দুপুরে মা তুমি চিন্তা করিও না, আমি নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছি’, রাতে মৃত্যুর খবর

  • Update Time : ০৫:২৭:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪
  • / 35

দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি:

‘মা তুমি চিন্তা করিও না, আমি নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছি’—ঘটনার দিন দুপুরে এটাই ছিল কোটা আন্দোলনে নিহত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী রুদ্র সেনের শেষ কথা। গত ১৯ জুলাই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলে পালাতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান তিনি।

নিহত রুদ্র সেন শাবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি দিনাজপুরের পাহাড়পুর এলাকার সুবীর সেনের একমাত্র ছেলে।

নিহত রুদ্র সেনের একমাত্র বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুস্মিতা সেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কেউ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না। যেহেতু কোটা আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সবাই যাচ্ছিল, আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করছিল, তাই তার (রুদ্র সেন) মনে হয়েছিল আমিও যাই। সে কখনো কোনো গণ্ডগোলের মধ্যে জড়ায়নি। আমরা সবসময় তাকে নিষেধ করতাম। তবে যথেষ্ট সেফ থেকে সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

১৯ জুলাই দুপুরে ক্যাম্পাসে গেলে ধাওয়া খেয়ে সে পড়ে যায়। এতে সে হাঁটুতে আঘাত পায়। পরে যেখানে ভাড়া থাকতো সেই বাড়িতে ফিরে আসে। সহপাঠীরা তার আঘাত পাওয়া স্থানে ড্রেসিং করে দেয়। যেহেতু সে আহত হয়, তাই তার সহপাঠীরা মনে করে পরে গণ্ডগোল আরও বেড়ে গেলে তাদের জন্য ওই বাড়িটি নিরাপদ হবে না। তাই বিকেলে আবারও সংঘর্ষ শুরু হলে চার বন্ধু মিলে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে কলাগাছের তৈরি ভেলায় বাড়ির পেছনে সুরমা আবাসিক এলাকায় খাল পার হচ্ছিল।’

ওইদিন দুপুরে রুদ্র সেনের সঙ্গে তার মা শিখা বণিকের শেষ কথা হয়। রুদ্র সেন তার মাকে বলেন, ‘আমি ভালো আছি। আজ নিরাপদ স্থানে চলে যাবো’। এরপর রাত সাড়ে ৮টায় ফোন করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে রুদ্র সেনের এক বন্ধু ফোন করে জানান, তিনি পানিতে ডুবে মারা গেছেন।

সুস্মিতা সেন বলেন, সন্ধ্যার দিকে তৃতীয় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলে দ্রুত চার বন্ধু মিলে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কলাগাছের তৈরি ভেলায় বাড়ির পেছনে সুরমা আবাসিক এলাকায় খাল পার হচ্ছিল তারা। খালের মাঝামাঝি গিয়ে ভেলাটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। এতে তারা চার বন্ধু খালের গভীর পানিতে পড়ে যায়।

অন্যরা সাঁতার জানলেও আমার ভাই রুদ্র সেন সাঁতার জানতো না। তাছাড়া পায়ের আঘাতের কারণে খালের পানিতে ডুবে যায় সে। পরে বন্ধুরা ও এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে চাপ দিয়ে পেটের পানি বের করেন। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওইদিন রাত সাড়ে ১২টায় রুদ্র সেনের মরদেহ দিনাজপুরের পাহাড়পুরে বাসায় পৌঁছায়। পরে প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতেই ফুলতলা শ্মশানে মরদেহ সৎকার করা হয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুদ্র সেনের বোন সুস্মিতা সেন বলেন, ‘এ ঘটনার পর কোটা আন্দোলনকারী বা ক্ষমতাসীন দলের কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নিতে আসেনি। বাবা দিনাজপুর সদর উপজেলার পাঁচবাড়ী মোকলেছুর রহমান মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। আমার ভাই আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কার কাছে যাবো? আমরা দুনিয়ায় বিচার চাইবো না, বিচার সৃষ্টিকর্তার কাছে ছেড়ে দিলাম।’

এদিকে মা শিখা বণিক ছেলের মৃত্যু সংবাদে বাকরুদ্ধ। বাবা সুবীর সেন ছেলের মরদেহ বাড়িতে আসার বর্ণনা দিতে দিতেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিরি বলেন, আমার মুখাগ্নি করার আর কেউ রইলো না।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

দুপুরে মা তুমি চিন্তা করিও না, আমি নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছি’, রাতে মৃত্যুর খবর

Update Time : ০৫:২৭:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৯ জুলাই ২০২৪

দিনাজপুর জেলা প্রতিনিধি:

‘মা তুমি চিন্তা করিও না, আমি নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছি’—ঘটনার দিন দুপুরে এটাই ছিল কোটা আন্দোলনে নিহত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থী রুদ্র সেনের শেষ কথা। গত ১৯ জুলাই ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলে পালাতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা যান তিনি।

নিহত রুদ্র সেন শাবিপ্রবির কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। তিনি দিনাজপুরের পাহাড়পুর এলাকার সুবীর সেনের একমাত্র ছেলে।

নিহত রুদ্র সেনের একমাত্র বোন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা সুস্মিতা সেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কেউ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না। যেহেতু কোটা আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, সবাই যাচ্ছিল, আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করছিল, তাই তার (রুদ্র সেন) মনে হয়েছিল আমিও যাই। সে কখনো কোনো গণ্ডগোলের মধ্যে জড়ায়নি। আমরা সবসময় তাকে নিষেধ করতাম। তবে যথেষ্ট সেফ থেকে সে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে।

১৯ জুলাই দুপুরে ক্যাম্পাসে গেলে ধাওয়া খেয়ে সে পড়ে যায়। এতে সে হাঁটুতে আঘাত পায়। পরে যেখানে ভাড়া থাকতো সেই বাড়িতে ফিরে আসে। সহপাঠীরা তার আঘাত পাওয়া স্থানে ড্রেসিং করে দেয়। যেহেতু সে আহত হয়, তাই তার সহপাঠীরা মনে করে পরে গণ্ডগোল আরও বেড়ে গেলে তাদের জন্য ওই বাড়িটি নিরাপদ হবে না। তাই বিকেলে আবারও সংঘর্ষ শুরু হলে চার বন্ধু মিলে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়ো করে কলাগাছের তৈরি ভেলায় বাড়ির পেছনে সুরমা আবাসিক এলাকায় খাল পার হচ্ছিল।’

ওইদিন দুপুরে রুদ্র সেনের সঙ্গে তার মা শিখা বণিকের শেষ কথা হয়। রুদ্র সেন তার মাকে বলেন, ‘আমি ভালো আছি। আজ নিরাপদ স্থানে চলে যাবো’। এরপর রাত সাড়ে ৮টায় ফোন করলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। পরে রাত সাড়ে ৯টার দিকে রুদ্র সেনের এক বন্ধু ফোন করে জানান, তিনি পানিতে ডুবে মারা গেছেন।

সুস্মিতা সেন বলেন, সন্ধ্যার দিকে তৃতীয় দফায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হলে দ্রুত চার বন্ধু মিলে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কলাগাছের তৈরি ভেলায় বাড়ির পেছনে সুরমা আবাসিক এলাকায় খাল পার হচ্ছিল তারা। খালের মাঝামাঝি গিয়ে ভেলাটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে উল্টে যায়। এতে তারা চার বন্ধু খালের গভীর পানিতে পড়ে যায়।

অন্যরা সাঁতার জানলেও আমার ভাই রুদ্র সেন সাঁতার জানতো না। তাছাড়া পায়ের আঘাতের কারণে খালের পানিতে ডুবে যায় সে। পরে বন্ধুরা ও এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে চাপ দিয়ে পেটের পানি বের করেন। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওইদিন রাত সাড়ে ১২টায় রুদ্র সেনের মরদেহ দিনাজপুরের পাহাড়পুরে বাসায় পৌঁছায়। পরে প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতেই ফুলতলা শ্মশানে মরদেহ সৎকার করা হয়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে রুদ্র সেনের বোন সুস্মিতা সেন বলেন, ‘এ ঘটনার পর কোটা আন্দোলনকারী বা ক্ষমতাসীন দলের কেউ আমাদের কোনো খোঁজখবর নিতে আসেনি। বাবা দিনাজপুর সদর উপজেলার পাঁচবাড়ী মোকলেছুর রহমান মহাবিদ্যালয়ের প্রভাষক ছিলেন। ছেলেকে নিয়ে বাবা-মায়ের অনেক আশা ছিল। আমার ভাই আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কার কাছে যাবো? আমরা দুনিয়ায় বিচার চাইবো না, বিচার সৃষ্টিকর্তার কাছে ছেড়ে দিলাম।’

এদিকে মা শিখা বণিক ছেলের মৃত্যু সংবাদে বাকরুদ্ধ। বাবা সুবীর সেন ছেলের মরদেহ বাড়িতে আসার বর্ণনা দিতে দিতেই বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিরি বলেন, আমার মুখাগ্নি করার আর কেউ রইলো না।