কফি চাষের সম্ভাবনা বাড়ছে বাংলাদেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • Update Time : ০৭:৪০:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১
  • / ৩৬৫ Time View

মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন:

দেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কফি চাষ পৃথিবীতে পানীয়র মধ্যে চায়ের পরের অবস্থান হচ্ছে কফির।পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘুম থেকে উঠে,আড্ডায় কিংবা মিটিংয়ের ফাঁকে কফি নিত্যদিনের সঙ্গী। এই রেওয়াজ চালু হয়েছিল আমেরিকায় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। আমাদের দেশেও কফির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। দেরিতে হলেও এই খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আর পাহাড়ের মাটিতে চাষের উপযোগী হিসেবে বাড়তি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ভালো, উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করছে কৃষি গবেষণাকেন্দ্র। ইতোমধ্যে সফলও হয়েছে। এখন কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে অর্থকরি ফসল কফি আবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আম, আনারস, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফলদ বাগানে বান্দরবানের কৃষকরা বহু আগেই সফলতা অর্জন করেছেন। এখন নতুন করে কফি চাষে উদ্যোগী হয়েছেন কৃষকরা। আবাদও দ্রুত বেড়ে চলেছে। এ পণ্যটি চাষের দিকে অনেকেই এগিয়ে আসছেন উৎসাহের সাথে। এতে করে ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল চাষের পাশাপাশি কফিও বাংলাদেশকে এনে দিতে পারে রপ্তানি খাতে আর্থিক সাফল্যের মুখ। কফির সঙ্গে মিশে আছে একটা আভিজাত্য। বাংলাদেশে সাধারণত প্যাকেটজাত কফি বিদেশ থেকেই আমদানি করা হয়ে থাকে। তার কারণ কফি চাষের কোন প্রকার সুযোগ সুবিধা এর আগে বাংলাদেশে ছিলনা।

সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬শ’ ফুট ওপরে যে কোন মাটিতে কফি চাষ করা সম্ভব। তবে পাহাড়ি উপত্যকা ও ঝরণার পাশের জমি এবং যেসব জমি তে লবণাক্ততা নেই সে সব জমি কফি চাষের উপযোগী। এছাড়া রাবার বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো যাবে কফির চারা। বাড়ির আঙ্গিনা, ফুলের টব কিংবা বাড়ির ছাদেও কফির চাষ সম্ভব। চারা রোপণের দুবছরের মধ্যে কফির ফল সংগ্রহ করা যাবে। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বছরে দুবার গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। একটি কফি গাছ থেকে ২০/৩০ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে কফি চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটি গাছের জন্য খরচ হবে মাত্র এক থেকে দেড়শ’ টাকা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কফির কেজি এখন ৪ হাজার ২শ’ টাকার বেশি । প্রতিটি গাছ থেকে বছরে আধা কেজি বা তারও বেশি কফির ফল পাওয়া যাবে। একটি গাছে বছরে ৫ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কেজি পর্যন্ত কফি ফল পাওয়া যায়। কফির খোসাসহ প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।

কফি গাছ থেকে শুধুমাত্র পানীয় কফিই নয়, একে সহায়ক হিসেবে নিলে এ কফি গাছের অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে মধু ও শ্যাম্পুও তৈরি করা যাবে। মধু চাষের জন্যও কফি বাগানে উপযোগী। কফি গাছে ফুল এলেই মৌমাছিরা সেখানে আসবে। একটি কফি গাছের ফুল থেকে প্রতি বারে একশ’ গ্রাম মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ওই গাছের উপকরণকে প্রক্রিয়া করে উন্নতমানের ‘শ্যাম্পু’ তৈরি করা যাবে। যা করতে পারলে উন্নতমানের শ্যাম্পুর জন্য আর বিদেশ মুখি হতে হবে না।

দেশের চাহিদা মিটিয়ে কফি বিদেশেও রপ্তানী করা যাবে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার তথা কৃষিবিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বাণিজ্যিক কৃষির জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশকে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে কফি ও কাজুবাদামের সম্প্রসারণে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কফি একটি অর্থকরী ফসল বিধায় এটি চাষ করে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনি এটি বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ বলে জনগণের পুষ্টি চাহিদা ও পূরণ করবে।

এক কাপ ব্লাক কফি (১২৫মিলিলিটার) কার্যত কোনও ফ্যাট,কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিন থাকে না সুতরাং এর শক্তির পরিমাণ কেবল ১-২ কিলোক্যালরি। কফিতে অনেকগুলো খনিজ এবং ভিটামিন রয়েছে।

বাংলাদেশে কফি চাষের বর্তমান অবস্থা ও বাজার পরিস্থিতি কফি গ্রহণের ও বিপণনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় এটি উৎপাদিত হলেও এর মধ্যে প্রায় ৯০% উৎপাদিত হয় বান্দরবানে। পাহাড়ি এলাকা বাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী,মৌলভীবাজার ও রংপুর জেলায় এবং টাঙ্গাইলে কফির চাষ শুরু হয়েছে।

কফি চাষের

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১১৮.৩ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫৫.৭৫ টন। বর্তমানে কৃষকগণ যতটুকু চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করছে তার সবটুকুই সনাতন পদ্ধতিতে করছে যার ফলন অনেক কম এবং লাভও কম হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানিকৃত গ্রিন কফির পরিমাণ হলো ৩২.৫১৭ টন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিয়য়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ’শীর্ষক এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে করা হবে।চাহিদার বেশির ভাগ অংশই প্রায় ৯৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে আমদানি করা কফি দিয়ে। তাই আমাদের কফির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এক্ষণই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্ভাবনাময় কফি হতে পারে বাংলাদেশের পাহাড়ি মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস। কফি চাষের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে পেঁপে,আনারস,গোলমরিচ অনায়াসে চাষ করা যায়। কফি হালকা ছায়ায় ভালো হয় এবং অতিরিক্ত সার ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থানে চাষ করলে সার ও সেচের প্রয়োজন আছে। স্থানীয় চাহিদা অনেক বেশি ও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বলে এটির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও কফির চাষ বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স,ঢাকা। যারা সরাসরি পার্বত্য অঞ্চলের কফি উৎপাদকদের কাছ থেকে কফি ক্রয় করছেন।কফির চাষ বৃদ্ধিতে উৎপাদক,গবেষক,সম্প্রসারণ অফিসার,মিডিয়া,বেসরকারি সংস্থা ও বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা উচিত যাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সফল হয়।

বাংলাদেশে চাষ উপযোগী আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং জাতসমূহবাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের অনুকূল তবে ভালো ও উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে এর চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কফি চাষের উপযোগী মাটি হলো গভীর,ঝুরঝুরে,জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও হিউমাস সমৃদ্ধ,হালকা অম্লমাটি (পিএইচ ৪.৫-৬.৫)। পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদযোগ্য কফির ২টি জাত রয়েছে যেমন- যেমন- কফি এরাবিকা (Coffeaarabica)এ কফি রোবাস্টা (Coffeacanephora – robusta)। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খুব উপযোগী। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলে সেজন্য বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা যেমন -পার্বত্য অঞ্চল ও টাংগাইলের মধুপুর গড়ের আবহাওয়ায় এটির সম্প্রসারণ সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১২ শতাংশ জমির এলিভেশন প্রায় ১০০০ মিটার। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকাবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায়ও চাষ করা যাবে। রোবাস্টা জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। এরাবিকা জাত আমাদের দেশে চাষ উপযোগী তবে ফলন কম হয়। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে নতুন গতি নিয়ে আসতে পারে কফি

আমেরিকার জাতীয় কফি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে কফির চারা রোপণ থেকে কাপে পানযোগ্য কফি পেতে কমপক্ষে ১০টি ধাপ পেরোতে হয়। কফির স্বাদ ও গুণগত মান পরীক্ষা করা হয় বিভিন্নভাবে। বাছাইকৃত গ্রিন কফিকে রোস্টিং করে তৈরি করা হয় সুঘ্রাণযুক্ত বাদামি কফি বীজ। যেটা আমরা সুপার সপ বা ক্যাফে থেকে ক্রয় করে থাকি। বেশির ভাগ রোস্টিং মেশিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রায় ৫৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই সময়ে সঠিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি কারণ এই ধাপেই সৃষ্টি হয় অসাধারণ স্বাদ ও ঘ্রাণ। রোস্টিং এর পর অতি দ্রুত ঠান্ডা করতে হবে। তাহলেই এর স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকবে যার জন্য ক্রেতাগণ অনেক বেশি আকৃষ্ট হবে কেনার জন্য। কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রাহকের কাপ পর্যন্ত রাখতে হলে সঠিকভাবে কফিগ্রাইন্ডিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কফি বীজ গুঁড়া করা যত মিহি হবে তত দ্রুত সুন্দর কফি তৈরি হবে। আধুনিক বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে ব্লাক কফি বা মিল্ক কফি তৈরি করে কফি প্রেমিদের সন্তুষ্টি করা যায়। দেশে আধুনিক প্রক্রিয়াজাত মেশিন ও প্রযুক্তি সহজলভ্যতা হলে এর চাষ বৃদ্ধি পাবে।

কৃষি মন্ত্রী ড.মো. আব্দুর রাজ্জাক এর মতে কফিকে লাভজনক ও জনপ্রিয় ফসলকরতে কৃষক পর্যায়ে সব রকম সহায়তা দেওয়া হবে। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কফির আবাদ হবে। আবাদ বাড়াতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কফি বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।‘ কাজুবাদাম ও কফির মতো অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে সবধরণের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। সরকার বিনামূল্যে উন্নত জাতের চারা, প্রযুক্তি ও পরামর্শ সেবা দিচ্ছে। গতবছর কাজুবাদামের এক লাখ ৫৬ হাজার চারা বিনা মূল্যে কৃষকদের দেয়া হয়েছে; এবছর তিনলাখ চারা দেয়া হবে।’ দেশে যেন কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেজন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্কহার প্রায় ৯০ শতাংশ থেকে মাত্র ৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে পার্বত্য এলাকার মোট ভূমির প্রায় ২২ শতাংশ আবাদের আওতায় আনার সম্ভাবনা আছে। এ এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও আবহাওয়া বিবেচনায় কফি ও কাজুবাদাম এবং মসলা জাতীয় ফসল আবাদের অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলের পার্বত্য বৈশিষ্ট্য অনুরূপ জমিও কাজুবাদাম ও কফিচাষের উপযোগী।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের কফি আমদানি ব্যয় ছিল ৯৩ হাজার ৮শ মার্কিন ডলার যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ২২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশী ।দেশে কফির উৎপাদন বাড়িয়ে এবং আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কফিচাষ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে তা নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে এদেশে নব দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।

Tag :

Please Share This Post in Your Social Media

কফি চাষের সম্ভাবনা বাড়ছে বাংলাদেশে

Update Time : ০৭:৪০:৫৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৩ নভেম্বর ২০২১

মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন:

দেশে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে কফি চাষ পৃথিবীতে পানীয়র মধ্যে চায়ের পরের অবস্থান হচ্ছে কফির।পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘুম থেকে উঠে,আড্ডায় কিংবা মিটিংয়ের ফাঁকে কফি নিত্যদিনের সঙ্গী। এই রেওয়াজ চালু হয়েছিল আমেরিকায় আঠারো শতকের প্রথম দিকে। আমাদের দেশেও কফির প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। দেরিতে হলেও এই খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আর পাহাড়ের মাটিতে চাষের উপযোগী হিসেবে বাড়তি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ভালো, উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করছে কৃষি গবেষণাকেন্দ্র। ইতোমধ্যে সফলও হয়েছে। এখন কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।

পার্বত্য জেলা বান্দরবানে অর্থকরি ফসল কফি আবাদের ব্যাপক সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আম, আনারস, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন ফলদ বাগানে বান্দরবানের কৃষকরা বহু আগেই সফলতা অর্জন করেছেন। এখন নতুন করে কফি চাষে উদ্যোগী হয়েছেন কৃষকরা। আবাদও দ্রুত বেড়ে চলেছে। এ পণ্যটি চাষের দিকে অনেকেই এগিয়ে আসছেন উৎসাহের সাথে। এতে করে ধান, পাট ও অন্যান্য ফসল চাষের পাশাপাশি কফিও বাংলাদেশকে এনে দিতে পারে রপ্তানি খাতে আর্থিক সাফল্যের মুখ। কফির সঙ্গে মিশে আছে একটা আভিজাত্য। বাংলাদেশে সাধারণত প্যাকেটজাত কফি বিদেশ থেকেই আমদানি করা হয়ে থাকে। তার কারণ কফি চাষের কোন প্রকার সুযোগ সুবিধা এর আগে বাংলাদেশে ছিলনা।

সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৬শ’ ফুট ওপরে যে কোন মাটিতে কফি চাষ করা সম্ভব। তবে পাহাড়ি উপত্যকা ও ঝরণার পাশের জমি এবং যেসব জমি তে লবণাক্ততা নেই সে সব জমি কফি চাষের উপযোগী। এছাড়া রাবার বাগানের ফাঁকে ফাঁকে লাগানো যাবে কফির চারা। বাড়ির আঙ্গিনা, ফুলের টব কিংবা বাড়ির ছাদেও কফির চাষ সম্ভব। চারা রোপণের দুবছরের মধ্যে কফির ফল সংগ্রহ করা যাবে। বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বছরে দুবার গাছ থেকে ফল সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। একটি কফি গাছ থেকে ২০/৩০ বছর ধরে ফল পাওয়া যায়। বাংলাদেশে কফি চাষের ক্ষেত্রে প্রতিটি গাছের জন্য খরচ হবে মাত্র এক থেকে দেড়শ’ টাকা। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে কফির কেজি এখন ৪ হাজার ২শ’ টাকার বেশি । প্রতিটি গাছ থেকে বছরে আধা কেজি বা তারও বেশি কফির ফল পাওয়া যাবে। একটি গাছে বছরে ৫ কেজি থেকে সর্বোচ্চ ১৫ কেজি পর্যন্ত কফি ফল পাওয়া যায়। কফির খোসাসহ প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়।

কফি গাছ থেকে শুধুমাত্র পানীয় কফিই নয়, একে সহায়ক হিসেবে নিলে এ কফি গাছের অন্যান্য উপকরণ ব্যবহার করে মধু ও শ্যাম্পুও তৈরি করা যাবে। মধু চাষের জন্যও কফি বাগানে উপযোগী। কফি গাছে ফুল এলেই মৌমাছিরা সেখানে আসবে। একটি কফি গাছের ফুল থেকে প্রতি বারে একশ’ গ্রাম মধু সংগ্রহ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি ওই গাছের উপকরণকে প্রক্রিয়া করে উন্নতমানের ‘শ্যাম্পু’ তৈরি করা যাবে। যা করতে পারলে উন্নতমানের শ্যাম্পুর জন্য আর বিদেশ মুখি হতে হবে না।

দেশের চাহিদা মিটিয়ে কফি বিদেশেও রপ্তানী করা যাবে বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার তথা কৃষিবিজ্ঞানী মাননীয় কৃষিমন্ত্রী বাণিজ্যিক কৃষির জন্য উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন।

বাংলাদেশকে খোরপোশ কৃষি থেকে বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করতে কফি ও কাজুবাদামের সম্প্রসারণে জোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কফি একটি অর্থকরী ফসল বিধায় এটি চাষ করে এদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন যেমন হবে তেমনি এটি বহুমাত্রিক পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ বলে জনগণের পুষ্টি চাহিদা ও পূরণ করবে।

এক কাপ ব্লাক কফি (১২৫মিলিলিটার) কার্যত কোনও ফ্যাট,কার্বোহাইড্রেট বা প্রোটিন থাকে না সুতরাং এর শক্তির পরিমাণ কেবল ১-২ কিলোক্যালরি। কফিতে অনেকগুলো খনিজ এবং ভিটামিন রয়েছে।

বাংলাদেশে কফি চাষের বর্তমান অবস্থা ও বাজার পরিস্থিতি কফি গ্রহণের ও বিপণনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের তিনটি জেলায় এটি উৎপাদিত হলেও এর মধ্যে প্রায় ৯০% উৎপাদিত হয় বান্দরবানে। পাহাড়ি এলাকা বাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায় ইতোমধ্যে চাষ শুরু হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের নীলফামারী,মৌলভীবাজার ও রংপুর জেলায় এবং টাঙ্গাইলে কফির চাষ শুরু হয়েছে।

কফি চাষের

২০১৯-২০২০ অর্থবছরে কফির উৎপাদন এলাকা ছিল প্রায় ১১৮.৩ হেক্টর এবং মোট উৎপাদন প্রায় ৫৫.৭৫ টন। বর্তমানে কৃষকগণ যতটুকু চাষ ও প্রক্রিয়াজাত করছে তার সবটুকুই সনাতন পদ্ধতিতে করছে যার ফলন অনেক কম এবং লাভও কম হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে আমদানিকৃত গ্রিন কফির পরিমাণ হলো ৩২.৫১৭ টন। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিয়য়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ’শীর্ষক এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে করা হবে।চাহিদার বেশির ভাগ অংশই প্রায় ৯৫ শতাংশ পূরণ হচ্ছে আমদানি করা কফি দিয়ে। তাই আমাদের কফির উৎপাদন বৃদ্ধিতে ও প্রক্রিয়াজাতকরণে এক্ষণই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

সম্ভাবনাময় কফি হতে পারে বাংলাদেশের পাহাড়ি মানুষের বিকল্প আয়ের উৎস। কফি চাষের সাথে আন্তঃফসল হিসেবে পেঁপে,আনারস,গোলমরিচ অনায়াসে চাষ করা যায়। কফি হালকা ছায়ায় ভালো হয় এবং অতিরিক্ত সার ও সেচের তেমন প্রয়োজন হয় না যা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে রৌদ্রোজ্জ্বল স্থানে চাষ করলে সার ও সেচের প্রয়োজন আছে। স্থানীয় চাহিদা অনেক বেশি ও রপ্তানির সুযোগ রয়েছে বলে এটির উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও কফির চাষ বৃদ্ধিতে অবদান রাখছে নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স,ঢাকা। যারা সরাসরি পার্বত্য অঞ্চলের কফি উৎপাদকদের কাছ থেকে কফি ক্রয় করছেন।কফির চাষ বৃদ্ধিতে উৎপাদক,গবেষক,সম্প্রসারণ অফিসার,মিডিয়া,বেসরকারি সংস্থা ও বৈদেশিক উন্নয়ন সংস্থাকে এগিয়ে আসা উচিত যাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) অর্জনে বাংলাদেশ সফল হয়।

বাংলাদেশে চাষ উপযোগী আবহাওয়া ও জলবায়ু এবং জাতসমূহবাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু কফি চাষের অনুকূল তবে ভালো ও উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে এর চাষ সম্প্রসারণের জন্য পাহাড়ি এলাকায় বিশেষ কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কফি চাষের উপযোগী মাটি হলো গভীর,ঝুরঝুরে,জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ ও হিউমাস সমৃদ্ধ,হালকা অম্লমাটি (পিএইচ ৪.৫-৬.৫)। পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদযোগ্য কফির ২টি জাত রয়েছে যেমন- যেমন- কফি এরাবিকা (Coffeaarabica)এ কফি রোবাস্টা (Coffeacanephora – robusta)। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় খুব উপযোগী। এটি সাধারণত সমুদ্র থেকে ৫০০-১০০০ মিটার উচ্চতায় এবং ১০০০-২০০০ মিলিমিটার বৃষ্টিতে ভালো ফলে সেজন্য বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকা যেমন -পার্বত্য অঞ্চল ও টাংগাইলের মধুপুর গড়ের আবহাওয়ায় এটির সম্প্রসারণ সম্ভব। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ১২ শতাংশ জমির এলিভেশন প্রায় ১০০০ মিটার। এ ছাড়া পাহাড়ি এলাকাবাদে বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকায়ও চাষ করা যাবে। রোবাস্টা জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। এরাবিকা জাত আমাদের দেশে চাষ উপযোগী তবে ফলন কম হয়। দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে নতুন গতি নিয়ে আসতে পারে কফি

আমেরিকার জাতীয় কফি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে কফির চারা রোপণ থেকে কাপে পানযোগ্য কফি পেতে কমপক্ষে ১০টি ধাপ পেরোতে হয়। কফির স্বাদ ও গুণগত মান পরীক্ষা করা হয় বিভিন্নভাবে। বাছাইকৃত গ্রিন কফিকে রোস্টিং করে তৈরি করা হয় সুঘ্রাণযুক্ত বাদামি কফি বীজ। যেটা আমরা সুপার সপ বা ক্যাফে থেকে ক্রয় করে থাকি। বেশির ভাগ রোস্টিং মেশিনের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয় প্রায় ৫৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। এই সময়ে সঠিকভাবে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি কারণ এই ধাপেই সৃষ্টি হয় অসাধারণ স্বাদ ও ঘ্রাণ। রোস্টিং এর পর অতি দ্রুত ঠান্ডা করতে হবে। তাহলেই এর স্বাদ ও গন্ধ অটুট থাকবে যার জন্য ক্রেতাগণ অনেক বেশি আকৃষ্ট হবে কেনার জন্য। কফির স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রাহকের কাপ পর্যন্ত রাখতে হলে সঠিকভাবে কফিগ্রাইন্ডিং করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কফি বীজ গুঁড়া করা যত মিহি হবে তত দ্রুত সুন্দর কফি তৈরি হবে। আধুনিক বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে ব্লাক কফি বা মিল্ক কফি তৈরি করে কফি প্রেমিদের সন্তুষ্টি করা যায়। দেশে আধুনিক প্রক্রিয়াজাত মেশিন ও প্রযুক্তি সহজলভ্যতা হলে এর চাষ বৃদ্ধি পাবে।

কৃষি মন্ত্রী ড.মো. আব্দুর রাজ্জাক এর মতে কফিকে লাভজনক ও জনপ্রিয় ফসলকরতে কৃষক পর্যায়ে সব রকম সহায়তা দেওয়া হবে। আগামী তিন-চার বছরের মধ্যে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কফির আবাদ হবে। আবাদ বাড়াতে পারলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে কফি বিদেশেও রপ্তানি করা যাবে।‘ কাজুবাদাম ও কফির মতো অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে সবধরণের সহযোগিতা দেয়া হচ্ছে। সরকার বিনামূল্যে উন্নত জাতের চারা, প্রযুক্তি ও পরামর্শ সেবা দিচ্ছে। গতবছর কাজুবাদামের এক লাখ ৫৬ হাজার চারা বিনা মূল্যে কৃষকদের দেয়া হয়েছে; এবছর তিনলাখ চারা দেয়া হবে।’ দেশে যেন কাজুবাদামের প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেজন্য কাঁচা কাজুবাদাম আমদানির ওপর শুল্কহার প্রায় ৯০ শতাংশ থেকে মাত্র ৫ শতাংশে নিয়ে আসা হয়েছে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে পার্বত্য এলাকার মোট ভূমির প্রায় ২২ শতাংশ আবাদের আওতায় আনার সম্ভাবনা আছে। এ এলাকার ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থান ও আবহাওয়া বিবেচনায় কফি ও কাজুবাদাম এবং মসলা জাতীয় ফসল আবাদের অনেক সুযোগ ও সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া দেশের বরেন্দ্র অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলের পার্বত্য বৈশিষ্ট্য অনুরূপ জমিও কাজুবাদাম ও কফিচাষের উপযোগী।

২০১৯ সালে বাংলাদেশের কফি আমদানি ব্যয় ছিল ৯৩ হাজার ৮শ মার্কিন ডলার যা বিগত বছরের তুলনায় প্রায় ২২ দশমিক ৮ শতাংশ বেশী ।দেশে কফির উৎপাদন বাড়িয়ে এবং আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করা সম্ভব। যথাযথ বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশে কফিচাষ সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা গেলে তা নতুন অর্থকরী ফসল হিসেবে এদেশে নব দিগন্ত উন্মোচন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর, বাংলাদেশ সচিবালয়, ঢাকা।