্ড। কিন্তু তা মাত্র দু-তিন সপ্তাহের জন্য। তারপরই আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে অনেকগুলো দল একসঙ্গে। সেপ্টেম্বরের শেষে আবার শোনা যায় গেরিলাদের নিঃশঙ্ক পদচারণা, শোনা যেতে থাকে এখানে ওখানে বিস্ফোরণের শব্দ। মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে তারা আঘাত হানতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনীর দুর্গে।

এর একটা মনস্তাত্ত্বিক দিকও ছিল। অবরুদ্ধ ঢাকা শহরের বন্দী বাসিন্দারা তখন বিষ্ফোরণের শব্দ শোনার জন্য কান পেতে থাকত, উদগ্রীব হয়ে থাকত। এই শব্দ তাদের সাহস জোগাতো, মনে আশা-ভরসা দিত যে তাদের দামাল ছেলেরা ঘুমিয়ে নেই, জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো। দুই নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ একে বলতেন ‘সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার’- মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।

সেপ্টেম্বরের শেষ থেকে শুরু হলো ঢাকা শহরে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের দ্বিতীয় ঢেউ। ছোট-বড় অনেক গেরিলা দল একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তাদের নির্দেশ দেয়া হলো সুযোগমতো বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা ফাটাও, শত্রুর দুর্গে আঘাত হানো যে যেখানে পার। আমাদের দলটাকেও একটা অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হলো। আমরা থাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকায়- আমি, মঞ্জু, মোহন, মোমিন- ফুলার রোডের বিচ্ছুরা। এখান থেকে হোটেল ইন্টারকন বেশি দূরে নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিস্ফোরণ হলে হোটেলে থাকা বিদেশী সাংবাদিকরা তা শুনতে পাবে। এই উদ্দেশ্যে সলিমুল্লাহ হলের পূর্ব দিকের ট্রান্সফর্মারটি ওড়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। আমরা তা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দিলাম শব-ই-বরাতের রাতে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ হলো, কেঁপে উঠল সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, নেমে এলো অন্ধকার। অন্ধকারের ভেতরে ছুটতে ছুটতে আমার বন্ধু চাপা গলায় বলে উঠলো, ‘শ-ই-বরাতের বাজি ফোটালাম! জয় বাংলা!’

ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আমি আর মঞ্জু আবার এলাম রুহিতপুর ক্যাম্পে। সেখানে আগে থেকেই ছিল অনেক মুক্তিযোদ্ধা। আমরা তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। হাড় কাঁপানো শীত। রাতের বেলা বেড়ার ফাঁক দিয়ে হু-হু করে ঠাণ্ডা বাতাস আসে। টিনের চালে হিম আর কুয়াশা। মেঝেতে খড়ের বিছানা পাতা।

নানারকম কথা শোনা যায়। চূড়ান্ত আঘাত হানা হবে ঢাকার ওপর। পাকবাহিনীর শেষ দুর্গ এখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট। ঢাকার পতন হলেই বিজয় হবে আমাদের। সেই লক্ষ্যে ঢাকার চারপাশে জড়ো হয়েছে মুক্তিযোদ্ধারা। শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে। ছিন্নবস্ত্র নগ্নপায়ে আছে তারা। তাদের পেটে খাবার নাই, গায়ে গরম কাপড় নাই। গত নয় মাস এক আস্তানা থেকে আরেক আস্তানায়, এক ঘাঁটি থেকে আরেক ঘাঁটিতে ছুটেছে তারা। পথে ভয় শঙ্কা আর মৃত্যু ছিল পায়ে পায়ে, ছায়ার মতো। প্রতি মুহূর্তে শত্রুর আঘাত কিংবা পাল্টা আঘাতের চিন্তা। অথবা নিঃশব্দে পিছু হটে যাওয়া। কখনও দিনে কখনও রাতের অন্ধকারে। মুখে তাদের একটাই উচ্চারণ- ‘জয় বাংলা’ আর বুকের ভেতরে একটাই স্বপ্ন ‘স্বাধীনতা’।

ক্যাম্পে আমরা অপেক্ষা করি নির্দেশের। কবে নির্দেশ আসবে- ঢাকা চলো। নির্দেশ আর আসে না। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলের দিকে হঠাৎ সাড়া পড়ে গেল ক্যাম্পে। প্রথমে ফিসফিস গুঞ্জন, তারপর সবাই বলতে থাকে, ‘স্বাধীন! স্বাধীন! স্বাধীন হয়ে গেছি আমরা!’ ঢাকা থেকে খবর এসেছে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে আজই। রেসকোর্স ময়দানে। চলো চলো, ঢাকা চলো সবাই। ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম আমরা। তবে, যে খবর এসেছে তা কতটুকু সত্য কে জানে। প্রতিদিনই সত্য-মিথ্যা নানারকম কথা শোনা যাচ্ছে। তাই ব্যাগের ভেতরে নেয়া হলো স্টেনগান আর গ্রেনেড।

ছয়জনের দলটা চলেছে গ্রামের পথে হনহনিয়ে। দু’পাশে হলুদ কার্পেটের মতো সর্ষের ক্ষেত। তার ওপর এসে পড়েছে ডিসেম্বরের শেষ বিকেলের নরম রোদ। সূর্য দ্রুত নেমে যাচ্ছে দিগন্তের দিকে। দৌড়াতে দৌড়াতে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে দেখা গেল একটা নৌকাও নাই। জনহীন নদীর তীর- পার হবো কীভাবে? শেষমেশ বহু খোঁজাখুঁজির পর নৌকা আর মাঝি দু’টোই পাওয়া গেল। কোনাকুনি নদী পাড়ি দিচ্ছে মাঝি। অন্ধকার রাত। কালো জলে ছপাস ছপাস দাঁড়ের শব্দ। একটু পরেই ওপারে পৌঁছে যাব আমরা। কিন্তু কী অপেক্ষা করছে ওখানে আমাদের জন্য? আনন্দ, বেদনা, দুঃখ নাকি হতাশা…?

যুদ্ধ শেষে ফুলার রোডে ফিরে জানতে পারলাম অনেক কিছু- জানা গেল শহীদ শিক্ষক এবং বুদ্ধিজীবীদের কথা। তাদের মধ্যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাবা আছেন, ডাক্তার মোর্তজা আছেন, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আছেন- যাদের আমরা প্রতিদিন দেখেছি ফুলার রোডের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সকাল-বিকেল। তাদের হত্যা করেছে আলবদর বাহিনী। আবার শিক্ষক নামের কলঙ্ক এমন কেউ কেউ যোগ দিয়েছেন শান্তি কমিটিতে। তারা সহায়তা করেছেন আলবদর বাহিনীকে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষ দুটি ধারা তখন থেকেই শুরু হলো। স্বাধীনতার পর বিপক্ষ শক্তি কিছুদিন আত্মগোপনে ছিল, ঘাপটি মেরে ছিল। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর তারা আবার প্রকাশ্যে এলো। যতই দিন গড়াল ততই স্পষ্ট হলো পক্ষ-বিপক্ষ বিভাজন।

স্বাধীনতার পর পার হয়ে গেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী। আজকে আবার সেই দিনটি এসেছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন করব আমরা। এখন হিসেব-নিকেশ মেলাবার পালা। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে বাংলাদেশের। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল তাদের বিচার হয়েছে বাংলার মাটিতে। বিচারে শাস্তি হয়েছে, শাস্তি কার্যকর হয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম এর ভেতর দিয়ে মুক্তযুদ্ধ-বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরতরে পরাজিত হলো। কিন্তু তা হয়নি। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় ত্রিশ লক্ষ মানুষ হত্যায় সহযোগিতা করেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের বলেছে ‘দেশবিরোধী দুষ্কৃতকারী’, বাঙালী মেয়েদের বলেছে ‘গণিমতের মাল’- সেই শক্তি আবার মাথাচাড়া দিচ্ছে দেশে। তারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙ্গেছে- এমন এক সময় যখন বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করছে সারাদেশ।

বঙ্গবন্ধুবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী, সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার এখনই সময়।