বার্গম্যান-খলিল: সাংবাদিকতা বনাম সাংঘাতিকতা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ১২:২৬:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১
  • / ২০০ Time View

ফারাজী আজমল হোসেন:

বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে সম্প্রতি সময় চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন বাংলাদেশের বাইরে থেকে সাংবাদিকতা (!) চর্চা করা কিছু ব্যক্তি। তাদের ভাষ্যমতে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং কেউ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করছে না। বরং মূলধারার গণমাধ্যমগুলো থেকেও ভালো, গঠনমূলক এবং বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও সাংবাদিকতার চর্চা করছেন তারা।

তার এমন মন্তব্যের কিছু প্রেক্ষাপট রয়েছে। ব্রিটিশ এই সাংবাদিক ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। এর জন্য প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, যেই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল, এর আইনজীবী, সাক্ষী ও বিচারকদের বিশ্বের বুকে চরিত্রহনন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিভ্রান্তি তৈরি। এই লক্ষ্য নিয়ে সেই সময়ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আল-জাজিরাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেন ডেভিড বার্গম্যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় মিশন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেয়া এই ব্রিটিশ নাগরিক।

যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দলকে ক্ষমতায় বসাতে কাজ শুরু করেন তিনি। ড. কামাল হোসেনের মেয়ে জামাই ডেভিড বার্গম্যান। শ্বশুরকে ক্ষমতায় বসাতে বিগত নির্বাচনে এমন কোন কাজ নেই যা করেননি এই বার্গম্যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টাতে ব্যর্থ হয়ে নতুন পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের বুকে যেই ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে রয়েছে তা নষ্টের জন্য তিনি এবং বাংলাদেশ থেকে ভুল তথ্য দিয়ে পালিয়ে যাওয়া তাসনিম খলিল গং সম্মিলিতভাবে গঠন করে নেত্র নিউজ।

ব্যক্তিগতভাবে ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজ অথবা দেশে পরিচিতি নেই এমন সব অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিস্থাপন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা এই মানুষগুলো সম্পর্ক সাংবাদিক তথা দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি হওয়া খুবই জরুরি। কেননা এরা সাংবাদিকতার নামে অনলাইন প্লাটফর্মে ‘সাংঘাতিক আচরণ’ করে বেড়াচ্ছে।

আলোচনার শুরুতেই আমার মাথায় যেই নামগুলো আসছে তার মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য একজন ডেভিড বার্গম্যান। ব্রিটিশ এই নাগরিক তার সাদা চামড়ার জোরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চর্চা শুরু করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বস্তুনিষ্ঠ (!) আলোচনায় অতিষ্ঠ এই বিশ্ব। তার বস্তুনিষ্ঠতার চরিত্র দেখে অস্থির হয়ে বাংলাদেশের নামীদামী বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক তাকে চাকরিচ্যুত করেছে। হয়তো ব্রিটিশ নাগরিকত্ব না থাকলে তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কয়েকটা মানহানির মামলাও হয়ে যেত। তিনি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার জন্য বলেন, বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধ হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি ভুল এবং মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের মা-বোনদের পাকিস্তানিরা সম্ভ্রমহানি করেনি। এ সবই নাকি আন্তর্জাতিকভাবে ফায়দা লোটার জন্য বাংলাদেশের বানানো সব সংখ্যা! তার ভাষ্যমতে বাংলাদেশে প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত সকল গণকবর ভুয়া। বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়া দ্বারপ্রান্তে খুন হননি এবং বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধের জন্য যাদের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা সকলে নির্দোষ। মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদকে নিয়ে কটূক্তি করায় বাংলাদেশের আদালত তাকে শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও থামেননি এই ব্রিটিশ নাগরিক।

বর্তমান সরকার ও সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যানের ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে যা তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও ভাষার ব্যবহারে স্পষ্ট। সেই সঙ্গে নেত্র নিউজের অর্থের উৎস আরও স্পষ্ট করছে কি কারণে এই ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করছে তাসনিম খলিল এবং ডেভিড বার্গম্যান।

নেত্র নিউজ অর্থায়নের জন্য ন্যাশনাল এন্ডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির (এনইডি) ওপর নির্ভরশীল; এটা একটা নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এনজিও, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাসনিম খলিল জানায়, এনইডি যেসব মিডিয়া আউটলেট বিশ্বজুড়ে নানা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে সেসব ইনডিপেনডেন্ট মিডিয়া আউটলেটকে প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য অর্থ দেয়। নেত্র নিউজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৯ সালে, এনইডির আর্থিক সহায়তা নিয়ে। এ আউটলেটের পরিচালন ব্যয় এনইডির বরাদ্দকৃত অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

এই এনইডি প্রসঙ্গে ‘দ্য ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি’ বইয়ে বিখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচেলস লেখেন, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এবং নাইন-ইলেভেনে ইসলামী জঙ্গিরা টুইন টাওয়ারে হামলা চালানোর পর মার্কিন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স (সিআইএ, ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ অব স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-এর অপারেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। তখন গণতন্ত্রকে সমর্থন জানাতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে এই এনইডি’র জন্ম। সুতরাং বেশ স্পষ্টতই বোঝা যায়, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার একটি হাতিয়ার এনইডি। আর এই এনইডি অর্থায়ন করছে নেত্র নিউজে।

এবার একটু দেখে নেই তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যানের সাংবাদিকতা চর্চা নিয়ে। একজন সাংবাদিক সর্বদাই একজন সাংবাদিক হিসেবেই আচরণ করবেন বলে আমরা আশা করি। কেননা তাকে অনুসরণ করে, তার তথ্যের ওপর ভরসা করে অনেকেই অনেক সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তেমন কোন প্রচেষ্টা ডেভিড বার্গম্যান বা তাসনিম খলিলের মধ্যে নেই। করোনা মহামারির শুরুতে হঠাৎ করেই বার্গম্যান হাজির হন তার ‘বিশেষ বিশ্লেষণ’ নিয়ে। তিনি জানান, বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হার প্রায় ৫১ ভাগ! বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার জন্য এই দেশে মৃত্যু অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে বলে মত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গত বছরের বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। আর করোনায় মৃত্যুতে বার্গম্যানের প্রকাশ করা পরিসংখ্যান যে ভুল, তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

‘কারাবন্দী অবস্থায় হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যু। এই মৃত্যুর দায় আওয়ামী রাষ্ট্রের সকল রাজবন্দীদের মুক্ত করতে হবে। কারা নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’- এটি চলতি বছরের মে মাসের ২০ তারিখে তাসনিম খলিলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগৃহীত। তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ সরকারের জুলুমের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেন। কিন্তু তার এই ফেসবুক পোস্টের কমেন্টগুলো পড়লে বোঝা যাবে, কতটা বস্তুনিষ্ঠ (!) তথ্য পরিবেশন করেছেন তাসনিম খলিল। সত্য ঘটনা হল- আটকের পরপর অসুস্থ বোধ করা হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনকে ১১ মে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণ অবস্থায় তিনি মারা যান। অর্থাৎ তার মৃত্যু কারাগারে হয়নি, হাসপাতালে ৯ দিন চিকিৎসা গ্রহণ শেষে হয়েছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা তৈরির জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করেছেন তাসনিম খলিল, ডেভিড বার্গম্যান, কনক সারওয়ার, মেজর (অব.) দেলোয়ার, কর্নেল (অব.) শহীদ উদ্দিন ও ইলিয়াস হোসেন। মজাদার বিষয় হল- কিছুদিন আগেই হঠাৎ করেই তারা নতুন ক্যাম্পেইনে নামেন- যেখানে বারবার করে বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে চীনের দিকে ঝুঁকতে হবে’। সম্প্রতি চীন থেকে আসা টিকা নিয়েও ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। বোঝা যাচ্ছে নতুন এক মিশনে নামতে যাচ্ছে অনলাইনে সাংবাদিকতার নামে ‘সাংঘাতিক আচরণ করা’ এই মানুষগুলো।

তাদের সকলের মধ্যে একটি বিষয় অভিন্ন। আর তা হলো- এরা সকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘৃণা করে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করে, প্রত্যেকেই কোন না কোন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সহায়তা পায় (মার্কিন, পাকিস্তানের আইএসআই, চীন)। এ ছাড়াও তাদের আলোচনার বিষয়গুলো সাধারণত খুব কাছাকাছি থাকে সবসময়। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কোয়াড নিয়ে আলোচনার আগেই মেজর (আব.) দেলোয়ার এ কারণেই হয়ত কোন কারণ ছাড়াই বলে বসেন, বাংলাদেশের ভারতকে ছেড়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত।

সর্বশেষ দেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের দুটি জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে বড় অঙ্কের টাকাসহ নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছেন তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যান। আগামী তিন বছর এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তাদের অপারেশন চলবে। এই প্রজেক্টে অর্থায়ন করবেন বিএনপিকে অর্থায়ন করা বাংলাদেশের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এবার তাদের মূল লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোর চরিত্রহনন। দেশি-বিদেশি যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে ভালবেসে কাজ করে যাচ্ছে অথবা তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিচ্ছে তাদের চরিত্রহনন করার এই মিশনে তাসনিম খলিল গংদের বস্তুনিষ্ঠতা (!) চর্চা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Please Share This Post in Your Social Media

বার্গম্যান-খলিল: সাংবাদিকতা বনাম সাংঘাতিকতা

Update Time : ১২:২৬:২১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৭ জুলাই ২০২১

ফারাজী আজমল হোসেন:

বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোকে সম্প্রতি সময় চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন বাংলাদেশের বাইরে থেকে সাংবাদিকতা (!) চর্চা করা কিছু ব্যক্তি। তাদের ভাষ্যমতে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর কণ্ঠরোধ করা হয়েছে এবং কেউ বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করছে না। বরং মূলধারার গণমাধ্যমগুলো থেকেও ভালো, গঠনমূলক এবং বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও সাংবাদিকতার চর্চা করছেন তারা।

তার এমন মন্তব্যের কিছু প্রেক্ষাপট রয়েছে। ব্রিটিশ এই সাংবাদিক ২০১৩-১৪ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় যুদ্ধাপরাধীদের লবিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন। এর জন্য প্রাথমিকভাবে ২০০ মিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি হয় বলে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, যেই চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল, এর আইনজীবী, সাক্ষী ও বিচারকদের বিশ্বের বুকে চরিত্রহনন এবং বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করে উপস্থাপনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকালীন যুদ্ধাপরাধ নিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বিভ্রান্তি তৈরি। এই লক্ষ্য নিয়ে সেই সময়ও যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আল-জাজিরাকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেন ডেভিড বার্গম্যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে দ্বিতীয় মিশন শুরু করেন সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় দেয়া এই ব্রিটিশ নাগরিক।

যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষায় ব্যর্থ হয়ে যুদ্ধাপরাধীদের দলকে ক্ষমতায় বসাতে কাজ শুরু করেন তিনি। ড. কামাল হোসেনের মেয়ে জামাই ডেভিড বার্গম্যান। শ্বশুরকে ক্ষমতায় বসাতে বিগত নির্বাচনে এমন কোন কাজ নেই যা করেননি এই বার্গম্যান। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই চেষ্টাতে ব্যর্থ হয়ে নতুন পরিকল্পনা শুরু করেন তিনি। বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের বুকে যেই ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে রয়েছে তা নষ্টের জন্য তিনি এবং বাংলাদেশ থেকে ভুল তথ্য দিয়ে পালিয়ে যাওয়া তাসনিম খলিল গং সম্মিলিতভাবে গঠন করে নেত্র নিউজ।

ব্যক্তিগতভাবে ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজ অথবা দেশে পরিচিতি নেই এমন সব অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিস্থাপন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা এই মানুষগুলো সম্পর্ক সাংবাদিক তথা দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি হওয়া খুবই জরুরি। কেননা এরা সাংবাদিকতার নামে অনলাইন প্লাটফর্মে ‘সাংঘাতিক আচরণ’ করে বেড়াচ্ছে।

আলোচনার শুরুতেই আমার মাথায় যেই নামগুলো আসছে তার মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য একজন ডেভিড বার্গম্যান। ব্রিটিশ এই নাগরিক তার সাদা চামড়ার জোরে বাংলাদেশে সাংবাদিকতার চর্চা শুরু করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার বস্তুনিষ্ঠ (!) আলোচনায় অতিষ্ঠ এই বিশ্ব। তার বস্তুনিষ্ঠতার চরিত্র দেখে অস্থির হয়ে বাংলাদেশের নামীদামী বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক তাকে চাকরিচ্যুত করেছে। হয়তো ব্রিটিশ নাগরিকত্ব না থাকলে তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে কয়েকটা মানহানির মামলাও হয়ে যেত। তিনি বস্তুনিষ্ঠ আলোচনার জন্য বলেন, বাংলাদেশে কোন যুদ্ধাপরাধ হয়নি। ৩০ লাখ শহীদের সংখ্যাটি ভুল এবং মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের মা-বোনদের পাকিস্তানিরা সম্ভ্রমহানি করেনি। এ সবই নাকি আন্তর্জাতিকভাবে ফায়দা লোটার জন্য বাংলাদেশের বানানো সব সংখ্যা! তার ভাষ্যমতে বাংলাদেশে প্রকাশিত বা অপ্রকাশিত সকল গণকবর ভুয়া। বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়া দ্বারপ্রান্তে খুন হননি এবং বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকালে অপরাধের জন্য যাদের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তারা সকলে নির্দোষ। মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদকে নিয়ে কটূক্তি করায় বাংলাদেশের আদালত তাকে শাস্তিও দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও থামেননি এই ব্রিটিশ নাগরিক।

বর্তমান সরকার ও সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যানের ব্যক্তিগত ক্ষোভ রয়েছে যা তাদের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও ভাষার ব্যবহারে স্পষ্ট। সেই সঙ্গে নেত্র নিউজের অর্থের উৎস আরও স্পষ্ট করছে কি কারণে এই ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা করছে তাসনিম খলিল এবং ডেভিড বার্গম্যান।

নেত্র নিউজ অর্থায়নের জন্য ন্যাশনাল এন্ডৌমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির (এনইডি) ওপর নির্ভরশীল; এটা একটা নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এনজিও, যুক্তরাষ্ট্র থেকে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তাসনিম খলিল জানায়, এনইডি যেসব মিডিয়া আউটলেট বিশ্বজুড়ে নানা দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কথা বলে সেসব ইনডিপেনডেন্ট মিডিয়া আউটলেটকে প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করার জন্য অর্থ দেয়। নেত্র নিউজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০১৯ সালে, এনইডির আর্থিক সহায়তা নিয়ে। এ আউটলেটের পরিচালন ব্যয় এনইডির বরাদ্দকৃত অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

এই এনইডি প্রসঙ্গে ‘দ্য ইউএস ইন্টেলিজেন্স কমিউনিটি’ বইয়ে বিখ্যাত মার্কিন গোয়েন্দা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচেলস লেখেন, স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর এবং নাইন-ইলেভেনে ইসলামী জঙ্গিরা টুইন টাওয়ারে হামলা চালানোর পর মার্কিন সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স (সিআইএ, ব্যুরো অব ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড রিসার্চ অব স্টেট ডিপার্টমেন্ট, ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি)-এর অপারেশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। তখন গণতন্ত্রকে সমর্থন জানাতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার অর্থায়নে এই এনইডি’র জন্ম। সুতরাং বেশ স্পষ্টতই বোঝা যায়, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার একটি হাতিয়ার এনইডি। আর এই এনইডি অর্থায়ন করছে নেত্র নিউজে।

এবার একটু দেখে নেই তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যানের সাংবাদিকতা চর্চা নিয়ে। একজন সাংবাদিক সর্বদাই একজন সাংবাদিক হিসেবেই আচরণ করবেন বলে আমরা আশা করি। কেননা তাকে অনুসরণ করে, তার তথ্যের ওপর ভরসা করে অনেকেই অনেক সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তেমন কোন প্রচেষ্টা ডেভিড বার্গম্যান বা তাসনিম খলিলের মধ্যে নেই। করোনা মহামারির শুরুতে হঠাৎ করেই বার্গম্যান হাজির হন তার ‘বিশেষ বিশ্লেষণ’ নিয়ে। তিনি জানান, বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হার প্রায় ৫১ ভাগ! বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশার জন্য এই দেশে মৃত্যু অন্য দেশের তুলনায় অনেক বেড়ে যাবে বলে মত দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু গত বছরের বাস্তবতা ছিল একেবারেই ভিন্ন। আর করোনায় মৃত্যুতে বার্গম্যানের প্রকাশ করা পরিসংখ্যান যে ভুল, তা আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

‘কারাবন্দী অবস্থায় হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনের মৃত্যু। এই মৃত্যুর দায় আওয়ামী রাষ্ট্রের সকল রাজবন্দীদের মুক্ত করতে হবে। কারা নির্যাতন বন্ধ করতে হবে।’- এটি চলতি বছরের মে মাসের ২০ তারিখে তাসনিম খলিলের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সংগৃহীত। তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ সরকারের জুলুমের শিকার হয়ে কারাগারে বন্দী অবস্থায় মারা গেছেন হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেন। কিন্তু তার এই ফেসবুক পোস্টের কমেন্টগুলো পড়লে বোঝা যাবে, কতটা বস্তুনিষ্ঠ (!) তথ্য পরিবেশন করেছেন তাসনিম খলিল। সত্য ঘটনা হল- আটকের পরপর অসুস্থ বোধ করা হেফাজত নেতা মাওলানা ইকবাল হোসেনকে ১১ মে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে চিকিৎসা গ্রহণ অবস্থায় তিনি মারা যান। অর্থাৎ তার মৃত্যু কারাগারে হয়নি, হাসপাতালে ৯ দিন চিকিৎসা গ্রহণ শেষে হয়েছে।

বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অস্থিরতা তৈরির জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করেছেন তাসনিম খলিল, ডেভিড বার্গম্যান, কনক সারওয়ার, মেজর (অব.) দেলোয়ার, কর্নেল (অব.) শহীদ উদ্দিন ও ইলিয়াস হোসেন। মজাদার বিষয় হল- কিছুদিন আগেই হঠাৎ করেই তারা নতুন ক্যাম্পেইনে নামেন- যেখানে বারবার করে বলা হচ্ছে ‘বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে চীনের দিকে ঝুঁকতে হবে’। সম্প্রতি চীন থেকে আসা টিকা নিয়েও ভূয়সী প্রশংসা করতে দেখা যাচ্ছে তাদের। বোঝা যাচ্ছে নতুন এক মিশনে নামতে যাচ্ছে অনলাইনে সাংবাদিকতার নামে ‘সাংঘাতিক আচরণ করা’ এই মানুষগুলো।

তাদের সকলের মধ্যে একটি বিষয় অভিন্ন। আর তা হলো- এরা সকলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ঘৃণা করে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ঘৃণা করে, প্রত্যেকেই কোন না কোন গোয়েন্দা সংস্থা থেকে সহায়তা পায় (মার্কিন, পাকিস্তানের আইএসআই, চীন)। এ ছাড়াও তাদের আলোচনার বিষয়গুলো সাধারণত খুব কাছাকাছি থাকে সবসময়। বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত কোয়াড নিয়ে আলোচনার আগেই মেজর (আব.) দেলোয়ার এ কারণেই হয়ত কোন কারণ ছাড়াই বলে বসেন, বাংলাদেশের ভারতকে ছেড়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করা উচিত।

সর্বশেষ দেশের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের দুটি জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদককে সঙ্গে নিয়ে বড় অঙ্কের টাকাসহ নতুন প্রজেক্ট শুরু করতে যাচ্ছেন তাসনিম খলিল ও ডেভিড বার্গম্যান। আগামী তিন বছর এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তাদের অপারেশন চলবে। এই প্রজেক্টে অর্থায়ন করবেন বিএনপিকে অর্থায়ন করা বাংলাদেশের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এবার তাদের মূল লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের কাছাকাছি থাকা মানুষগুলোর চরিত্রহনন। দেশি-বিদেশি যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে ভালবেসে কাজ করে যাচ্ছে অথবা তাদের অবদানের স্বীকৃতি দিচ্ছে তাদের চরিত্রহনন করার এই মিশনে তাসনিম খলিল গংদের বস্তুনিষ্ঠতা (!) চর্চা দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।